রতন চন্দ্র সাহা “পার্পেলাস লি.” এর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। উক্ত প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ সম্পর্কিত বিষয়াদি তিনিই দেখাশোনা করেন। তিনি ভবিষ্যতে কত সংখ্যক কর্মী লাগবে তা নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত পদের জন্য কাজ করণীয় কী হবে তা নির্দিষ্ট করে দেন। উক্ত কাজ সম্পাদনের জন্য কী যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মীর প্রয়োজন তাও নির্ধারণ করেন। এই যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা কোথা হতে সংগ্রহ করা হবে এ জাতীয় বিষয় তিনিই চিন্তা-ভাবনা করেন। এসব কিছুর আলোকে তিনি প্রতিষ্ঠানের লোকবল সম্পর্কে কর্মপরিকল্পনা (Action Plan) তৈরির কাজও করেন। ওপরে রতন চন্দ্র সাহা যেসব কাজ সম্পাদন করছেন সেগুলোর সমন্বয় হলো মানবসম্পদ পরিকল্পনা।
হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ
পরিকল্পনা হলো প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে ভবিষ্যতে কী করা হবে তার আগাম পরিকল্পনা। এতে হিউম্যান রিসোর্সের চাহিদা ও যোগান এবং এর যথার্থ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়। মূলত হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়। এগুলো হলো—
১. প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ হিউম্যান রিসোর্স প্রয়োজন?
২. হিউম্যান রিসোর্সের উৎসগুলো কী?
৩. কাজের জন্য তাদের কী ধরনের যোগ্যতা প্রয়োজন?
৪. প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা কী ভূমিকা পালন করতে পারবে?
হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত পরিকল্পনা এবং হিউম্যান রিসোর্স কার্য প্রণালির সাথে সেতুবন্ধনের কাজ করে। আবার হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনাকে বলা হয় কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন বাছাই, প্রশিক্ষণ, কর্ম নকশা এবং কার্যবিধি প্রণয়ন করার সংক্ষিপ্ত রূপ।
জেনে রাখো হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্যবস্থাপনাবিদগণ বলেন—এস.পি. রবিন্স (S.P. Robins) এর মতে, "HRP is the process by which an organization ensures that it has the right number and kind of people at the places, at the right time capable of effectively and effeciently completing these task that will help the organization achieve its overall objectives." “হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উদ্দেশ্য ও দক্ষতা কার্যকরভাবে অর্জনের জন্য যথাসংখ্যক ও যথাযোগ্য কর্মীদের যথাসময়ে, যথাস্থানে স্থাপনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।” উইলিয়াম এফ. গ্লুয়েক (William E. Glueck) বলেছেন, "Manpower planning is the process by which management attempt to provide adequate human resource to achieve organization objectives." অর্থাৎ, “হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মানবসম্পদ সংগ্রহের চেষ্টা করে। ” |
হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার যে বিষয়গুলো পাওয়া যায় তা হলো-
• ভবিষ্যৎ কর্মীর চাহিদা নিরূপণ;
• বর্তমান হিউম্যান রিসোর্সের একটি মজুদ গড়ে তোলা;
• হিউম্যান রিসোর্সের ভবিষ্যৎ সমস্যা সম্পর্কে পূর্বানুমান করা;
• ভবিষ্যতে হিউম্যান রিসোর্সের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কর্মী চাহিদা নির্ধারণ, কর্মী নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রভৃতি।
তাই আমরা বলতে পারি, হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে এর হিউম্যান রিসোর্সকে বর্তমান অবস্থান থেকে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত হিউম্যান রিসোর্সে পরিণত করবে তা নির্ধারণ করে।
প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সকে বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত হিউম্যান রিসোর্সে পরিণত করার পরিকল্পনাকে বলে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব মূলনীতি মেনে চলতে হয়, তা হলো-
▪️প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া (Emphasis on organizational interest) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে সহজে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বার্থ বা কর্মীদের স্বার্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।
▪️দক্ষতার অগ্রাধিকার (Priority of efficiency) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় কর্মীদের দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দক্ষ কর্মীদের মূল্যায়ন করা হলে কর্মীরা আরও দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায়, কর্মী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দক্ষ ব্যক্তিরা সুযোগ পায় এমনভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
▪️দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ তৈরি (Creating long term assets ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কর্মীদেরকে দীর্ঘদিন ধরে রাখার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, দক্ষ কর্মী বাছাই, দক্ষতা বাড়ানো এবং তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এতে তারা প্রতিষ্ঠান বা কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থেকে পুরো কর্মী জীবন একই প্রতিষ্ঠানে শ্রম দেওয়ার চেষ্টা করবে।
▪️ব্যয় নিয়ন্ত্রণ (Cost control) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স সংক্রান্ত ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন, হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ, নির্বাচন, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সবক্ষেত্রে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা ও কর্মীদের সুবিধা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
