বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনযাপনের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের লোকশিল্প ও কারুশিল্প। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা লোকশিল্প ও কারুশিল্প সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। এ অধ্যায়ে আমরা বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি লোকশিল্প ও কারুশিল্প সম্পর্কে জানব এবং আমাদের জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকশিল্প ও কারুশিল্পের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা লাভ করব।
এ অধ্যায় পাঠ শেষ করলে আমরা-
বাংলাদেশের লোকশিল্পের ভুবন অনেক বিস্তৃত। আলপনা, নকশিপিঠা, নকশিসাঁচ, নকশিপাখা, শীতল পাটি, নকশিকাঁথা, নকশিশিকা, লোকচিত্র, খেলনা, পুতুল, শোলার কাজ, বাঁশ-বেতের বেড়া, লোক-অলঙ্কার, লোকবাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির ফলকচিত্র প্রভৃতি নিয়ে বাংলাদেশের লোকশিল্পের বিচিত্র জগৎ।
বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসবে বিভিন্নরকম লোকচিত্র তৈরি করা হয়। এর মধ্যে আছে মহররম সম্পর্কিত চিত্র, পটচিত্র, ঘটচিত্র, সরাচিত্র, দেয়ালচিত্র, মুখোশচিত্র, পিড়িচিত্র ইত্যাদি। এ সমস্ত লোকচিত্র আমাদের লোকশিল্পের অংশ। বাংলাদেশের এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকশিল্পগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান কয়েকটি সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
আলপনা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লোকশিল্প। বাঙালির বিভিন্ন উৎসবে আলপনা আঁকা হয়। এখন নববর্ষের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, বিয়ে, গায়ে হলুদ এবং ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহিদ মিনারঞ্ছল ও সড়কে আমরা আলপনার ব্যবহার দেখতে পাই। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উৎসবের সৌন্দর্য ও জাঁকজমক বাড়িয়ে দিতে আমরা আলপনার ব্যবহার করি। যে কোনো শুভকাজে আলপনা আঁকা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য ও অনেক প্রাচীন একটি রীতি। এর উদ্ভব হয়েছিল মূলত প্রাচীন বাঙালি লোকজীবনের ধর্ম ও জাদু বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। বিভিন্ন প্রকার পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠানে আলপনা আঁকা হতো। যেমন লক্ষ্মীপূজায় গোলাকার আকৃতির আলপনা দেবীর আসন বা বেদী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আলপনায় বহুল ব্যবহৃত একটি মোটিফ হচ্ছে কল্কি। কল্কি এখানে লক্ষ্মীর ধনভাণ্ডারের ধানে ভর্তি প্রতীক চিহ্ন। এই প্রতীক বা রূপক চিহ্ন দিয়ে আলপনা এঁকে লক্ষ্মীদেবীর পূজা করলে সংসারে সমৃদ্ধি আসবে। ধানে গোলা পরিপূর্ণ থাকবে। এই বিশ্বাস থেকে এমন আলপনা আঁকা হতো।
অন্যদিকে আমরা সাংসারিক ও সামাজিক জীবনে যা পাবার আশা করি বা চেষ্টা করি সে আশা পূরণের জন্য করা হতো ব্রতের অনুষ্ঠান। এই ব্রতের অনুষ্ঠানে ও আলপনা আঁকা হতো। ব্রতের আলপনায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মোটিফগুলো ছিল মনের কামনার এক একটি প্রতীক। পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে আলপনা বাঙালির সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের শুভ অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে ওঠে। এখন বিভিন্ন লোকজ মোটিফ যেমন-ফুল, পাতা, মাছ, পাখি ইত্যাদি এবং নানা রকম জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক আকৃতির ব্যবহার করে আলপনা আঁকা হয়। পানিতে চালের গুঁড়া মিশিয়ে পিঠালি তৈরি করে তাতে ন্যাকড়া ভিজিয়ে উঠানে, ঘরের বারান্দায় ও মেঝেতে আলপনা আঁকা হয়। চালের গুঁড়া ছিটিয়ে তার ওপর আঙ্গুল দিয়ে আলপনা