খাদ্যকে ভাঙলে বিভিন্ন ধরনের জৈব রাসায়নিক বস্তু পাওয়া যায়। খাদ্যের মধ্যে যেগুলো আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পাদন করে শরীরকে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম রাখে তাদের পুষ্টি উপাদান বা খাদ্য উপাদান বলে। এই পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের দেহে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। খাদ্যের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলো প্রধানত ছয় প্রকার। যথা—
(১) প্রোটিন
(২) কার্বোহাইড্রেট
(৩) ফ্যাট
(৪) ভিটামিন
(৫) ধাতব লবণ
(৬) পানি
এগুলো আমাদের শরীর গঠন, রক্ষণাবেক্ষণ ও তাপশক্তি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত ছয়টি পুষ্টি উপাদানের প্রতিটিই আমাদের দেহে একাধিক কাজ করে থাকে। আমরা এই ছয়টি পুষ্টি উপাদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রোটিন
‘প্রোটিন' শব্দটা গ্রিক শব্দ প্রোটিওজ থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো সর্বপ্রথম অবস্থান। যেখানেই প্রাণের অস্তিত্ব সেখানেই থাকে প্রোটিন। তাই প্রোটিন ছাড়া কোনো প্রাণির অস্তিত্ব কল্পনা করা সম্ভব না। প্রাণি এবং উদ্ভিজ জগতে প্রোটিন একটা প্রধান অংশ। এজন্য প্রোটিনকে মূখ্য উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রোটিনের গঠন সব প্রোটিনই কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন নিয়ে গঠিত। কোনো
কোনো ক্ষেত্রে সালফার, ফসফরাস, লৌহ ইত্যাদি মৌলিক পদার্থ যুক্ত থাকে। প্রোটিনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে
ভাঙলে প্রথমে অ্যামাইনো এসিড এবং পরে কার্বন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায় ৷
অ্যামাইনো এসিড – বড় আকারের এক একটা প্রোটিনকে আর্দ্র বিশ্লেষিত করলে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসিড অণু পাওয়া যায়। এদের প্রত্যেকটা অণুতে কমপক্ষে একটা অ্যামাইনো দল (–NH2) ও একটা কার্বক্সিল দল (–CooH) বিদ্যমান থাকে। এদের অ্যামাইনো এসিড বলে। অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে এদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা— অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড ও অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড।
অ্যামাইনো এসিড
অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড
অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড
ক) অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড – কতোগুলো অ্যামাইনো এসিড আমাদের শরীরে তৈরি হয় না ফলে এই অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজন মিটানোর জন্য খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। এই সমস্ত অ্যামাইনো এসিডকে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড বলে।
খ) অনাবশ্যক আমাইনো এসিড -কতোগুলো অ্যামাইনো এসিড আমাদের শরীরে তৈরি হয় ফলে এই অ্যামাইনো এসিডগুলোর প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ না করলেও কোনো সমস্যা হয় না। ওই সমস্ত অ্যামাইনো এসিডকে অনাবশ্যক অ্যামাইনো এসিড বলে।
প্রোটিনের শ্রেণি বিভাগ
(ক) উৎস অনুযায়ী শ্রেণি বিভাগ -
উৎস অনুযায়ী প্রোটিনকে ২ ভাগে ভাগ করা যায় (১) প্রাণিজ প্রোটিন – যে প্রোটিনগুলো প্রাণিজগৎ থেকে পাওয়া যায় তাকে প্রাণিজ প্রোটিন বলে। যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিন।
(২) উদ্ভিজ্জ প্রোটিন - উদ্ভিজ জগৎ থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনকে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন বলে। যেমন- ডাল, বাদাম, সয়াবিন, সিমের বিচি ইত্যাদি খাদ্যের উদ্ভিজ্জ প্রোটিন।
(খ) অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস - অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডের পরিমানের ওপর ভিত্তি করে ৩ শ্রেণিতে ভাগ করা হয় ।
(১) সম্পূর্ণ বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন – যে সব প্রোটিনে অত্যাবশকীয় অ্যামাইনো এসিডগুলো দেহের প্রোটিন - গঠনের উপযোগী অনুপাতে বর্তমান থাকে সেই প্রোটিনকে সম্পূর্ণ প্রোটিন বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন বলে। মাছ, মাংস ইত্যাদি প্রাণিজ প্রোটিনে অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো এসিডগুলো দেহের প্রোটিন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে বর্তমান থাকে। এই জন্য এই প্রাণিজ প্রোটিনগুলো সম্পূর্ণ বা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন।