▪️প্রযুক্তিগত উপযুক্ততা (Technological suitable ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় কর্মীদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ দিতে হবে বা কর্মীদের জ্ঞান ও দক্ষতা অনুযায়ী প্রযুক্তি নির্বাচন করতে হবে কিংবা কর্মীদেরকে আধুনিক প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
▪️প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি (Culture of the organization) : প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব নিয়ম, আচরণবিধি ও সংস্কৃতি থাকে। এই সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারে এমন কর্মী বাছাই ও নিয়োগের চেষ্টা করতে হবে । অর্থাৎ, কর্মী সংক্রান্ত কাজে প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
▪️মানবিকতা (Humanity) : হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদের সাথে মানবিক আচরণ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কর্মীদেরকে শুধু উৎপাদনের উপকরণ মনে করলেই হবে না। তাদের সাথে যন্ত্রের মতো আচরণ করলে চলবে না। তাদের মানবীয় দিক বিবেচনায় নিয়ে, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে কর্মীরা কাজে পূর্ণ আন্তরিক থাকবে এবং প্রতিষ্ঠানে নিবেদিত প্রাণ হয়ে শ্রম দিয়ে যাবে।
▪️আইন বিবেচনা (Considering the law) : হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ, নির্বাচন, কর্মী পরিচালনা, অবসর প্রদানসহ সবক্ষেত্রেই আইনি বিধি-বিধান রয়েছে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে এবং প্রতিষ্ঠানকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।
▪️দূরদর্শিতা (Foresight) : দেশের অবস্থা ও বিশ্ব পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার কার্যক্রমও। এজন্য আগামীতে এক্ষেত্রে দেশের পরিস্থিতি ও বিশ্বের অবস্থা কী হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। অন্যথায় কর্মীবাহিনী সম্পদের পরিবর্তে দায়ে পরিণত হবে।
▪️কর্মীদের মানসিকতা (Mentality of the employees) : একেক এলাকার লোকের মানসিকতা একেক রকম। আবার প্রতিষ্ঠানভেদেও কর্মীদের আচরণে পার্থক্য তৈরি হয়। এজন্য দেখা যায় রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মানসিকতায় ভিন্নতা নিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
▪️যোগ্যতার সর্বোচ্চ ব্যবহার (Maximum utilization of quality ) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স খাতে সর্বোচ মাত্রায় ব্যবহার করা যায় তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষায়ণের মাধ্যমে যে কাজের জন্য যে যোগ্য তাকে সে কাজেই নিয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যোগ্যতা যেন কাজে লাগানোর সুযোগ কর্মীরা পায় তার সুযোগ রাখতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, হিউম্যান রিসোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। আর এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে একজন হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজারকে তার হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত পরিকল্পনায় কর্মী চাহিদা উল্লেখ করা হয়। সেই চাহিদা অনুযায়ী যথাযথ কর্মী প্রাপ্তির জন্য হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকগণ নিয়োগ পরিকল্পনা করেন। আবার কর্মীদেরকে প্রযুক্তিগত ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়া, সম্পদের অপচয় হ্রাস, উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতি উদ্দেশ্যে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। নিচে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হলো-
▪️দক্ষতার সাথে কাজ সম্পাদন (To perform the job efficiently) : দক্ষ ও যোগ্য কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নই মূলত হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উৎপাদনকে গতিশীল রাখার জন্যও প্রয়োজন বিভিন্ন কৌশলগত পরিকল্পনা। তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের কাজ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা খুবই জরুরি।
▪️কর্মী প্রতিস্থাপন (Replacement of employee) : কর্মীরা কাজ করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে গেলে অবসরে যেতে বাধ্য হন। আবার অনেকে চাকরির যেকোনো মুহূর্তে অবসরে যান বা অন্যত্র যোগদান করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠানে পদ খালি হওয়া একটি চলমান প্রক্রিয়া। উৎপাদন যেন বাধাগ্রস্ত না হয় তার জন্য কর্মী প্রতিস্থাপনের আগাম চিন্তা করে রাখতে হয়। এতে প্রয়োজনের সময় কর্মী নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়।
▪️খরচ কমানো (To reduce cost) : প্রতিষ্ঠানে কখনো হিউম্যান রিসোর্সের ঘাটতি দেখা দেয়, কখনো হিউম্যান রিসোর্স প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি হয়। আবার খরচ যখন অতিরিক্ত বা ভারসাম্যহীন হয় তখন তা নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়। সঠিক হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার দ্বারা এ কাজগুলো সহজেই করা যায়।
▪️ দক্ষতাসম্পন্ন হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ (Recruiting skilled human resource) : নির্দিষ্ট ধরনের কাজের জন্য বিশেষ ধরনের যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। কাজের স্তরভেদে যোগ্যতা ও দক্ষতার স্তরও আলাদা হয়। এসব দক্ষতা ও যোগ্যতা নির্ণয়ে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
▪️ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন (Technological change) : ব্যবসায়কে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে প্রযুক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল রাখতে হলে প্রযুক্তির সাথে ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে খাপ খাওয়ানো প্রয়োজন। যেমন: বর্তমানে শিল্প বাণিজ্য অনেকটাই কম্পিউটার নির্ভর। এর সুবাদে উন্নত বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও অনলাইন ব্যবসায়ের প্রসার ঘটছে। তাই কীভাবে ই-বিজনেসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা বিভাগের হাতে থাকতে হবে এবং সে ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের প্রস্তুতিও নিতে হবে।