আঁকার একটি প্রাচীন রীতি ছিল। ডালের গুঁড়া, পোড়া তুষ, ইটের গুঁড়া প্রভৃতি দিয়ে আলপনায় রঙের বৈচিত্র্য আনা হতো। গতানুগতিকতা ও বাঁধাধরা কিছু আকার-আকৃতি আলপনার একটি বিশেষ দিক হিসেবে গণ্য হতো। এই বাঁধাধরা আকার-আকৃতি বা নকশাকে মোটিফ বলে। তবে আধুনিককালে আলপনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ও পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে এর আঙ্গিক ও মোটিফের ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। রঙের ব্যবহারে এসেছে বৈচিত্র্য। এখন প্লাস্টিক রং ও বিভিন্ন রঙের অক্সাইড এর সাথে আইকা গাম মিশিয়ে তুলি দিয়ে আলপনা করা হয়।
চিত্রিত বিভিন্ন প্রকার সরা লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত। পাতিলের ঢাকনার নাম সরা। রান্নাঘরের কাজে ব্যবহৃত এ রকম সরা চিত্রিত হয় না। তবে এ ধরনের সরাচিত্র আঁকা হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ে অনুষ্ঠানের উপকরণ হিসেবে। সরাতে সাধারণত পদ্ম, প্রজাপতি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য চিত্র আঁকা হয়। তবে সরাচিত্রের সব থেকে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে লক্ষ্মীসরা। লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মীসরা প্রধান উপকরণ। পূজার শেষে তা গৃহসজ্জার জন্য ঘরে রাখা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকমের লক্ষ্মীসরা দেখা যায়। লক্ষ্মীসরাতে দেবী দুর্গার ছবির সাথে লক্ষ্মীর ছবি থাকে। সাথে লক্ষ্মী দেবীর বাহন পেঁচার ছবিও থাকে। লোকজ রীতিতে উজ্জ্বল বিভিন্ন রং দিয়ে এসব ছবি আঁকা হয়। বর্তমানে সরাচিত্র আর শুধু ধর্মীয় বিষয়ে আবদ্ধ নয়। এখন বিভিন্ন লোকজ বিষয় ও নানারকম নকশা দিয়ে সরা আঁকা হয়। এসব সরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে সাজসজ্জার কাজে ব্যবহার করা হয় এবং গৃহসজ্জাতেও ব্যবহার করা হয়। তাই এসব সরাচিত্র আমাদের লোকসংস্কৃতির অংশ।
বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম একটি নিদর্শন হচ্ছে পট। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে আঁকা হতো। পট্ট বা কাপড় শব্দ থেকে পট শব্দের উৎপত্রি। জড়ানো পট ও চৌকা পট-এ দুই ধরনের আঁকা হতো। আর এর শিল্পীরা পটুয়া নামে পরিচিত। জড়ানো পট বেশ বড়ো ও লম্বা আকারের হয়ে থাকে। একটা পটে পর পর লম্বাভাবে সাজানো থাকে অনেকগুলো টুকরো ছবি। এ ছবিগুলো কোনো লোককাহিনি বা ধর্মীয় কাহিনির চিত্ররূপ। বুদ্ধের জীবনী, জাতকের গল্প, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের কাহিনি, মহররমের কাহিনি, সোনাই-মাধব এরকম বহু বিষয়ের উপর পট আঁকা হতো। পরবর্তীকালে লৌকিক পির গাজীর জীবনের গল্প, কালুগাজী-চম্পাবতীর গল্প নিয়েও পট আঁকা হয়েছে। এগুলো গাজীর পট নামে খ্যাত।
এই পটগুলোর দু প্রান্তে দুটি কাঠি লাগিয়ে তার সাথে জড়িয়ে রাখা হতো। কাপড়ের ওপর কাগজ লাগিয়ে তার ওপর চিত্র আঁকা হতো। তাছাড়া কাপড়ের ওপর আঠালো রং দিয়েও চিত্র আঁকা হতো। গ্রামে কিছু লোক এই পট নিয়ে ঘুরে ঘুরে পটের গল্প সুন্দর সুর করে বর্ণনা করেন। ছেলে-বুড়ো ও মেয়েরা সবাই ভিড় করে এসব পটের গল্প-কাহিনি শোনেন এবং খুব আনন্দ পান।
চৌক পট ছোটো আকারের কাগজের ওপর আঁকা চিত্র। সাধারণত ১ ফুট লম্বা ও ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি চওড়া হয়। এগুলোর মধ্যে কালীঘাটের পট ছিল বিখ্যাত। কালীঘাটের পটের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য ও শিল্পমান ছিল অসাধারণ। এগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের জীবনযাপনের ভালোমন্দ দিক, সামাজিক আচার-অনাচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদির চিত্রায়ন করা হতো। মৃত ব্যক্তির স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য চক্ষুদান পট নামে একরকম পট আঁকতেন পটুয়ারা। মৃত ব্যক্তির চক্ষুবিহীন ছবি এঁকে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে উপযুক্ত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাতে চোখ এঁকে দেওয়া হতো। যাতে করে সে স্বর্গের পথ দেখতে পায়।
