সংসদীয় সরকার
যে সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং শাসন বিভাগের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা আইন বিভাগের উপর নির্ভরশীল তাকে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার বা সংসদীয় পদ্ধতির সরকার বলে। এতে মন্ত্রিসভার হাতে দেশের শাসন ক্ষমতা থাকে। সাধারণ নির্বাচনে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দল মন্ত্রিসভা গঠন করেন । দলের আস্থাভাজন ব্যক্তি হন প্রধানমন্ত্রী । তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্য থেকে অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করেন ও তাঁদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন । মন্ত্রীগণ সাধারণত আইন পরিষদ বা সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হন। তাই এ সরকারকে বলা হয় সংসদীয় বা পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার। বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার রয়েছে । এ ধরনের সরকারে একজন নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা হয় প্রকৃত শাসন ক্ষমতার অধিকারী । এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কার্যত কিছু করেন না । সংসদীয় সরকারে আইনসভা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভা তাদের কাজের জন্য আইন পরিষদের নিকট দায়ী থাকে । আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে । এছাড়া মন্ত্রিসভার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে সংসদ অনাস্থা আনলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। এ ব্যবস্থায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী নিযুক্ত করায় একই ব্যক্তির হাতে আইন ও শাসন ক্ষমতা থাকে ।
সংসদীয় সরকারের গুণ:
সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের যেসব গুণ রয়েছে তা নিম্নরূপ-
১ . দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা: সংসদীয় সরকার দায়িত্বশীল সরকার । এতে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ই তাদের কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকে ।
২. আইন ও শাসন বিভাগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক: শাসন বিভাগের সদস্যগণ আইনসভার সদস্য হওয়ায় এ সরকারে আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে।
৩. বিরোধী দলের মর্যাদা: এ সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে বিকল্প সরকার মনে করা হয়। ফলে জাতীয় সংকটে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল একসাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারে । বিরোধী দল হচ্ছে সংসদীয় ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ।
8. সমালোচনার সুযোগ: এ সরকারে সংসদ সদস্যগণ বিশেষ করে বিরোধী দলের সদস্যগণ সংসদে বসে সরকারের কাজের সমালোচনা করার সুযোগ পায়। ফলে সরকার তার কাজে সংযত হয় ও ভালো কাজ করার চেষ্টা করে ।
৫. রাজনৈতিক শিক্ষা দেয়: সংসদীয় সরকার জনমতের দ্বারা পরিচালিত হয় । জনমতকে অনুকূলে রাখার জন্য তাই সরকারি ও বিরোধী দল সবসময় তৎপর থাকে । সংসদে বিতর্ক হয় । এতে জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়।
সংসদীয় সরকারের ত্রুটিঃ
সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের কিছু ত্রুটি রয়েছে । যথা-
১. স্থিতিশীলতার অভাব: সংসদীয় সরকার অস্থিতিশীল হতে পারে। মন্ত্রিসভা আইনসভার আস্থা হারালে অথবা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার হেরফের হলে সরকারের পতন ঘটে । এ ধরনের পরিস্থিতি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে ।
২. ক্ষমতার অবিভাজন: এ ধরনের সরকারে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার প্রায় সকল সদস্য আইন সভারও সদস্য। ফলে শাসনকার্য পরিচালনার সাথে আইন প্রণয়নেও সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শাসন ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা একই স্থানে তথা মন্ত্রিপরিষদের হাতে থাকে বলে মন্ত্রীগণ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে । এ জন্য সংসদীয় সরকারকে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার বলে আখ্যায়িত করা যায় ।
৩. অতি দলীয় মনোভাব: সংসদীয় সরকার মূলত দলীয় সরকার। এতে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার উপর সরকারের গঠন ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে । ফলে দলকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলই চরম দলীয় মনোভাব নিয়ে কাজ করে। এছাড়া দলীয় সরকার হওয়ায় দলের সদস্যদের সন্তুষ্ট করার জন্য মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে অনেককে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় । ফলে জাতীয় স্বার্থ ব্যাহত হয় ।
৪. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব: এখানে যেকোনো বিষয়ে বহু আলোচনা ও পরামর্শের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয় । অনেক কাজই সময়মত করা সম্ভব হয় না ।
আরও দেখুন...