মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - জাতীয় চেতনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় | NCTB BOOK

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন:

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের শক্তির ওপর আস্থা স্থাপন করে, নিজের দেশের প্রতি শ্রদ্ধায় অবিচল থেকে, দেশের বিচ্ছিন্ন সকল শক্তিকে এক জায়গায় সংহত করে সর্বোপরি দেশের আপামর জনসাধারণকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাংলাদেশ একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পরিণত হয় । এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পূর্ণগঠন নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয় । নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর (১৯৭২-৭৫) সময়কালে যে সকল সফলতা অর্জন করেন তা' যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্য নিঃসন্দেহে বিরাট সাফল্য। দেশের পূর্ণগঠনে বঙ্গবন্ধু সরকারের (১৯৭২-৭৫) গৃহীত পদক্ষেপ সংক্ষেপে নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. ভারতীয় সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানো: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেহেতু সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল তাই ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ পরবর্তীতে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর থেকে ৩ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ।

২. পুনর্বাসন: বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি লোককে পুনর্বাসন করা । মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য যারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে এনে পূর্নবাসন করেছিলেন। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যদান, নির্যাতিতা মা-বোনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সরকার তার সফল কুটনীতি দ্বারা পাকিস্তানে আটকে পড়া ১ লক্ষ ২২ হাজার বাঙালীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।

৩. সংবিধান প্রণয়ন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন। দায়িত্ব গ্রহনের মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি উত্তম সংবিধান প্রণয়ন সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে রচিত সংবিধানের চারটি মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ।

৪. জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল যুক্ত পাকিস্তানী কাঠামোতে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর পর বঙ্গবন্ধু দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করেন।

৫. শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি: বঙ্গবন্ধু সরকার অল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজ্ঞান ভিত্তিক করার জন্য ১৯৭২ সালে ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ ৭৩ প্রণয়ন করেন। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সরকারের সময়কালে ৩৮ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং এসকল স্কুলে কর্মরত ১ লক্ষ ৬৫ হাজার শিক্ষকের চাকুরি সরকারিকরণ করা হয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরকার ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৯০০ মহাবিদ্যলয় ভবন পূনর্নির্মাণ করেন। জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

৬. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধু সরকার হার্ডিঞ্জ ও ভৈরব ব্রীজসহ ৫৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত, ৭টি নতুন ফেরী, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন ও যাত্রীবাহী বগী, ৪৬০টি বাস, ৬০৫টি নৌযান ক্রয় এবং চট্টগ্রাম চালনা বন্দর থেকে মাইন উদ্ধার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হয়।

৭. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফলতা: বঙ্গবন্ধু সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন । বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্য সবার সাথে বন্ধুত্ব নীতি অবলম্বন করেন ৷ তাই বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য পদ লাভ করে । বাংলাদেশ ঐ সময় পাকিস্তানসহ ১৪০টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও অর্জন করে।

শুরু থেকেই বাঙ্গালীরা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল । আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলে ছিল স্বতন্ত্র জাতিসত্তার চেতনা, যাকে আমরা বলি ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ”। স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ভাষা আন্দোলন থেকে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর ধাপে ধাপে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়েছি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর সারা দেশে সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পন ও দেশের স্বাধীনতা লাভের পর ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া হয়। এর পর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তিনি স্বদেশে ফিরে দেশের পূর্ণগঠন কার্যক্রম শুরু করেন। দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ' (অনুচ্ছেদ ৭ (১))। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র হবে সবার'- এ চেতনা ও আদর্শকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion