পাঠ : ১
বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পরিচয়
বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব দুটি নামবাচক শব্দ। একটি অপরটির পরিপূরক। বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। এখানে বুদ্ধ বলতে শুধু গৌতম বুদ্ধ নয়। শাস্ত্রমতে তাঁর আগেও অনেক বুদ্ধ ছিলেন। তাঁরা আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যে প্রায় এক। তাঁরা অতুলনীয় গুণের আধার। বুদ্ধের ন্যায় বোধিসত্ত্বের সংখ্যাও অনেক। বুদ্ধত্ব অর্জনের সাধনায় তাঁরা নিবেদিত। নিম্নে বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পরিচয় তুলে ধরা হলো :
বুদ্ধ-পরিচিতি :
‘বোধি’ শব্দের অর্থ পরম জ্ঞান। বোধ শব্দ থেকেই বোধি শব্দের উদ্ভব। যিনি বোধি বা জ্ঞানে পরিপূর্ণতা লাভ করেন তিনিই হন বুদ্ধ। তাই ‘বুদ্ধ' শব্দের সরল অর্থ জ্ঞানী। তবে এই জ্ঞান সাধারণ বা শুধু জাগতিক জ্ঞান নয়। বহুবিধ বিষয়ের সমন্বিত জ্ঞান। বিশেষত চার আর্যসত্য অধিগত জ্ঞান । এই জ্ঞানকে পরমার্থ জ্ঞানও বলা যায়। জাতিস্মর জ্ঞান ও পরচিত্ত অবগতি জ্ঞান এর অধীন। জাতিস্মর জ্ঞান হলো পূর্ব জন্মবৃত্তান্ত স্মরণ করতে পারা এবং পরচিত্ত অবগতি হলো অন্যের মানসিক অবস্থা জানতে পারার বোধশক্তি । এরূপ জ্ঞানশক্তি অর্জন অত্যন্ত কঠিন। কঠোর ত্যাগ তিতিক্ষা ও গভীর একাগ্রতায় রাজপুত্র সিদ্ধার্থ গৌতম এ-জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাই তিনি জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হয়েছেন। 'বুদ্ধ' মানবোত্তম এক অভিধাবিশেষ। সর্ববিধ তৃষ্ণা বিনাশপূর্বক বিশুদ্ধ জ্ঞানসাধনায় পূর্ণতা সাধিত হলেই এই অভিধা অর্জিত হয় ।
সুতরাং বুদ্ধ শব্দের সাধারণ অর্থ জ্ঞানী হলেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ আরও গভীর। এজন্যই পৃথিবীর সব জ্ঞানী ব্যক্তি বুদ্ধ নন। বুদ্ধ রাগ, হিংসা ও লোভহীন এক মহোত্তম পুরুষ। বুদ্ধ নিজের এবং অন্যের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে বলতে পারতেন। কাকে, কখন এবং কীভাবে উপদেশ দেওয়া উচিত তিনি তা জানতেন। বুদ্ধত্ব জ্ঞান অনন্য ও অসাধারণ। এ-জ্ঞান অতুলনীয়। কর্মের মাধ্যমেই এর পরিচয় মেলে। তিনি অসীম জ্ঞানের অধিকারী, তাঁর জ্ঞানের পরিধিও অনন্ত। সাধারণ মানুষের সীমিত জ্ঞানের দ্বারা তা পরিমাপ করা যায় না ।
জগতে বুদ্ধের আবির্ভাব অত্যন্ত দুর্লভ। জন্মজন্মান্তরের একনিষ্ঠ সাধনায় বুদ্ধত্ব লাভ করা যায়। বুদ্ধত্বলাভের পথ সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু সকলের পক্ষে বুদ্ধত্ব লাভ করা সম্ভব হয় না। জগতে একজন বুদ্ধের অন্তর্ধানের বহুকাল পরে আর একজন বুদ্ধের আবির্ভাব হওয়ার কথা শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। নতুন বুদ্ধ আবির্ভূত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ববর্তী বুদ্ধের অনুশাসনই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অনুশীলন করে। যেমন এখন গৌতম বুদ্ধের অনুশাসন চলছে। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
বুদ্ধত্ব অর্জনের সাধনা একটি অঙ্গীকারাবদ্ধ পথপরিক্রমার মতো। এটিকে পারমী পূর্ণতার পরিক্রমাও বলা যায়। অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম জগতের এই তিন লক্ষণ যিনি সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে সমর্থ হন তিনিই বুদ্ধত্বলাভে অগ্রসর হন। তিনি চতুরার্য সত্য উপলব্ধি করে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গসাধনায় নিয়োজিত হন। এ ছাড়া বুদ্ধত্বলাভের জন্য পূরণ করতে হয় দশ পারমী। পারমী অর্থ পূর্ণতা। দশ পারমী হলো- দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, ক্ষান্তি, বীর্য, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী, উপেক্ষা ও প্রজ্ঞা। পারমী ও উপপারমী এবং পরমার্থ পারমী ভেদে এগুলো আবার ত্রিশ প্রকার। এসব বিষয়ে পূর্ণতা লাভ করা সহজসাধ্য নয়। সকল পারমী পূরণের জন্য প্রয়োজন জন্মজন্মান্তরের অসংখ্য কুশল কর্মের প্রভাব। এই প্রভাব বা পুণ্যফল অর্জনের জন্য তাঁকে অসংখ্যবার জন্ম নিতে হয়। শুধু মানবকূলে নয়, অন্যান্য প্রাণী হিসেবেও তাঁকে জন্মগ্রহণ করতে হতে পারে। সেই অসংখ্য জন্মে তাঁকে কুশলকর্ম সম্পাদন করে পারমীপূর্ণ ও পুণ্য সঞ্চয় করতে হয়। এভাবে বিবিধ জন্মে পারমী পূরণ করে অতীতে বহু বুদ্ধ পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হবেন ।
বোধিসত্ত্ব-পরিচিতি :
‘বোধিসত্ত্ব’বলতে দুঃখমুক্তির পথ অন্বেষণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সত্ত্বকে বোঝানো হয়। বোধি ও সত্ত্ব দুটি শব্দের সমন্বয়ে ‘বোধিসত্ত্ব' শব্দটি গঠিত। এখানে 'বোধি' অর্থ হলো জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। আর সত্ত্ব হলো সেইজন, যিনি জ্ঞান বা প্রজ্ঞা-সাধনায় নিয়োজিত। তিনি জ্ঞান অর্জনের পথে বা দুঃখমুক্তির পথ অন্বেষণে নিজেকে উৎসর্গ করতে সমর্থ হয়েছেন। এ মহৎ লক্ষ্য অর্জনে তিনি সর্বদা প্রচেষ্টা করেন। তাই সরল অর্থে বোধিসত্ত্ব হলো বুদ্ধত্বলাভে অনুপ্রাণিত প্রজ্ঞাবান সত্ত্ব বা বোধি'র লালনকারী সত্ত্বই বোধিসত্ত্ব ।
বোধিসত্ত্ব চেতনার উৎসাহ জাগ্রত হয় সাধনকারীর স্বতঃস্ফূর্ত অভিপ্রায় থেকে। কিন্তু আচরণ রীতি হয় অঙ্গীকারাবদ্ধ । এটি আবেগ ও কৌতূহলের বিষয় নয়। চিন্তাশীল সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সচেতনভাবে অনুশীলনের বিষয়। বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন মতে বহু জন্মের সুকৃতির ফল না থাকলে বোধিসত্ত্ব চেতনা জাগ্রত হয় না। বোধিসত্ত্ব সাধনার পূর্ণতা অর্জিত হয় বুদ্ধত্ব লাভের মাধ্যমে। তাই বোধিসত্ত্বকে বলা হয় বুদ্ধাঙ্কুর। এরূপ চেতনা অত্যন্ত বিরল ও দুর্লভ।
অনুশীলনমূলক কাজ বুদ্ধ জ্ঞান কীরূপ? বোধিসত্ত্ব শব্দের অর্থ কী? |
পাঠ : ২
বুদ্ধের গুণাবলি
বুদ্ধের গুণ অসীম । এই বিশাল গুণ রাশি একসাথে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। এগুলোকে শ্রেণিভিত্তিক বিভাজন
করলে নয়টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। সে হিসেবে বলা যায় বুদ্ধের গুণ নয়টি । এই নয়টি গুণ হলো নিম্নরূপ :
১. তিনি অর্থৎ : সর্ববিধ অরি বা শত্রুশূন্য মুক্ত মহাপুরুষ।
২. তিনি সম্যকসম্বুদ্ধ : সর্ব বিষয়ে সম্যক জ্ঞানসম্পন্ন।
৩. তিনি বিদ্যা ও আচরণসম্পন্ন : অনুশীলনীয়তত্ত্ব ও উপযুক্ত আচরণ জ্ঞানসম্পন্ন ।
৪. তিনি সুগত : নির্বাণরূপ সুস্থানে সুন্দরভাবে পৌঁছেছেন ।
৫. তিনি লোকবিধ : ত্রিলোক সম্পর্কে সম্যকজ্ঞানসম্পন্ন ।
৬. তিনি অনুত্তর : শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাগুণের সর্বোচ্চস্থানের অধিকারী।
৭. তিনি পুরিসদম্ম সারথি : সর্ববিধ অশুভ শক্তির দমনকারী।
৮. তিনি সখা দেবমনুস্সানং : দেব ও মনুষ্যগণের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক।
৯. তিনি বুদ্ধোভগবা : সর্ববিধ জ্ঞানের পূর্ণতায় তিনি বুদ্ধ, সেই সমুদয় শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের আধার বলে
তিনি ভগবান ।
বুদ্ধের এই গুণসমূহ অর্জন সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি এই গুণরাশির গুরুত্ব উপলব্ধি করাও কঠিন। বুদ্ধ গুণাবলির যে-কোনো একটি গুণ যাঁর পক্ষে অর্জন সম্ভব, কেবল তিনিই এই গুণের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সমর্থ হন। এজন্যেই বলা হয় বুদ্ধগুণ অচিন্তনীয়।
উপরে বর্ণিত নয়টি গুণের প্রত্যেকটি স্তর বহুবিধ বিষয়ে সমন্বিত ও সমৃদ্ধ। যেমন- অর্থৎ বা সর্ববিধ শত্ৰুশূন্য বলতে আট পর্যায়ের সমাধিচর্যায় উত্তীর্ণ হওয়াকে বোঝায়। রাগ, দ্বেষ, মোহ ও তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে এগুলো ক্রমান্বয়ে অনুশীলন করতে হয়। এই ক্রমিক সাধনরীতির প্রতিটি পর্যায়ের অর্জিত সুফলকেও সচেতনতার সাথে সুরক্ষা করতে হয়। সাধনচর্যা ও চর্যায় উন্নীত চিত্তাবস্থাকে স্থিত রাখতে পারলেই পরবর্তী পর্যায়ের অনুশীলন করা যায়। এভাবে দীর্ঘদিনের সাধনায় এক-একটি স্তর অতিক্রম সম্ভব হয়। বৌদ্ধ সাহিত্যে এগুলোকে মার্গ ও ফললাভের সাধনা বলা হয়। এগুলো হলো : ১) শ্রোতাপত্তি-মার্গ ২) শ্রোতাপত্তি—ফল ৩) সকৃতাগামী-মার্গ ৪) সকৃতাগামী ফল ৫) অনাগামী-মার্গ ৬) অনাগামী-ফল ৭)অর্হৎ -মার্গ ৮)অর্হত্ব-ফল। সুতরাং অর্থৎ বলতে আট স্তরের উচ্চতর সাধন প্রক্রিয়ার পূর্ণতাকে বোঝায় । যিনি এ স্তরে উন্নীত হন, তিনি সর্বজয়ী সাধক।
