মানব জীবনে যোগাযোগ একটি অপরিহার্য উপাদান । মানুষ নিজের প্রয়োজনে পরস্পরের মধ্যে ভাব বা তথ্য বিনিময় করে । ভাব বা তথ্যেও এ বিনিময় কার্যকেই যোগাযোগ বলে। দোলনা থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার প্রতিটি মুহূর্তে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। যোগাযোগ শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর কার্যক্রম বিস্তৃত । বর্তমান যুগে যোগাযোগ ব্যতীত কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অচল ।
যোগাযোগ পদ্ধতির মাধ্যমসমূহ (Media of Communication)
মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যম বা কৌশলসমূহ: মানবজীবনের যোগাযোগ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মৌখিক যোগাযোগই সর্বপ্রথম প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিম্নে মৌখিক যোগাযোগের বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম বা কৌশলসমূহ আলোচনা করা হলো:
১। কথোপকথন: কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া যোগাযোগকারী পক্ষসমূহের মধ্যে যে আলাপ- আলোচনা হয় তাকে কথোপকথন বলে। কথোপকথন মৌখিক যোগাযোগে ব্যবহৃত সর্বাধিক প্রচলিত মাধ্যম । এ পদ্ধতিতে বার্তা প্রেরক ও বার্তা প্রাপক উভয়েই খোলাখুলিভাবে মতবিনিময় করতে পারে ।
২। সাক্ষাৎকার: বার্তা প্রেরক ও প্রাপক নির্দিষ্ট সময়ে একত্রে মিলিত হয়ে পূর্বনির্ধারিত বিষয়ের উপর আলাপ-আলোচনা করলে তাকে সাক্ষাৎকার বলে। এ পদ্ধতিতে সাক্ষাৎপ্রার্থী নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর উপস্থিত হয়ে নির্ধারিত বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে তথ্যাদি আদান-প্রদান করে থাকে ।
৩। টেলিফোন: মৌখিক যোগাযোগের একটি আধুনিকতম পদ্ধতি হলো টেলিফোন। ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত না হয়েও টেলিফোনের মাধ্যমে দূর-দূরান্তে অবস্থিত ব্যক্তির সাথে অল্প সময়ে তথ্য বা সংবাদ আদান-প্রদান করতে পারেন ।
৪। মঞ্চ বক্তৃতাঃ যে পদ্ধতিতে একযোগে বহুসংখ্যক জনতার উদ্দেশে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যোগাযোগকারী বক্তব্য পেশ করে তাকে মঞ্চ বক্তৃতা বলে। তবে এরূপ যোগাযোগে পারস্পরিক মত বিনিময়ের ক্ষেত্রে তেমন সুযোগ থাকে না ।
৫। দলগত আলোচনা: মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে দলগত আলোচনা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে । কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে একটি দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে দলগত আলোচনা । কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে দলগত আলোচনার সুফল পাওয়া যায়। যেমন- প্রশিক্ষণ, মানব সম্পর্কে ধারণা যাচাই ।
৬। সম্মেলন বা কনফারেন্স: এটি মৌখিক যোগাযোগের একটি অন্যতম কৌশল। সাধারণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো একটি দল আলাপ-আলোচনায় মিলিত হলে তাকে সম্মেলন বা কনফারেন্স বলে।
৭। টেলিভিশন ও বেতার: রেডিও-টেলিভিশনে কথিকা পাঠ করে যোগাযোগকারী তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করতে পারে । এটি একটি একতরফা যোগাযোগ পদ্ধতি ।
৮। চা-চক্রঃ মৌখিক যোগাযোগের একটি আকর্ষণীয় পদ্ধতি হলো চা-চক্র। এ যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যবস্থাপকগণ মাঝে মধ্যে চা-চক্রে মিলিত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে থাকেন ।
৯। আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কোর্সঃ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উপায়ে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কোর্স পদ্ধতি বিশেষ ফলপ্রসূ ।
১০। কমিটি পর্যালোচনা: কমিটি পর্যালোচনা যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ মাধ্যম। এ মাধ্যমে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি সামনাসামনি আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে ।