▪️ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো (To cope with change) : বিশ্বায়নের প্রভাব আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে শিল্প বাণিজ্যের ধাঁচই পাল্টে গেছে। তাই টিকে থাকার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাতে হয়। কর্মীরা যাতে সহজেই এসব পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেজন্য হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনার সাহায্যে কর্মীরা পরিবর্তনের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নেয়।
▪️ হিউম্যান রিসোর্সের অবস্থান ও চাহিদা নির্ধারণ (Determining the present condition and future demand of human resource) : বর্তমানে কতজন কর্মী কর্মরত আছে, কীভাবে প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যায় এবং ধরে রাখা যায় তার জন্য দরকার হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা । আবার ভবিষ্যতের জন্য কী পরিমাণ কর্মী প্রয়োজন তারও সঠিক ধারণা পাওয়া যায় কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, পরিকল্পনাই হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের ভিত্তি। আবার হিউম্যান রিসোর্স বিভাগের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। তাই প্রতিষ্ঠানের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনা এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স বিভাগ বর্তমান কর্মী সংক্রান্ত সব তথ্য ধারণ এবং ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করে। সঠিক হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব নয়। নিচে এর উদ্দেশ্যগুলো বর্ণনা করা হলো-
→ ভবিষ্যৎ দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা ( Assumption of future skill) : পরিবর্তিত ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে নতুন ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর প্রয়োজন হয়। এসব কর্মীর দক্ষতার বৈশিষ্ট্য কী হবে, কী পরিমাণ লোকবল দরকার হবে তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে ধারণা করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান অলনাইনে প্রচারণা চালাতে চায়। তাদের কী পরিমাণ পারদর্শী লোক (যেমন : সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, অপারেটর) দরকার হবে তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে ঠিক করা হয় ।
→ হিউম্যান রিসোর্সের কাম্য ব্যবহার (Optimum utilization of human resource) : প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্মীদের দক্ষতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য যথার্থ হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। কর্মীদের সর্বোচ্চ দক্ষতা কাজে লাগাতে হলে দরকার তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন। সঠিকভাবে কর্মীদের মূল্যায়ন করা হলেই কেবল তাদের শ্রমের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হবে। আর হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার দ্বারাই এটি সম্ভব হয়।
→ হিউম্যান রিসোর্সের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা (To ensure availability of human resource) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে পরিকল্পনা থাকলে হিউম্যান রিসোর্সের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে নতুন হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ করা যায়। আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিউম্যান রিসোর্স থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সঠিক পরিকল্পনা না থাকলে প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত জনবলের বোঝা টানতে হয়; বাড়তি খরচও গুণতে হয়। আবার কর্মী সংকট হলেও উৎপাদনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
→ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ (To control cost) : প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে খরচ একটি মুখ্য বিষয়। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উদ্দেশ্য ভেস্তে যায় শুধু অপরিকল্পিত খরচের কারণে। হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনার সব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে খাতওয়ারি খরচ বরাদ্দ করা দরকার। আয়ের সাথে ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে মুনাফা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাই খরচ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
→ হিউম্যান রিসোর্সের যোগ্যতা নির্ধারণ (To specify the qualification of human resource ) : হিউম্যান রিসোর্সের যোগ্যতা নির্ধারণে পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেমন : কীভাবে সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী চিহ্নিত করা যায়, তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী, তাদের দিয়ে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন সম্ভব কিনা— এসবই হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় নির্ণয় করা হয়।
→ প্রশিক্ষণ চাহিদা নির্ধারণ (To determine of training need): কাজের বিভিন্ন স্তরে হিউম্যান রিসোর্সের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মীর কাজের কোন স্তরে কী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার নকশা প্রণয়ন করা হয়। সাধারণ কর্মীদের প্রশিক্ষণ এক রকম হয়ে থাকে, নির্বাহীদের প্রশিক্ষণ অন্য রকম হয়ে থাকে। সুপরিকল্পিতভাবে এসব কাজ করতে না পারলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন করা যায় না।
