যাকাত ( الزَّكُوةُ )
প্রিয় শিক্ষার্থী যাকাত ইসলামের অর্থনৈতিক স্তম্ভ। সালাতের পরেই যাকাতের স্থান। যাকাত সমাজের ধনী ব্যক্তিদের সম্পদে অসহায়, গরিব-দুঃখী ও নিঃস্বদের হক। এ হক বা অধিকার আদায় করা অবশ্যকর্তব্য। তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে যাকাতের নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছো। যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত, যাকাত ব্যয়ের খাত, যাকাতের গুরুত্ব, যাকাত আদায় না করার পরিণাম, যাকাতের নিসাব এবং যাকাত হিসাবের নিয়ম সম্পর্কে জেনেছ। চলো আমরা আরো বিস্তৃত পরিসরে কৃষিজ ফসল, ব্যবসায়িক সম্পদ ও গবাদি পশুর যাকাত এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা সম্পর্কে জেনে নিই।
যাকাতের পরিচয়
যাকাত অর্থ হলো পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তির মনের কলুষতা দূর হয়। তার অন্তর থেকে কার্পণ্য চলে যায়। তার অন্তর মানুষের প্রতি সদয় হয়। এভাবে তার মনের পবিত্রতা অর্জিত হয়। এছাড়া তাঁর সম্পদে অসহায়, গরিব-দুঃখীদের যে হক আছে তা যাকাতের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ফলে তার সম্পদও পবিত্র হয়। এ জন্য যাকাতের অর্থ পবিত্রতা। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا
অর্থ: 'তাদের সম্পদ হতে 'সদকা' গ্রহণ করবেন। এর দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিশোধিত করবেন।' (সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৩)।
তাছাড়া যাকাত দানকারীর সম্পদে আল্লাহ তা'আলা বরকত দান করেন। যাকাত প্রদানের ফলে সমাজে অসহায়, গরিব-দুঃখী ও নিঃস্বদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সামগ্রিক উৎপাদন, সরবরাহ ও ভোগ-ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। ফলে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয় এবং প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। তাই যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদও বৃদ্ধি পায়। এজন্য যাকাতের অন্য অর্থ বৃদ্ধি।
ইসলামি পরিভাষায়, সাহিবে নিসাবের সম্পদে দরিদ্র, অসহায়, গরিব, অভাবী ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত যে অংশ রয়েছে, তা যথাযথভাবে আদায় করে দেওয়ার নামই যাকাত।
প্যানেল আলোচনা 'সঠিক নিয়মে যাকাত প্রদান করলে আমাদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা প্যানেল আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।
|
উশর (عُشْرٌ) বা ফসলের যাকাত
সোনা, রূপা, নগদ টাকা ও ব্যবসায়িক সম্পদের যেমন যাকাত প্রদান করতে হয়; তেমনি জমিনে উৎপাদিত কৃষি সম্পদের যাকাত প্রদান করতে হয়। কৃষি সম্পদ বা ফসলের যাকাতকে উশর নামে অভিহিত করা হয়। একে ফল ও ফসলের যাকাতও বলা হয়। আল্লাহ তা'আলা ফসলের যাকাতের কথা উল্লেখ করে বলেন,
وَهُوَ الَّذِي أَنشَأَ جَنَّتٍ مَّعْرُوشُتٍ وَغَيْرَ مَعْرُوشُتٍ وَالنَّخْلَ وَالزَّرْعَ مُخْتَلِفًا أُكُلُهُ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُتَشَابِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ كُلُوا مِنْ ثَمَرَةٍ إِذَا أَثْمَرَ وَأَتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ * وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ 3
অর্থ: তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, যায়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন। এগুলো একে অন্যের সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন এগুলো ফলবান হয়, তখন এগুলোর ফল খাও আর ফসল তোলার দিন ফসলের হক দিয়ে দাও। (সূরা আল-আন'আম, আয়াত: ১৪১)
এই আয়াতে ফসলের হক বলতে ফসলের যাকাতকে বুঝানো হয়েছে।