নকশিকাঁথা বাংলাদেশের লোকশিল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন। শীতকালে গায়ে দেওয়ার জন্য কাপড় কয়েক পরত একসঙ্গে সাজিয়ে কাঁথা সেলাই করা হয়। এর মধ্যে কিছু কাঁথা তৈরি করা হয় নানা রঙের সুতায়, নানারকম নকশা করে। অনেক নকশা দিয়ে যে কাঁথা সেলাই হয় সেটাই হলো নকশিকাঁথা। গাঁয়ের মেয়েরা কাজের অবসরে দিনের পর দিন খেটে সুই-সুতায়, রং-বেরঙের ছবি ও নকশা
কাঁথায় ফুটিয়ে তোলে। এসব ছবিতে থাকে অনেক গল্প, অনেক কাহিনি। গাঁয়ের বধূ তার নিজের জীবনের সুখ-দুঃখের কথা সুঁই-সুতার ছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলে। এক-একটি কাঁথা বানাতে এক বছর, কখনো কখনো দুই বছর সময় পেরিয়ে যায়। এক-একটি কাঁথার শিল্পনৈপুণ্য দেখে বিস্মিত হতে হয়। কাঁথাতে যেসব নকশা থাকে তা হলো- ফুল, পাতা, গাছ-পালা, পদ্ম, চাঁদ, তারা, পাখি, মাছ, নানারকম জীবজন্তু এমনকি ঘরবাড়ি ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু কাঁথাতে রেখা, বৃত্ত, গোলাকার ঘর, তিনকোনা ঘর এসব আদল বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়। একই আদল বা নকশার বারবার ব্যবহারকে 'মোটিফ' বলে। ব্যবহারিক দিক থেকে নকশিকাঁথাকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যেমন-
সুজনিপেড়ে, লেপকাঁথা, চাদর কাঁথা, জায়নামাজ, আসন কাঁথা, পালকির কাঁথা, রুমাল কাঁথা ইত্যাদি। বাংলাদেশে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের দুটি মূলধারা বা রীতি আছে। তার একটি হলো যশোর রীতি, অন্যটি রাজশাহী রীতি।
তাছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলেও নকশিকাঁথার উল্লেখযোগ্য ধারা আছে। যশোর অঞ্চলের নকশিকাঁথা বাংলাদেশের শীর্ষস্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের কাঁথার ফোঁড় অত্যন্ত সূক্ষ্ম, রং রুচিসম্মত। গ্রামীণ মেলায় এই কাঁথা কোনোদিন বিক্রি হয় না। নিজেদের উদ্দেশ্যে এই কাঁথা তৈরি হয়। তবে অপরের ফরমাসে পারিশ্রমিকের বিনিময়েও নকশিকাঁথা তৈরি করা হয়। আজকাল শহরের কারুশিল্পের দোকানে নকশিকাঁথা বেচাকেনা হতে দেখা যায়। এমনকি বিদেশের বাজারেও আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের বিক্রয় হয়ে থাকে।
পোড়ামাটির ফলকচিত্র বা টেরাকোটা
পোড়ামাটির ফলক বাংলাদেশের আদি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প এবং খুবই বিখ্যাত। মধ্যযুগে বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনাতে, বিশেষ করে মন্দির, মসজিদ ইত্যাদির দেয়ালে এ ফলকচিত্র ব্যবহার করা হতো। পোড়ামাটির ফলকচিত্র বা Terracotta হচ্ছে মাটির পাটাতনের বা ফলকের সমান জমিনের উপর ছবি বা নকশা উঁচু উঁচু হয়ে থাকে এমন রিলিফ ওয়ার্ক। এটা বানানোর জন্য প্রথমে কাঁচা মাটি দিয়ে ফলকগুলো তৈরি করে তারপর পুড়িয়ে নেওয়া হয়। তাই এগুলোকে বলে পোড়ামাটির ফলক। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে তথা প্রাচীন পুন্ড্র নগরীর প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ফলকচিত্র পাওয়া গেছে।