→ পদোন্নতির নীতিমালা প্রণয়ন (To formulate promotion policies) : প্রতিষ্ঠানের সুবিধার্থে এবং কর্মীদের মূল্যায়নের লক্ষ্যে তাদের বদলি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হয়। হিউম্যান রিসোর্সের জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে কীভাবে তাদের বদলি ও পদোন্নতি দেওয়া হবে; আবার কেউ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করলে কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তার সবই হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।
→ কর্মীদের কাজের পরিপক্কতার সময় নির্ধারণ (To calculate the time required for work force to start work) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষানবিশ ও নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা কতদিনের মধ্যে কাজের জন্য উপযুক্ত হবে তার সময়ভিত্তিক নকশা প্রণয়ন করা হয়। ধারাবাহিকভাবে কর্মীর যোগ্যতা ও মান উন্নয়ন করে যথাসময়ে কর্মীদের কাজে নিয়োগ দিতে পারলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়।
তাই বলা যায়, হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার মাধ্যমে উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের চেষ্টা করা হয়। আর এই উদ্দেশ্যগুলো প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
হিউম্যান রিসোর্স (মানবসম্পদ) ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনা। এর ওপর প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবস্থা বিশ্লেষণ করে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনাই হলো হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা। হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার বিশেষ কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে এসব বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো-
▪️চাহিদার পূর্বানুমান (Forecasting needs) : পরিকল্পনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চাহিদার পূর্বানুমান। ভবিষ্যতে কী পরিমাণ কর্মী প্রয়োজন তার ওপর ভিত্তি করেই হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আর এর ভিত্তিতেই জনশক্তি নিয়োগের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
▪️খরচ নির্ধারণ (Determining cost) : হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ করার জন্য অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হবে তা পরিকল্পনায় উল্লেখ করা থাকে। এই পরিকল্পনার সব কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে ও স্বল্প খরচে করা যায় তার নির্দেশিকা উল্লেখ করা থাকে।
▪️প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উদ্দেশ্য বা মিশন (Overall purpose or mission) : প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উদ্দেশ্য বা মিশন নির্ধারণ করা হয়। আর হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনাও এই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেই প্রণয়ন করতে হয়। তাই বলা যায়, মিশন হলো এই পরিকল্পনার ভিত্তি।
▪️পরিকল্পনার বাস্তবায়ন (Implementation of plan) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠানের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ জনশক্তির চাহিদা পূরণের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়।
▪️প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য (Organizational goal) : যেকোনো পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের সাথে সম্পর্কিত থাকে। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত উদ্দেশ্য অর্জনের পরিকল্পনা। আর হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা এটি অর্জনে সাহায্য করে।
▪️হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ ও উন্নয়ন (Recruitment and development of human resource ) : প্রতিষ্ঠানে ভবিষ্যতে কী পরিমাণ জনশক্তি সংগ্রহ, প্রয়োজন এবং তাদের উন্নয়নের জন্য কী ব্যবস্থা নিতে হবে তা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় উল্লেখ করা থাকে। এসব বিষয়ের ভিত্তিতে জনশক্তি সংগ্রহ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
▪️প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি ও পরিবেশ (Organizational culture and environment) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি ও পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। উচ্চপদস্থ নির্বাহীগণ প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের সংস্কৃতি ও পরিবেশ চায় তার ওপর হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার সংস্কৃতি ও পরিবেশ নির্ভর করে।
▪️সময় ও স্থান নির্বাচন (Selection of time and place ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের কোন সময়ে, কোন স্থানে, কী পরিমাণ হিউম্যান রিসোর্স প্রয়োজন হবে তা উল্লেখ থাকে। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী সঠিক সময় ও স্থান থেকে কর্মী সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা হয়।
▪️হিউম্যান রিসোর্সের যোগ্যতা নিরূপণ (Determining the qualifications of human resource ) : হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ বা কী ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন হিউম্যান রিসোর্স প্রয়োজন হবে তা উল্লেখ করা থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সহজেই যোগ্যতাসম্পন্ন হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ করতে পারে।
▪️সাংগঠনিক পরিকল্পনা (Organizational planning) : প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক পরিকল্পনা হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে। তাই হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনাকে সাংগঠনিক পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।