উশর ( عُشر )অর্থ এক-দশমাংশ বা ১০ ভাগের ১ ভাগ। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় নদী, ঝরনা বা বৃষ্টির পানি দ্বারা সিক্ত জমি থেকে যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার এক-দশমাংশ যাকাত প্রদান করাকে উশর বলে। তবে কৃত্রিম চাষাবাদ পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে ২০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়। এটাকে নিসফে উশর বলে।
এ যাকাত অন্যান্য গবাদি পশু, নগদ সম্পদ ও ব্যবসায়ের পণ্য ইত্যাদির যাকাত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এর হিসাবও আলাদা। এতে এক বছর পূর্ণভাবে অতিবাহিত হওয়ার কোনো শর্ত নেই; বরং শুধু তা উৎপাদিত হলেই যাকাত প্রদান করতে হবে। কেননা, উৎপাদিত ফসলই জমির প্রবৃদ্ধি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ফসলের যাকাতের পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন,
فِيمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيَّا الْعُشْرُ وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ
অর্থ: বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা সেচ ছাড়া উর্বরতার জন্য উৎপন্ন ফসলের ওপর উশর (১০ ভাগের ১ ভাগ) যাকাত ওয়াজিব হয়। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর নিসফে উশর (২০ ভাগের ১ ভাগ)। (বুখারি)
উৎপাদিত ফসল ও ফলের নিসাব
ধান, গম, যবসহ অন্যান্য সকল ফসল অল্প হোক বা বেশি, ভূমি থেকে উৎপাদিত সকল শস্যের ওপর উশর ওয়াজিব হবে। তা প্রবাহিত পানি দ্বারা সিঞ্চিত হোক, কিংবা বৃষ্টির পানি দ্বারা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসলের ওপর উশর আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের ওপর নিসফে উশর ওয়াজিব হয়। (বুখারি) এ হাদিসে ফসলের কোনো পরিমাণের কথা উল্লেখ করা হয়নি।
আর কারো কারো মতে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ৫ ওয়াসাক হলে উশর ওয়াজিব হবে। এক ওয়াসাক হলো ৬০ সা এর সমপরিমাণ। তাদের দলীল হলো-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
لَيْسَ فِيْمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ
অর্থ: 'পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত ওয়াজিব নয়।' (বুখারি)
পাঁচ ওয়াসাক'-এর পরিমাণ
১ ওয়াসাক সমান ৬০ সা। ৫ ওয়াসাক সমান ৬০×৫ = ৩০০ সা।
১ সা সমান ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম। অতএব ৩০০ সা সমান ৯৯০ কেজি বা ২৪ মণ ৩০ কেজি। এই পরিমাণ শস্য উৎপাদিত হলে যাকাত ফরয হবে।
যেসব ফসলের ওপর উশর ধার্য হবে
জমি থেকে উৎপন্ন প্রতিটি ফসলের ওপর উশর ওয়াজিব। যেমন-খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, বাদাম, আখ, খেজুর, আঙ্গুর, অন্যান্য ফল ইত্যাদি। এছাড়া জমিতে উৎপাদিত শাকসবজির ওপরও উশর ওয়াজিব। কেননা, আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে জমি থেকে উৎপন্ন সকল ফসলের হক (যাকাত) আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জমিতে যা-ই উৎপাদিত হবে, তাতেই এক-দশমাংশ যাকাত ধার্য হবে। এমনকি জমির ফসলের ফুল থেকে উৎপাদিত মধুতেও যাকাত ধার্য হবে। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) মধু থেকেও উশর আদায় করেছেন।
তবে কারো কারো মতে, যে সকল শস্য মানুষের সাধারণ খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং যা ওজন ও গুদামজাত করা যায়, সে সকল শস্যেই কেবল যাকাত ফরয। যেমন: গম, যব, কিসমিস, খেজুর প্রভৃতি।
গবাদিপশুর যাকাত
মানব সভ্যতার ইতিহাসে পশুর অনেক ব্যবহার রয়েছে। সকল পশুর মধ্যে আল্লাহ তা'আলা কেবল গৃহপালিত পশুর ওপর যাকাত ফরয করেছেন। তবে সকল গৃহপালিত পশুর ওপর যাকাত ফরয নয়। উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগলের ওপর যাকাত প্রদান করতে হয়। গবাদিপশুর ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্ত আবশ্যক:
