'আবহাওয়া' ও 'জলবায়ু' শব্দ দুটি এক বলে মনে হলেও বস্তুত এক নয়। আবহাওয়া হলো কোনো একটি অঞ্চলের এক দিন বা দিনের কোনো বিশেষ সময়ের বাতাসের তাপ, চাপ, আর্দ্রতা। তাপমাত্রা, বায়ুর চাপ ও গতি, বাতাসের আর্দ্রতার পরিমাণ হিসাব করে এটা নির্ধারণ করা হয়। আবহাওয়া প্রতিদিন, এমন কি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদলাতে পারে, বদলায়ও। অন্যদিকে কোনো অঞ্চলের ৩০ থেকে ৪০ বছরের গড় আবহাওয়াকে বলা হয় তার জলবায়ু। তবে কোনো দেশ বা অঞ্চলের জলবায়ু বোঝার জন্য ওই উপাদানগুলো ছাড়াও আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক আছে। যেমন দেশটির অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ, সমুদ্র থেকে তার দূরত্ব, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত, ভূমির ঢাল, মৃত্তিকার গঠন, বনভূমির পরিমাণ ও অবস্থান প্রভৃতিও জলবায়ুর প্রকৃতি নির্ণয়ের নিয়ামক।
মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তন এবং ভোগ-বিলাসিতা অথবা উন্নয়নের কারণে জলবায়ু তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারায়। যার দরুণ পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবকে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। এজন্য বাংলাদেশের জলবায়ু, জলবায়ুগত পরিবর্তন, এর প্রভাবের কারণ, প্রভাব ও পরিস্থিতি মোকাবিলার উপায় সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
বাংলাদেশ ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। সমুদ্রের নিকটবর্তী হওয়ায় ও মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে শীত বা গ্রীষ্ম কোনোটাই খুব তীব্র নয়। এখানে গ্রীষ্মকালটা উষ্ণ ও বৃষ্টিবহুল এবং শীতকাল শুষ্ক। হিমালয় পর্বতমালা যদিও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নয়, বেশ উত্তরে, তবু তা শীতকালে বাংলাদেশকে উত্তর থেকে আসা হিমপ্রবাহ থেকে রক্ষা করে। তাই শীতকাল এখানে দীর্ঘ হয় না। শীতকালে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ৯.৯°-৩০.৭° সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তবে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে এই তাপমাত্রা কখনো কখনো ৪°-৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে আসে। ঠাকুরগাঁ, পঞ্চগড়, শ্রীমঙ্গল এসব জায়গায় সবচেয়ে বেশি শীত।
বৈশাখ মাস থেকে বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ঋতু আরম্ভ হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ২১° সেলসিয়াস। এ সময় দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে কখনো কখনো তাপমাত্রা ৪০° - ৪৫° সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতে কোথাও কোথাও কালবৈশাখি হয়। সমুদ্র উপকূলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসও হয়। বর্ষাকালে বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগর হতে জলীয়বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। একে গ্রীষ্মের মৌসুমি বায়ু বলা হয়। এই মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে আবহাওয়া ও অবস্থান জনিত কারণে দেশের সব এলাকায় সমান বৃষ্টিপাত হয় না।
সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এসব এলাকায় বেশি বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া এসব এলাকায় কম বৃষ্টি হয়। শরৎকালেও বাংলাদেশে বৃষ্টি হয়, তবে এ সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে খুব কম। বর্ষাকালে নদীভাঙনের পরিমাণও বেড়ে যায়। এপ্রিল-মে ও অক্টোবর-নভেম্বর বছরের এ দুই সময়ে মৌসুমি বায়ুর কারণে বাংলাদেশে বেশ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়।
বাংলাদেশের জলবায়ুকে বলা হয় সমভাবাপন্ন। অর্থাৎ এখানে অনুকূল ও প্রতিকূল দুই ধরনের আবহাওয়ারই প্রভাব সমান। অনুকূল আবহাওয়ার ফলে বাংলাদেশের প্রকৃতি সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা। অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাবে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, কালবৈশাখি, টর্নেডো ও অতিবৃষ্টির মতো কোনো কোনো দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে।
কাজ-১: বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলো দলীয় আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধর। কাজ-২ : বাংলাদেশে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে কী ধরনের দুর্যোগ হয়? ব্যাখ্যা কর। |
নানা কারণে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। যেমন-বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। শীতকালে শীত দেরিতে আসছে এবং স্বল্পসময়ে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও খরার প্রকোপ বাড়ছে। নদী, খাল, বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে প্রাকৃতিক কারণ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে মানবসৃষ্ট কারণও। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা পৃথিবীতেই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (global warming)। উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ অস্বাভাবিকভাবে গলে যাচ্ছে। এই বরফগলা জলরাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের দক্ষিণাংশের নিম্নাঞ্চলসহ পৃথিবীর সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলো ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অন্যতম কারণ হলো গ্রিনহাউস গ্যাস। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি গ্যাসকেই একসাথে গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়। বায়ুমণ্ডলে এই গ্যাসগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় সঞ্চারিত হয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে। আর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধির জন্য মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডই সবচেয়ে বেশি দায়ি। মানুষের তৈরি গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প-কারখানার উৎপাদন, বিদ্যুৎ ব্যবহার, যানবাহনের তেল ও গ্যাসের ধোঁয়া, ইটের ভাটা প্রভৃতি থেকে এই কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়। আগের তুলনায় বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস সঞ্চারের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এ থেকে আমরা সহজেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদটি বুঝতে পারি।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণগুলো প্রায় একই। তবে পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলো যে পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ততটা করে না। সেদিক থেকে জলবায়ুর পরিবর্তন বা পরিবেশের বিপর্যয়ের জন্য উন্নত দেশগুলোই বেশি দায়ী-যদিও তার ফলটা আমাদেরকেই বেশি ভোগ করতে হয়।
ক্রমাগত বনভূমি ধ্বংসের কারণেও পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের এই বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৭ ভাগ। তারপরও অবাধে গাছ ও পাহাড় কেটে নানান অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য কারণে এই বনভূমির পরিমাণ ক্রমাগত কমে আসছে। ফলে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে।
কাজ- ১: গ্রিনহাউস গ্যাস বলতে কোন কোন গ্যাসকে বোঝায়? বাংলাদেশে এ গ্যাসগুলো কীভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে? ব্যাখ্যা কর। কাজ-২: জলবায়ু স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে মানুষ কী ভূমিকা পালন করতে পারে? বিশ্লেষণ কর। |
বাংলাদেশে প্রায়ই নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। এসব দুর্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, শৈত্যপ্রবাহ, টর্নেডো, কালবৈশাখী, বজ্রপাত প্রভৃতি। এছাড়াও বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
কোনো স্থানে বাতাসে তাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে ওই অঞ্চলের বাতাসের চাপ কমে যায়। ফলে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এ সময় আশেপাশের অঞ্চল থেকে বাতাস প্রবল বেগে ওই নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ছুটে আসে। নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে বায়ুর এই প্রবল গতিকে বলে সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়। বাংলাদেশে অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড় হয় বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে। সমুদ্রে সৃষ্ট নিম্নচাপ ও ঝড়ের ফলে সমুদ্রের লোনা জল বিশাল উচ্চতা নিয়ে তীব্রবেগে উপকূলে আছড়ে পড়ে এবং স্থলভাগকে প্লাবিত করে। একেই বলে জলোচ্ছ্বাস। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এ পর্যন্ত কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে।
এতে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গবাদিপশু ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘটে যাওয়া এমনি একটি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া এ রকম দুটি বড়ো ঘূর্ণিঝড় হলো সিডর ও আইলা। ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর সিডর-এ দেশের ২৮টি জেলার প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আর ২০০৯ সালের ২৫শে মে আইলায়ও মানুষ, পশুপাখি, ফসল ও ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ের আগে সাধারণত আবহাওয়া বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত পূর্বাভাস ও সতর্কবাণী প্রচার করা হয়। আমরা যদি সে সতর্কবাণী মেনে আগে থেকে সাবধান হই, তবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাণহানি এড়ানো যায়। এ সময় দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে ঘূর্ণিঝড়-আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই কমবেশি বন্যা হয়। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, যমুনা ও মেঘনাসহ প্রায় সবগুলো নদীরই উৎস ভারতে। এসব নদনদী হিমালয়ের বরফগলা ও উজানে বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বিপুল পানিপ্রবাহ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ফেলে। বৃষ্টির পানি ও পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি একসঙ্গে মিলে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি করে পাড়ে উপচে দু-কূলের জনপদকে প্লাবিত করে ও জানমালের ক্ষতি করে।
এছাড়া উজানের দেশগুলোতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও নদীসংযোগ প্রকল্পের কারণেও বন্যার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো লক্ষ লক্ষ টন পলি বয়ে আনে, যার সবটা সাগরে যায় না, কিছু অংশ নদীর তলদেশে জমা হয়ে তাকে ভরাট করে ফেলে। এতে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমে যায়। পানি উপচে আশেপাশের এলাকা প্লাবিত হয়। প্রায় প্রতি বছর বন্যায় আমাদের দেশে মানুষ ও সম্পদের অনেক ক্ষতি হয়। ব্যাপক ফসলহানি ঘটে, ফলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালে এদেশে বড়ো আকারের বন্যা হয়েছে। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বন্যা একেবারে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব।
নদীভাঙন বাংলাদেশের একটি নিয়মিত দুর্যোগ। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীভাঙনের একটি কারণ হলো বাংলাদেশের নদীগুলোর গতিপথের ধরন। আমাদের অনেক নদীরই গতিপথ আঁকাবাঁকা। নদীর বাঁকগুলোও ঘনঘন। ফলে পানির প্রবল স্রোত সোজাপথে প্রবাহিত হতে না পেরে নদীর পাড়ে এসে আঘাত করে।
এজন্য নদীর পাড় ভাঙতে থাকে। এছাড়াও নদীর গতিপথ পরিবর্তন, নদীপাড়ের মাটির দুর্বল গঠন, নদীভরাট ও যেখানে-সেখানে বাঁধ দিয়ে নদী শাসনের চেষ্টা, নতুন নতুন সেতু নির্মাণ, নদীর পাড়ে যথেষ্ট গাছপালা না থাকা ইত্যাদি কারণেও নদীভাঙন ঘটে। নদীভাঙনের ফলে এ দেশে হাজার হাজার একর আবাদি জমি, বসতবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতিবছর এ দেশের হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি ও কাজের সংস্থান হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। যেসব কারণে নদীভাঙন ঘটে থাকে সে-সম্পর্কে সচেতন হলে নদীভাঙন ও তার ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
খরা বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাতের অভাবে ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে খরা হয়। প্রায় প্রতি বছর বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খরা দেখা যায়। উত্তরাঞ্চলে এই খরার প্রকোপ বেশি। পানির অভাবে জমির সেচকাজ ব্যাহত হয়, ফসল নষ্ট হয়। বৃষ্টিপাতের অভাব ছাড়াও বিভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ, বননিধন, পরিবেশদূষণ ইত্যাদি কারণেও খরা হয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি পুরোপুরি প্রতিরোধ করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে সচেতন হলে ও সময়মতো ব্যবস্থা নিলে খরাজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যেতে পারে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। সুষ্ঠু পানিব্যবস্থাপনা ও পানি ব্যবহারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশ শীতপ্রধান দেশ না হলেও কোনো কোনো বছরে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে হিমালয়ের উত্তর দিক থেকে আগত মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে এর তীব্রতা বেশি হয়। প্রবল শীতে মানুষের প্রাণহানিও ঘটে। শৈত্যপ্রবাহের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কাজ পায় না। শৈত্যপ্রবাহে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাসস্থান