▪️ মূল্যায়ন (Evaluation) : হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনার কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য হিউম্যান রিসোর্স মূল্যায়ন আবশ্যক। এর মাধ্যমে পরিকল্পনার ত্রুটি-বিচ্যুতি বের করা যায় এবং তা দূরীকরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয় ।
পরিশেষে বলা যায়, হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার ওপর প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে। একটি পরিপূর্ণ হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা জরুরি। আর এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ব্যবস্থাপকীয় সফলতা অর্জন সহজ হবে।
হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার পদ্ধতি (Methods of Human Resource Planning )
হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনা হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ কর্মী চাহিদা অনুসারে সুবিধাজনক উৎস থেকে যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কর্মসূচির সমন্বিত রূপ। হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনা পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
ক. স্বল্পকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা পদ্ধতি এবং
খ. দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা পদ্ধতি ।
নিচে এগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো—
ক. স্বল্পকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা পদ্ধতি (Methods of short term human resource planning:) স্বল্পকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা পদ্ধতি বিশেষ প্রকল্প বা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত হিউম্যান রিসোর্সের বর্তমান কাজের সাথে মিলকরণের বিষয়টি এর অন্তর্ভুক্ত। স্বল্পকালীন পরিকল্পনা দ্বারা কর্মরত হিউম্যান রিসোর্সের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। যখন হিউম্যান রিসোর্সের কাজ পরিমাপ করা যায় না তখন সমস্যা সমাধানে তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। যথা :
১. কাজ পরিবর্তন ( Change of job): কাজ পরিবর্তন করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামোর সংশোধন করা যায়। কাজ বিকেন্দ্রীকরণ, প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে হিউম্যান রিসোর্সের দক্ষতা বাড়িয়ে, হিউম্যান রিসোর্সকে অন্যত্র সরিয়ে কাজ পরিবর্তন করা যায়।
২. প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (Arrangement for training): হিউম্যান রিসোর্সের কাজের জন্য উপযুক্ত পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিলে তাদের কাজের উন্নতি ঘটে। তাই কাজের জন্য উপযুক্ত করে উন্নত অবস্থায় উন্নীত করা যায়।
৩. হিউম্যান রিসোর্স অপসারণ (Removal of human resource ) : নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হিউম্যান রিসোর্স কাজের যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে তাকে বদলি করা হয়। যদি তারপরও সমস্যা সমাধান না হয় তাহলে তাকে অপসারণ করতে হয় এবং তার জায়গায় নতুন হিউম্যান রিসোর্স নিয়োগ দেওয়া হয় ।
খ. দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা পদ্ধতি (Method of longterm human resource planning): দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবর্তন বিবেচনা করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা সাধারণত বিশ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য করা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রত্যেক হিউম্যান রিসোর্স যাতে যোগ্যতা লাভ করতে পারে সেজন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও অন্য কাজে বদলি করার ব্যবস্থাও করা হয়ে থাকে। দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা কার্যকর করতে হলে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় সেগুলো হলো-
১. সাংগঠনিক কাঠামোর পরিবেশ ও অতীত কার্যাবলি বিশ্লেষণ (Analysis of organizational environment and past activities) : প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য ও তার চাহিদা, ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা, দেশের বর্তমান অবস্থা, কলাকৌশলগত উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ ও তার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে।
২. উদ্দেশ্য নির্ধারণ (Determination of objectives): সংগৃহীত তথ্য থেকে প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি সম্প্রসারণ করা হবে নাকি সংকোচ করা হবে এই সিদ্ধান্তের ওপরই হিউম্যান রিসোর্সের পূর্বানুমান করা হয় ।
৩. চাহিদার পূর্বানুমান (Demand forecasting): বিভিন্ন বিভাগের ব্যবস্থাপকগণ তাদের বিভাগে কতজন কর্মী প্রয়োজন তা নির্ধারণ করবে। কতজন কর্মী, কোন বয়সের, কেমন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দরকার বা তাদের মধ্যে কতজন পুরুষ বা কতজন মহিলা হবে তা নির্ধারণ করে কর্মী বিভাগের নিকট চিঠি পাঠাবে 1
৪. কর্মী তালিকা (Human resource inventory): কর্মী তালিকায় বর্তমান কর্মীর সংখ্যাই শুধু প্রকাশ করা হয় না; বর্তমান ও সম্ভাব্য দক্ষ কর্মীদের শ্রেণিবিন্যাসও দেখানো হয়। এরপর তালিকা তৈরিতে চারটি ধাপ রয়েছে। যথা :
i. হিউম্যান রিসোর্সের তালিকা স্থিরকরণ;
ii. হিউম্যান রিসোর্সের প্রত্যেকের অতীতের তথ্য অনুযায়ী গুণাবলি শ্রেণিবিন্যাস করা;
iii. সেসব হিউম্যান রিসোর্সের যথাযথ মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা এবং
iv. সম্ভাবনাময় হিউম্যান রিসোর্সের পর্যালোচনা।
৫. চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান (Consistency between demand and supply): প্রতিটি বিভাগে কতজন কর্মী প্রয়োজন তা স্থির করার পর বর্তমান কর্মীর পরিমাণ বেশি বা কম হলে ব্যবস্থাপকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে, যে তারা এরূপ পরিস্থিতিতে কী করবে। হিউম্যান রিসোর্স কম হলে নতুন হিউম্যান রিসোর্স নিয়োগ আবার বেশি হলে ছাঁটাই বা দ্রুত অবসরে পাঠানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