(ক) প্রতিটি জাতের গবাদিপশুর সংখ্যা ভিন্ন ভিন্নভাবে নিসাব পরিমাণ হতে হবে।
(খ) গবাদি পশু চারণভূমিতে বিচরণশীল হতে হবে।
(গ) নিসাব পরিমাণ পশু পূর্ণ এক বছর মালিকানাধীন থাকতে হবে।
উটের নিসাব
উট পাঁচটি হলে যাকাত প্রদান করতে হয়। এর কম হলে যাকাত ফরয হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন-
لَيْسَ فِيْمَا دُونَ خَمْسِ ذَوْدٍ مِنَ الْإِبِلِ صَدَقَةٌ
অর্থ: উট পাঁচটির কম হলে তার যাকাত নেই। (বুখারি)
গরু বা মহিষের নিসাব
গরু বা মহিষের যাকাত একই নিয়মে প্রদেয় হবে। গরু বা মহিষ ৩০টি হলে যাকাত ফরয হবে। এর কম হলে যাকাত ফরয হবে না। মু'আয ইবনে জাবাল (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাকে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে পাঠালেন, তখন তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন,
أَنْ أَخُذَ مِنْ كُلِّ ثَلَاثِيْنَ بَقَرَةً تَبِيعًا أَوْ تَبِيْعَةً وَمِنْ كُلِّ أَرْبَعِيْنَ مُسِنَّةً
অর্থ: আমি যেন প্রতি ৩০টি গরুতে একটি তাবী অথবা তাবী'আহ (এক বছরের গরু) গ্রহণ করি এবং প্রতি ৪০টিতে একটি 'মুসিন্নাহ' (দু'বছরের গরু)। (তিরমিযি)
বকরি, ভেড়া ও দুম্বার নিসাব
বকরি, ভেড়া ও দুম্বা সমগোত্রীয় গবাদি পশু। এ সকল পশুর নিসাব হলো ৪০টি। এর কম হলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, বকরি ৪০টি থেকে ১২০টি পর্যন্ত একটি বকরি। এর বেশি হলে ২০০টি পর্যন্ত ০২টি বকরি। দুইশর অধিক হলে তিনশ পর্যন্ত তিনটি বকরি। তিনশ'র বেশি হলে প্রতি এক শ' তে একটি করে বকরি। কারো বকরির সংখ্যা ৪০ থেকে একটিও কম হলে যাকাত নেই। (বুখারি)
ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত
পৃথিবীতে সম্পদের বণ্টন ও উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। আল্লাহ তা'আলা ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন। ইসলাম ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ওপর যাকাত প্রদান করাকে বাধ্যতামূলক করেছে। ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সোনা-রুপার যাকাতের পরিমাণের মতোই ২.৫% হারে আদায় করতে হয়। চলো, আমরা ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করি।
ব্যবসায়িক সম্পদ ও পণ্য
যেসব সম্পদ ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাকে ব্যবসায়িক সম্পদ বা পণ্য বলে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত সব ধরনের সম্পদই ব্যবসায়িক সম্পদ হতে পারে। যেমন জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি, খাদ্যদ্রব্য, কৃষিপণ্য, চতুষ্পদ প্রাণী, শেয়ার, যন্ত্রপাতি, গোডাউন, গাড়ি ইত্যাদি। এসব সম্পদ একক মালিকানাধীন হতে পারে বা যৌথ মালিকানাভুক্ত হতে পারে। তবে পারিবারিক প্রয়োজনে কোনো সম্পদ বা পণ্য ক্রয়ের পর লাভে বিক্রি করে দিলেও তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না।
ব্যবসায়িক সম্পদ ও পণ্যের যাকাত প্রদান করা প্রতিটি বালেগ ও বুদ্ধিমান মুসলমানের ওপর আবশ্যক। ব্যবসায়িক পণ্য যাকাত প্রদানের জন্য সারা বছর বিদ্যমান থাকা জরুরি নয়। যাকাত নিরূপণকালে বছর সমাপ্তি দিবসে মালিকানায় যে সম্পদ থাকবে তা-ই সারা বছর ছিল ধরে নিয়ে তার ওপর যাকাত প্রদান করতে হবে। সমাপ্তি দিবসে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির যে স্থিতিপত্র তৈরি করা হয়, এতে সাকুল্য দেনা-পাওনা, যেমন মূলধন সম্পদ, চলতি মূলধন, অর্জিত মুনাফা, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ-সম্পদ, দোকানে এবং গুদামে রক্ষিত মালামাল, কাঁচামাল, প্রক্রিয়ায় অবস্থিত মাল, প্রস্তুতকৃত মাল, ঋণ, দেনা ও পাওনা ইত্যাদি যাবতীয় হিসাব আনতে হবে। এসবের মধ্য থেকে ব্যাংক ঋণ, ক্রেডিটকৃত মাল এবং অন্যান্য ঋণ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হবে।