সম্যক সম্বুদ্ধ বলতে স্ব-উদ্যোগে আর্যসত্যকে সম্যকভাবে স্বয়ং জ্ঞাত হওয়াকে বোঝায়। এজন্য তাঁকে তিন স্তরের জ্ঞান-মহিমায় সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হয়েছে। এগুলো হলো : ১) যা জানা অপরিহার্য তা তিনি জেনেছেন, যেমন আর্যসত্য জ্ঞান ; ২) যা চিন্তা করার যোগ্য তা তিনি চিন্তা করেছেন, সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল কর্ম সম্পাদন করে স্বয়ং জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং ৩) যা ত্যাগ করার যোগ্য তা তিনি সযত্নে ত্যাগ করেছেন। এভাবে তিনি তৃষ্ণাহীন বিশুদ্ধ মহাপুরুষ হয়েছেন। অনুরূপভাবে বুদ্ধগুণের প্রত্যেক স্তর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তাই বলা হয় বুদ্ধগুণ অবর্ণনীয়, অচিন্তনীয় ।
অনুশীলনমূলক কাজ বুদ্ধের নয়টি গুণ কী কী? মার্গ ও ফললাভের সাধনার স্তরগুলোর নাম লেখ |
পাঠ : ৩
বুদ্ধের প্রকারভেদ
বৌদ্ধধর্ম গ্রন্থে তিন প্রকার বুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। যথা :
১. সম্মাসম্বুদ্ধ বা সম্যকসম্বুদ্ধ।
২. পচ্চেকবুদ্ধ বা প্ৰত্যেকবুদ্ধ ।
৩. সাবকবুদ্ধ বা শ্রাবকৰুদ্ধ ।
নিচে এই তিন প্রকৃতির বুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো ।
সম্যক সম্বুদ্ধ
বুদ্ধগণের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সম্যকসম্বুদ্ধ । সম্যকসম্বুদ্ধ বলতে বোঝায়, যিনি কোনো গুরুর সাহায্য ছাড়া স্বীয় আদর্শ ও কর্মের দ্বারা নিরলস প্রচেষ্টায় বুদ্ধত্বলাভ করেছেন। তিনি সর্বোত্তম জ্ঞানের অধিকারী। সম্যকসম্বুদ্ধগণ জন্ম-জন্মান্তরের সাধনায় দশ পারমী পূর্ণ করেন। তিনি শেষজন্মে মানবকুলে উপযুক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বের অনন্ত জন্মের সুকর্মের প্রভাবে এই জন্মে তিনি অর্হত্ব ফল বা সর্বজ্ঞতা অর্জন করে বুদ্ধ হন ।
সম্যকসম্বুদ্ধগণ শুধু নিজের জন্য বুদ্ধ হন না। তাঁরা জগতের সর্বসত্তার পরম মুক্তির দ্বার উন্মোচনের ব্রত নিয়েই বুদ্ধ হন । এজন্যে সকল জীবের কল্যাণে তাঁরা দুঃখমুক্তির পথ ও নির্বাণলাভের উপায় প্রচার করেন।
বৌদ্ধমতে, জগতে সম্যকসম্বুদ্ধের আবির্ভাব অতীব দুর্লভ। একই সময়ে পৃথিবীতে দুজন সম্যকসম্বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে না। একজন সম্যকসম্বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভ করার হাজার হাজার বছর পর অন্য এক সম্যকসম্বুদ্ধের আবির্ভাব হয়। সে অনুযায়ী পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আটাশজন সম্যকসম্বুদ্ধের আবির্ভাবের কথা জানা যায়।
‘বুদ্ধবংস' নামক গ্রন্থ পাঠে আটাশজন বুদ্ধের কথা জানা যায়। এ গ্রন্থের বিবরণ অনুযায়ী গৌতম বুদ্ধই হলেন সর্বশেষ সম্যকসম্বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আড়াই হাজার বছরেরও আগে থেকে গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত ধর্মপালন করে আসছেন। তাঁরই প্রতিমূর্তি অথবা ছবি সামনে রেখে বৌদ্ধেরা উপাসনা করেন। কারণ সর্বশেষ সম্যকসম্বুদ্ধরূপে তিনি মানুষের দুঃখমুক্তি ও তৃষ্ণাক্ষয়ের পথ প্রদর্শন করেছেন, নির্বাণ লাভের উপায় নির্দেশ করে গেছেন। তিনি ভবিষ্যত বাণী করেছেন, আর্য মৈত্রের নামে আর একজন সম্যকসম্বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হবেন। এভাবে সময়ের স্রোতে দশ পারমী পূর্ণ করে অনন্তকালের ব্যবধানে একেক জন বুদ্ধের আবির্ভাব হয় ।
প্রত্যেকবুদ্ধ
