আমাদের সমাজে পেশা বিষয়ে সাধারণ ধারণা খুবই সাদামাটা ধরনের। আমাদের ভোটার তালিকা বা নাগরিকত্ব সনদের ফর্ম পূরণকালে পেশা হিসেবে কৃষিকাজ, চাকরি এমনকি ছাত্র পর্যন্ত লেখা হয়ে থাকে । তাই পেশা কী এ নিয়ে ভুল ধারণা যেমনি রয়েছে তেমনি ব্যবস্থাপনাকে ভিন্ন পেশা হিসেবে দেখা উচিত কি না তা নিয়েও শিক্ষিত মহলে দ্বন্দ্ব বর্তমান। তবে এক কথায় বলা যায়, ব্যবস্থাপনা এখনও পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে গণ্য নয় ।
বিশেষায়িত জ্ঞান সম্বলিত কোনো কাজ বা বৃত্তিকে সাধারণ অর্থে পেশা বলে । বিশেষায়িত জ্ঞান বলতে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানকে বুঝায় । একজন সাধারণ কৃষকের কৃষি বিষয়ক তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকে না । কৃষিকাজ করতে করতে তিনি যা শিখেছেন তা নিঃসন্দেহে মূল্যবান কিন্তু তাকে পেশার মানদণ্ডে ফেলা যাবে না । কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা গ্রাজ্যুয়েট কৃষি বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানসমৃদ্ধ । এই জ্ঞানের প্রয়োগ বিষয়ে তিনি পড়াকালীন সময়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ! তাই তাকে একজন কৃষিবিদ বলা হয়। একজন হাতুড়ে ডাক্তারকেও গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ডাক্তার বলে। কিন্তু যখন কারও পেশা ডাক্তারি বলা হবে তখন ডাক্তারি বিদ্যার ওপর তাত্ত্বিক জ্ঞান বা ডিগ্রি আছে কি না তা দেখতে হবে । এক্ষেত্রে কৃষিবিদ ও ডাক্তারের জ্ঞানকে বিশেষায়িত জ্ঞান বলা হবে । কারণ তাঁরা এ বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন । এভাবে ইঞ্জিনিয়ার, আইনবিদ, চাটার্ড একাউন্টেন্ট ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গও স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী । এরূপ ব্যক্তিবর্গের রাষ্ট্রস্বীকৃত সংঘ বা সমিতি রয়েছে এবং এর সকল সদস্যদের এর সদস্যপদ গ্রহণ করতে হয় । তাদের পেশাগত আচরণ বিধি ও নিয়ম-নির্দেশিকা থাকে এবং যার প্রতি সদস্যগণ দায়বদ্ধ থাকেন । তাই এরূপ জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিবর্গের কাজকে পেশা হিসেবে গণ্য করা হয় ।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনো কাজ বা বৃত্তিকে পেশা হতে হলে তার নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য:
১. পেশা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুস্পষ্ট বিশেষায়িত জ্ঞান;
২. পেশাগত বিষয় দেখার জন্য রাষ্ট্র স্বীকৃত প্রতিনিধিমূলক সংঘ বা সংস্থা;
৩. পেশার প্রমাণ হিসেবে উক্ত সংঘ বা সংস্থার সদস্য পদ লাভ ;
৪. পেশাগত আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সংঘ বা সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত বিধি-বিধানের উপস্থিতি;
৫. উক্ত বিধি-বিধান মেনে চলার প্রতি সদস্যদের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং
৬. সদস্যবৃন্দের পরামর্শ প্রদানের সক্ষমতা ও ক্ষেত্র বিশেষে পরামর্শক শ্রেণির আবির্ভাব ।
ব্যবস্থাপনা একটি পেশা কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এক্ষেত্রে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলির বিদ্যমানত মূল্যায়ন প্রয়োজন । এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ব্যবস্থাপনার মিল থাকলেও কতকগুলো ক্ষেত্রে অমিল বিদ্যমান । নিম্নে সামঞ্জস্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. সুসংবদ্ধ জ্ঞানের প্রসার (Expansion of organized knowledge) : বর্তমানকালে বিশ্বজুড়েই ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়া হচ্ছে । সারা বিশ্বেই B.B.A ও M.B.A কোর্স এখন খুবই জনপ্রিয় । বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স প্রদান করছে । এ বিষয়ে গবেষণাকর্ম চলছে সারা বিশ্বজুড়েই । তাই ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র হিসেবে বর্তমানে সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত ।
২. বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা সংঘ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা (Establishment of different management association) : উন্নত দেশসমূহে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিভিন্ন সংঘ ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করছে । যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন, ন্যাশনাল অফিস ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন, আমেরিকান ব্যাংকার
এসোসিয়েশনের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য । শুধুমাত্র ব্যবস্থাপক বা নির্বাহীগণই এর সদস্য হতে পারেন ।
৩. ব্যবস্থাপকীয় পরামর্শক শ্রেণির আবির্ভাব (Emergence of management consultants) : শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী পদে কর্মরত ছিলেন এমন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ অনেকেই ব্যবস্থাপকীয় পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। এ ধরনের নিয়োগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞানের বিশেষত্ব বা মর্যাদাই তুলে ধরেছে ।
উপরোক্ত যুক্তিসমূহের মধ্যে অনেকটা সারবত্তা থাকলেও পরিশেষে বলা যায়, ব্যবস্থাপনা এখনও ডাক্তারি বা প্রকৌশলী পেশার ন্যায় বিশেষ পেশার মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়নি । ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবস্থাপনাকে পেশার মর্যাদায় নিয়ে যাওয়ার সক্রিয় প্রয়াস লক্ষণীয় হলেও বাস্তব অর্থে এখনও ব্যবস্থাপনা সে মর্যাদা লাভ করতে পারেনি । তবে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রভাব যেভাবে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে একদিন তা পেশার মর্যাদা লাভে সমর্থ হবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় ।
আরও দেখুন...