বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সরকার ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই গণতন্ত্র ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সাধারণভাবে গণতন্ত্র কলতে বোঝায়, যে শাসন ব্যবস্থায় শাসন ক্ষমতা মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত না থেকে রাষ্ট্রের সব জনসাধারণের ওপর ন্যস্ত থাকে এবং জনগণই তাদের সরকার গঠন করে । গণতন্ত্র হলো এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যাতে প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার থাকে। এ ব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ থাকে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও কল্যাণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের সরকার পদ্ধতি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এজন্যে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি আচরণবিধি এবং নির্বাচনি আচরণ লঙ্ঘন করার শাস্তির বিধান রয়েছে। এ অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও নির্বাচনি আচরণবিধি সম্পর্কে অবহিত হব।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
গণতন্ত্রের ধারণা আমেরিকার প্রখ্যাত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- গণতন্ত্র হলো, 'জনগণের জনগণের জন্য ও জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা। অধ্যাপক গেটেলের মতে, 'যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র। সাধারণ অর্থে, গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থে গঠিত ও পরিচালিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে, বরং গণতন্ত্রে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। সুতরাং গণতন্ত্র বিশ শতকের একটি জনপ্রিয় ধারণা, যা বর্তমানে সরকার পরিচালনার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই গণতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত অধ্যয়নযোগ্য বিষয়াবলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
সরকার ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রচলিত হয় প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে। গ্রিসের নাগরিক সমাজ গণতন্ত্র বলতে বুঝতো এমন একটি রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা যাতে গোটা নাগরিক সমাজ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এথেন্সীয় গণতন্ত্র পরবর্তীতে চলমান থাকেনি। মধ্যযুগে ধর্ম ও রাজার দ্বৈত শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘকাল পরে ইউরোপে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ঊনিশ ও বিশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারার উৎসমূল হিসেবে ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্য লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে।
গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
গণতন্ত্র সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে কার্যকর হয়, যথা: (১) প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র ও (২) পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
যে শাসন ব্যবস্থায় নাগরিকগণ প্রত্যক্ষ বা সরাসরিভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় তাকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রিসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর ধার্য, বিচারকার্য পরিচালনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করত। সে সময় নাগরিকের ধারণা সীমাবদ্ধ ছিল। রাষ্ট্রের সকলেই নাগরিকত্বের সম্মান পেত না । আধুনিক রাষ্ট্র আয়তনে বিশাল। এর জনসংখ্যাও বেশি। এ অবস্থায় প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ কম। তবে সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি অঞ্চলে আংশিকভাবে এখনও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ব্যবস্থা চালু আছে।
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করার পদ্ধতিকেই বোঝায়। এ ধরনের গণতন্ত্রকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ পদ্ধতিতে সাধারণত নাগরিকগণ সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করেন না । পরোক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়নসহ শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রই প্রচলিত রয়েছে।
গণতন্ত্রের দোষগুণ
গণতন্ত্রের সুন্দর দিকগুলো হলো গণতন্ত্রে আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হলো দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা। এ শাসন ব্যবস্থায় সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় এবং জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হলো জনমত দ্বারা পরিচালিত সরকার। স্বৈরাচারী পন্থায় নিয়ন্ত্রণ, দমন, নিপীড়নমূলক আচরণ এ শাসনব্যবস্থায় কোনোক্রমেই কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ব্যবস্থায় জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা স্বীকৃত। ফলে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি হয়। এ ব্যবস্থায় সরকার জনগণের সরকার হিসেবে বিবেচিত। জনগণের আস্থা হারালে এ সরকার টিকে থাকতে পারে না। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি তার আত্মবিকাশের সর্বাধিক সুবিধা ভোগ করে। তদুপরি গণতন্ত্র হচ্ছে কল্যাণকামী সরকার। এর মূল উদ্দেশ্যই হলো জনকল্যাণ সাধন ।