প্রত্যেকবুদ্ধ হলো আত্মমুক্তির সাধনায় পূর্ণতা অর্জনকারী বিমুক্ত মহাপুরুষ। তাঁরা সম্যক সম্বুদ্ধের দেশিত সাধনপ্রণালি অনুশীলন করে সর্ব তৃষ্ণা ক্ষয় করেন। এভাবে স্বীয় সাধনাবলে অর্হত্ব ফল লাভ করে তাঁরা বুদ্ধ হন। প্রত্যেকবুদ্ধগণ জীবনাবসানে নির্বাণ লাভ করে পুনর্জন্ম রোধ করেন। প্রত্যেকবুদ্ধগণের সাধনালব্ধ জ্ঞান কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁরা অন্যদের নিকট মুক্তির পথ উন্মোচন করেন না ।
প্রত্যেকবুদ্ধগণ মূলত সম্যকসম্বুদ্ধের অনুগামী বুদ্ধ। অর্হত্ব ফললাভী এবং নির্বাণগামী এরূপ অসংখ্য প্রত্যেকবুদ্ধ পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। এজন্য বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন জগৎ অহৎ বা বুদ্ধশূন্য নয়। সম্যক সম্বুদ্ধগণের মতো প্রত্যেকবুদ্ধগণ সরব নয়। তাঁরা নীরবে নিভৃতে সাধনা করে থাকেন।
শ্রাবকবুদ্ধ
শ্রাবকবুদ্ধ হলো সম্যকসম্বুদ্ধের অনুশাসন অনুশীলনে পারঙ্গম পুণ্যপুরুষ । একজন সম্যকসম্বুদ্ধের অনেক শিষ্য থাকেন। এই শিষ্যদেরও অনেক শিষ্য থাকেন। এসব শিষ্য ও প্রশিষ্যগণ সম্যকসম্বুদ্ধের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে মুক্তি সাধনায় রত থাকেন। এঁদের মধ্যে অনেকে অর্হত্ব ফল লাভ করেন । তাঁরা আর জন্মগ্রহণ করে দুঃখভোগ করবেন না। তাঁরা নির্বাণগামী । এরূপ বিমুক্ত পুরুষকে বলা হয় শ্রাবকবুদ্ধ ।
সম্যকসম্বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন অনুশীলনের শীর্ষে অবস্থান করেন শ্রাবকবুদ্ধগণ। প্রত্যেক সম্যকসম্বুদ্ধের অনুসারীদের মধ্যে শ্রাবকবুদ্ধ থাকেন। গৌতম বুদ্ধের অনেক শিষ্য শ্রাবকবুদ্ধ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রশ্রাবক সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়ন, মহাকশ্যপ, বিনয়ধর উপালি, ধর্মভাণ্ডারিক আনন্দ, লাভীশ্রেষ্ঠ সীবলী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বুদ্ধের সময় অনেক শ্রাবকবুদ্ধ ছিলেন। তাঁরা জীবজগতের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন এবং অন্যদের নির্বাণলাভে সহায়তা করেন।
অনুশীলনমূলক কাজ তিন প্রকার বুদ্ধের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ কোনটির অন্তর্গত? প্রত্যেকবুদ্ধের গুণাবলি বর্ণনা কর কয়েকজন শ্রাবকবুদ্ধের নাম বল |
পাঠ : ৪
বোধিসত্ত্বের গুণাবলি
বোধিসত্ত্বের পরম গুণ হলো দশ পারমীর পূর্ণতা সাধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া। এটি বোধিসত্ত্বের অনুশীলনীয় মুখ্য বিষয়। এই পারমীসমূহ চর্চার ফলে বোধিসত্ত্বের জীবনাচরণে স্বাভাবিকভাবে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়, যা অন্য মানুষদের থেকে বোধিসত্ত্বকে অনন্য ও অসাধারণ করে তোলে। এই অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহই হলো বোধিসত্ত্বের গুণ।
বোধিসত্ত্বগুণ হঠাৎ সৃষ্টি হয় না। গুণগুলো বোধিসত্ত্ব সাধনার ক্রমধারায় ধাপে ধাপে অর্জিত হয় । যেমন বোধিসত্ত্ব চেতনা সকলের অন্তরে বিরাজমান হলেও সকলেই বোধিসত্ত্ব পদবাচ্য নয়। যিনি বুদ্ধত্বলাভে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে পারমী পূর্ণতার সাধনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন, তিনিই প্রকৃত অর্থে বোধিসত্ত্ব। পারমী পূর্ণতার অভিপ্রায়ে যে-চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী হওয়া যায় সেগুলোই হলো বোধিসত্ত্বের গুণ ।
বোধিসত্ত্বব্ৰত অনুশীলন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। জন্ম-জন্মান্তরে এটি অনুশীলন করতে হয়। বোধিসত্ত্ব জীবনলাভের জন্য কিছু গুণ অর্জন করতে হয়। এগুলো এক জন্মের সাধনায় অর্জন করা যায় না । এর জন্য জন্ম-জন্মান্তরের অব্যাহত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এরূপ নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমেই বোধিসত্ত্ব গুণের অধিকারী হতে হয়। বোধিসত্ত্ব গুণ নিম্নরূপ :
১. সর্ব বিষয় অনিত্য –এ ধারণাকে বোধিসত্ত্ব জীবনাচারের সর্বোচ্চ সত্য হিসেবে গ্রহণ করেন ।