১১। অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ: এ ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক অধীনস্থ কর্মীদের ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধা, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি সম্পর্কের খোঁজ-খবর পেতে পারে। এ ধরনের যোগাযোগ চায়ের টেবিলে, খেলার মাঠে স্থাপন করা সম্ভব ।
১২। পারিবারিক সমস্যা: পারিবারিক সন্ধ্যার ব্যবস্থা করলে ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীগণ ঘরোয়া পরিবেশে মিলিত হয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন ।
১৩ । পুরস্কার বিতরণী সভা: এরূপ যোগাযোগ মাধ্যমে যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মীদের জন্য পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান করে একত্রিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় । এতে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।
১৪। সামাজিক অনুষ্ঠান: বিয়ে, বনভোজন, বিতর্ক, বার্ষিক প্রীতিভোজ ইত্যাদি অনুষ্ঠান হলে নির্বাহী কর্মকর্তা ও অধস্তন কর্মীগণ মিলিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। এতে উভয়ের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক মৌখিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে থাকে ।
লিখিত যোগাযোগের মাধ্যমসমূহ
লিখিত যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়: যথা:
(ক) ব্যবস্থাপনার জন্য লিখিত যোগাযোগ ।
(খ) কর্মচারীদের জন্য লিখিত যোগাযোগ ।
(ক) ব্যবস্থাপনার জন্য লিখিত যোগাযোগ মাধ্যম বা কৌশলসমূহ: প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক, নির্বাহী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যোগাযোগের জন্য যে লিখিত যোগাযোগ পদ্ধতি ব্যবহার করেন তাকে ব্যবস্থাপনার জন্য লিখিত যোগাযোগ পদ্ধতি বলে । নিম্নে এরূপ যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আলোচনা করা হলো:
১। সংগঠন সম্পকির্ত যোগাযোগ: সংগঠন সম্পর্কিত যোগাযোগ যেমন- সাধারণ ঘোষণা, নীতি, বিজ্ঞপ্তি, প্রশাসনিক নির্দেশনা ইত্যাদি যোগাযোগ লিখিত হওয়া একান্ত অপরিহার্য ।
২। জরুরি ব্যবস্থাপনা বুলেটিন: ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিশেষ জরুরি বিবৃতি পরিবেশন এবং তা নির্ভুল ও অবিকৃত অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের কাছে পৌঁছাতে হলে লিখিত যোগাযোগ আবশ্যক ।
৩। আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন: প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা, সংগঠন ও উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত ব্যক্তি তার উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে কার্য ধারায় যে লিখিত রিপোর্ট পেশ করে থাকেন তাকেই আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা প্রতিবেদন বলে ।
৪ । ব্যবস্থাপনা বিষয়ক চিঠি: সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ অথচ কম জরুরি বিষয়াদি চিঠির মাধ্যমে ব্যবস্থাপককে জানানোর পদ্ধতিকে ব্যবস্থাপনা সংবলিত চিঠি বলা হয়। এ ধরনের চিঠি সাধারণত সাপ্তাহিক খবরাখবর প্রকাশ করা হয় ।
৫। তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশিকা পুস্তক: প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মীদের সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য তত্ত্বাবধায়কের নির্দেশনা পুস্তক সরবরাহ করা হয় । এতে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আইন-কানুন, রীতি-নীতি, ট্রেড ইউনিয়নের কর্তব্য ও অধিকার ইত্যাদি লিখিত থাকে।