যেসব ব্যবসায়িক সম্পদের ওপর যাকাত নেই
ব্যবসায়ের স্থাবর পণ্য বা ব্যবসায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, দালান কোঠা, জমি, কলকারখানা গোলাঘর, শোরুমে ব্যবহৃত শেলফ, চেয়ার, টেবিল, ফার্নিচার ইত্যাদির ওপর যাকাত ধার্য হবে না। এসব সম্পদ ব্যবসায়ে স্থাবর বা মূল সম্পদ, এগুলো যাকাতের সম্পদের মধ্যে ধরা হবে না। তাই এতে যাকাত ফরয হবে না।
ব্যবসায়িক পণ্যে যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত
ব্যবসায়িক পণ্যের ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্ত থাকা আবশ্যক। যথা:
১. পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়া। অর্থাৎ পণ্যটি নগদ অর্থ, তাৎক্ষণিক ঋণ বা বাকি ঋণের বিনিময়, প্রতিদান বা ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করা।
২. সম্পদের ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যবসার নিয়ত তথা লাভের নিয়ত থাকতে হবে। যদিও কোনো কোনো অবস্থায় লাভ না-ও হতে পারে।
৩. ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব পূর্ণ হতে হবে। অর্থাৎ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য ৮৫ গ্রাম বা ৭.৫০ তোলা সোনার মূল্যের সমান হতে হবে।
দলগত আলোচনা 'ফসল, গবাদি পশু ও ব্যবসায়িক সম্পদের যাকাত সঠিক নিয়মে প্রদান করলে আল্লাহ তা'লা সম্পদ বৃদ্ধি করেন' (শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।
|
দারিদ্র্য দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা
যাকাত ইসলামি অর্থ ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। যাকাতকে কেন্দ্র করেই সম্পদের সুষম বণ্টন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়। যাকাতের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদ যেন মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা, সমাজের অভাব ও বৈষম্য দূর করা।
আল্লাহ তা'আলা প্রথমে মানুষকে যাকাত প্রদানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। এরপর পুরস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন, যাকাত অনাদায়ে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন। যাকাতকে ধনীদের জন্য অবশ্য প্রদেয় এবং দরিদ্রদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছেন। আর এ অধিকার বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন-
خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا
অর্থ: তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) আদায় করে তাদের পবিত্র ও পরিশোধিত করুন। (সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৩) আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন,
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّابِلِ وَالْمَحْرُومِ
অর্থ: তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার। (সূরা আয যারিয়াত, আয়াত: ১৯)
আল্লাহ তা'আলার বিধান অনুযায়ী মহানবি (সা.) যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত আদায় ও বণ্টনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা পূর্ণাঙ্গ ও আবশ্যিকভাবে নয়, ঐচ্ছিকভাবে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিচ্ছিন্নভাবে যাকাত আদায় করে থাকেন। যা সমন্বয়হীনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে পর্যাপ্ত ভূমিকা রাখতে পারছে না। এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও স্থায়ী কোনো উপকার হচ্ছে না। ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূরীভূত হচ্ছে না।
যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত গ্রহীতাকে সচ্ছল করে তোলা। তাকে গ্রহীতার পর্যায় থেকে দাতার পর্যায়ে উন্নীত করা। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে যাকাত প্রদানের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। নগদ ৫০০/১০০০ টাকা কিংবা শাড়ি, লুঙ্গি দিয়ে যাকাত প্রদান করা হয়, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কোনো কাজে আসে না। তাছাড়া যাকাত যে সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি তারও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাকাত আদায় ও বণ্টন করা প্রয়োজন।
যাকাত আদায় ও তার যথাযথ ব্যবহার সমাজে আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে ব্যবহৃত ও বণ্টিত হয়, যারা প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণিভুক্ত। এদের মধ্যে রয়েছে গরিব, মিসকিন, ঋণগ্রস্ত, মুসাফির ও নওমুসলিম। কিন্তু বাংলাদেশে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় করা হয় না। ফলে যাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হলে এর মাধ্যমে বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও স্বনির্ভরতা অর্জন করা সম্ভব।
যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনের একটি স্থায়ী পদ্ধতি। সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে দারিদ্র দূরীকরণের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এসব উদ্যোগের পাশাপাশি যাকাতভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দেশের ভূমিহীন ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন এবং সম্পূর্ণভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। দরিদ্র ব্যক্তিকে এমন পরিমাণ যাকাত প্রদান করা উচিত, যাতে তার কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হয় এবং সে আর দ্বিতীয়বার যাকাতের অর্থের মুখাপেক্ষী না হয়। ইমাম নববী বলেছেন, ফকির ও মিসকিনকে এতটুকু পরিমাণ সম্পদ দিতে হবে যাতে তারা অভাবের গ্লানি থেকে মুক্তি পায় এবং তাদের সচ্ছলতা ফিরে আসে। ইমাম মালেক এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ)-এর মতে, ফকির-মিসকিনকে তার পরিবার-পরিজনের এক বছরের ভরণ-পোষণ সম্ভব- এমন পরিমাণ সম্পদ যাকাত দিতে হবে। আর সর্বনিম্ন এক বছর সচ্ছলভাবে চলার পর ব্যতিক্রম ছাড়া সকল ব্যক্তিই স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়।
যাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে। কারণ, সমাজের গরিব, অসহায়, দুস্থ ও বেকার লোকদের হাতে অর্থ বা ক্রয় ক্ষমতা থাকে না বললেই চলে। কিন্তু যাকাত বণ্টন করে তাদের হাতে অর্থ পৌঁছালে তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা পূর্বের চেয়ে বেশি পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে সক্ষম হবে। ফলে পণ্যসামগ্রীর চাহিদা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পাবে। বর্ধিত চাহিদা পূরণের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো হবে এবং উৎপাদন ও যোগান বৃদ্ধি পাবে। ক্রয়-বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদনকারীদের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। যাকাত এভাবেই ক্রয় ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফা বৃদ্ধি করে। এই উৎপাদনকারীরাই যাকাত দেন, যা আবার বর্ধিত মুনাফা হয়ে তাদের হাতেই ফিরে আসে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا أَتَيْتُمْ مِّن رِّبًا لِّيَرْبُواْ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلَا يَرْبُوا عِنْدَ اللَّهِ وَمَا أَتَيْتُمْ مِّنْ زَكُوةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَبِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ
অর্থ: মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে না। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, প্রকৃতপক্ষে তাই-বৃদ্ধি পায়, তারাই (যাকাতদানকারীই) সমৃদ্ধিশালী। (সূরা আর রূম, আয়াত: ৩৯)
যাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং নগদ অর্থকে অলসভাবে ধরে রাখার পথে বাঁধা হিসেবে কাজ করে। সম্পদ অলসভাবে ফেলে রাখলে বছর বছর যাকাত দিতেই তা শেষ হয়ে যাবে। তাই যাকাতভিত্তিক অর্থনীতিতে যাবতীয় সম্পদ এমনভাবে বিনিয়োগ করা হয়, যাতে কমপক্ষে যাকাতের হারের সমান আয় বাড়ানো সম্ভব হয়। অন্যথায় আসল থেকে যাকাত দিতে হয়। ফলে অর্থনীতিতে পূর্ণ বিনিয়োগ ও সর্বোচ্চ উৎপাদন সম্ভব হয়। বেকার লোকদের কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, চাহিদা বাড়ে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। এভাবেই যাকাত একদিকে ভোগ ও অন্যদিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبُوا وَيُرْبِي الصَّدَقْتِ
অর্থ: আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৬)
সমাজ থেকে দারিদ্র্য নির্মূল করা যাকাতের অন্যতম লক্ষ্য। এদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ যাকাত বিধানের মাধ্যমে আহরণ ও বিতরণ করা যায়। যদি সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে যাকাত আদায় ও তা বণ্টন করা যায়, তাহলে প্রতিবছর বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বনির্ভর করা সম্ভব হবে। একটি গ্রামের যাকাতের অর্থ দ্বারা প্রতিবছর অন্তত ৩/৪টি পরিবারকে স্বনির্ভর করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বা রিকশা, ভ্যান, নৌকা, সেলাই মেশিন, গাভি, ছাগল বা এ জাতীয় কোনো উপার্জনের উপকরণ দিয়ে সাহায্য করা যায়। এভাবে ১০-১৫ বছর পর্যায়ক্রমিকভাবে করতে পারলে একটা গ্রামের অসচ্ছলতা দূর করা সম্ভব।
তাছাড়া জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে যাকাত প্রদানের জন্য বিত্তবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনে গ্রাম, সমাজ বা উপজেলা পর্যায়ে সমন্বিতভাবে যাকাত আদায় করে তহবিল গঠন এবং দরিদ্র পরিবারের তালিকা তৈরি করে পর্যায়ক্রমিকভাবে তাদের মধ্যে সেই তহবিল থেকে টাকা দিয়ে তাদের স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য কিংবা ভূমিহীন পরিবারের বিপরীতে বাৎসরিক আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ কম নয়। যদি আমাদের দেশে যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকা হয়, তাহলে এর থেকে ২.৫% হারে যাকাত আদায় করলে ২৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব।
যাকাত আদায়যোগ্য ২৫ হাজার কোটি টাকা প্রথম বছর ভূমিহীন ১৫ লাখ পরিবারকে দেড় লাখ টাকার বেশি করে কর্মসংস্থানের কাজে বণ্টন করা সম্ভব। আর ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া যাবে ২৫ লাখ পরিবারকে। পরের বছর আরো ২৫ লক্ষ পরিবারকে এর আওতায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এভাবে ১০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে দুই কোটি ৫০ লক্ষ মানুষকে স্বনির্ভর করা সম্ভব। এ ১০ বছরের যাকাত গ্রহীতা থেকেও নতুন যাকাত দাতা সৃষ্টি হবে। এতে যাকাত দাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এভাবে যাকাত গ্রহীতার সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। তাই সরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাকাত সংগ্রহ করে তার সুপরিকল্পিত বণ্টন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
প্যানেল আলোচনা 'আমাদের সমাজে দারিদ্র্য-দূরীকরণে যাকাতের ভূমিকা বিশ্লেষণ' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল বা দলে আলোচনা করে যাকাত সংক্রান্ত পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বাণী উল্লেখপূর্বক শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)
|
আরও দেখুন...