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বেশকিছু সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিও রয়েছে। প্রাচীনকালের প্রখ্যাত মনীষী ও দার্শনিকগণ, যেমন- প্লেটো ও অ্যারিস্টটল গণতন্ত্রকে মূর্খ বা অযোগ্যের শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হিসেবে গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে অজ্ঞ, অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। ফলে উপযুক্ত লোকের অভাবে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না এবং শাসনকার্য পরিচালনায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। বাস্তবে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুরা আইনসভায় তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। ফলে তাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সরকার উদাসীন থাকতে পারে। গণতন্ত্রে বহু পরস্পরবিরোধী মত ও ধারণা দেখা যায়। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতপার্থক্য ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হতে পারে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে জাতি দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে। অনুন্নত দেশগুলোতে সরকারি দল নিজ দলের স্বার্থের প্রতি লক্ষ রেখে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। ফলে নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। এতে করে গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। গণতন্ত্র তুলনামূলক ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। ঘন ঘন নির্বাচনের ব্যবস্থা, জনমত গঠন, ব্যাপক প্রচারকার্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে দেশের সংবিধান প্রণয়ন করতে ৯ বছর সময় লাগে । এ সময় পার্লামেন্টারি শাসনের নামে বস্তুত গভর্নর জেনারেল এবং আমলারাই দেশ শাসন করত। প্রধানমন্ত্রী অথবা আইনসভার মতামতের তোয়াক্কা না করে গভর্নর জেনারেল নিজের পছন্দ অনুযায়ী মন্ত্রিসভা গঠন করতেন। সংবিধান প্রণয়নের আড়াই বছরের মাথায় জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করেন। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি সোচ্চার হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে এবং সেটিই ছিল তৎকালীন পাকিস্তানে শেষ নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬শে মার্চ ১৯৭১। এর চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে। এগুলো হলো: আওয়ামী লীগ, বি.এন.পি.ও জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটি সময় কেটেছে অগণতান্ত্রিক সেনা শাসনের অধীনে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠন করে। পাকিস্তানি অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিরা তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই গণতন্ত্র লাভ করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, অবকাঠামো নির্মাণ, দেশের বিভিন্ন শিল্পের পুনরুজ্জীবিতকরণ এবং জাতীয়করণ, প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে আওয়ামী লীগ সরকার। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসবের মধ্যে রয়েছে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন, স্বাধীনতার দশ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রণয়ন (১৯৭২), নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ, জাতিসংঘ ও ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনের সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং নতুন সংবিধান অনুসারে ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ।
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট দেশি-বিদেশি স্বাধীনতা বিরোধীচক্রের ষড়যন্ত্রে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। একই সালের ৩রা নভেম্বর জাতীয় চার নেতা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সংবিধান স্থগিত করে সামরিক শাসন জারি করা হয়। বাংলাদেশ উল্টোপথে যাত্রা শুরু করে। অগণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত থাকে নব্বই এর গনঅভ্যুত্থান পর্যন্ত। ৭৫ পরবর্তী পনেরো বছর দেশ ছিল সেনা শাসনের অধীনে। এ সময় জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়। বিভিন্ন দল ভেঙে বা নেতাদের ভাগিয়ে এনে সেনা-সমর্থক দল গঠন করা হয়। নির্বাচনের নামে ক্ষমতাসীনদের কর্তৃক ভোটকেন্দ্র দখল ও আসন ভাগাভাগি হয়। নির্বাচন কমিশন বলতে গেলে অকার্যকর ও অসহায় হয়ে পড়ে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহামদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ের সূচনা করে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি.) সরকার গঠন করে। নির্বাচনের পর পর জাতীয় সংসদে সকল দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৯১ সালে ৬ই আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হয়। অবশ্য সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এরূপ পারস্পরিক সমঝোতা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। জাতীয় সংসদের ঢাকার মিরপুর (১৯৯৩) এবং মাগুরার (১৯৯৪) প্রহসনমূলক উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপিকে কেন্দ্র করে অচিরেই তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। জাতীয়ভাবে একধরনের আশঙ্কা তৈরি হয় যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। অতএব আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকারের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকে। এ দাবিতে একপর্যায়ে ১৪৭ জন সদস্য জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য রাজপথে আন্দোলন শুরু করে । বি.