৬। তত্ত্বাবধায়কের জন্য বিশেষ প্রকাশনা: অনেক সময় বড় বড় কোম্পানি তত্ত্বাবধায়কের তত্ত্বাবধান কাজের সুবিধার জন্য বিশেষ প্রকাশনার ব্যবস্থা করে থাকে । এতে প্রতিষ্ঠানের ব্যয়, হ্রাস, পণ্যের মানোন্নয়ন, দুর্ঘটনা হ্রাস, নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি বিষয় লিপিবদ্ধ থাকে ।
(খ) কর্মচারীদের জন্য লিখিত যোগাযোগ মাধ্যমমূহ: প্রতিষ্ঠানের নিম্নস্তরে কর্মরত কর্মচারীদের কাছে লিখিত আকারে তথ্য প্রেরণ করার জন্য কতিপয় মাধ্যম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নিম্নে কর্মচারীদের জন্য লিখিত যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আলোচনা করা হলো :
১। কর্মচারী বুলেটিন: অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোনো জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ খবর কর্মচারীদের জানানোর জন্য লিখিতভাবে এ বুলেটিন প্রকাশ করা হয় ।
২। কর্মচারীদের সংবাদ: প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে কর্মচারীদেরকে জানানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে লিখিত সংবাদ প্রকাশ করা হয় ।
৩। মাসিক পত্রিকা প্রকাশ: অনেক সময় বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠান এর কর্মচারীদেরকে সকল ব্যাপারে অবহিত করার জন্য নিজস্ব মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে ।
৪। নতুন কর্মচারীদের কাছে পত্র: নবনিযুক্ত কর্মীদেরকে অভিনন্দন ও তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির জন্য স্বাগত জানিয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়।
৫। কর্মচারীদের বাড়িতে পত্র প্রেরণ: কর্মচারীদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানানোর জন্য ব্যবস্থাপক সাধারণত পাক্ষিক বা মাসিক তাদের বাড়ির ঠিকানায় পত্র প্রেরণ করে থাকে। তবে এতে কোনো প্রত্যুত্তর চাওয়া হয় না।
৬। বার্ষিক প্রতিবেদন: কর্মচারীদেরকে প্রতিষ্ঠানের সফলতা ও ব্যর্থতা, বাৎসরিক আয়-ব্যয় ইত্যাদি বিষয়সমূহ জানানোর জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রতিবছর বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয় ।
৭। অভিযোগ বই: প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কর্মচারীদের অভিযোগ লিখিতভাবে জানানোর জন্য প্রত্যেক বিভাগে যে বই সংরক্ষণ করা হয় তাকে অভিযোগ বহি বলে। এতে কর্মচারীরা তাদের সুবিধা-অসুবিধা, অভাবে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে পারে ।
৮। নোটিশ বই: অধস্তন কর্মচারীদেরকে জরুরি ভিত্তিতে কোনো তথ্য অবগত করানোর জন্য নোটিশ বই ব্যবহার করা হয় ।
৯। রচনা প্রতিযোগিতা: কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম অতিরিক্ত কৌশল হিসেবে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে । এর ফলে প্রতিষ্ঠানে কর্মচারীদের আগ্রহ সৃষ্টি হয় ।
১০ । বেতন খাম: অনেক সময় কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, কর্তন, ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য ভাতা সম্পর্কিত তথ্য লিখিতভাবে বেতন খামের মাধ্যমে জানানো হয় ।
১১। পঠন তাক: প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে তাকের মধ্যে বইপত্র সাজিয়ে রাখা হয় । এ সমস্ত বইপত্র হতে কর্মচারীরা অবসর সময়ে প্রশাসনিক বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
১২। শ্রবণ দর্শন মাধ্যম: কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের লিখিত যোগাযোগ সহযোগী বা পরিপূরক হিসেবে চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে ।
১৩। স্মারকপত্র: বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি, ছুটি মঞ্জুর এবং চাকরি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় কর্মচারীদের জানানোর জন্য কোম্পানি যে পত্র সরবরাহ করে থাকে তাকে স্মারক পত্র বলে ।
১৪। কার্যতালিকা: কর্মচারীদের কাজের বিশদ বিবরণ, তা সম্পাদনের সময় ও পদ্ধতি সম্পর্কে নির্বাহীবৃন্দের লিখিত তালিকাকে কার্যতালিকা বলে ।
আরও দেখুন...