২. তথাগত বুদ্ধের দর্শনকেই বোধিসত্ত্বরা একমাত্র পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে সর্বসত্তার কল্যাণকামী হন ।
৩. স্বকৃত কর্মকেই জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গী হিসেবে বোধিসত্ত্বরা গ্রহণ করেন। তাই নিঃস্বার্থ, নির্মোহ কর্ম অনুশীলনই বোধিসত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
8. বোধিসত্ত্বের একমাত্র লক্ষ্য বুদ্ধত্বলাভ । নাম, যশ, খ্যাতি নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেন না ।
৫. বোধিসত্ত্বগণ জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু সত্যসাধনা হতে বিচ্যুত হন না ।
৬. বোধিসত্ত্বগণ সত্য, ন্যায় ও ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনে বদ্ধপরিকর হন।
৭. বোধিসত্ত্বগণ সর্বদা সর্বসত্তার কল্যাণ কামনা করেন। তাঁদের কাছে আপন-পর ভেদাভেদ নেই ।
৮. বোধিসত্ত্বগণ মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার সর্বোত্তম অনুশীলনকারী হন ।
৯. বোধিসত্ত্বগণ দশ পারমী অনুশীলনে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
১০. বোধিসত্ত্বব্রত একটি স্বতঃস্ফূর্ত সাধনা, বোধিসত্ত্বগণ আপন চেতনা বলে বলীয়ান হয়ে স্বচিত্তকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন।
উপরে বোধিসত্ত্বের শুধুমাত্র উল্লেখযোগ্য ও বিরল গুণসমূহ তুলে ধরা হয়েছে।
অনুশীলনমূলক কাজ কী কী গুণ থাকলে আমরা বোধিসত্ত্বকে চিনতে পারি – উল্লেখ কর |
পাঠ : ৫
বোধিসত্ত্বের প্রকারভেদ
বোধিসত্ত্ব সাধনা অত্যন্ত দুষ্কর। কঠোর তপস্যা ও চরম আত্মত্যাগের দৃঢ় চেতনায় প্রত্যয়াবদ্ধ হয়েই এ- সাধনা করতে হয়। মানুষ সহজে বোধিসত্ত্বব্রত অনুশীলন করতে পারে না। কারণ মানুষের সহজাত স্বার্থচিন্তা মানুষকে সহজ প্রাপ্তির দিকে ধাবিত করে। পরম মুক্তির কথা মানুষ ভাবতে পারে না। বৌদ্ধধর্ম মতে বোধিসত্ত্ব তিন প্রকার। যথা :
ক) শ্রাবকবোধিসত্ত্ব
খ) প্রত্যেকবোধিসত্ত্ব
গ) সম্যকসম্বোধিসত্ত্ব
ক) শ্রাবকবোধিসত্ত্ব : এখানে শ্রাবক অর্থে শ্রবণকারী, শ্রোতা, শিষ্য বা শ্রদ্ধানুরাগে অনুপ্রাণিত হয়ে বোধিজ্ঞান লাভকারীকে বোঝানো হয়। এরূপ বোধিসত্ত্বের সাধনা ইচ্ছা, শ্রবণ বা দর্শন থেকে জাগ্রত হলেও আবেগতাড়িত নয় বরং স্থির সিদ্ধান্তপ্রসূত। গৌতম বুদ্ধের শিষ্য প্রশিষ্যগণ যাঁরা এরূপ জ্ঞান মার্গের সাধনাব্রতে রত ছিলেন তাঁদের শ্রাবকবোধিসত্ত্ব বলা হয় । সাধনমার্গের পূর্ণতায় শ্রাবকবোধিসত্ত্বগণ শ্রাবক বুদ্ধে উন্নীত হন। শ্রাবকবোধিসত্ত্ব সারিপুত্র, মোল্যায়ন প্রমুখ বুদ্ধের সময়ে শ্রাবকবুদ্ধ হন ।
খ) প্রত্যেকবোধিসত্ত্ব : স্ব-উদ্যোগে ও স্বাধীনভাবে কোনো গুরুর অধীন না হয়ে বুদ্ধ প্রদর্শিত পথে বোধিজ্ঞান লাভের সাধনায় নিয়োজিত সাধককে প্রত্যেকবোধিসত্ত্ব বলে। প্রত্যেকবোধিসত্ত্বগণ বোধিজ্ঞানের সর্বাঙ্গীণ গুণে গুণান্বিত হলেও তাঁরা নিজ গুণ প্রভায় অন্যকে প্রভাবান্বিত করতে পারেন না। বুদ্ধের অনেক শিষ্যই এই স্তরের ছিলেন।
গ) সম্যকসম্বোধিসত্ত্ব : বোধিসত্ত্ব সাধনার সর্বোত্তম প্রক্রিয়া এটি। সর্বসত্তার কল্যাব্রত নিয়ে বোধিচিত্ত সাধনার অনুসরণকারীকে সম্যকসম্বোধিসত্ত্ব বলে। তাঁরা সাধনার পূর্ণতায় সম্যক সম্বুদ্ধ হন । যেমন গৌতম বুদ্ধ একজন সম্যকসম্বুদ্ধ। সম্যক সম্বোধিসত্ত্বগণ সর্বজীবের মুক্তির মাধ্যমেই নিজের মুক্তি প্রত্যাশা করেন। এভাবেই তাঁরা পারমী অনুশীলন করেন।
আবার সাধনা ব্রতের উৎস বিচারেও বোধিসত্ত্বকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। কোন প্রেক্ষিতে কীভাবে বোধিচিত্ত বা বোধিসত্ত্ব সাধনার উৎসাহ জাগ্রত হলো সে উৎসের ভিত্তিতে বোধিসত্ত্বকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১. প্রজ্ঞাধিক বোধিসত্ত্ব
২. শ্রদ্ধাধিক বোধিসত্ত্ব ৩. বীর্যাধিক বোধিসত্ত্ব
১. প্রজ্ঞাধিক বোধিসত্ত্ব - যে বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য অর্জনে প্রজ্ঞা সাধনাকে সর্বাগ্রে স্থান দেয় তাঁকে প্রজ্ঞাধিক বোধিসত্ত্ব বলে । এ-স্তরের বোধিসত্ত্বগণ প্রজ্ঞা পারমী'র অনুশীলনের মাধ্যমে স্বীয় চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে এনে ক্রমে অন্য পারমীর পূর্ণতাসাধন করেন ।