এন.পি. সরকার এ দাবি উপেক্ষা করে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। তবে আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলো এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। প্রায় ভোটারবিহীন পরিবেশে তথাকথিত এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করায় এ নির্বাচন গুরুত্ব ও বৈধতা হারায়। চার দিন স্থায়ী ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল গৃহীত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এসবের মধ্যে বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদকে শক্তিশালী করা, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রবর্তন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পথ উন্মোচন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বি.এন.পি-জামায়াত সমর্থিত চারদলীয় জোট সরকার গঠন করে। এ সময় দলীয় স্বার্থে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ২ বছর বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করে পছন্দের লোককে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের নীলনকশা প্রণীত হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। দেশে চরম সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের নেতৃত্বে রাজনীতিতে পরোক্ষভাবে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা-সমর্থিত সরকার দুই বছর ক্ষমতাসীন থাকে। এ সময়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও বিএনপির নেত্রীদ্বয়ের গ্রেফতার, , তাঁদের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সংস্কার আনয়নের উদ্যোগ, একের পর এক অধ্যাদেশ জারি ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা স্থায়ীকরণের অপপ্রয়াস চলে। দুই বছর পর এ সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নবম এ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে সরকার গঠন করে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৫ ই জানুয়ারি ২০১৪ এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী উন্নয়নের জন্য উভয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে।
রাজনৈতিক দল
আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বলতে দলীয় সরকারকেই বোঝায়। রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা কল্পনা করা যায় না। রাজনৈতিক দলকে কেন্দ্র করেই জনমত গঠন, দলীয় আদর্শের প্রচার, সমর্থকগোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠে।
রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা
সাধারণ ভাষায়, রাজনৈতিক দল বলতে একটি সংগঠিত নাগরিক সমষ্টিকে বোঝায়, যারা দলীয় আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে বৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে।
অধ্যাপক গেটেল রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, 'রাজনৈতিক দল বলতে কমবেশি সংগঠিত একদল লোককে বোঝায়, যারা রাজনৈতিক এককরূপে কাজ করে এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চায়। সংগঠন, কর্মসূচি প্রদান ও ক্ষমতা অর্জন রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য' ।
রাজনৈতিক দল সাধারণত একক কিংবা একদল বিশিষ্ট বা সৃজনশীল নেতৃত্বের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃবর্গের মাধ্যমে নাগরিক সমস্যাকে চিহ্নিত করে, সেই সমস্যাগুলো সমাধানে সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থায় জনমত গঠন এবং বৈধ উপায়ে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত সংঘবদ্ধ একটি জনসমষ্টি হলো রাজনৈতিক দল। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ও উন্নতির পাশাপাশি সাংগঠনিক দৃঢ়তা এবং দলীয় সদস্যদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে রাজনৈতিক দল তৎপরতা প্রদর্শন করে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বলেছেন, 'যারা কতকগুলো সুনির্দিষ্ট নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং সাংবিধানিক উপায়ে সরকার গঠন করতে চেষ্টা করে, সেই জনসমষ্টিকে রাজনৈতিক দল বলা হয়'।
সুতরাং, রাজনৈতিক দল এমন একটি জনসংগঠন যার সদস্যগণ রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হয়।
রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য
রাজনৈতিক দলের প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য হলো-
১. রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে আদর্শগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা;
২. রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কিছু নীতিমালা ও পরিকল্পনা জনগণের নিকট পেশ করে জনসমর্থন সৃষ্টি করা,
৩. দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা এবং জাতীয় স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা,
৪. বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