ও শীতবস্ত্রের অভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীই বেশি দুর্দশায় পড়ে। সরকার ও সমাজের সচেতন মানুষের সহায়তা ও উদ্যোগে শৈত্যপ্রবাহে মানুষের কষ্ট অনেকটা কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে টর্নেডো অন্যতম। এটি প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন এক ধরনের ঘূর্ণিঝড়। স্থলভাগে নিম্নচাপের ফলে এর উৎপত্তি হয়। এটি স্থানীয়ভাবে সংঘটিত এক ধরনের ঝড়। টর্নেডো এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার সম্পর্কে কোনো পূর্বাভাস বা সতর্কসংকেত দেওয়া যায় না। টর্নেডো শুরুর পূর্বে আকাশে ফানেল বা হাতির গুঁড়ের মতো মেঘ দানা বাঁধে। এই হাতির শুঁড়ের মতো মেঘ ক্রমে ভূপৃষ্ঠের নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসে। এই মেঘটি যখন ঘুরতে ঘুরতে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছুটে চলে তখন সেখানকার বাড়িঘর, গাছপালা ভেঙ্গে যায় এবং মানুষ ও পশুপাখি মারা যায়। ফানেলের অভ্যন্তরে প্রচুর ঘূর্ণন চলতে থাকে। এই গুঁড়ের মতো টর্নেডো যখন মাটি স্পর্শ করে তখন সবকিছুকে তছনছ করে ফেলে। এমনকি এক স্থানের জিনিসপত্র অন্যস্থানে নিয়ে যায়। এটি কোনো স্থানে আচমকা আঘাত হেনে মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায়। এর স্থায়িত্বকাল হয় খুবই অল্প, কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট মাত্র। খুব কম জায়গায় এটি আঘাত হানে। বাংলাদেশে সাধারণত ফাল্গুনের শেষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে টর্নেডো হয়ে থাকে।
কোনো স্থানের তাপমাত্রা প্রচুর বেড়ে গেলে সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। তখন পাশের অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত শীতল বাতাস প্রবল বেগে এই শূন্যস্থানে ধেয়ে আসে ও ঝড়ের সৃষ্টি করে যা আমাদের দেশে কালবৈশাখি ঝড় নামে পরিচিত। কালবৈশাখি হলো এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী ও স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট প্রচণ্ড ঝড়। সাধারণত বৈশাখ মাসেই এ ঝড় বেশি হয় বলে একে কালবৈশাখি বলা হয়। প্রায় সময় উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এ ঝড়টা আসে।
বাংলাদেশে প্রতি বছরই কমবেশি কালবৈশাখি ঝড় হয়ে থাকে। টর্নেডোর মতো অত বিধ্বংসী না হলেও এ ঝড়েও জানমালের প্রচুর ক্ষতি হয়। কালবৈশাখি ঝড় ঘরবাড়ি উড়িয়ে নেয়, গাছপালা উপড়ে ফেলে, নৌ-চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। কালবৈশাখির কবলে পড়ে ভয়াবহ নৌ-দুর্ঘটনাও ঘটে। এজন্য কালবৈশাখির মৌসুমে নদীপথে নৌকা ও লঞ্চ চলাচলে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
কাজ-১: বাংলাদেশে কী কী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে তার একটি তালিকা তৈরি কর। কাজ-২: বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন ও তার ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি কর। |
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, কালবৈশাখী ঝড় মোকাবিলায় করণীয়
ক. আবহাওয়া বিভাগ থেকে প্রচারিত পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা মেনে চলা;
খ. বাড়ির আশেপাশে গাছ লাগানো:
গ. গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্দ্গীরণ নিয়ন্ত্রণ করা।
বন্যা মোকাবিলায় করণীয়
ক. বাঁধ নির্মাণ করা;
খ. ঘরবাড়ির ভিটে উঁচু করা;
গ. নদী খননের ব্যবস্থা করা।
ঘ. ভারতের সাথে অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে শক্ত অবস্থান নেওয়া।
খরা মোকাবিলায় করণীয়
ক. পর্যাপ্ত বনায়ন করা;
খ. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ করা।
নদীভাঙন মোকাবিলায় করণীয়
ক. নদীর পাড়ে গাছ লাগানো;
খ. নদীর পাড় সংরক্ষণ করা;
গ. নিয়মিত নদী খননের ব্যবস্থা করা।
কাজ-১: তোমাদের এলাকায় বন্যা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় তুমি কী করতে পার? |
কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, সামাজিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক যে সকল ক্ষেত্রে প্রভাব লক্ষ করা যায় সেগুলো হলো:
কৃষি: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অধিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের জন্য দেশে আশানুরূপ ফসল ফলানো সম্ভব হয় না। কিছু এলাকায় বর্ষা মৌসুমে আগাম বন্যার কারণে এমনকি গভীর পানিতে উৎপাদনশীল ধানের আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে আউশ ধান ও পাট চাষের উপযোগী জমির পরিমাণ হ্রাস পায়।