এরূপ বোধিসত্ত্বগণ সর্বক্ষেত্রে বিশ্লেষণধর্মী হন। তাঁরা প্রজ্ঞার আলোকে প্রত্যেকটি বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করেন।
অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে তাঁরা স্বীয় পথ পরিক্রমায় অগ্রসর হন । ২. শ্রদ্ধাধিক বোধিসত্ত্ব – যে-বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য অর্জনে শ্রদ্ধাকেই সর্বাগ্রে স্থান দেন তাঁকে শ্রদ্ধাধিক বোধিসত্ত্ব বলে। এ স্তরের বোধিসত্ত্বগণ শ্রদ্ধার সঙ্গে ক্রমান্বয়ে সকল পারমী পূর্ণ করেন।
শ্রদ্ধাধিক বোধিসত্ত্বগণ নিবেদিত প্রাণ সাধক হন। তাঁরা শ্রদ্ধা চিত্তে একবার যে আদর্শকে গ্রহণ করেন
আমৃত্যু সে-ব্রত পূরণে প্রত্যয়াবদ্ধ থাকেন ।
৩. বীর্যাধিক বোধিসত্ত্ব – যে বোধিসত্ত্ব লক্ষ্য অর্জনে কর্ম প্রচেষ্টাকেই সর্বাগ্রে স্থান দেন তাঁকে বীৰ্যাধিক বোধিসত্ত্ব বলে । এ-স্তরের বোধিসত্ত্বগণ বীর্য পারমী'র অনুশীলনের মাধ্যমে স্বীয় চিত্তকে নিয়ন্ত্রণে এনে ক্রমে অন্য পারমীর পূর্ণতা সাধন করেন ।
বীর্যাধিক বোধিসত্ত্বগণ কঠিন সাধনা ব্রতের অনুরাগী হন। তাঁরা কঠোর সাধনায় নিয়োজিত থাকেন। বীর্য
পারমীর বলে মহীয়ান হয়ে তাঁরা সাধনায় অটল থাকেন ।
অনুশীলনমূলক কাজ শ্রাবক বোধিসত্ত্বের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর প্রজ্ঞাধিক বোধিসত্ত্ব বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? |
পাঠ : ৬ বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের পার্থক্য
যিনি বোধিজ্ঞান লাভের জন্য সাধনা করেন তাঁকে বোধিসত্ত্ব বলে। বোধিসত্ত্ব বুদ্ধ নন। তাঁদের ভাবী বুদ্ধ বা বুদ্ধাঙ্কুর বলা হয়। ভবিষ্যতে কোনো এক জন্মে তিনি বুদ্ধ হবেন। বুদ্ধ হওয়ার জন্য তাঁকে বিভিন্ন কুলে অসংখ্যবার জন্ম নিতে হয় এবং দশ উপপারমী, দশ পারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পূর্ণ করতে হয় । অর্থাৎ জন্ম-জন্মান্তরের কর্মের ধারাবাহিকতায় দশ পারমীর প্রত্যেকটি ত্রি-পর্যায়ে অনুশীলন করে আত্ম শুদ্ধির সাধনায় পরিপূর্ণতা অর্জন করতে হয়। নিজেকে সকল আসক্তি থেকে বিমুক্ত করাই বোধিসত্ত্বের প্রধান লক্ষ্য ।
গৌতম বুদ্ধ বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে অসংখ্য জন্ম পরিগ্রহ করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ পাঠে একথা জানা যায়। এসব জন্মে বিভিন্ন নামে তাঁকে আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর প্রধান পরিচয় হলো বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্বরূপে এক জন্মে তিনি পূর্ববর্তী বুদ্ধ দীপঙ্করের কাছ থেকে আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছিলেন। দীপঙ্কর সম্যকসম্বুদ্ধ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন লক্ষকল্প বছর আগে। সেসময় গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব জীবন সাধনায় রত ছিলেন। তিনি তখন বোধিসত্ত্ব সুমেধ তাপস নামে অমরাবতী নগরে বাস করতেন। দীপঙ্কর বুদ্ধ সশিষ্য এ অমরাবতী নগরে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন ।
অমরাবতী নগর ধনধান্যে পরিপূর্ণ হলেও এর যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তখন ছিল বর্ষাকাল। বৃষ্টিতে পথঘাট কর্দমাক্ত ছিল। নগরবাসীগণ বুদ্ধের যাতায়াতের জন্য রাস্তা মেরামতে ব্যস্ত ছিলেন। সুমেধ তাপসও সবার সাথে একাজে অংশ নিলেন। এদিকে বুদ্ধের আগমনের সময় হলো। কিন্তু রাস্তার কাজ তখনও সম্পূর্ণ শেষ হয়নি। এদিকে দীপঙ্কর বুদ্ধ শিষ্যদের নিয়ে সেই অসমাপ্ত রাস্তার কাছে এসে পড়েছেন। আর মাত্র কয়েক হাত রাস্তার কাজ বাকি। নগরবাসীগণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। সুমেধ তাপস দেখলেন আর কোনো উপায় নেই । তিনি হাতের কোদাল ফেলে পরম শ্রদ্ধাভরে সেই