৬. প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (Arrangement for training): যোগ্যতাসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ হিউম্যান রিসোর্স নিয়োগ করা হলেও তারা সবদিক থেকে যোগ্য নাও হতে পারে। তাই কাজে যোগদান করার পর বাস্তব অবস্থার মধ্যে তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়। কাজেই সেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে হলে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়।
৭. রেকর্ড সংরক্ষণ (keeping record): প্রতিষ্ঠানের বর্তমান হিউম্যান রিসোর্সের সংখ্যা, অবস্থা ও কাজের বিবরণী সম্পর্কে বিস্তৃত রেকর্ড রাখতে হবে। এসব তথ্য থেকে ব্যবস্থাপকগণ হিউম্যান রিসোর্সের পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে থাকেন।
৮. হিউম্যান রিসোর্সের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা (Future prospects of human resource): যেসব কর্মী নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে ভবিষ্যতে তাদের পদোন্নতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে হবে। এরূপ করতে গেলে প্রথমে হিউম্যান রিসোর্সের প্রত্যেকের দক্ষতা ও যোগ্যতার মান উল্লেখ করে একটি হিউম্যান রিসোর্স তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।
৯. কাজের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ (Job evaluation and analysis): কাজের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ হলো হিউম্যান রিসোর্সের কাজ সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য। এর অন্তর্ভুক্ত হলো কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, প্রয়োজনীয় ধাপ, চিহ্নিত দায়িত্ব প্রভৃতি। কাজের মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ।
১০. গৃহীত কর্মসূচি (Action program): হিউম্যান রিসোর্সের সংখ্যা সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনাকে কাজে রূপ দেওয়ার মানে হলো শ্রমের যোগানের বিভিন্ন উৎস নির্ধারণ করা। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যেকোনো উৎস থেকেই হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, দীর্ঘমেয়াদি না স্বল্পমেয়াদি হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিত নীতির ওপর। যথাযথ পদ্ধতিতে কর্মী সংগ্রহ ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া এবং দীর্ঘকালীন হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনায় সঠিক উপায়ে হিউম্যান রিসোর্স সংগ্রহ করা হলে তা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক। অন্যথায় প্রতিষ্ঠানটির হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে।
হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত হতে হয় সঠিক জায়গা থেকে এটি প্রণয়ন হচ্ছে কিনা এবং এই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। এই পুরো পদ্ধতিটি মূলত হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনা কৌশল। নিচে হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. পরিবেশ বিশ্লেষণ (Environmental analysis): হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার প্রথম ধাপ হলো হিউম্যান রিসোর্স পরিকল্পনার প্রেক্ষাপট জানা। ব্যবস্থাপকদের প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। প্রযুক্তি, প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক অবস্থা, শ্রমবাজার ও শ্রমনীতি, দক্ষতার প্রাপ্যতা, বেকারত্বের হার, শ্রমশক্তির বয়স ও লিঙ্গ বিভাজন প্রভৃতি বিষয় বাহ্যিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানে বর্তমান কর্মীর অবস্থা, স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা প্রভৃতি অভ্যন্তরীণ পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত।
২. হিউম্যান রিসোর্সের চাহিদা পূর্বানুমান (Forecasting human resource demand): এই ধাপে প্রতিষ্ঠানের জন্য কী পরিমাণ এবং কোন ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন হিউম্যান রিসোর্স লাগবে তার পূর্বানুমান করতে হয়। পূর্বানুমান হওয়া উচিত অতীত ও বর্তমান অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এবং ভবিষ্যতের সাংগঠনিক নির্দেশনা অনুযায়ী। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে হিউম্যান রিসোর্সের চাহিদার সমন্বয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানের হিউম্যান রিসোর্সের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়।
৩. সরবরাহ বিশ্লেষণ (Analysing supply): প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় উৎস থেকে কর্মী সংগ্রহ করতে পারে। অভ্যন্তরীণ কর্মী সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে দক্ষতা মজুদ (Skill inventories) কৌশল বলা হয়। এ পদ্ধতিতে নথিপত্র বা কম্পিউটারে কর্মীদের দক্ষতা, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। চলতি সময়ে হিউম্যান রিসোর্সের ঘাটতি মেটাতে বাহ্যিক উৎস থেকে হিউম্যান রিসোর্স সরবরাহ নিয়ে পূর্বানুমান করতে হয়।
৪. সমন্বয়সাধন ও পরিকল্পনা ( Coordination and planning): হিউম্যান রিসোর্স বা মানবসম্পদ পরিকল্পনার সর্বশেষ ধাপ হলো প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং বিকল্প অনুসারে কর্মপরিকল্পনা (Action plan) তৈরি করা। ব্যবস্থাপনা ও হিউম্যান রিসোর্স সবার কাছেই এই পরিকল্পনা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। গুরুত্ব সহকারে এই পরিকল্পনার সুবিধা ও অসুবিধা চিহ্নিত করতে হবে। মানবসম্পদ পরিকল্পনাকে আরও ছোট ছোট পরিকল্পনায় ভাগ করা যায়, যেমন- কর্মী ব্যবহার পরিকল্পনা, মূল্যায়ন পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা, হিউম্যান রিসোর্স সরবরাহ পরিকল্পনা প্রভৃতি।
