হজ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ ইচ্ছা করা, নিয়ত করা, বায়তুল্লাহ সফরের সংকল্প করা। আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভের নিয়তে যিলহজ মাসের নির্দিষ্ট দিনসমূহে ইহরাম বেঁধে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ, আরাফা ও মুযদালিফায় অবস্থান, সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ করা ও অন্যান্য কাজ সম্বলিত ইবাদাতের নাম হজ। হজ শারীরিক ও আর্থিক ইবাদাত এবং ইসলামের পাঁচটি রুকনের অন্যতম রুকন।
সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরয। একাধিকবার হজ আদায় করলে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। কেউ হজের বিধান অস্বীকার করলে, সে কাফির হিসেবে বিবেচিত হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, 'এক দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, 'হে মানব সমাজ। তোমাদের ওপর হজ ফরয করা হয়েছে। তাই তোমরা হজ আদায় করো।' এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, 'হে আল্লাহর রাসুল! তা কি প্রতি বছর?' তিনি নীরব থাকলেন এবং সে তিনবার কথাটি বলল। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'আমি 'হ্যাঁ' বললে তা (প্রতি বছরের জন্য) ওয়াজিব হয়ে যেত'। (মুসলিমন)
যেহেতু মানুষ যে কোনো সময় মৃত্যুবরণ করতে পারে, তাই হজ ফরয হওয়ার সাথে সাথে দেরি না করে তা আদায় করা অত্যন্ত জরুরি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করে, সে যেন তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়।' (আবু দাউদ) যার ওপর হজ ফরয, কোনো কারণে আদায় না করলে মৃত্যুর পূর্বে হজের ওসিয়ত করা ওয়াজিব। উত্তরাধিকারীগণ তার পক্ষ থেকে হজ আদায় না করলে সে গুনাহগার হবে।
হজের ঐতিহাসিক পটভূমি
আল্লাহর নবিগণের স্মৃতিবিজড়িত নগরী মক্কাতুল মুকাররমা, কুরআন মাজিদে যাকে 'উম্মুল কুরা' বা আদি নগরী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এখানে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতের উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম ঘর বায়তুল্লাহ নির্মিত হয়। কালের বিবর্তনে এ জনপদ জনমানবহীন মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়। আর সেখানে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাত বন্ধ হয়ে যায়।
হযরত ইবরাহিম (আ.) একজন অত্যন্ত মর্যাদাবান পয়গম্বর বা নবি। তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) স্বীয় স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) কে বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী জনমানবহীন মরুভূমিতে সামান্য কয়েক দিনের খাদ্য ও পানীয় দিয়ে রেখে আসেন। হযরত হাজেরার আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা ছিল। তিনি জানতেন নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা তাঁদের জন্য উত্তম রিযিকের ব্যবস্থা করবেন।
প্রিয় পুত্র ও স্ত্রীকে একাকী রেখে যাওয়ার সময় হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ তা'আলার নিকট দোয়া করলেন। এ দোয়া আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজিদে বর্ণনা করেছেন: 'হে আমাদের রব! আমি আমার বংশধরদের কিছু সংখ্যককে আপনার পবিত্র ঘরের নিকটে ফসলহীন অনুর্বর উপত্যকায় বসবাস করালাম। হে আমাদের রব্য এ জন্য যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে। অতএব আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন এবং ফল-ফলাদি দিয়ে তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা শুকরিয়া আদায় করে।' (সূরা ইবরাহিম, আয়াত: ৩৭)
আল্লাহ তা'আলা হযরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া কবুল করলেন। যখন ইসমাইল (অং) ও তাঁর মা হাজেরার খাবার শেষ হয়ে গেল, ইসমাইল (আ.) ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর হয়ে উঠলেন। মা হাজেরা বারবার সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের চূড়ায় উঠে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলেন, কোনো কাফেলা এই পথ দিয়ে যায় কি না। তাহলে তাদের কাছে একটু পানি পাওয়া যেতো। কিন্তু কোথাও কোনো মানুষ তিনি দেখতে পেলেন না। তিনি এভাবে সাতবার সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করলেন। পানি না পেয়ে মা হাজেরা শিশু ইসমাইল (আ.)-এর কাছে ফিরে আসলেন এবং বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখতে পেলেন, কাছেই মাটি ফুঁড়ে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বইছে। এ পানির ফোয়ারাই হলো বিখ্যাত যমযম কূপ। মা হাজেরা শিশু ইসমাইল (আ.) কে পানি পান করালেন, নিজেও পানি পান করে পরিতৃপ্ত হলেন। আল্লাহ তা'আলার শুকরিয়া আদায় করলেন।
পানির মাধ্যমে তাঁদের খাবারের সমস্যাও মিটে গেলো। মরুভূমিতে পানির তীব্র সংকট। কোথাও পানি থাকলে সেখানে পাখিরা উড়াউড়ি করে, অনেক দূর থেকে দেখা যায়। পানির সন্ধানে অনেক কাফেলা সেখানে আসতে লাগলো। তারা পানি সংগ্রহ করে যাওয়ার সময় হযরত হাজেরা (আ.)-কে উপহার স্বরূপ খাদ্যদ্রব্য দিয়ে যেত। এভাবেই সেখানে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। জুরহাম গোত্রের এক কাফেলা মা হাজেরা (আ.)- এর অনুমতিক্রমে সেখানে বসবাস শুরু করে। ক্রমে আরো মানুষ বসবাস করতে থাকে। মক্কা নগরী ধীরে ধীরে জনপদে রূপান্তরিত হয়। সবাই হযরত ইসমাইল (আ.) ও তাঁর মা হাজেরাকে খুব সম্মান করতেন। কারণ তাঁদের কারণেই তো আল্লাহ তা'আলা ধু ধু মরুপ্রান্তরে শীতল পানির কূপের ব্যবস্থা করেছেন।