(২) আংশিক পূর্ণ বা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন – কোনো কোনো প্রোটিনে একটা বা দুইটা অত্যাবশ্যক অ্যামাইনো - এসিড দেহ গঠনের জন্য উপযোগী অনুপাতে থাকে না ফলে দেহের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এই সব প্রোটিনকে কম উপযোগী বা আংশিক পূর্ণ বা দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন বলে। যেমন—চাল, ডাল, আটা, বাদাম, আলু ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্ভিদজাত প্রোটিনে অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডগুলো কম পরিমাণে থাকে। যেমন- ডালে মেথিওনিন, চালে লাইসিনের পরিমাণ কম থাকে ।
(৩) অসম্পূর্ণ বা তৃতীয় শ্রেণির প্রোটিন- যে প্রোটিনে দেহের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় সকল অ্যামাইনো এসিডগুলো পরিমিত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে না সেগুলোকে অসম্পূর্ণ প্রোটিন বলে। যেমন— ভূট্টার প্রোটিন জেইন (Zein)।
প্রোটিনের উৎস-
প্রাণিজ প্রোটিন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পনির, ছানা ইত্যাদি ।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন – বিভিন্ন ধরনের ডাল, সয়াবিন, বাদাম, চাল, গম ইত্যাদিতে প্রোটিন পাওয়া যায় ।
প্রোটিনের কাজ
১। দেহ গঠন ও বৃদ্ধি সাধন - প্রোটিনের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে দেহ কোষের গঠন ও বৃদ্ধি সাধন করা আমাদের দেহের অস্থি, পেশি, বিভিন্ন দেহযন্ত্র, রক্ত কণিকা হতে শুরু করে দাঁত, চুল, নখ পর্যন্ত প্রোটিন দিয়ে তৈরি।
২। ক্ষয় পূরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আমাদের কোষগুলি প্রতিনিয়তই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এই ক্ষয়প্রাপ্ত স্থানে - নতুন কোষ গঠন করে ক্ষয়পূরণের কাজ করে প্রোটিন। কোনো ক্ষতস্থান সারাতেও প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে।
৩। তাপশক্তি উৎপাদন -১ গ্রাম প্রোটিন থেকে ৪ কিলোক্যালরি শক্তি উৎপন্ন হয়। যখন দেহে ফ্যাট ও - কার্বোহাইড্রেটের ঘাটতি থাকে তখন প্রোটিন তাপ উৎপাদনের কাজ করে থাকে।
৪। দেহের রোগ প্রতিরোধক শক্তি অর্জন - বাইরের বিভিন্ন রোগজীবাণু নানা ভাবে আমাদের দেহে প্রবেশ করে নানা রকমের রোগব্যাধি জন্মাতে পারে। এইসব রোগ-জীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য দেহে তাদের বিরোধী পদার্থ বা এন্টিবডি তৈরি করা প্রোটিনের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ।
৫। মনন শক্তির বিকাশ - মানসিক বিকাশেও প্রোটিন অপরিহার্য। মানসিক বিকাশ বা মস্তিস্কের বিকাশের - সময় প্রোটিনের অভাব হলে বুদ্ধির বিকাশ ব্যহত হয়।
৬। দেহাভ্যন্তরের কাজ নিয়ন্ত্রণ – প্রোটিন দিয়ে তৈরি এনজাইম, হরমোন, ইত্যাদি দেহাভ্যন্তরের বিভিন্ন
কাজকর্ম সুপরিচালিত করে থাকে।
৭। প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবহন করে- রক্তের প্রোটিন হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রেরণ করে।
৮। দেহে পানির সমতা রক্ষা করে- প্লাজমা বা রক্তের প্রোটিন দেহে পানির সমতা বজায় রাখে ।
অভাবজনিত লক্ষণ—
শিশুর খাদ্যে প্রোটিনের অভাব হলে-
দেহের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় । ওজন কমে যায় ৷
•চামড়া খসখসে হয়।
• চুলের রং ফ্যাকাশে হয় ।
মেজাজ খিটখিটে হয় ।
• মানসিক বিকাশ পিছিয়ে পড়ে।
প্রোটিনের ঘাটতিতে এনজাইমের সংশ্লেষণ কমে যায়
• খাদ্য ঠিকমতো পরিপাক হয় না, বদহজম হয়।
রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যায়।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই লক্ষণগুলো দেখা দেয়, যাকে প্রাক– কোয়াশিয়রকর অবস্থা বলে
যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে শিশুর উপরের লক্ষণগুলের পাশাপাশি হাত-পা ফুলে যায়, মুখে পানি আসে এই অবস্থাকে কোয়াশিয়রকর বলা হয়। সাধারণত ১-৪ বছরের শিশুরাই এর শিকার হয় ৷
এ ছাড়া প্রোটিন ও ক্যালরি উভয়েরই অভাব হলে ম্যারাসমাস দেখা যায়। এই ক্ষেত্রে শিশুর শরীর খুবই শুকিয়ে যায়। বৃদ্ধদের মতো চেহারা হয় ও বর্ধন ব্যাহত হয়।
প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের অভাব -
কাজ – আমাদের দেহে প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা কর।
আরও দেখুন...