মৎস্যসম্পদ: জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদ তিন দিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যেমন: লবণাক্ততা, বন্যা ও উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস। লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে স্বাদু পানির মৎস্যসম্পদ কমে যাবে। বন্যার কারণে নদী-পুকুরের পাড় উপচে পানি জনবসতিতে প্রবেশ করলে মাছের বসবাসের স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাসে দেশের অভ্যন্তরে নদীসমূহে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়।
স্বাস্থ্য: জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চল ক্রমবর্ধমান বন্যার কারণে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। এর ফলে সেখানে ছোঁয়াচে রোগের বিস্তার লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
শিল্প: শিল্পের প্রধান উপকরণ হলো কাঁচামাল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষিজ পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
সামাজিক: জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। স্বল্প সময়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত সংঘটিত হওয়ায় বন্যা ও নদীভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে নগর ও গ্রামে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়।
কাজ-১: বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত্রসমূহ তালিকায় প্রদর্শন কর। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. বাংলাদেশে সাধারণত কোন মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেয়?
ক. গ্রীষ্ম
খ. বর্ষা
গ. শীত
ঘ. বসন্ত
২. আমাদের দেশে নদীভাঙনের কারণ হচ্ছে-
i নদীগুলোর চলার পথ সোজা না হওয়া
ii নদীর পাড়ের মাটির দুর্বল গঠন
iii নদীর পাড়ে প্রচুর গাছপালা থাকা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i, ii ও iii
নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং ৩ ও ৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও।
কক্সবাজারের মেয়ে রূপসা ঘরে বসে রেডিয়ো শুনছিল। রেডিয়োতে সতর্কবার্তা শুনে সে এবং তার পরিবারের সদস্যগণ আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে রওনা হলো।
৩. রূপসা কিসের সতর্ক বার্তা শুনেছিল?
ক. ঘূর্ণিঝড়ের
খ. ভূমিকম্পের
গ. নদীভাঙনের
ঘ. টর্নেডোর
৪. রূপসার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ হচ্ছে-
i. পুরো এলাকা দ্রুত প্লাবিত হয়ে যেতে পারে।
ii. একটি কম্পনের পর পরই আর একটি কম্পন শুরু হবে।
iii. আশ্রয়কেন্দ্রে সময়মতো পৌঁছানো নিয়ে।
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১১ এর দৈনিক পত্রিকায় একটি খবর দেখে জারিফ চমকে ওঠে। বিশ্বব্যাপী এক ধরনের গ্যাস অধিক নিঃসরণের জন্য জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের মতো সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি উচ্চতার দেশগুলো আজ হুমকির মুখে পড়েছে। এই বিপর্যয়ের জন্য জারিফ মানবসৃষ্ট নানা কর্মকাণ্ডকে দায়ী করে এক ধরনের উৎকণ্ঠা অনুভব করে।
ক. বাংলাদেশ কোন অঞ্চলে অবস্থিত?
খ. বাংলাদেশের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের বাংলাদেশ কী ধরনের হুমকির মুখোমুখি- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকে উল্লিখিত বিপর্যয়ের জন্য মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডই দায়ী- তোমার উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।
২. আরিফ টেলিভিশনে 'বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ' সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখছিল। প্রতিবেদনের প্রথম অংশে দেখানো হয় কীভাবে উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষিজমিগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশে দেখানো হয় উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কীভাবে জনজীবন ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ অঞ্চলে অবস্থানগত কারণে প্রায়শই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে।
ক. প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়কে কী বলে?
খ. কালবৈশাখি কী? বুঝিয়ে লিখ।
গ. প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশে দেখানো দুর্যোগ ঘটার কারণ ব্যাখ্যা কর।
ঘ. প্রতিবেদনের প্রথম অংশে দেখানো দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়- তা ব্যাখ্যা কর।
Read more