ইসমাইল (আ.) কিশোর বয়সে উপনীত হলে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহিম (আ.) এর ওপর আদেশ হলো প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করার জন্য। আল্লাহ তা'আলার হুকুম মেনে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করতে প্রস্তুত হলেন। পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহ তা'আলার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
মহান আল্লাহ পিতা ও পুত্রের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে কাবাঘর পুনর্নিমাণের আদেশ দিলেন। তিনি ইবরাহিম (আ.)-কে কাবা ঘরের স্থানটি চিহ্নিত করে দিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, 'যখন আমি ইবরাহিমকে বায়তুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়েছিলাম (আর বলেছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরিক করো না। আর আমার ঘরকে পবিত্র রাখবে তাওয়াফকারী, নামাযে কিয়ামকারী, রুকুকারী ও সিজদাকারীদের জন্য।' (সুরা আল-হাজ, আয়াত ২৬)
হযরত ইবরাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.) এর সহযোগিতায় কাবাঘর পুনর্নিমাণ করলেন। এরপর মহান আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন,
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অর্থ: 'হে আমাদের রব! আমাদের এ কাজ আপনি কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন।' (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৭)
আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে হযরত ইবরাহিম (আ.) মানুষকে বায়তুল্লাহর যিয়ারত ও হজ করার জন্য আহ্বান করেন। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে,
وَ أَذَنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَ عَلَى كُلِّ ضَامِرٍ
يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ
অর্থ: 'আর মানুষের মাঝে হজের ঘোষনা করে দিন, তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সবধরনের কৃশকায় উটের পিঠে করে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।' (সুরা আল হাজ্জ, আয়াত ২৭)
পৃথিবীর নানা প্রান্তের মুমিনগণ বায়তুল্লাহর যিয়ারতে আসতে থাকলো। বায়তুল্লাহ মহান আল্লাহর ইবাদাতের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হলো। ইবরাহিম (আ.)-এর ইন্তেকালের পর হযরত ইসমাইল (আ) নবি হলেন। তিনি কাবা শরিফের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। এভাবে বংশানুক্রমিকভাবে তারা কাবা শরিফের তত্ত্বাবধান করতেন। কিন্তু কালক্রমে মানুষ আবার মহান আল্লাহকে ভুলে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। কাবাগৃহে ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করে পূজা শুরু করে। হজ পালনের জন্য তারা নানা ভ্রান্ত নিয়ম চালু করে। তারা বিবস্ত্র হয়ে কাবাগৃহ তাওয়াফ করতো, আরাফার ময়দানে অবস্থান না করে আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য মুযদালিফায় অবস্থান করতো। কিন্তু তখনো কুরাইশরাই কাবা শরিফ ও হজের তত্ত্বাবধায়ক ছিল। বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে আরব অঞ্চল ও অন্যান্য দেশে তাদের বিশেষ মর্যাদা ছিল। তাদের মাঝে অল্প সংখ্যক লোক ছিল তখনো মুর্তিপূজাকে ঘৃণা করতেন। তাদেরকে হানিফ বা আল্লাহ তা'আলার একনিষ্ঠ ইবাদাতকারী বলা হতো। তারা মূর্তিপূজা না করে ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসরণে হজ আদায় করতেন। আমাদের প্রিয় মহানবি (সা.) এমন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছোটোবেলা থেকে মূর্তিপূজা ঘৃণা করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের পর পুনরায় কাবা ঘরকে মুর্তিমুক্ত করেন ও হযরত ইবরাহিম (আ.)- এর অনুসরণে হজের বিধানাবলি প্রবর্তন করেন।
হজের ফযিলত
হজ মুসলিম জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল, 'কোন আমলটি উত্তম?' তিনি বললেন, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আনা।' প্রশ্ন করা হলো, 'তারপর কোনটি?' তিনি বললেন, 'আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।' প্রশ্ন করা হলো, 'তারপর কোনটি?' তিনি বললেন, 'মকবুল হজ।' (বুখারি) আল্লাহ তা'আলা যে ব্যক্তির হজ কবুল করেন, তার জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে তাকে জান্নাত দান করেন। মহানবি (সা.) বলেন 'তোমরা হজ ও ওমরাহ মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় রাখো। কেননা এ ইবাদাত দু'টি দরিদ্রতা ও গুনাহসমূহ এমনভাবে দূর করে দেয়, যেমন (কামারের আগুনের) হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে বিশুদ্ধ করে দেয়। আর কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়'। (তিরমিযি। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন-
مَنْ حَجَّ هَذَا الْبَيْتَ فَلَمْ يَرْفُتُ وَلَمْ يَفْسُقُ رَجَعَ كَمَا وَلَدَتْهُ أُمُّهُ
অর্থ: 'যে ব্যক্তি এ ঘরের হজ করলো আর হজ পালনের সময় কোনো অশ্লীল কাজ করেনি এবং কোনো প্রকার পাপাচারে নিমজ্জিত হয়নি, সে হজ থেকে এমন নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে, যেমন নিষ্পাপ অবস্থায় তাঁর মা তাকে জন্ম দিয়েছিলেন।' (বুখারি)
হজের গুরুত্ব
হজের বিধান ফরয হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَأَتِمُوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلَّهِ
অর্থ: 'আর তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরাহ পরিপূর্ণভাবে পালন কর।' (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬)
বায়তুল্লাহর হজ চালু থাকা মুমিন জীবিত থাকার দলিল। আর যতদিন কোনো মুমিন পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