মহাস্থানগড়ের এবং দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের ফলকচিত্রের বিষয়বস্তু নরনারী ও দেবদেবী। অন্যদিকে পাহাড়পুর ও কুমিল্লার ময়নামতির ফলকগুলোতে তৎকালীন সমাজ ও নিসর্গের ছবি পাওয়া যায়। বাঘা মসজিদের বা টাঙ্গাইলের আদিনা মসজিদের ফলকচিত্রের বিষয়বস্তু ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক বিভিন্ন বিষয় ও আকৃতি নিয়ে টেরাকোটা তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন অফিস ও বাসাবাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও ভবনের বাইরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য এখন প্রচুর টেরাকোটা ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিস যেমন- দা, কুড়াল, খন্তা, কাঁচি, যাঁতি, লাঙলের ফলা, হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, মটকা, তামা, কাঁসা-পিতলের অনেক জিনিস, নৌকা, রিকশা, খাট-পালঙ্ক, দরজা ইত্যাদিতে সৌন্দর্য আরোপের জন্য এসবের গায়ে আঁচড় কেটে, খোদাই করে, কখনোবা আলাদা করে লাগিয়ে লতা, পাতা, ফুল, পাখি, বিভিন্ন জীবজন্তু ইত্যাদির ছবি বা নকশা আঁকা হয়। কারুকাজ করা এসব ব্যবহার্য সামগ্রীকে আমরা কারুশিল্প বলি। আমাদের দেশে বহু প্রকার কারুশিল্প আমরা ব্যবহার করি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারুশিল্প সম্পর্কে এখানে আমরা জানব।
বাংলাদেশের সুন্দর কারুশিল্প হিসেবে রিকশা দেশে ও বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। তিন চাকাবিশিষ্ট রিকশা চেহারা ও আকৃতির দিক থেকে একটি শিল্পকর্ম। তদুপরি বাঁশ, প্লাস্টিক ও কাপড় দিয়ে ফুল, পাতা, পাখির নকশা কেটে সেলাই করে রিকশাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোলা হয়। রিকশার হ্যান্ডেলের দুপাশে কখনও কখনও দুটি ফুলদানি স্থাপন করে তাতে প্লাস্টিকের ফুল লাগানো হয়। আবার হ্রডের চারপাশে রঙিন ঝুনঝুনি ঝুলিয়ে সাজানো হয়। এতে করে রিকশা চলার সময় ঝুনঝুনির ছন্দময় শব্দ হয়। প্রতিটি রিকশার সিটের পেছন দিকে সুন্দর ছবি এঁকে তা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে রিকশা একটি আকর্ষণীয় কারুশিল্প।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা অত্যন্ত পরিচিত একটি বাহন। এটি শুধু জলপথের নির্ভরযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত বাহনই নয় বরং আমাদের কারুশিল্পেরও উজ্জ্বল নিদর্শন। নৌকার চেহারা ও গড়নের দিক দিক থেকে যেমন শিল্পনৈপুণ্য
রয়েছে, এমনি কাঠ খোদাই করে নৌকার গায়ে অনেক কারুকাজ করা হয়। নৌকা তার চেহারার কারণে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- গয়না, পানসি, বজরা, কোশা, সারঙ্গ, সাম্পান, দ্বীপ, জেলেনাও ইত্যাদি। অতীতে ময়ূরপঙ্খী, টিয়াঠোঁটি প্রভৃতি নামের নৌকা ছিল। গলুই ও অন্যান্য অংশের গড়ন ময়ূর, টিয়া ইত্যাদি পাখির অনুকরণে করা হতো। নৌকার গোলুইতে পিতলের দুটি চোখ, পিতল ও অ্যালুমিনিয়ামের পাত ইত্যাদি বসিয়ে নৌকা অলংকৃত করা হয়। পদ্ম, চাঁদ, তারা প্রভৃতি মোটিফ তার শোভা বর্ধন করে।
কাঠের তৈরি বেড়া ও খাট-পালঙ্ক বাংলাদেশের অতি প্রাচীন কারুশিল্প। কাঠের বেড়াতে সুন্দর কারুকাজ করে তাতে সিংহ, হাতির মুখ, পদ্ম ইত্যাদি মোটিফের ব্যবহার করা হতো। কাঠের বেড়া একদা ফরিদপুর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় শিল্প ছিল। দরজার তোরণের দুপাশে লতা-পাতা মাঝখানে থাকে দুটি সিংহ। সিংহদ্বারের ঐতিহ্য থেকে এ রীতির প্রবর্তন হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। কাঠের বেড়ার মতো কাঠের পালঙ্কও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প। নানারকম কারুকার্যখচিত পালঙ্ক বা খাট বহু প্রাচীন কাল থেকে এদেশের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অতীতে পালঙ্কের পায়া বাঘ-সিংহের থাবার মতো করে খোদাই করা হতো। কখনোবা তা পরির মতো করে খোদাই করা হতো। জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত দুটি পালঙ্কের পায়া, মশারির স্ট্যান্ড পরিরা যেন ধারণ করে আছে। তাছাড়া আছে লতাপাতার বিচিত্র অলঙ্করণ। গ্রাম অঞ্চলে সচরাচর একজোড়া ময়ূর দিয়ে খাট-পালঙ্কের মাথার দিকের কাঠ অলঙ্কৃত করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই কাঠের তৈরি কারুকার্য খচিত দরজা আমাদের কারুশিল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। ফুল-লতা-পাতার নকশা ছাড়াও সিংহ, হাতি প্রভৃতি প্রাণীর মুখ খোদাই করে দরজা অলঙ্কৃত করা হতো। সুরম্য ভবনের বিশাল আকৃতির কারুকার্য খচিত দরজা ভবনের সৌন্দর্য দ্বিগুণ করে দিত। এখনো সৌখিন বাঙালিরা তাদের বাসগৃহে কারুকার্যময় দরজার ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের রুচিবোধের পরিচয় দেয়।