পরিকল্পনাকে বলা হয় ব্যবস্থাপনার সব কাজের (সংগঠন, কর্মীসংস্থান, প্রেষণা, নির্দেশনা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ) ভিত্তি। একইভাবে হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনাতেও মানবসম্পদ পরিকল্পনা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। তাই এই পরিকল্পনা তথ্যনির্ভর ও নির্ভুল হওয়া জরুরি।
অফিস বা কারখানার দৈনিক মোট কার্য সময়কে একাধিক ভাগে বিভক্ত করে প্রতিটি ভাগের জন্য পৃথক কর্মী দিয়ে কাজ করা হলে এর একেকটি ভাগকে শিফট বলা হয়। সরকারি অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই দৈনিক আট ঘণ্টা বা তার চেয়ে কিছু বেশি। সময় খোলা থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো কাজে একজন কর্মীই অফিসের শুরু থেকে শেষ সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যথেষ্ট। তবে প্রতিষ্ঠানটি যদি ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়ে বেশি সময় খোলা থাকে, তবে একটি কাজের জন্য একজন কর্মীই যথেষ্ট নয় এবং তা আইনসম্মতও নয়। এক্ষেত্রে সময় ভাগ করে দুজন কর্মীকে নিয়োজিত করতে হবে।
এভাবে সময় ভাগ করে পৃথকভাবে কর্মীদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে কার্যক্ষেত্রে শিফট বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে কাজ করার লোক বা সেবাপ্রার্থী বেশি থাকে। সেই তুলনায় কাজ করার জায়গা বা সেবা দেওয়ার লোক কম থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে কাজ করার লোক বা সেবা প্রার্থীদেরকে একাধিক গ্রুপে ভাগ করে একেক গ্রুপকে একেক সময় কাজের সুযোগ দেওয়া হয় কিংবা সেবা প্রার্থীদেরকে সেবা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে পোশাক তৈরির কারখানায় এভাবে শিফটের ভিত্তিতে কাজ করা হয় এবং শহর এলাকার অনেক স্কুলে একাধিক শিফটে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
কিছু কাজ আছে যা কর্মীকে সশরীরে কর্মক্ষেত্রে এসে করতে হয়। আবার কিছু কাজ এমন আছে, যা কম্পিউটারভিত্তিক এবং এগুলো যেকোনো জায়গায় বসেই করা যায়। এক্ষেত্রে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হয়। অর্থাৎ, এগুলোকে অনলাইনে করা যায়। অনলাইনের কাজগুলোও সবসময় সব কর্মী একই সময়ে করতে পারে না। তাই কাজগুলোকে সময়ভিত্তিক ভাগ করে কর্মী ভাগ করে দিতে হয়। একে অনলাইন কাজের শিফট বলা যায়।
প্রতিষ্ঠানের ডেটা এন্ট্রির কাজ বা কম্পিউটারে কম্পোজের কাজ অনলাইনে করতে চাইলে যেকোনো সংখ্যক লোক বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করেও একই সময়ে করতে পারে। কিন্তু অনলাইনে মনিটরিং, অনলাইনে মজুদ ব্যবস্থাপনা, অনলাইনে টিকেটিং প্রভৃতি কাজ এভাবে সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যক কর্মী বা অপারেটরকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এজন্য ২৪ ঘণ্টা বা পুরো অফিস টাইমকে সুবিধামতো ভাগ করে একেক ভাগের জন্য পৃথক কর্মী বা কর্মীদল নির্ধারণ করতে হয়। একে অনলাইন কাজের শিফট বলা যায় । তাই বলা যায়, কাজের সময়কে একাধিক ভাগে ভাগ করে পৃথক কর্মীদের দিয়ে একেক সময়ের কাজ করানোর কৌশল হলো শিফট। আর অনলাইনে করা যায় এরূপ কাজের ক্ষেত্রে পৃথকভাবে সময় ও কর্মী বরাদ্দ দিয়ে কাজ করানোর কৌশলকে অনলাইন কাজের শিফট বলা হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক কাজ একজন কর্মীর স্বাভাবিক কর্মঘণ্টার চেয়ে অনেক বেশি সময় চলমান রাখতে হলে একজনের পর অন্য জনকে কাজে নিয়োজিত থাকতে হয়। এভাবে সময় বিভক্ত করে একাধিক ব্যক্তির কাজের সুযোগ তৈরির কৌশলই হলো শিফট। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ইউনিট একাধিক শিফটে পরিচালনা করতে হলে উক্ত ইউনিটের কাজের ধরন অনুযায়ী দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীকে দায়িত্ব দিতে হয়। এজন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় তা নিচে বর্ণনা করা হলো-
১. কাজ চিহ্নিতকরণ (Identifying the job) : কোন কাজ শিফটের ভিত্তিতে করা হবে তা ঠিক করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সব কাজ শিফটের ভিত্তিতে করার প্রয়োজন হয় না। আবার যে কাজ শিফটের ভিত্তিতে করতে হবে তাও সারাবছর শিফটের ভিত্তিতে করতে নাও হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক প্রথমে কাজ বা কাজের ইউনিট নির্ধারণ করতে হবে।
২. কার্য বিশ্লেষণ (Job analysis) : শিফটের জন্য নির্ধারিত/বাছাইকৃত ইউনিটের কাজের যাবতীয় বিষয় বিশ্লেষণ করতে হবে। অর্থাৎ উক্ত ইউনিটের কাজের ধরন, কোন ধরনের দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী প্রয়োজন প্রভৃতি বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে।
৩. কার্য সময়ের ব্যপ্তি নির্ধারণ : (Determining the working hour) : শিফটের জন্য নির্ধারিত ইউনিটের কাজ কত সময়ব্যাপী চলমান রাখতে হবে তা ঠিক করতে হবে। যদি আট ঘণ্টায় কাজ শেষ হয়ে যায় তাহলে অতিরিক্ত শিফট চালু করার প্রয়োজন হয় না। যদি ১০/১২ ঘণ্টাব্যাপী কাজ চালু রাখতে হয় তবুও অতিরিক্ত শিফট চালু করা জরুরি নয়। এক্ষেত্রে কর্মীদেরকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ওভারটাইম (Overtime) কাজ করানোর চিন্তা করা যেতে পারে। কার্য সময় আরও বেশি হলে শিফট বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়ে। এজন্য কত ঘণ্টা ইউনিটের কাজ করতে হবে তা আগে ঠিক করতে হবে।
৪. কাঙ্ক্ষিত মানের কর্মীর সংখ্যা যাচাই (Verifying the number of employees of the desired quality): শিফটের প্রয়োজন হলেই তা বাড়ানো যায় না। এজন্য প্রয়োজন কাঙ্ক্ষিত মানের কর্মী। তাই বর্ধিত শিফটের জন্য যে মানের কর্মী যত সংখ্যক লাগবে তা প্রতিষ্ঠানে আছে কিনা বা নিয়োগ দেওয়া যাবে কিনা তা যাচাই করতে হবে।
৫. কার্যসময় বিভক্তিকরণ (Dividing the job time): কাঙ্ক্ষিত মোট কর্মঘণ্টাকে এ পর্যায়ে বিভক্ত করতে হবে। অর্থাৎ শিফট কয়টি করতে হবে, কতঘন্টা করে এক শিফট কাজ করবে, সব শিফটের সময় একই রকম হবে কিনা এগুলোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাজটি বেশ সহজ। কিন্তু সেবা ও সরবরাহমূলক কাজে বিষয়টি বেশ জটিল। এজন্য পিক (Peak) আওয়ার, অফ পিক আওয়ার, প্রতিযোগীদের ও সহযোগীদের অবস্থা প্রভৃতি বিবেচনায় নিতে হবে।
