হযরত উমর (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তিনি ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বিখ্যাত আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম খাত্তাব। তিনি কুরাইশ বংশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। আর মাতার নাম খানতামা। তিনি ছিলেন বিখ্যাত সেনাপতি হিশাম ইবন মুগিরার কন্যা। হযরত উমর (রা.) শিক্ষা-দীক্ষায় সুপরিচিত ছিলেন। তিনি কবিতা লেখায় পারদর্শী ছিলেন। কুস্তিবিদ্যায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানে হযরত উমর (রা.)-এর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সাহসী যোদ্ধা, কবি ও সুবক্তা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।
ইসলাম গ্রহণ
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে হযরত উমর (রা.) ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন। নবদীক্ষিত মুসলমানদের অমানুষিক নির্যাতন করতেন। তাঁর গৃহপরিচারিকা লুবানা ইসলাম কবুল করলে তিনি তাকেও নির্যাতন করেন। একদা তিনি তরবারি নিয়ে মহানবি (সা.) কে হত্যার জন্য ছুটলেন। পথিমধ্যে জানতে পারেন যে, তাঁর বোন ফাতিমা ও ভগ্নিপতি সাঈদ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি গতি পরিবর্তন করে বোনের বাড়িতে যান এবং বোন ও ভগ্নিপতিকে প্রচণ্ড মারতে থাকেন। তখন তারা কুরআন পাঠ করছিলেন। তাদের শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই তাঁরা ইসলাম ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। ইসলামের প্রতি তাদের দৃঢ়তা দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী পড়ছিলে? উমরের বোন জবাব দিলেন, কুরআন পড়ছিলাম। হযরত উমর (রা.) বললেন, তা আমাকে দেখাও। বোন বললেন, তুমি অপবিত্র। অপবিত্র হাতে কুরআন স্পর্শ করা যাবে না। বোনের এ কথা শুনে উমর (রা.) পবিত্র হয়ে এলেন। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা ত্বাহা ও হাদিদের আয়াতগুলো পড়লেন। মহান আল্লাহর বাণী তাঁর মনের ভিতর তোলপাড় সৃষ্টি করে দিল। তিনি ইসলাম গ্রহণের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। উমর (রা.) বললেন, নবিজি কোথায়? আমি তাঁর কাছে যাব, মুসলমান হবো। এরপর তিনি প্রিয়নবির কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। মহানবি (সা.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আবু জাহাল অথবা উমর ইবনুল খাত্তাব এ দুজনের একজনকে ইসলাম কবুল করার তাওফিক দিয়ে ইসলামকে শক্তিশালী করুন।' তাঁর ইসলাম গ্রহণ মূলত মহানবি (সা.)-এর উক্ত দোয়ারই ফল। ইসলাম গ্রহণের পর হযরত উমর (রা.) কা‘বার সামনে প্রকাশ্যে নামায আদায়ের ঘোষণা দিলেন। নবি (সা.) উমর (রা.)-এর উপর খুশি হয়ে তাঁকে ‘ফারুক’ বা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী উপাধিতে ভূষিত করলেন।
ইসলামের সেবা
হযরত উমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের শক্তি বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। তিনি নিজের ধন-সম্পদের সর্বস্ব দিয়ে ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তাবুক অভিযানে তিনি তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করা সম্ভব হয়। তিনি সকল যুদ্ধে মহানবি (সা.)-এর সাথি হয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। খেলাফতের মহান দায়িত্ব পালনকালে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের শাসন, বিচার ও অর্থ ব্যবস্থায় বহু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
চারিত্রিক গুণাবলি
হযরত উমর (রা.) ন্যায় বিচারক ছিলেন। তাঁর কাছে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, আপন-পর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। মদ্য পানের অপরাধে নিজ পুত্র আবু শাহমাকে তিনি কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন।
তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অর্ধজাহানের খলিফা হয়েও তিনি অত্যন্ত দীনহীন ও সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। তিনি সাথে কোন দেহরক্ষী রাখতেন না। বায়তুল মাল থেকে তাকে যে ভাতা দেওয়া হতো, তা-ও ছিল একেবারে নগণ্য। খাওয়া-দাওয়া করতেন একেবারে সামান্য। শুধু খেজুর ও রুটি দিয়ে আহার সম্পন্ন করতেন। খেজুর পাতার আসন ছিল তাঁর সিংহাসন।
তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল খুবই সাদাসিধে। তিনি তালিযুক্ত পোশাক পরিধান করতেন। জেরুজালেমের খ্রিষ্টান শাসকের আহ্বানে তিনি একবার সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি ও তাঁর ভৃত্য পালাবদল করে উটে আরোহণ করে জেরুজালেম পৌঁছান। উট যখন জেরুজালেম পৌঁছাল, তখন উটের পিঠে ছিল ভৃত্য আর খলিফা রশি ধরে হেঁটে আসছিলেন। তাঁর পরনে ছিল ধুলো মলিন ছিন্নবস্ত্র। খলিফার এই পোশাক ও অবস্থা দেখে খ্রিষ্টান শাসক ও অন্যান্য সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর চরিত্রে কঠোরতা ও কোমলতার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি সত্য ও ন্যায়ের ব্যাপারে যেমন ইস্পাতসম কঠিন ছিলেন, তেমনি মানুষের অভাব-অনটন ও দুঃখ-কষ্টে ছিলেন মোমের মতো নরম। তিনি সাধারণ প্রজাদের দুঃখ-কষ্ট জানার জন্য গভীর রাতে একাকি পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়াতেন। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন গভীর রাতে এক গৃহে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। তখন তিনি বায়তুল মাল থেকে নিজ কাঁধে আটার বস্তা বহন করে সেই বাড়িতে গমন করেন। শিশুদের রুটি বানিয়ে খাওয়ানোর পর তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন। তিনি বলতেন— ‘যদি ফোরাত নদীর তীরে কোনো ছাগলের বাচ্চাও মারা যায়, এ বিষয়ে আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন।’
তিনি ছিলেন গণতন্ত্রমনা ও সুশাসক। রাষ্ট্রের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে করতেন। প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি মজলিশে শূরার সাথে পরামর্শ করতেন।
তিনি ছিলেন সাম্য ও মানবতাবোধের মহান আদর্শ। তিনি শাসনব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করেছিলেন। হযরত উমর (রা.) কে একজন সাধারণ লোকের কাছেও জবাবদিহি করতে হয়েছিল। তিনি একদা জুমু'আর খুতবা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন যে ‘বায়তুল মাল থেকে প্রাপ্ত কাপড় দিয়ে কারও পুরো একটি জামা হয়নি, অথচ খলিফার গায়ে সে কাপড়ের পুরো একটি জামা দেখা যাচ্ছে। খলিফা অতিরিক্ত কাপড় কোথায় পেলেন?' তখন খলিফার পক্ষে তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ জবাব দিলেন ‘আমি আমার প্রাপ্য অংশটকু আব্বাকে দিয়েছি। তাঁর ও আমার দুটুকরা মিলিয়ে তাঁর জামা তৈরি করা হয়েছে।' মানবতার ইতিহাসে একজন শাসকের এরুপ জবাবদিহির ঘটনা সত্যি-ই বিরল। আমাদের সমাজব্যবস্থায় শাসকদের জন্য এরুপ জবাবদিহির সুযোগ করা গেলে আশা করা যায় তারাও এ আদর্শে আদর্শবান হতে পারবেন।
হযরত উমর (রা.) একজন শিক্ষানুরাগীও ছিলেন। ইসলামের খেদমতে তিনি অনেক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, কুফা, বসরাসহ যেখানেই জয়লাভ করেছেন সেখানেই শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন।
হযরত উমর (রা.) সৃষ্টিকুলের ভাষাহীন পশু-পাখি ও প্রাণীদের প্রতি অত্যন্ত দরদি ছিলেন। এরুপ পশুদের প্রতি কেউ জুলম করে কি না, এরুপ প্রাণিকুল অনাহারে থাকে কি না খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি বলতেন— ‘এরাও মহান আল্লাহর সৃষ্টি। প্রতিটি প্রাণীর প্রতি দয়া প্রকাশ করা পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ।’
মোট কথা ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। মানব চরিত্রের সকল ভালো গুণ ও মহান আদর্শের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে। আমরা তাঁর জীবনাদর্শ ভালোভাবে জানব এবং সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন গড়তে সচেষ্ট হবো।
দলগত কাজ: শিক্ষার্থীরা হযরত উমরের চরিত্রের কঠোরতা ও কোমলতা সম্পর্কে আলোচনা করবে। ইসলাম সকল কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করে— হযরত উমরের জীবনাদর্শ অবলম্বনে বিষয়টি আলোচনা করবে। |
আরও দেখুন...