বাংলাদেশের অসংখ্য কারুশিল্প থেকে উপরে মাত্র কয়েকটি নিয়ে আলোচনা হলো। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকশিল্প ও কারুশিল্প সম্পর্কে আমরা আরও সচেতন হলে এ সকল বিষয়ে আরও জানতে পারব। বাংলাদেশের এক এক অঞ্চলে এক এক লোকশিল্প ও কারুশিল্প শিল্পগুণের জন্য, নিপুণ কাজের জন্য ও সৌন্দর্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। তোমরা যখন যে কারুশিল্প বা লোকশিল্প হাতের কাছে পাবে সেটি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে জেনে নেবে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকশিল্প ও কারুশিল্পের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এ সমস্ত শিল্প আমাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। নিচে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোকশিল্প ও কারুশিল্পের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
বাংলাদেশের লোকশিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে মাটি, কাঠ ও কাপড়ের তৈরি নানারকম রঙিন খেলনা। এগুলো শিল্পমানের সাথে সাথে ছোটো শিশুদের খেলনা হিসেবেও খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জের শিশুরা এসব মন ভোলানো খেলনা দিয়েই তাদের রঙিন শৈশব পার করে। আবার পাটের তৈরি শিকা, ফ্লোরম্যাট, টেবিলম্যাট ইত্যাদির ব্যবহারিক উপযোগিতা রয়েছে। গ্রামেগঞ্জে ঘরে ঘরে এগুলো ব্যবহার করা হয়। লোকশিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত উপাদানটি নকশিকাঁথা। মনোরম এই শিল্পটি শিল্পগুণ ও মানে যেমন সেরা তেমনি গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরেও সমানভাবে এর ব্যবহার হয়। শীতে এ কাঁথার ব্যবহার হয় ঘরে ঘরে। এমনকি দেশের বাইরেও এর জনপ্রিয়তা ও চাহিদা আছে। অন্যদিকে লক্ষ্মীসরা হিন্দুদের লক্ষ্মীপূজার একটি প্রধান উপকরণ। তেমনি আলপনা, দেয়ালচিত্র ইত্যাদি বাঙালির উৎসব অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে উঠেছে। বর্ষবরণ, পূজা, বিয়ে, জন্মদিন, গায়ে হলুদ, শহিদ দিবসসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলপনা ও দেয়ালচিত্রের ব্যাপক ব্যবহার করা হয়। এগুলো অনুষ্ঠানকে জাঁকজমকপূর্ণ ও রঙিন করে তোলে।
নকশিপিঠা বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলের খুবই জনপ্রিয় একটি খাবার। শীতে এই পিঠা দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করা হয়। এসব নকশিপিঠা শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, খেতেও সুস্বাদু। বাঙালির যে কোনো উৎসব, অনুষ্ঠান ও বিয়ে এই পিঠা ছাড়া হতো না। এখনো এই পিঠা বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানের প্রিয় খাবার।
অন্যদিকে নকশিপাখার ব্যবহার গরমের দিনে গ্রামের সাথে সাথে শহরেও দেখা যায়। মধ্যযুগে টেরাকোটা বা পোড়ামাটির ফলকচিত্র বিভিন্ন স্থাপনা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে স্থাপন করা হতো ভবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য। বর্তমানে আধুনিক বিষয় ও প্রকৃতি নিয়ে প্রচুর টেরাকোটা করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়ি ইত্যাদিতে এ সমস্ত টেরাকোটার সৌখিন ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তাই আমরা বলতে পারি যে, লোকশিল্প শুধুমাত্র একটি শিল্পমাধ্যম নয় বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবময় লোকশিল্পের সম্প্রসারণে আমরা অধিক যত্নবান হব। আমাদের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করার জন্য লোকশিল্পের ভূমিকা ব্যাপক।