শক্তিশালী ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের প্রধান শর্ত। অধ্যাপক ফাইনার (Finer) বলেছেন, ‘আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন কার্যত রাজনৈতিক দলের শাসন'। একটি রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক যে ধরনের সরকার ব্যবস্থাই বিদ্যমান থাকুক না কেন, সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব স্বীকৃত। বস্তুত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্ব সর্বাধিক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তার আলোকে প্রতিটি রাজনৈতিক সংগঠন দলীয় নীতিমালা ও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই নীতিমালা ও কর্মসূচি সাধারণত রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে (ম্যানিফেস্টো) উল্লেখ থাকে।
একক কাজঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্তায় রাজনৈতিক দল কেন অপরিহার্য? উল্লেখ কর। দলগত কাজ : রাজনৈতিক দলের প্রধান কাজগুলোর তালিকা তৈরি কর । |
দলের নীতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণকে জানানোর জন্য রাজনৈতিক দল সভা-সমিতি,টকশো আয়োজনসহ পত্র-পত্রিকায় মতামত ব্যক্ত করে তাদের নীতি ও কর্মসূচি প্রচার করে এবং জনসমর্থন সৃষ্টি করে।
দেশের জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী মনোনয়ন এবং তার পক্ষে দলীয় প্রচারকার্য চালানো রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মনোনীত প্রার্থীদেরকে নির্বাচিত করার জন্য রাজনৈতিক দল তাদের সমর্থনে ব্যাপক নির্বাচনি প্রচারণা চালায়।
রাজনৈতিক দলের অন্যতম কাজ হচ্ছে নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন করা। সাধারণত নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তারাই সরকার গঠন করে থাকে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজনৈতিক দল তার দলীয় নীতিমালা ও কর্মসূচির ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করে। নাগরিকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে যে সকল দল বা দলসমূহ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না তারাই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। বিরোধী দল পার্লামেন্টে বিতর্ক, সরকারের নীতির সমালোচনা, মুলতবি প্রস্তাব উপস্থাপন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করে সংসদকে কার্যকর রাখে। সংসদের বাইরেও বক্তব্য, বিবৃতি ও সমালোচনার মাধ্যমে বিরোধী দল সরকারকে আইনের শাসন অনুশীলনে সহায়তা করে। এ ছাড়া বিরোধী দল জনগণের সামনে সরকারের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসূচি তুলে ধরে। তাই গঠনমূলক সমালোচনা এবং কার্যকর ভূমিকা রাখা বিরোধী দলের অন্যতম দায়িত্ব।
রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মাঝে মিশে থাকে। সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ মানুষের কাছে তুলে ধরে। জনগণ তাদের মতামত ও অভিযোগ রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দের মাধ্যমে সরকারের নিকট উত্থাপন করে এবং সরকারের করণীয় দাবি করে। মূলত রাজনৈতিক দল সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বা সেতুবন্ধন রচনা করে ।
রাজনৈতিক দল যে কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরাধীনতা থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতার জন্য রাজনৈতিক দল গণআন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে । যেমন- বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামী লীগ আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করেছে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অপরিহার্য। জনগণের অভাব, অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশাকে চিহ্নিত করে তারা সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এছাড়া সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দল হলো বিকল্প সরকার। সরকার সমর্থন হারালে বা কোনো কারণে পতন হলে বিরোধী দলের ক্ষমতা লাভ বা সরকার গঠনের সুযোগ সৃষ্টি হয় ।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের সম্পর্ক
গণতন্ত্রের একটি মৌলিক বিষয় হলো নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিন্তা করা যায় না। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসন পরিচালনার জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।
আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ভোটদানের মাধ্যমেই জনগণ তাদের এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে। এ প্রক্রিয়ায় জনগণ তাদের দৃষ্টিতে সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে বৈধ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের সম্পর্ক রয়েছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণ চাইলে পূর্ববর্তী সরকার ও দলকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। যে সরকার বা দল জনগণের স্বার্থ বা জনমতের বিরোধিতা করে তার বা তাদের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে না। নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণ তাদের জবাব প্রদান করে। গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয়। জনগণের সার্বভৌমক্ষমতার প্রয়োগ ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে ।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া
