মিসেস নাসরীন বড় চাকরি করেন । বাসা-বাড়ির কাজে তেমন সময় দিতে পারেন না । তাই তিনটা কাজের মেয়ে রেখেছেন । তারা কাজ নিয়ে প্রায়শই ঝগড়া করে । কোনো কাজ কেন হয়নি জিজ্ঞাসা করলে একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপায় । সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে কাজের মেয়েদের ঝগড়া মিটাতেই তার নাভিশ্বাস । তিনি এ সমস্যাটা তার বান্ধবী মিসেস চৌধুরীকে বললেন । বান্ধবীর পরামর্শ, প্রত্যেকের কাজ আলাদা আলাদা করে ভাগ করে দাও। কে ঘর-দোর, হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার করবে, কে কাপড়-চোপড় ধোয়া ও ঘর-দোর গুছানোর কাজ করবে এবং কে রান্নাবান্না করবে- এটা ঠিক করে দিলে দেখবে কাজও ভালো হচ্ছে, ঝগড়াও কমে গেছে । সম্ভব হলে তিনজনের মধ্যে যে একটু বয়স্ক ও অন্যদের চালাতে পারবে- তাকে অন্য দু'জনের ওপর দায়িত্বশীল করে দাও । সেক্ষেত্রে তুমি যাকে দায়িত্ব দিয়েছো তার সাথে যোগাযোগ করে কাজ সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিতে পারবে । মিসেস চৌধুরীর কথামতো কাজ করে মিসেস নাসরীন ভালো ফল পাচ্ছেন। একটা বাসা- বাড়িতে তিনজনের কাজ ভাগ করে তাদের সংগঠিত না করলে যদি সমস্যা হয় তবে যেখানে নানান মানের শত শত কর্মী কাজ করে তাদেরকে সঠিকভাবে সংগঠিত করে কাজ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিতে না পারলে সঠিকভাবে কাজ বুঝে নেয়া বা শৃঙ্খলার সাথে কাজ পরিচালনা করা কখনই সম্ভব নয় । তাই সংগঠিত করার বা সংগঠনের বেশ কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকলেই তাকে আদর্শ সংগঠন হিসেবে গণ্য করা যায় । এরূপ সংগঠনের কতিপয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. উদ্দেশ্যকেন্দ্রিকতা (Objects oriented) : প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্যকে ঘিরে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হওয়াকেই উদ্দেশ্যকেন্দ্রিকতা বলে । একটি উত্তম সংগঠনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি এমনভাবে বিন্যস্ত ও সংহত করা হয় যাতে তা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। উৎপাদনধর্মী একটি প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে সংগঠিত করা হয় একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সেভাবে সংগঠিত করলে চলে না । একটি সামরিক ও একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে একইভাবে সাজানো হয় না । তাই একটি ভালো সংগঠনে এর কার্য বিভাজন, দায়িত্ব-কর্তৃত্ব নির্ধারণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণে এর উদ্দেশ্যকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে ।
২. সহজবোধ্যতা (Easy understanding) : সহজে চেনা যায়, বোঝা যায় বা ধারণা লাভ করা যায় কোনো বিষয়ের এমন গুণকেই সহজবোধ্যতা বলে । একটি উত্তম সংগঠনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি যতদূর সম্ভব সহজবোধ্য হতে হয় । একটি সংগঠন চার্ট দেখে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরের যে কেউ যাতে এর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিভিন্ন পদ, পারস্পরিক সম্পর্ক, কর্তৃত্ব শৃঙ্খল (Chain of command) ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পেতে পারে-একটি উত্তম সংগঠনে তা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। সংগঠন জটিল হলে সেখানে আদেশ দান, যোগাযোগ, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণে সব সময়ই সমস্যা দেখা দেয় এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কার্যধারা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
৩. বিশেষায়ণের সুযোগ (Opportunity of specialization): বিশেষ কাজে কর্মীর বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনের সুযোগকেই বিশেষায়ণের সুযোগ বলে । একটা উত্তম সংগঠনে প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোকে এমনভাবে বিভাজন করা হয় যাতে বিশেষায়ণের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে । প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী যদি একটা কাজ করে তবে সে ঐ একক কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে । কিন্তু তাকে যদি একই সাথে একাধিক কাজ দেয়া হয় তবে তার পক্ষে কোনো কাজেই যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় না । তাই সংগঠনে কার্য বিভাজন এবং দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণকালে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে ।
৪. সুসংজ্ঞায়িত দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব (Well-defined responsibility and authority) : কর্তৃত্ব হলো আদেশ দানের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব হলো জবাবদিহি করার বাধ্য-বাধকতা । কোনো ব্যক্তি বা বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব কতটা— তার সুস্পষ্ট বর্ণনা ও যথাযথ অনুসরণ একটি ভালো সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । প্রতিষ্ঠান যতো বড় হয় বা এর কাজ যতো জটিল হয় ততোই সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তি নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের দায়িত্ব-কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা না হলে ভুল বোঝাবুঝি ও জটিলতা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা থাকে । তাই একজন ভালো সংগঠক তার প্রতিষ্ঠানের ওপর হতে নিচ পর্যন্ত সকল পদে কর্মরত ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করার প্রয়াস পেয়ে থাকেন ।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ (Well-balancing) : কাজের ভারে এবং দায়িত্ব-কর্তৃত্বের মাত্রায় সামঞ্জস্য বিধানের গুণকেই ভারসাম্যপূর্ণ বলে। একটি উত্তম সংগঠনকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হয়। এক্ষেত্রে বিভাগ ও উপবিভাগ এমনভাবে খোলা হয় যাতে প্রত্যেকটি বিভাগই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও একে অন্যের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে । প্রত্যেকেই পরিমিত কাজ পায় । কোনো ব্যক্তি বা বিভাগ কর্মভারগ্রস্ত আবার কারও তেমন কোনো কাজ নেই এমন অবস্থার সুযোগ উত্তম সংগঠনে থাকে না। এ ছাড়া একটি উত্তম সংগঠনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেও ভারসাম্য বজায় থাকে। অধিক কেন্দ্রীকরণ যেনো কাউকে স্বেচ্ছাচারী না করে এবং অধিক বিকেন্দ্রীকরণ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করা হয়ে থাকে ।
৬. আনুগত্য ও শৃঙ্খলা (Loyalty and discipline) : অন্যের বশ্যতা স্বীকার বা বাধ্যতার গুণকে আনুগত্য বলে । অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি মান্য করে চলা শৃঙ্খলা হিসেবে গণ্য । একটি কার্যকর সংগঠনে আনুগত্য ও শৃঙ্খলার ভাবধারা সব সময়ই বজায় থাকে । প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট থাকায় প্রত্যেকেই যার যার কাজ সম্পাদন করে । কেউ কোনোরূপ ফাঁকি দিলে সাংগঠনিক নিয়মের কারণে তা সহজেই ধরা পড়ে যায় । জবাবদিহিতা করাও দ্রুত ও সহজ হয় । ফলে কার্যক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার কোনোই সুযোগ থাকে না । প্রতিষ্ঠানে 'জোড়া-মই-শিকল' নীতি অনুসরণ করায় প্রত্যেকেই অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করে । উপর হতে নিচের দিকে পর্যায়ক্রমে কর্তৃত্বরেখা প্রবাহিত হওয়ায় প্রত্যেকেই তার ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ মান্য করতে বাধ্য থাকে । ফলে আনুগত্যহীনতার সুযোগ থাকে না ।
আরও দেখুন...