لا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى لَا يُحَجَّ الْبَيْتُ
অর্থ: 'বায়তুল্লাহর হজ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না' (বুখারি)
হজের উদ্দেশ্যে রওনা হলে, হজ আদায় না করে মৃত্যুবরণ করলেও আল্লাহ তা'আলা তাকে হজের সাওয়াব দান করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি হজ, ওমরাহ অথবা আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে বের হবে আর পথেই মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ তা'আলা তাকে গাজি, হাজী বা ওমরাহ পালনকারীর সাওয়াব প্রদান করবেন'। (বায়হাকী)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সামর্থ্যবান ব্যক্তির হজ পালনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সুস্পষ্ট অভাব বা অত্যাচারী শাসকের বাধা অথবা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়া ব্যতীত হজ পালন না করে মৃত্যুবরণ করলো, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করুক বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না'। (দারিমি)
হজের তাৎপর্য
হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। হজ পালনের সফরে আমরা আল্লাহ তা'আলার নিদর্শনাবলি প্রঅক্ষ করতে পারি, ফলে আমাদের ঈমান মজবুত হয়। তাকওয়া বা আল্লাহভীতি বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিদর্শনাবলির সম্মান সম্পর্কে বলেন-
وَ مَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থ: 'যে আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা তাঁর অন্তরের তাকওয়া থেকেই করে।' (সূরা আল-হাচ্ছ, আয়াত: ৩২)
হজ আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যম। হজ মানুষকে অন্যায় অশ্লীলতা থেকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনে মানুষ তাওবা করে, আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চায়। সাদা ইহরামের কাপড় তাকে মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মানুষ তাঁর অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। তাইতো আমরা হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মানুষের মাঝে আমূল পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করি।
হজ ইসলামের সাম্যনীতির প্রমাণ। লাখ লাখ হার্জী সবাই একই পোশাকে আল্লাহ তা'আলার দরবারে লাব্বাইক ধ্বনিতে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে সবাই সমান, সেটার স্পষ্ট প্রমাণ হজে পাওয়া যায়। হজের মাধ্যমে মুসলিমদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়। দেশ, ভাষা ও জীবনাচার আলাদা হওয়ার পরও সবাই সুশৃঙ্খলভাবে হজের কার্যাবলি আদায় করে, একে অপরকে সহযোগিতা করে। এক অতুলনীয় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ পায়। তাদের মাঝে আলোচনা করার ও সমস্যা সমাধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। হজের ইমাম আরাফার ময়দানে বিশ্ব মুসলমানদের জন্য দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য পথনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।
একজন মুমিন বান্দা প্রতিদিন বায়তুল্লাহর দিকে ফিরে সালাত আদায় করেন। হজের সফরে তিনি বায়তুল্লাহকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর রওজা মুবারক যিয়ারাত করারও সুযোগ পান। এসব মহিমান্বিত স্থানগুলোর ভ্রমণ মানুষের অন্তরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর মুমিন ব্যক্তি প্রতিনিয়ত আল্লাহর পথে এগিয়ে যেতে শুরু করে।
একক/জোড়ায় কাজ |
হজের ফরয
হজের ফরয তিনটি।
১. হজের নিয়ত করে ইহরাম বাঁধা।
২. উকুফে আরাফা অর্থাৎ ৯ই যিলহজ যোহর থেকে ১০ই যিলহজ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্য আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা।
৩. তাওয়াফে যিয়ারত করা অর্থাৎ ১০ই যিলহজ ভোর থেকে ১২ যিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো সময় কাবা শরিফ তাওয়াফ করা।
হজের ওয়াজিব
হজের ওয়াজিবসমূহ-
১. মিকাত অতিক্রম করার আগেই হজের নিয়ত করে ইহরাম বাঁধা।
২. ৯ যিলহজ আরাফার ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
৩. আরাফা থেকে মিনায় ফেরার পথে ১০ই যিলহজ ফজর থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে কিছু সময় মুযদালিফায় অবস্থান করা।
৪. সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করা বা দৌড়ানো।
৫. ১০, ১১ ও ১২ যিলহজ শয়তানকে জামরায় পাথর নিক্ষেপ করা।
৬. মাথা মুন্ডন করা বা চুল ছোট করা।
৭. মক্কার বাইরে থেকে আগত হাজীদের জন্য বিদায়কালীন তাওয়াফ বা তাওয়াফুল বিদা করা।
৮. তামাণ্ডু ও কিরান হজ আদায়কারীগণের জন্য শুকরিয়াস্বরূপ কুরবানি করা।
হজের সুন্নাত
হজের সুন্নাতসমূহ-
১. ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করা; সম্ভব না হলে ওযু করা।
২. বেশি বেশি তালবিয়া পাঠ করা।
৩. মক্কার বাইরে থেকে আগত ব্যক্তিদের জন্য তাওয়াফে কুদুম (আগমনী তাওয়াফ) করা।
৪. তাওয়াফের সময় প্রথম তিন চক্কর সৈনিকের মতো বীরদর্পে চলা।
৫. ইমামের জন্য ৩টি খুতবা দেওয়া। ইমাম ৭ই যিলহজ তারিখ মক্কায়, ৯ই যিলহজ আরাফায় যোহরের নামাযের পূর্বে, ১১ই যিলহজ মিনায় যোহরের নামাযের পর হজের খুতবা প্রদান করেন।
৬. ৮ই যিলহজ মক্কা থেকে মিনায় যাত্রা করা, সেখানে পৌঁছে যোহর থেকে ৯ যিলহজ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা।
৭. ৯ই যিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া।
৮. উকুফে আরাফা বা আরাফাতে অবস্থানের পূর্বে গোসল করা।
৯. আরফার ময়দান থেকে ফেরার সময় ইমান রওনা হওয়ার পরে রওনা হওয়া।
১০. আরাফা থেকে ফিরে মুযদালিফায় রাত কাটানোর পর ১০ই যিলহজ ফজরের নামায আদায় করে সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া।
১১. জামরায় পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০, ১১ ও ১২ ফিলহজ মিনায় রাত্রিযাপন করা।
১২. যিলহজ মাসের ১১, ১২, ১৩ তারিখ পথর নিক্ষেপের সময় ক্রমধারা ঠিক রাখা।
১৩. মিনা থেকে ফেরার পথে 'মুহাসসার' নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করা
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন (বাড়ির কাজ) | ||
ক্রমিক | হজের নিয়ম | কার্যাবলি |
১ | ফরয | |
২ | ওয়াজিব | |
৩ | সুন্নাত |
হজ ফরয হওয়ার শর্ত
হজ ফরয হওয়ার শর্ত পাঁচটি। যথা,
১. মুসলিস হওয়া
হজ ফরয হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে মুসলিম হওয়া।
২. বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া
অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক-বালিকার ওপর হজ ফরয নয়। তবে তারা যদি হজ আদায় করে, হজের সাওয়াব পাবে। প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ার পরে শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হলে, তাদেরকে আবার হজ আদায় করতে হবে।
৩. বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়া
বোধশক্তিহীন ব্যক্তির ওপর হজ ফরয নয়।
৪. স্বাধীন হওয়া
কোনো পরাধীন ব্যক্তির ওপর হজ ফরয নয়।
৫. শারীরিক ও আর্থিক সামর্থ্য থাকা
যে ব্যক্তি মক্কা শরিফ পর্যন্ত হজের সফরের যাতায়াত ও হজ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবার-
পরিজনের অত্যাবশকীয় ব্যয় নির্বাহ করতে পারে এবং শারীরিকভাবে সুস্থ আছে, তার ওপর হজ ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
অর্থ: 'আর যে ব্যক্তির সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, তার ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ ঘরের হজ করা ফরয।' (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)
আর্থিক সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি হজের সফর করতে অক্ষম হন, তিনি অন্যের মাধ্যমে হজ আদায় করবেন। এমন হজকে বদলি হজ বলে। তবে কোনো ব্যক্তির হজ যাত্রার পথ নিরাপদ না হলে তার উপর হজ ফরয হবে না। হজ আদায়কারী যদি মহিলা হন, তার সাথে তার স্বামী বা কোনো মাহরাম থাকতে হবে। ইসলামি শরিয়ায় মাহরাম বলা হয় এমন নিকটাত্মীয়কে যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া হারাম। যেমন, বাবা, চাচা, মামা, ভাই, ছেলে ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'কোনো নারী যেন মাহরাম ছাড়া সফর না করে'। (বুখারি)
হজের মিকাত
ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থানকে মিকাত বলা হয়। হজ ও ওমরার জন্য বায়তুল্লাহ যাওয়ার পথে মিকাত অতিক্রম করার আগে ইহরাম বাঁধা ওয়াজিব। আকাশপথে বা জলপথে বা স্থলপথে যারা হজে গমন করেন, তাদেরকেও এই স্থানগুলা অতিক্রমের পূর্বেই ইহরাম বাঁধতে হয়। অঞ্চলভেদে মহানবি (সা.) ইহরামের জন্য পাঁচটি স্থানকে মিকাত হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। মিকাত বা ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থানগুলো নিম্নরূপ:
১. ইয়ালামলাম
ইয়ালামলাম একটি উপত্যকা যা মক্কা থেকে বিরানব্বই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি ইয়ামেনবাসী ও সে পথে আগমনকারী হাজীদের মিকাত। এটি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আগত হাজীদেরও মিকাত। যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশের হাজীগণ আকাশপথে হজে গমন করেন, তাই যারা সরাসরি বায়তুল্লায় যান তারা ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে উঠার আগেই ইহরাম বাঁধেন। তবে যারা শুরুতে মদিনায় যান, তাদেরকে ঢাকা থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় না।
২. ফুল-হুলায়ফা
মদিনা মুনাওয়ারা থেকে ও এ পথে মক্কা শরিফ আগমনকারীদের মিকাত হচ্ছে যুল হুলায়ফা। বর্তমানে এটি আবইয়ারে আলি বা বীরে আলি নামে পরিচিত। বাংলাদেশ থেকে হজ আদায় করতে যাওয়ার সময় যারা আগে মদিনায় যান, তাঁরাও হজ ও ওমরা পালনের জন্য ফুলহুলাইফা থেকে ইহরাম বাঁধেন।
৩. যাতে ইরাক
ইরাকবাসী ও সে পথে আগমনকারী হাজীদের মিকাত। এটি একটি উপত্যকা।
৪. জুহফা
মিসর ও সিরিয়াবাসী এবং সেই পথে মক্কা মোকাররমা আগমনকারীদের মিকাত। এটি রাবাগ নামক স্থানের একটি বিরান গ্রাম। রাবাগে পৌঁছে ইহরাম বাঁধলেও কোনো সমস্যা নেই।
৫. করনুল মানাজিল
এটি নজদবাসী ও সে পথে আগমনকারীদের জন্য মিকাত তথা ইহরাম বাঁধার স্থান। এটি বর্তমানে 'আস-সায়েল' নামে পরিচিত।
হেরেমের বাইরে কিছু বর্ণিত পাঁচটি মিকাতের সীমানার ভেতরে যারা বসবাস করেন যেমন জেদ্দা, বাহরা, তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী এলাকার বাসিন্দাগণ বা চাকরিরত বিদেশিগন, হজের জন্য তাদের নিজেদের ঘর থেকেই ইহরাম বাঁধা উত্তম। তারা চাইলে হেরেমের চৌহদ্দির বাইরে যে কোনো স্থান তথা সমগ্র 'হিল' থেকেও ইহরাম বাঁধতে পারেন। হেরেমের বাইরের এলাকা হলো 'হিল'। যারা হেরেমের ভেতরে বসবাস করেন তারা হজের ইহরাম হলে নিজ নিজ ঘর থেকে, আর ওমরাহর ইহরাম হলে হেরেমের সীমানার বাইরে যে কোনো স্থানে গিয়ে ইহরাম বাঁধবেন।
হজ ও ওমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে ইহরাম ব্যতীত মিকাত অতিক্রম করা জায়েজ নেই। কেউ ইহরাম ব্যতীত মিকাত অতিক্রম করলে, তাকে ইহরাম বাঁধার জন্য মিকাতে ফিরে যেতে হবে এবং সেখান থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে। যদি সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে যেখানে আছে সেখান থেকেই ইহরাম বাঁধবে। তখন তার ওপর দম বা পশু কুরবানি দিয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়া ওয়াজিব হবে।
হজ পালনের নিয়ম
জাহেলি যুগে হজ পালনের ক্ষেত্রে নানা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। যেমন তারা হজের নিয়ত করলে হজ আদায় না করা পর্যন্ত ঘরের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করাকে অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ হিসেবে বিশ্বাস করতো। তাই তারা সব সময় পেছনের দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করতো। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেসব কুসংস্কার দূর করেছেন। হজ ফরয হওয়ার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের হজের বিধান শিক্ষা দিয়েছেন। চলো এবার আমরা হজের নিয়মাবলি শিখি।
ইহরান
ইহরাম আরবি শব্দ যার অর্থ নিষিদ্ধ। ইহরাম হজের আনুষ্ঠানিক নিয়ত। নির্দিষ্ট দিনে মিকাত থেকে ইহরামের কাপড় পরিধান করে হজের নিয়ত করাকে ইহরাম বলে। ইহরাম বাঁধার সাথে সাথে হজের নিষিদ্ধ কার্যাবলি থেকে দূরে থাকতে হবে। শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখ থেকে যিলহজ মাসের নয় তারিখের মাঝে যে কোনো সময় নির্দিষ্ট মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। এর আগে বা পরে ইহরাম বাঁধলে হজ আদায় হবে না। ওযু ও গোসল করে দুই রাকাআত নফল সালাত আদায় করে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম বাঁধার সময় পুরুষের জন্য ইহরামের নির্দিষ্ট কাপড় তথা সেলাইবিহীন দুইটি চাদর পরিধান করতে হয়। নারীগণ স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করবে, তবে মুখ খোলা রাখবে। কিবলামুখী হয়ে পুরুষগণ সশব্দে আর নারীগণ নিরবে তিনবার তালবিয়ার পাঠ করবে। আর তালবিয়া হলো-
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ - لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ
إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ - لَا شَرِيكَ لَكَ
অর্থ: 'আমি আপনার সমীপে হাযির, হে আল্লাহ! আমি আপনার সমীপে হাজির। আমি আপনার সমীপে হাযির, আপনার কোনো শরীক নেই, আমি আপনার সমীপে হাজির। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা ও নিয়ামতরাজি ও রাজত্ব আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।' (বুখারি)
তারপর দরুদ পাঠ করে নিজের ইচ্ছামতো দোয়া করতে হয়। ইহরাম বাঁধার পর দোয়া করা সুন্নাত। হজ ও ওমরাহর উদ্দেশ্য ছাড়াও বহিরাগত কেউ (মক্কার বাইরে বসবাসকারী) বায়তুল্লাহ যিয়ারত করতে গেলে, তাকেও মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়।
তাওয়াফে কুদুম
তাওয়াফে কুদুম অর্থ আগমনী তাওয়াফ। মক্কার বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় প্রবেশ করে প্রথমে বায়তুল্লায় গিয়ে যে তাওয়াফ করেন, তা তাওয়াফে কুদুম বা আগমনী তাওয়াফ নামে পরিচিত। তাওয়াফে কুদুম আদায় করা সুন্নাত। মক্কায় বসবাসকারী হাজীদের তাওয়াফে কুদুম করার প্রয়োজন নেই। কারণ তারা মক্কাতেই থাকেন। যে কোনো সময় ইচ্ছা করলেই তাওয়াফ করতে পারেন। আর যারা ওমরাহ করবে, তাদেরও আলাদা করে তাওয়াফে কুদুম করার প্রয়োজন নেই। কেননা ওমরাহর তাওয়াফ, তাওয়াফে কুদুমের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গন্য হয়।
যখন কাবা শরিফ দৃষ্টিগোচর হবে, আল্লাহ আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়বে। হাজারে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করতে হয়। কোনো মুসলমানকে কষ্ট না দিয়ে যদি সম্ভব হয়, তাহলে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করবে। হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করা সম্ভব না হলে, হাজারে আসওয়াদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পড়বে। আর প্রতি চক্কর দেওয়ার সময় এভাবে হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করবে বা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়বে। আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা করবে ও রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ওপর দরূদ পাঠ করবে। হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করা সুন্নাত। আর কোনো মুসলিমকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
হাতিমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করতে হয়। প্রথম তিন চক্কর দেওয়ার সময় রমল করতে হয়। রমল অর্থ বীরদর্পে দুই কাঁধ দুলিয়ে দ্রুত চলা। রমলের সময় ভিড়ের ভেতর পড়ে গেলে দাঁড়িয়ে যাবে। আবার যখন ফাঁকা পাবে, তখন রমল করবে। অবশিষ্ট চার চক্কর স্বাভাবিক অবস্থায় চলতে হয়। তাওয়াফের সময় পুরুষের চাদর ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর রাখতে হয়। একে ইজতিবা বলে। তাওয়াফের প্রতি চক্করে রুকনে ইয়ামিনি স্পর্শ করা মুস্তাহাব। তাওয়াফ শেষে যমযম কূপের পানি পান করা মুস্তাহাব। বায়তুল্লাহমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে পানি পান করা ও শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা উত্তম।
মাকামে ইবরাহিমে সালাত আদায়
রাসুলুল্লাহ(সা.) কাবা শরিফে সাত চক্কর তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহিমের পিছনে দু'রাকাআত সালাত আদায় করেছেন। (বুখারি) তাওয়াফ নফল হলেও দু রাকাআত সালাত আদায় করা ওয়াজিব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন 'তাওয়াফকারী যেন প্রতি সাত চত্তরের পর দু'রাকাআত নামায আদায় করে।' (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা) মাকামে ইবরাহিমের যত নিকটবর্তী স্থানে সালাত আদায় করা যায়, ততই ভালো। ভিড়ের কারণে সম্ভব না হলে, হারাম শরিফের যে কোনো স্থানে নামায আদায় করা যায়। মাকামে ইবরাহিমে সালাত আদায়
সাঈ
করে দোয়া করা উত্তম। সাঈ অর্থ দৌড়াদৌড়ি করা, দ্রুত চলা, পথ অতিক্রম করা। তাওয়াফে বিদা আদায় করে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাঈ করতে হয়। সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে সাঈ শেষ করতে হয়। যখন সাফা পাহাড়ের দিকে যাওয়ার সময় বাইতুল্লাহর দিকে মুখ করে অল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলবে আর রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ওপর দরুদপাঠ করবে ও উভয় হাত উপরে উঠিয়ে দোয়া করবে। বাতনুল ওয়াদি, যা বর্তমানে সবুজ রং দ্বারা চিহ্নিত করা আছে, সেখানে দৌড়াতে হবে। ভিড়ের কারণে দৌড়ানো সম্ভব না হলে দ্রুত হাঁটতে হবে। তবে নারীরা স্বাভাবিকভাবে হেঁটে পথ অতিক্রম করবে। সাঈ করা ওয়াজিব।
নফল তাওয়াফ
এ সময় যতবার ইচ্ছা নফল তাওয়াফ করা যায়। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে নফল সাঈ করার বিধান নেই। প্রতিবার নফল তাওয়াফ করে, মাকামে ইবরাহিমে দুই রাকাআত সালাত আদায় করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) নফল তাওয়াফের ফযিলত সম্পর্কে বলেন, "তাওয়াফের প্রতি কদমে আল্লাহ তা'আলা তাওয়াফকারীর একটি গুনাহ মাফ করেন, একটি সাওয়াব লেখেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন'। (মুসনাদে আহমদ)
৭ই যিলহজ
যিলহজ মাসের সাত তারিখ যোহরের সালাতের পর হাজীগণের করণীয় সম্পর্কে ইমাম খুতবা দেন। হাজীদের উচিৎ তা যথাযথ ভাবে শুনে সে অনুযায়ী আমল করা।
৮ই যিলহজ
যিলহজের আট তারিখ সূর্যোদয়ের পর যোহর সালাতের আগে হাজীগণ মিনায় যাবেন। তবে যারা হজে তামাতু আদায় করবে, অর্থাৎ প্রথমে ওমরাহ আদায় করে ইহরাম খুলে ফেলেছে তারা এ দিন ইহরাম বাঁধবে। সুন্নাত অনুযায়ী গোসল করে ইহরামের চাদর পরিধান করে বায়তুল্লায় আসবে ও সেখানে ইহরাম বাঁধবে। তাদের জন্য মসজিদুল হারামে ইহরাম বাঁধা মুস্তাহাব। তবে হারাম শরিফের অভ্যন্তরে যে কোনো জায়গা থেকে ইহরাম বাঁধা জায়েয আছে। মিনায় যাওয়ার সময় তালবিয়া পাঠ করতে থাকবে। সেখানে আট তারিখ যোহর থেকে নয় তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা সুন্নাত।
৯ই ফিলহজ
৯ই যিলহজ ফজরের নামায আদায় করে সুর্যোদয়ের পর আরাফার ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে ও সেখানে অবস্থান করবে। কেউ যদি মিনায় না যেয়ে থাকে, তাহলে সে সরাসরি আরাফা অভিমুখে রওনা হবে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাত অনুসরণ না করার কারণে তার কাজটি মন্দ কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে। আরাফার মাঠে অনা লোকদের সাথে অবস্থান করবে। আলাদা অবস্থান করবে না, কেননা তা অহংকার প্রকাশ করে। আর জামাতের সাথে দোয়া কবুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়লে, ইমাম লোকদের নিয়ে এক আজান ও দুই ইকামতে যোহর ও আসরের সালাত যোহরের ওয়াক্তে একসাথে আদায় করবেন। আর যোহর ও আসরের মাঝে কোনো নফল সালাত আদায় করা মাকরুহ। তাই নফল সালাত আদায় করা যাবে না। সালাত আদায়ের পূর্বে ইমাম খুতবা পাঠ করবেন। খুতবায় তিনি হজের বিধিনিষেধ বর্ণনা করবেন ও মুসলিম উম্মাহর সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করবেন। মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির ওপর গুরুত্বারোপ করে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিবেন। এরপর সবাইকে সাথে নিয়ে ইমাম দোয়া করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরাফার ময়দানে দু'হাত প্রসারিত করে দোয়া করতেন। আরাফার ময়দানে অবস্থান হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরয কাজ। যে আরাফার ময়দানে ইহরাম বেঁধে অবস্থান করলো, সে হজ পেলো। যদি কোনো কারণে নয় তারিখ যোহরের সময় আরাফায় উপস্থিত হতে না পারে তাহলে নয় তারিখ দিবাগত রাতে বা সুবহে সাদিকের পূর্বে কোনো সময় কিছুক্ষণের জন্য হলেও আরাফার ময়দানে অবস্থান করলে হজ আদায় হবে। নতুবা হজ বাতিল হয়ে যাবে। আরাফার ময়দানে অবস্থানের সময় যথাসম্ভব জাবালে রহমতের নিকট কিবলামুখী হয়ে অবস্থান করবে। আর বাতনে উরানা থেকে দূরে থাকবে। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'আরাফার সব স্থানই অবস্থানস্থল। তবে বাতনে উরানা থেকে তোমরা উঠে যাও।' (মুয়াত্তা মালেক)
সূর্যাস্তের পর হাজীগণ মুযদালিফায় ফিরে আসবে ও রাত অতিবাহিত করবে। যদি সূর্যাস্তের পূর্বে আরাফার সীমানা ত্যাগ করে, তাহলে তার ওপর দম ওয়াজিব হবে। তবে ভিড় এড়ানোর জন্য সূর্যাস্তের পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে অসুবিধা নেই। মুযদালিফায় পৌঁছে ইনাম এক আজানে এক ইকামতে মাগরিব ও এশা একত্রে আদায় করবেন। তখনও দুই সালাতের মাঝে নফল আদায় করা যাবে না। কেউ আরাফায় মাগরিব আদায় করলে, সুবহে সাদিকের পূর্বে পুনরায় মাগরিব আদায় করে নিবে। ওয়াদিয়ে মুহাসসার ব্যতীত মুযদালিফার যে কোনো জায়গায় অবস্থান করতে পারবে।
১০ই যিলহজ
মুযদালিফায় রাত কাটিয়ে ফজরের ওয়াক্তের প্রথম সময়ে অন্ধকার থাকতেই ফজরের সালাত আদায় করতে হয়। তারপর ইমাম সবাইকে নিয়ে দোয়া করবেন। চারদিকে ফর্সা হয়ে গেলে সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্বে কিছুক্ষন মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব। সমগ্র মুযদালিফায় যে কোনো স্থানে অবস্থান করা জায়েয ওয়াদিয়ে মুহাসসার নামক স্থান ব্যতীত। মিনায় শয়তানের প্রতিকৃতি হিসাবে তিনটি স্তম্ভ আছে। মিনায় পৌঁছে এ দিন শুধু জামরাতুল আকাবা বা বড় শয়তানকে উদ্দেশ্য করে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করতে হয়। মুযদালিফা থেকে জামরাতে পাথর নিক্ষেপের জন্য ৭০টি পাথর কুড়িয়ে আনা মুস্তাহাব। পাথরগুলো ছোলা পরিমাণ বড় হতে হয়, যাতে অন্যকে আঘাত না করে। পাথর নিক্ষেপের পর কুরবানি করবে। যারা শুধু হজ করবেন, তাদের জন্য কুরবানি করা মুস্তাহাব। যারা হজ ও ওমরাহ আদায় করবেন তাদের জন্য শুকরিয়াস্বরূপ কুরবানি ওয়াজিব। কুরবানি করার পর মাখা মুন্ডন করে ইহরাম খুলে ফেলতে হয়। মাথা মুচন করা উত্তম। তবে মাথা মুণ্ডন না করে শুধু চুল কাটলেও হবে। চুল কাটার নিয়ম হলো অগ্রভাগ থেকে এক আঙ্গুল পরিমাণ চুল কাটবে। মেয়েদের চুলের অগ্রভাগ থেকে কিছুটা কাটতে হয়। তখন থেকে স্বাভাবিক পোশাক পরিধান করতে পারবে ও অন্যসব কিছু করতে পারবে। তবে সম্পূর্ণ হালাল হবে না।
তারপর যিলহজের ১০, ১১, ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে যে কোনো একদিন বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে হয়। এটি তাওয়াফে যিয়ারত নামে পরিচিত। তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করা ফরয। ১২ তারিখ সুর্যাস্তের পর তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করা মাকরুহ। কেউ বিলম্বে তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করলে, তার ওপর দম ওয়াজিব হবে। তাওয়াফে যিয়ারত আদায় করে, মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ তারিখ অবস্থান করবে। এ দিনগুলোতে মিনায় অবস্থান না করা মাকরুহ।
১১ ও ১২ যিলহজ প্রতিদিন দুপুরের পর মিনার প্রতিটি স্তন্ধে ৭ টি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবে। পাথর নিক্ষেপের সময় যেখানে সবাই দাঁড়ায়, সেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার ও লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়বে আর রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর ওপর দরুদপাঠ করবে ও দোয়া করবে। ১১ যিলহজ মিনার মসজিদুল খায়েফে যোহরের সালাতের পর ইমাম খুতবা দিবেন, সবার খুতবা শোনা উচিত। কেউ ১২ তারিখ পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরতে চাইলে, মক্কায় ফিরে আসবে। মিনায় থেকে গেলে ১৩ তারিখ দুপুরের পর আবার তিনটি প্রতিটি স্তম্ভে ৭টি করে ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ১৩ তারিখ মিনায় অবস্থান করেছিলেন। মিনা থেকে মক্কায় ফেরার সময় আবতাহ নামক স্থানে অবতরণ করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ (সা.) এখানে অবতরণ করেছিলেন।
ভাওয়াফে বিদা বা বিদায়ি তাওয়াফ
বহিরাগত হজ পালনকারী অর্থাৎ যারা মক্কার বাইরে থেকে হজ আদায় করতে আসেন তাদের জন্য দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাওয়াফে বিদা বা বিদায়ি তাওয়াফ আদায় করা ওয়াজিব। এর মাধ্যমে হজের কার্যাবলি আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। তবে যিলহজ মাসের ১২ তারিখের পর যে কোনো নফল তাওয়াফই বিদায়ি তাওয়াফ হিসেবে আদায় হয়ে যায়। বিদায়ি তাওয়াফ করার পরে কেউ মক্কায় অবস্থান করলে মক্কা থেকে ফিরে যাওয়ার সময় পুনরায় তাওয়াফ করা মুস্তাহাব।
বাড়ির কাজ | |
হজের ধর্মীয় তাৎপর্য | হজের সামাজিক তাৎপর্য |
গুনাহ মাফ | মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্য |
হজের কার্যাবলির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
হজ আদায়ের সময় আমরা পবিত্র কাবাঘরসহ আল্লাহর নিদর্শনাবলি প্রত্যক্ষ করতে পারি। ফলে আমাদের তাকওয়া বৃদ্ধি পায়। এছাড়া হজের প্রত্যেকটি কাজের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। চলো সে বিষয়ে জেনে নেই।
ইহরাম বাঁধা
ইহরাম অবস্থায় বান্দ্য নিজেকে আল্লাহর নিকট সমর্পণ করে। সবকিছু থেকেও ফকির মিসকিনের মতো সেলাইবিহীন দুটি চাদর পরিধান করে কাবা শরিফে উপস্থিত হয়। সবকিছু থাকলেও সে এই কাপড় ব্যতীত আর কিছুই পরিধান করতে পারে না। ফলে হাজী মৃত্যুর চিন্তা করে। মানুষ মৃত্যুর সময়ও এভাবে সব রেখে দুনিয়া থেকে চলে যাবে। এছাড়া আল্লাহ তা'আলার হুকুমের কারণে হাজী ইহরাম অবস্থায় অনেক বৈধ বিষয় থেকেও দূরে থাকে, যা তাকে হজ আদায় শেষে অবৈধ বিষয় থেকেও দূরে থাকতে সাহায্য করে। ইহরাম মানুষকে তাওবা করতে অনুপ্রাণিত করে। সে উপলব্ধি করে, পশুপাখিও আল্লাহ তা'আলার নির্ধারিত হেরেমে প্রবেশ করলে নিরাপদ থাকে। আমরা যদি আল্লাহর রহমতের দিকে ফিরে যাই, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের মাফ করবেন।
সাঈ করা
হযরত হাজেরা (আ.) পানির জন্য সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। তাই আমরা হযরত হাজেরা (আ.) এর সারণে সাঈ করি। আল্লাহ তা'আলা সাফা ও মারওয়া সম্পর্কে বলেন-
إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِن شَعَائِرِ اللَّهِ
অর্থ: 'নিশ্চয়ই 'সাফা' এবং 'মারওয়া' আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫৮)
হাজরে আসওয়াদে চুম্বন
হাজরে আসওয়াদ জান্নাতি পাথর। এটি চুম্বনের মাধ্যমে মানুষের গুনাহ মাফ হয়। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হচ্ছে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পরিপূর্ণ আনুগত্য। তাইতো হযরত ওমর (রা.) একদিন হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার সময় বলেছিলেন, 'আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। আমি মহানবি (সা.)-কে যদি তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে কখনোই চুম্বন করতাম না।' (বুখারি ও মুসলিম)
মাকামে ইবরাহিমে সালাত আদায়