প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত ছিল। নাগরিকগণই সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র আয়তনে বিশাল এবং এর জনসংখ্যাও বেশি। সবার পক্ষে সরাসরি রাষ্ট্রের শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং ভোটদানের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে জনগণ পরোক্ষভাবে এ দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পায় ।
নির্বাচন হলো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নাগরিকবৃন্দ কর্তৃক বিভিন্ন প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি বাছাই প্রক্রিয়া । অন্যকথায়, যে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে পছন্দ অনুযারী প্রতিনিধি বাছাই করে তাকেই নির্বাচন বলে। প্রায় সকল রাষ্ট্রেই গোপন ব্যালটে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যারা প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষমতা অর্থাৎ ভোটদানের অধিকার ভোগ করেন তাদের ভোটার বা নির্বাচক বলে। সকল ভোটারকে একত্রিতভাবে নির্বাচকমণ্ডলী বলা হয়। প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য সারা দেশকে কতকগুলো নির্বাচনি এলাকার (constituency) ভাগ করা হয়। এভাবে প্রতিটি এলাকা থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে পার্লামেন্ট বা লাইনসভা গঠিত হয়। বাংলাদেশে নির্ধারিত মেয়াদান্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত বর।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুই প্রকার নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে, যথা: প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও পরোক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভোটারগণ সরাসরি ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, তাকে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে। আর পরোক্ষ নির্বাচন বলতে সাধারণ ঐ নির্বাচন পদ্ধতিকে বোঝায় যেখানে ভোটারগণ ভোট দিয়ে সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচন করে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনি সংস্থা গঠন করে। এ নির্বাচনি সংস্থা ইলেক্টোরাল কলেজ (Electoral College) নামে পরিচিত। ইলেক্টোরাল কলেজ চূড়ান্তভাবে প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হন।
সংসদ নির্বাচনের সুবিধার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ৩০০টি নির্বাচনি এলাকার বিক্রয় করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ এবং 'নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রার্থীরা প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন। প্রধানত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়েই প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পান। এছাড়াও জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে যা নির্বাচিত আসনের আনুপাতিক হারে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে ।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পরই নির্বাচন প্রক্রিয়া অর্থাৎ নির্বাচন অনুষ্ঠান কাজকর্ম শুরু হয়। এ কাজের তালিকার মধ্যে গাছে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, নির্বাচনি এলাকা নির্ধারণ, রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ, মনোনয়নপত্র বিতরণ, গ্রহণ ও বাছাই প্রভৃতি। প্রার্থীদের প্রতীক বণ্টন, ব্যালট পেপার ছাপানো, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ, ব্যালট বাক্স বিতরণ, ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনা, ফলাফল ঘোষণা প্রভৃতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার পল। নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ও নিয়ন্ত্রণে এ সকল কাজ সম্পাদিত হয়।
নির্বাচন কমিশনের গঠন, ক্ষমতা ও কাজ নির্বাচন কমিশনের গঠন বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন পরিচালনা করে। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে এ কমিশন গঠিত হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগদান করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমিশনের সভাপতি হিসেবে কাজ করেন। কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর। কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির কাছে সেচ্ছায় পদত্যাগপত্র পেশ করতে পারেন। অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কারণে কমিশনাররা দায়িত্ব থেকে অপসারিত হতে পারেন।
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কাজ
নির্বাচন কমিশন স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও তত্ত্বাবধান করে। ভোটার তালিকা বিষয়ক কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কমিশন এর নিষ্পত্তিমূলক সিদ্ধান্ত দেয়। কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করে। এছাড়াও সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থাও নির্বাচন কমিশনের কাজ। নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশনের জন্য সহায়তামূলক কাজ করে।
নির্বাচন কমিশন নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করে। সীমানা বিতর্কের অবসান ঘটাতে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। কমিশনই নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রিটার্নিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ করে।
নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাছাই করার দায়িত্ব কমিশনের। মনোনয়নপত্র বাছাই সংক্রান্ত বিষয়ে বিতর্ক দেখা দিলে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে উপ-নির্বাচনের দায়িত্ব কমিশন পালন করে। কোনো সংসদ সদস্যের অযোগ্যতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন দেখা দিলে কমিশন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী ও আইনের দ্বারা অর্পিত দায়িত্ব পালন করে।
নির্বাচনি আচরণবিধি নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্বাচনি আচরণবিধি নিম্নে উল্লেখ করা হলো : ১. নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিবিধান পালন : নির্বাচন সংক্রান্ত আইনকানুন ও বিধিবিধান অবশ্যই সকলকে মেনে চলতে হবে। ২. কোনো প্রতিষ্ঠানে চাঁদা বা অনুদান প্রদান নিষিদ্ধ : নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত কোনো প্রার্থী তাঁর নির্বাচনি এলাকার কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে বা গোপনে চাঁদা বা অনুদান প্রদান বা প্রদানের অঙ্গীকার করতে পারবেন না। নির্বাচনি এলাকার কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের অঙ্গীকার প্রদান করাও যাবে না। ৩. নির্বাচনি প্রচারণা : ৩.১. রাজনৈতিক দল ও প্রার্থী নির্বিশেষে প্রচারণার ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবে। প্রতিপক্ষের কোনো সভা, শোভাযাত্রা ও প্রচারে কোনোরূপ বাধা দেওয়া যাবে না । ৩.২. কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো সড়ক বা মহাসড়কে জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে জনসভা করা যাবে না। ৩.৩. সভা বা মিছিলে কেউ বাধা প্রদান করলে তার বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে হবে। প্রার্থী নিজে এবং তার সমর্থকরা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কিছু করতে পারবে না। ৩.৪. রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী সরকারি প্রচারপত্র, সরকারি যানবাহন, সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সহায়তা কিংবা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না । ৩.৫. কোনো প্রার্থীর পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিলের ওপর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পোস্টার, লিফলেট ও হ্যান্ডবিল লাগানো যাবে না । ৩.৬. রাস্তা বা সড়কের উপর নির্বাচনি ক্যাম্প স্থাপন করা যাবে না।
৩.৭. সরকারি ডাকবাংলো, সার্কিট হাউস, রেস্টহাউস ও সরকারি কার্যালয়কে কোনো দল বা প্রার্থীর নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনার স্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ৩.৮. নির্বাচন উপলক্ষে কোনো নাগরিকের জমি, বাড়ি-ঘর বা কোনো স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করা যাবে না। কারও শান্তি ভঙ্গ হয় এমন কোনো কাজ করা যাবে না।
৩.৯. সকল প্রকার দেয়াল লিখন হতে সকলকে বিরত থাকতে হবে।
৩.১০. ভোট কেন্দ্রের নির্ধারিত সীমার মধ্যে মোটরসাইকেলসহ যান্ত্রিক যানবাহন নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য বহন আইনত দণ্ডনীয় ।
৩.১১. প্রভাবশালী কোনো ব্যক্তি বা সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনি কার্যক্রমে অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না ।
৩.১২. ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে এরূপ উস্কানিমূলক কোনো বক্তব্য প্রদান করা যাবে না।
৪. নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখা : অর্থ, অস্ত্র, পেশিশক্তি কিংবা স্থানীয় ক্ষমতা দ্বারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যাবে না ।
৫. ভোট কেন্দ্রে প্রবেশাধিকার : কেবল নির্বাচনি কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রার্থী, নির্বাচনি এজেন্ট এবং ভোটারগণ ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবেন। কোনো প্রার্থীর বা দলের কর্মীগণ ভোটকেন্দ্রে ঘোরাফেরা করতে পারবে না।
৬. নির্বাচনি অনিয়ম : আচরণ বিধিমালার যে কোনো বিধানের লঙ্ঘন নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে। কোনো প্রার্থী বা দল এর প্রতিকার পেতে চাইলে নির্বাচনি এলাকাধীন 'ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি' বা নির্বাচন কমিশন বরাবর আবেদন করতে হবে।
নির্বাচনি অপরাধ ও অপরাধের দণ্ড গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুযায়ী নির্বাচনি অপরাধ ও এর দণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। সংক্ষেপে অপরাধসমূহ ও দণ্ডগুলো নিম্নে দেওয়া হলো : ক. নির্ধারিত নির্বাচনি ব্যয়ের বিধান লঙ্ঘন করা। খ. ঘুষ গ্রহণ করা। গ. জাল ভোট দেওয়া বা ছদ্মনামে ভোট দেওয়া। ঘ. নির্বাচনে প্রভাব খাটানো, জোর জবরদস্তি করে ভোট আদায় করা বা ভোটদানে বাধা সৃষ্টি করা। ঙ. প্রার্থী বা তার আত্মীয়স্বজনের চরিত্র সম্পর্কে মিথ্যা বলা। চ. কোনো প্রার্থীর প্রতীক সম্পর্কে মিথ্যা বলা । ছ. কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার সম্পর্কে মিথ্যা বলা। জ. জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি কারণে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটদান সম্পর্কে বলা ঝ. ভোটকেন্দ্রের কোনো ভোটারকে ভোট না দিয়ে যেতে বাধ্য করা। ঞ. বেআইনী আচরণ করা এবং
আরও দেখুন...