কাদাভরা রাস্তার ওপর শুয়ে পড়লেন । অত্যন্ত বিনীতভাবে তিনি দীপঙ্কর বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন তাঁর শায়িত দেহের ওপর দিয়ে যাওয়ার জন্য। দীপঙ্কর বুদ্ধ তাঁর মানসচেতনা উপলব্ধি করলেন। সুমেধ তাপসের মধ্যে তিনি অভীষ্ট সিদ্ধির সম্ভাবনা দেখতে পেলেন। অতঃপর দীপঙ্কর বুদ্ধ তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলেন। রাস্তা পার হওয়ার জন্য তিনি সুমেধ তাপসের গায়ের ওপর পা রাখলেন। ঠিক সে সময় সুমেধ তাপস দীপঙ্কর বুদ্ধের কাছে সশ্রদ্ধ চিত্তে ভবিষ্যতে সম্যকসম্বুদ্ধ হওয়ার প্রত্যাশা পূরণের আশীর্বাদ কামনা করেন। দীপঙ্কর বুদ্ধ সুমেধ তাপসের মধ্যে ভাবী বুদ্ধের সব লক্ষণ দেখতে পেলেন। তখন তিনি সুমেধ তাপসের প্রার্থনা পূরণের জন্য আশীর্বাদ করেন। তাঁর আশীর্বাদ সুমেধ তাপসের বোধিসত্ত্ব জীবনের সাধনাকে অনেক বেগবান করে। জন্ম-জন্মান্তরের সাধনায় তিনি সকল পারমী পূর্ণ করতে সমর্থ হন। এ-সুকৃতির ফলে শেষ জন্মে তিনি রাজা শুদ্ধোদনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। এ-সময় তাঁর নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ। উপযুক্ত সময়ে সিদ্ধার্থ সংসার ত্যাগ করে একাগ্র সাধনায় বুদ্ধত্ব লাভ করেন এবং ‘বুদ্ধ' নামে খ্যাত হন ।
বুদ্ধ সিদ্ধার্থরূপে জন্মগ্রহণের আগে অসংখ্য জন্ম বোধিসত্ত্ব সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। তাঁর বোধিসত্ত্ব জীবনের সাধনার কথা জাতক সাহিত্যে বর্ণিত আছে। জাতকের বর্ণনামতে গৌতম বুদ্ধ ৫৫০ বার বোধিসত্ত্বরূপে জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন জাতকের কাহিনীতে তিনি দান, ধর্ম ও সেবা ইত্যাদি সৎকাজ দ্বারা পারমী পূর্ণ করেন বলে উল্লেখ আছে। এই পারমী পূরণের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তিনি মানুষ, পশু-পাখিসহ নানা জাতিতে জন্ম নিয়েছিলেন । মহাসুদর্শন জাতকে দেখা যায়, বোধিসত্ত্ব কুশাবতী নগরে মহাসুদৰ্শন নামে এক রাজা হয়ে জন্মেছিলেন। বানরিন্দ্র জাতকে বানররূপে জন্মেছিলেন। মখাদেব জাতকে রাজা মখাদেবরূপে এবং মহাজনক জাতকে রাজা মহাজনকরূপে জন্মেছিলেন । এছাড়া বোধিসত্ত্ব চণ্ডাল, শুভ্র, ক্ষত্রিয়, ময়ূর, কপোত, হাতি, ইত্যাদি নানা কুলেও জন্ম নিয়েছিলেন। এ-জন্মসমূহের একমাত্র লক্ষ্য ছিল পারমী পূরণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করা। এ-আলোচনা বোঝা যায়, বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু পার্থক্য নিম্নে দেওয়া হলো :
বুদ্ধ
১. বুদ্ধ সম্যক জ্ঞানে ও গুণে পূর্ণতা বিষয়ক অভিধা - বা উপাধি ।
২. দশ পারমীর সাধনা পূর্ণ করেই বুদ্ধত্ব অর্জিত হয়। বুদ্ধগণ সর্ব তৃষ্ণামুক্ত বলে পরিনির্বাণ লাভ করেন ।
৩. বুদ্ধগণ বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্যকভাবে জ্ঞাত থাকেন। তাই তাঁদেরকে ত্রিকালদর্শী বলে ।
৪. বুদ্ধগণ সর্বজ্ঞ। তাঁরা সকল পার্থিব ও লোকোত্তর বিষয় সম্পর্কে জানেন। মানুষসহ সকল জীবের ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন ।
৫. বুদ্ধগণ স্থিত চিত্তের অধিকারী। লোভ, দ্বেষ, মোহ, নিন্দা, প্রশংসা ইত্যাদির অনেক ঊর্ধ্বে তাঁদের অবস্থান। তাঁরা বিমুক্ত মহাপুরুষ ।
৬. বুদ্ধগণ ভবিষ্যৎ বুদ্ধের আগমন সম্পর্কে আভাস দিতে পারেন ।
৭. বুদ্ধগণ আত্মস্থ ধর্ম দর্শন প্রচার করেন।
বোধিসত্ত্ব
১. বোধিসত্ত্ব — সম্যক জ্ঞান চর্চাকারীর অভিধা বা উপাধি ।
২. অনন্ত জন্মের কর্মপ্রচেষ্টায় বোধিসত্ত্বগণের পারমী চর্যা গতিশীল হয়। বোধিসত্ত্ব অবস্থায় কারো পক্ষে নির্বাণলাভ সম্ভব নয় ।
৩. বোধিসত্ত্বগণ ত্রিকালদর্শী নন। তাঁরা বর্তমান জন্মে সচেতনভাবে কুশলকর্ম সম্পাদনে বেশি তৎপর থাকেন।
৪. বোধিসত্ত্বগণ সর্বজ্ঞ জ্ঞানলাভের চর্চাকারী। জীবের ইহকাল ও পরকাল তাঁদের অজ্ঞাত। এ-ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব।
৫. বোধিসত্ত্বগণের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটতে পারে। বুদ্ধদের মতো তাঁরা বিমুক্ত মহাপুরুষ নন। ভবিষ্যতে বুদ্ধ হওয়াই তাঁদের সাধনার প্রধান লক্ষ্য ।