৬. কর্মী বরাদ্দ (Assigning employee) : এ পর্যায়ে কাজের জন্য নির্ধারিত মানের ও যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মীদের ইউনিটসমূহে বণ্টন করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কর্মীর সংখ্যা ও কাজের পদ বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ কোথাও একজনমাত্র কর্মীকে দায়িত্বে না রাখা বরং গ্রুপে কাজ দেওয়া, সহায়ক কর্মীর ব্যবস্থা রাখা, একজনকে সবসময় একই শিফটে না রাখা প্রভৃতি ।
৭. দায়িত্ব অর্পণ (Assigining responsibility) : এ পর্যায়ে বণ্টনকৃত বা বিভিন্ন ইউনিটের কর্মীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ ইউনিটে কার কী করণীয়, কার কী ক্ষমতা তা তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে। দায়িত্ব সুস্পষ্ট না থাকলে জবাবদিহিতা নেওয়া যায় না। এজন্য প্রত্যেক শিফটের জন্য বরাদ্দকৃত কর্মীদের কাজ ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে।
সুতরাং, বেশি সময় কোনো ইউনিট চালু রাখতে হলে অতিরিক্ত শিফট চালু করতে হয়। এই শিফট চালাতে লাগে দক্ষতা সম্পন্ন কর্মী। আর উপরিউক্ত পদ্ধতিতে দক্ষতা নির্ধারণ করা যায়।
প্রতিষ্ঠানের কোনো ইউনিটের একই পর্যায়ের কর্মীদের সাপ্তাহিক বা মাসিক কাজের রুটিনকে শিডিউলিং ম্যাট্রিক্স বলা হয়। এর একদিকে কর্মীর নাম, আইডি নম্বর প্রভৃতি তথ্য উল্লেখ থাকে। অন্যদিকে তারিখ বা সময় উল্লেখ থাকে। এটি ছোট প্রতিষ্ঠানে বা অল্পসংখ্যক কর্মী থাকলে সাদা কাগজে হাতে লিখে করা যেতে পারে। এটিকে শিডিউলিং ম্যাট্রিক্স বলে। বেশি কর্মী যেখানে কাজ করে বা যেখানে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় সেখানে কম্পিউটারের এক্সেল (Excel) প্রোগ্রাম বা অন্য কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। একে শিডিউলিং সফটওয়্যার বলা হয়। এরূপ সফটওয়্যার বা ম্যাট্রিক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয় তা হলো-
→ কর্মীর সংখ্যা (Number of employees) : শিডিউলিং সফটওয়্যার তৈরি ও ব্যবহারের শুরুতেই ইউনিট বা প্রতিষ্ঠানের মোট কর্মীর সংখ্যা জানতে হবে। কোন মান/পদের কতজন কর্মী কাজে নিয়োজিত আছে তা নির্দিষ্টভাবে জানতে হবে।
→ কর্ম ঘণ্টা (Working hour) : কর্মীদের দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক কর্মঘন্টার সীমা দেশে প্রচলিত শিল্প আইন, কারখানা আইন, শ্রম আইন প্রভৃতিতে উল্লেখ আছে। এসব আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক নীতির আলোকে একজন কর্মীর দৈনিক ও সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা কত হবে তা নিশ্চিতভাবে জানতে হবে।
→ কর্ম দিবস (Working day) : কোনো প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ৫ দিন কার্য দিবস থাকে, আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ৬ দিন কর্ম দিবস থাকে। আবার একই প্রতিষ্ঠানে কোনো ইউনিটে ৫ দিন, কোনো ইউনিটে ৬ দিন কার্য দিবস থাকতে পারে। শিডিডিলিং সফটওয়্যার তৈরির আগে এ ব্যাপারে তথ্য নিতে হবে।
→ সাপ্তাহিক ছুটি (Weekly holyday ) : সপ্তাহে ছুটি কোন দিন তা খেয়াল করতে হবে। আর পুরো প্রতিষ্ঠানে একই দিনে ছুটি নাকি একেক ইউনিট একেক দিন ছুটি থাকাবে তাও নিশ্চিত হতে হবে। আবার ইউনিটের অভ্যন্তরীণ কোনো উপদল থাকলে (বিশেষত নিরাপত্তা কর্মীদের ক্ষেত্রে) তাদের সপ্তাহের গণনা কীভাবে হবে তা পূর্বেই নির্ধারণ করে নিতে হবে।
→ দৈনিক শিফটের সংখ্যা (Shift in everyday) : দিনে কয়টি শিফটে কাজ চলবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। একাধিক শিফটে কাজ চললে খেয়াল রাখতে হবে যে একজন কর্মী সবসময় একই শিফটে যেন দায়িত্ব না পায়। একেক সময়/সপ্তাহে মাসে একেক শিফটে দায়িত্ব দিতে হবে।
→ মেশিন/পদের সংখ্যা (Number of machine/post) : অপারেটিং পর্যায়ে খেয়াল রাখতে হবে কয়টি মেশিনে কাজ চলে । আর ডেস্ক জবের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে পদের সংখ্যা কতটি। একাধিক শিফট হলে মেশিন বা পদের সংখ্যা অনুযায়ী কর্মী বরাদ্দ করতে হবে।
→ পিক এবং অফ পিক আওয়ার (Peak hour and off peak hour): সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের শিফটিং সফটওয়্যার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের আগমনের সময় বিবেচনায় নিতে হবে। অর্থাৎ, কখন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা কম থাকে আর কখন বেশি থাকে তা বিবেচনায় নিয়ে শিডিউলিং ম্যাট্রিক্স তৈরি তথা কর্মীর সংখ্যা বরাদ্দ করতে হবে।
→ বিরতি (Interval) : ঘণ্টা ভিত্তিক কার্যসময় বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো কর্মীর যেন পরপর অনেক ঘণ্টা দায়িত্ব না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পর যেন বিরতি থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে।
→ উদ্বৃত্ত কর্মী (Surplus employee) : প্রতি শিফটেই যেন এক বা একাধিক কর্মী উদ্বৃত্ত থাকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। অর্থাৎ যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা বা হঠাৎ কেউ অনুপস্থিত থাকলে বা অক্ষম হয়ে পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার মতো কর্মী হাতে অতিরিক্ত রাখতে হবে।
→ অভিজ্ঞতা বিবেচনা (Considering efficiency) : প্রতি শিফটেই অধিক ও কম দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী মিলিয়ে দায়িত্ব বণ্টন করতে হবে। সব দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মীরা যেন এক সময়ে দায়িত্বে না পড়ে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
তাই বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের কাজ পরিচালনায় শিডিউলিং সফটওয়্যার বা ম্যাট্রিক্স ব্যবহার অতি দরকারি বা জরুরি বিষয়। আর এক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতি ও নির্দেশনা মেনে চলতে হয়।
আরও দেখুন...