আল্লাহর নবি হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে আল্লাহ তা'আলা বার বার পরীক্ষা করেছেন। প্রতিবারই তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাই আল্লাহ ইবরাহিম (আ.) এর আদর্শ গ্রহণের উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য হয়রত ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর সাথীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।' (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত: ৪) হযরত ইবরাহিম (আ.) কাবা শরিফ নির্মাণের পর আল্লাহ তা'আলার নিকট দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ তা'আলা তাঁর দোয়া কবুল করেন। তাই তাঁর সারণে আমাদেরকেও সেখানে সালাত আদায় করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা মাকামে ইবরাহিমে সালাত আদায় প্রসঙ্গে বলেন-
وَاتَّخِذُوا مِن مَّقَامِ إِبْرَهِمَ مُصَلَّى
অর্থ: 'তোমরা মাকামে ইবরাহিমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫) আমরা মাকামে ইবরাহিমে ইখলাসের সাথে দোয়া করবো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা'আলা আমাদের দোয়া কবুল করবেন।
আরাফা ও মুযদালিফায় অবস্থান
আরাফা ও মুযদালিফায় মুমিন ব্যক্তি যখন লাখ লাখ মুমিনের সাথে একত্রিত হয়, তখন তার মাঝে প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। সেখানে সবাই সমান। সবাই একই পোশাকে তালবিয়া পাঠ করতে থাকে। খোলা মাঠে এভাবে রাত কাটানোর মাধ্যমে হাজীগণের মনে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত হয়।
শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ
আল্লাহ তা'আলার আদেশে ইবরাহিম (আ.) যখন ঈসমাইল (আ)-কে কুরবানি করতে মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন শয়তান, হযরত ইবরাহিম (আ), হযরত হাজেরা (আ.) ও হযরত ঈসমাইল (আ.)-কে কুমন্ত্রণা দিতে যায়। কিন্তু প্রত্যেকে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে তাড়িয়ে দেন। তাদের স্মরণেই আমরা প্রতীকীভাবে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করি। পাথর নিক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো আমরা যাতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকতে পারি।
হজের নিষিদ্ধ কার্যাবলি
ইহরাম বাঁধার পর হাজী আল্লাহ তা'আলার নিকট নিজেকে সমর্পণ করে। তখন তার ওপর কিছু হালাল কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যেমন সালাত আদায় করার সময় তাকবিরে তাহরিমা বলে সালাত শুরু করলে, সালাত শেষ করা পর্যন্ত অন্য সকল কাজ হারাম হয়ে যায়। তেমনি ইহরাম বাঁধার পর, হজ শেষে ইহরাম খুলে ফেলার আগ পর্যন্ত কিছু কাজ করা তার জন্য হারাম হয়ে যায়। সেগুলো নিম্নরূপ:
১. অশ্লীল কথা বলা বা অশ্লীল কাজ করা।
২. ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক সকল নিষিদ্ধ কাজ বা পাপাচার, সেগুলো এমনিতেই নিষিদ্ধ। ইহরাম বাঁধা অবস্থায় সে কাজগুলো করা আরো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
৩. কারো সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
فَلَا رَفَتَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ
অর্থ: 'যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করে) তার জন্য অশ্লীল কাজ, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়া নিষিদ্ধ।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
৪. কোনো প্রাণি শিকার করা বা অন্যকে শিকার করার জন্য শিকার দেখিয়ে দেওয়া। আল্লাহ তা'আলা বলেন
يَأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَ أَنْتُمْ حُرُمٌ
অর্থ: 'হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শিকার-জন্তু হত্যা করো না।' (সুরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৫)
৫. পুরুষের জন্য সেলাই করা কাপড় পরা নিষিদ্ধ। তাই পাঞ্জাবি, পায়জামা, মোজা পরা নিষিদ্ধ। তবে কোমরে টাকার ব্যাগ বেঁধে রাখতে অসুবিধা নেই। আর মহিলারা সেলাই করা কাপড়ই পরবে।
৬. পুরুষের জন্য মাথা ও মুখ আবৃত করা নিষিদ্ধ। তাই পাগড়ি ও টুপি পরা নিষিদ্ধ। তবে মহিলারা মাথা ঢেকে রাখবে ও মুখ খোলা রাখবে।
৭. আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা বা আতর সুগন্ধি মিশ্রিত পোশাক পরা। সুগন্ধি সাবানও ব্যবহার করা যাবে না।
৮. তেল ব্যবহার করা।
৯. নখ কাটা, মাথার চুল কাটা বা দাড়ি ছাঁটা। এমনকি পশমও কাটা বা উপড়ানো যাবে না। তবে অনিচ্ছাকৃত কোনো কাজ যেমন, গোসলের সময় বা মাথা চুলকানোর সময় চুল পড়লে কোনো অসুবিধা নেই। তবে হাজীর ইহরাম অবস্থায় চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানো অনুচিত।
হজের ত্রুটি ও তা সংশোধনের উপায়
হজ পালনকালে অনিচ্ছাকৃত অনেক ভুলত্রুটি বা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে যেতে পারে। ইসলামি পরিভাষায় একে জিনায়াত বলে। এসব ত্রুটিবিচ্যুতির মধ্যে কিছু বিষয় আছে অনেক বড়, আবার কিছু বিষয় আছে ছোট। আবার কিছু বিষয় আছে যা একেবারে সাধারণ পর্যায়ের; যার কোনো প্রতিকারের প্রয়োজন নেই।
হজের সময় অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া ত্রুটি বা বিষয়গুলোর গুরুত্ব ও লঘুত্ব বিবেচনা করে কয়েকটি বিধান রয়েছে। আর তা হলো: দম, বুদনা ও সাদকা। দম একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা জবেহ করা। গরু, মহিষ বা উট হলে তার ৭ ভাগের এক ভাগ দেওয়া।
যদি কেউ হজ বা ওমরার ওয়াজিব আদায়ে ভুল করে ফেলে অথবা ইহরামের নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে ফেলে তবে তাকে দম দিতে হবে। আবার অনেক সময় একাধিক দমও দিতে হয়। কারণ ইহরাম অবস্থায় কিরান হজ পালনকারী হাজী তার ত্রুটির জন্য হজ ও ওমরা উভয়টির নিয়তের কারণে ওমরার আগেই ২টি দম দিতে হয়। কেননা কিরান হজ পালনকারী ব্যক্তি এক ইহরামেই হজ ও ওমরা পালন করেন।
অভিনয় |
আরও দেখুন...