আমরা সবাই জানি, জীবনের সূচনা হয় মাতৃগর্ভ থেকে। ২৮০ দিন বা ৪০ সপ্তাহ বা নয় মাস গর্ভে থাকার পর শিশুর জন্ম হয়। জন্মের পর শৈশব, কৈশোর, প্রাপ্ত বয়স পার হয়ে একজন ব্যক্তি বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হয়। মানুষের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়ে একই রকম বৈশিষ্ট্য থাকে না। একটি দুই বছরের শিশু এবং একটি দশ বছরের শিশুর বৈশিষ্ট্যের অনেক পার্থক্য থাকে। আবার কৈশোর ও প্রাপ্ত বয়সের বিকাশ কখনোই একরকম নয়। জীবন প্রসারের সম্পূর্ণ সময়কে কয়েকটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলোই বিকাশের স্তর নামে পরিচিত।
এই স্তরগুলো হলো –
জন্মপূর্ব কাল (Prenatal Period) - জীবনের সূচনা থেকে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত সময়কাল। সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনের সময়কাল হলো মাতৃগর্ভের এই সময়কাল। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে একটি এককোষী জীব একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়। জন্মগ্রহণের পর মাতৃগর্ভের বাইরের পরিবেশের সাথে খাপখাওয়ানোর জন্য ভ্রুণ শিশুর মধ্যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে।
নবজাতকাল (Neonatal Period) - জন্ম মুহূর্ত থেকে দুই সপ্তাহ সময়কাল নবজাতকাল। এ সময়ে নবজাতককে নতুন পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য গ্রহণ ও শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশনে তার গ্রন্থি সক্রিয় হয়। মাতৃগর্ভের গরম পরিবেশ ( ১০০° ফারেনহাইট) থেকে কম তাপমাত্রার পরিবেশের সাথে তাকে সঙ্গতি বিধান করতে হয়। সুস্থ নবজাতক জন্মের সময় চিৎকার করে কাঁদে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ২০ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটায়। তার যেকোনো অসুবিধা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হলো কান্না । আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নবজাতকের স্বাভাবিক ওজন আড়াই কেজি থেকে তিন কেজি।
অতি শৈশব ও টডলারহুড (Babyhood & Toddlerhood) - দুই সপ্তাহ থেকে ২ বছর পর্যন্ত সময়কাল। কিছুদিন পূর্বেও যে শিশুটি বড় অসহায় ছিল সে এখন—বসতে পারে, হাঁটতে পারে, কথা বলতে পারে। এই বয়সের মধ্যে তার অন্যের সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। ১ম বৎসর অতি শিশু, ২য় বৎসর হলো টডলার। শিশুর দুই বছর বয়সের মধ্যে আত্মনির্ভরতার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হয়, যা তাদের স্বাধীনভাবে চলতে সহায়তা করে।
প্রারম্ভিক শৈশব (Early childhood) - ২ থেকে ৬ বছর। এ সময়ে শিশু লম্বা ও ক্ষীণকায় হয়। হাঁটা, দৌড়ানো, আরোহণ করা, ধরা ইত্যাদিতে আরও বেশি দক্ষতা অর্জন করে। তারা অনেক বেশি নিজের কাজগুলো করতে পারে। যেমন- নিজে খাওয়া, নিজে নিজে পোশাক পরা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া ইত্যাদি। তারা পরিবারের সদস্যদের অনুকরণ করে খেলে। তারা সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে শুরু করে। এ বয়সে তারা কৌতূহলী হয় ও অনেক প্রশ্ন করে।
মধ্য শৈশব (Middle Childhood) - ৬ থেকে ১১ বছর। এই বয়সে ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে এবং নতুন নতুন দায়িত্ব পালনে দক্ষ হয়। খেলাধুলায় দক্ষ হয়, নিয়ম সমৃদ্ধ খেলায় (যেমন-গোল্লাছুট, বৌচি, ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি) অংশ নেয়। তারা যুক্তিপূর্ণ চিন্তা, ভাষার দক্ষতা অর্জন করে এবং ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে তাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়। তারা বন্ধুত্ব তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