কাজ: খেলনা, গৃহসামগ্রী, উৎসবে যে সমস্ত লোকশিল্প ব্যবহৃত হয় সেগুলোর তিনটি করে তালিকা করো। |
লোকশিল্পের মতো কারুশিল্পও আমাদের জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা জানি যে, ব্যবহারিক বিভিন্ন সামগ্রী বা বস্তুকে অলঙ্কৃত করা হলেই সেটা হয় কারুশিল্প। সুতরাং সহজেই বোঝা যায় যে, সমস্ত কারুশিল্পই আমাদের ব্যবহারিক কাজে লাগে। যেমন- বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি কারুকার্যময় বিভিন্ন আসবাব আমাদের গৃহের সৌন্দর্য যেমন বাড়ায়, তেমনি এগুলো আমাদের শোয়া, বসা, জামাকাপড় সংরক্ষণ, খাবার রাখা থেকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়। মাটির তৈরি কারুকার্যময় বিভিন্ন হাঁড়ি, পাতিল ও বাসনকোসন গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘরসংসারের প্রধান উপকরণ। আবার তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈরি বিভিন্ন নকশা করা তৈজসপত্রও আমরা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করি। সুন্দর অলঙ্কার ও শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী। নকশা করা খাট, পালঙ্ক, দরজা, আলমারি এসব যেমন আমাদের সুরুচির পরিচয় দেয় তেমনি দৈনন্দিন জীবনে এসবের ব্যবহার অপরিহার্য। তাই বলা যায়, এসব শিল্প আমাদের জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
কাজ: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার সামগ্রীতে যে কারুশিল্পের কাজ দেখি এমন দশটি সামগ্রীর নাম লেখো |
১. 'আলপনা' বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কী শিল্প?
ক. কারুশিল্প
খ. লোকশিল্প
গ. কুটিরশিল্প
ঘ. দারুশিল্প
২. চৌকপটের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে কোনটি?
ক. গাজীরপট
খ. চক্ষুদানপট
গ. কালীঘাটেরপট
ঘ. যীশুপট
৩. কোন অঞ্চলের নকশিকাঁথা শীর্ষস্থানীয়?
ক. রাজশাহী
খ. ফরিদপুর
গ. যশোর
ঘ. চট্টগ্রাম
৪. বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন পোড়ামাটির ফলকচিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে কোথায়?
ক. বগুড়ার মহাস্থানগড়ে
খ. কুমিল্লার ময়নামতিতে
গ. দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরে
ঘ. রাজশাহীর বাঘা মসজিদে
৫. কাঠের তৈরি বেড়া ও খাটপালঙ্ক বাংলাদেশের অতি প্রাচীন-
ক. লোকশিল্প
খ. হস্তশিল্প
গ. কুটিরশিল্প
ঘ. কারুশিল্প
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন
১. কারুশিল্প বলতে কী বোঝায়?
২. কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এমন ৫টি কারুশিল্পের নাম লেখো।
৩. প্রতিদিন আমরা নানারকম কারুশিল্প ব্যবহার করি- সুনির্দিষ্ট উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করো।
৪. কারুকাজ খচিত আসবাবপত্র ও গয়না আমাদের অধিক পছন্দনীয় কেন?
৫. বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করে নকশিকাঁথা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
৬. বাংলাদেশের জনপ্রিয় বাহন ও সুন্দর কারুশিল্প রিকশা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
রচনামূলক প্রশ্ন
১. কারুশিল্পের সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবন একসূত্রে বাঁধা-কথাটি বিশ্লেষণ করো।
২. লোকশিল্পের ও কারুশিল্প ব্যবহারের বিষয়ে তোমরা কীভাবে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করবে?
৩. বাংলাদেশের উন্নয়নে চিত্রকলা কীভাবে ভূমিকা রেখেছে তা উল্লেখ করো।
8. পটচিত্র কী? যা জেনেছ তা লেখো।
Read more