৬. বোধিসত্ত্বগণের পক্ষে ভবিষ্যৎ বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
৭. বোধিসত্ত্বগণ নিজে কোনো দর্শন প্রচার করেন না। তাঁরা সর্বদা বুদ্ধের প্রচারিতধর্ম দর্শনের অনুসারী।
অনুশীলনী
শূন্যস্থান পূরণ কর
১. ‘বুদ্ধ' শব্দের সরল অর্থ------
2. দশ পারমীর সাধনা পূর্ণ করেই------ অর্জিত হয়।
৩. যিনি বোধিজ্ঞান লাভের জন্য সাধনা করেন ------ বলে ।
৪. বোধিসত্ত্বগণ------ পারমী অনুশীলনে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
৫. জাতকের বর্ণনা মতে গৌতম বুদ্ধ------ বার বোধিসত্ত্বরূপে জন্মগ্রহণ করেন।
৬. বোধিসত্ত্ব অবস্থায় কারো পক্ষে ---- লাভ সম্ভব নয়।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
বুদ্ধ কত প্রকার ও কী কী?
২. বোধিসত্ত্ব কত প্রকার ও কী কী?
৩. বুদ্ধ গুণ কেন অচিন্তনীয়?
৪. বোধিসত্ত্ব জীবনের কাহিনী কোথায় বর্ণিত আছে ?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. বুদ্ধত্বলাভের প্রক্রিয়া বর্ণনা কর ।
২. বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর।
৩. বুদ্ধ গুণের গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর ।
8. সুমেধ তাপস কে? তিনি কীভাবে বুদ্ধ হয়েছিলেন লেখ ।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। 'বোধি' শব্দের অর্থ কী ?
ক. পরমজ্ঞান
গ. সাধারণ জ্ঞান
খ. জাতিস্মর জ্ঞান
ঘ. ব্রহ্মজ্ঞান
সম্যক সম্বুদ্ধকে সর্বোত্তম বুদ্ধ বলার প্রধান কারণ কোনটি ?
ক. একাধিক শিষ্য থাকা
খ. আত্মমুক্তি সাধনায় পূর্ণতা অর্জন
গ. দুঃখমুক্তি ও তৃষ্ণাক্ষয়ের পথপ্রদর্শন
ঘ. গুরুর শরণাপন্ন না হওয়ার জন্য
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও
বেস্সান্তর রাজা সর্বজীবের প্রতি দয়ালু ছিলেন। তিনি কারো দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। সর্বজীবকে মুক্ত করার মানসে তিনি দান পারমী পূর্ণ করতে গিয়ে সমস্ত সম্পদ দান করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেন।
৩। বেস্সান্তর রাজাকে কোন ধরনের বোধিসত্ত্ব বলা হয় ?
ক. প্রত্যেকবোধিসত্ত্ব
খ. সম্যকসম্বোধিসত্ত্ব
গ. শ্রাবকবোধিসত্ত্ব
ঘ. শ্রদ্ধাধিকবোধিসত্ত্ব
81 সর্বজীবকে মুক্ত করার মানসে বেস্সান্তর রাজা বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব যে-জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন -
i. আর্যসত্য জ্ঞান
ii. সম্যক জ্ঞান
iii. সর্বজ্ঞ জ্ঞান
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১। বিজয় বড়ুয়া ত্রিরত্নের সেবক ছিলেন। তিনি সর্বদা কুশলকর্মে রত থাকতেন। ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা খুব শ্রদ্ধার সাথে শ্রবণ করতেন । তিনি জানতে পারলেন, মার্গলাভী এক ভিক্ষু গভীর জঙ্গলে ধ্যান করতে যাচ্ছেন। তা শুনে ভিক্ষু পৌঁছার আগে তিনি সেখানে গিয়ে অনেক কষ্টে জঙ্গল পরিষ্কার করে সুন্দর একটি আসনের ব্যবস্থা করেন এবং বহুদূরে লোকালয়ে গিয়ে পিণ্ডাচরণের সুযোগ করে দিলেন।
ক. জাতিস্মর জ্ঞান কী ?
খ. বোধিসত্ত্ব সাধনা অত্যন্ত দুষ্কর কেন সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর ।
গ. বিজয় বড়ুয়ার সাথে কোন সাধকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায় – ব্যাখ্যা কর। ঘ. “বিজয় বড়ুয়া যে-কোনো এক জন্মে শ্রাবক বুদ্ধ হওয়ার যোগ্য” – একথাটির সাথে তুমি কী একমত? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দাও।
২.
ক. জগতে কার আবির্ভাব অত্যন্ত দুর্লভ ?
খ. বুদ্ধগুণ অচিন্তনীয় কেন ? সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর ।
গ. ছক ১-এ কাদের বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করছে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. ছক ২ ও ৩-এ যাঁদেরকে নির্দেশ করছে তাঁদের কর্মকাণ্ডের তুলনামূলক পার্থক্য বিশ্লেষণ কর।
আরও দেখুন...