বয়ঃসন্ধি বা কৈশোরকাল ( Adolescence) - ১১ থেকে ১৮ বছর – এই সময়টি শিশু থেকে প্রাপ্ত বয়সে যাওয়ার সময়কাল। বয়ঃসন্ধিক্ষণে প্রাপ্ত বয়স্কের মতো দেহের আকার আকৃতি ও যৌন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়। যৌন ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশে তারা প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। বিমূর্ত বিষয় চিন্তা করতে পারে অর্থাৎ যে বিষয় চোখে দেখা যায় না যেমন- সততা, স্নেহ, ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়গুলো বুঝতে পারে। কে কোন পেশায় যাবে সে অনুযায়ী পড়াশোনা করে।তার মধ্যে নিজস্ব লক্ষ্য, মূল্যবোধ — তৈরি হয়। তারা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে আরম্ভ করে। এ বয়সে নিজ চেহারার প্রতি তাদের মনোযোগ বাড়ে।
প্রারম্ভিক বয়ঃপ্রাপ্তিকাল ( Early Adulthood) - ১৮ থেকে ২৫ বছর। পেশা ও সঙ্গী নির্বাচনের প্রস্তুতি— এ সময়ের অন্যতম কাজ। এ বয়সে বিয়ে ও পরিবার গঠনের আগ্রহ তৈরি হয়। অনেকে পেশা সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে আসে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি উত্তরণের পর বাস্তবমুখী পেশা নির্বাচনের পথ স্থির হয়। খেলাধুলায় অংশগ্রহণের চেয়ে এই বয়সে দর্শকের ভূমিকা পালনে তারা আগ্রহী হয়। তারা সরকার, রাজনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে বন্ধুদের সাথে চিন্তার আদান-প্রদান করে ।
বয়ঃপ্রাপ্তির শেষভাগ (Late Adulthood)- ২৫ থেকে ৪০ বছর। বয়ঃপ্রাপ্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মা- বাবা হিসেবে পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ। এ সময়ে বিয়ের পর দুইটি ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসা দুজনের মধ্যে খাপ খাওয়ানো শিখতে হয়। সন্তান লালন-পালন একটি নতুন কাজ, যা তাদের অবশ্যই পালন করতে হয়। স্বামী স্ত্রীর সুন্দর সমঝোতায় গৃহ পরিচালনায় সফলতা আসে। চাকরি, বিয়ে, সন্তান সবকিছু নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, তারা এসবের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ পায় না।
মধ্যবয়স (Middle Age ) - ৪০ থেকে ৬৫ বছর। কাজ থেকে অবসর গ্রহণের সময় পর্যন্ত এই বয়সের ব্যাপ্তি। এটা প্রাপ্ত বয়স থেকে বার্ধক্যে অবতীর্ণ হওয়ার মধ্যবর্তী সময়। কর্মক্ষেত্রে সফলতা বা নেতৃত্বদান এ বয়সেই হয়ে থাকে। মধ্য বয়সে প্রধান শারীরিক লক্ষণগুলো হলো- ওজন বৃদ্ধি, চুল পাকা, কুঁচকানো ত্বক, হাত পায়ের জোড়ায় ব্যথা, দৃষ্টি শক্তির সমস্যা ইত্যাদি।
বার্ধক্য (Old Age )-৬৫ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এটি মানব - বিকাশের সর্বশেষ স্তর। বার্ধক্য ক্ষয়ের সূচনা করে। এই সময়ে শারীরিক, মানসিক অবস্থার ধারাবাহিক অবনতি দেখা যায়। তাঁদের কাজ করার শক্তি হ্রাস পায়। বৃদ্ধরা তাঁদের নিজেদেরকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা খুব কম গঠনমূলক কাজ করতে পারে। তাদের ধর্মীয় আগ্রহ বাড়ে। যদি বার্ধক্যে হতাশা, জীবন সম্পর্কে বিরক্তি, মৃত্যু ভয় মোকাবিলা করা যায় তবে এ সময়টিতে পরিতৃপ্তির অনুভূতি আসে।
আরও দেখুন...