কোন বন্যপ্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে বিরুপ্ত?

Created: 2 years ago | Updated: 8 months ago
Updated: 8 months ago

বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীঃ

১. ঘড়িয়াল। বৈজ্ঞানিক নাম: Gavialis gangeticus Gmelin, 1789 লম্বাটে ও সরু ভুন্ডবিশিষ্ট কুমিরজাতীয় সরিসৃপ। উভয় চোয়াল সামনের দিকে প্রসারিত হয়ে তুন্ডের সৃষ্টি করেছে। তুন্ডের অগ্রপ্রান্ত মোটা ও ভোঁতা (পুরুষ ঘড়িয়ালের তুন্ডের শীর্ষভাগ কলাসাকৃতির। এটাকে 'ঘট' বা 'ঘড়া' বলে। ঘড়া থেকে এর নাম হয়েছে ঘড়িয়াল। তুন্ডের প্রতিপাশে এক ডজনের বেশি ধারালোও চোখা দাঁত থাকে। লেজ সুগঠিত ও দুপাশে চাপা। এদের অগ্র ও পশ্চাৎদের আঙ্গুল আংশিক লিপ্তপাদ । ঘড়িয়াল শান্ত প্রকৃতির প্রাণী। বিরক্ত না করলে সারাদিন নদীর পাড়ে বালিতে রোদ পোহায়। মাছখেকো, ভাল সাঁতারু, ডাঙ্গায় ভাল হাটতে পারে না। কিন্তু শুকনো মৌসুমে (ফাল্গুন-চৈত্র) নদীর পানি কমে গেলে বালিতে গর্ত খুঁড়ে ৪০-৫০টি ডিম পাড়ে। প্রায় ৩ মাস পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মাছ সমৃদ্ধ নদ-নদীতে বিশেষ করে পদ্মা ও যমুনা নদীর অংশবিশেষে এরা বিস্তৃত।

 ২. মিঠাপানির কুমির। বৈজ্ঞানিক নাম : Crocodylus palustris Lesson, 1768 খাটো ও চওড়া তুন্ডবিশিষ্ট, শত্রু চর্মে আবৃত, মাঝারি আকৃতির (৩-৪ মিটার লম্বা) কুমির। শিশু বয়সে তামাটে বা বাদামী রঙের এবং গাঢ় আড়াআড়ি ব্যান্ডযুক্ত। লেজে কালো ব্যান্ড থাকে। পরিণত কুমিরে ব্যান্ড অদৃশ্য হয়ে যায়, গায়ের রং হয় ধুসর থেকে বাদামী, তলদেশ সাদাটে বা হলদে। বুকে ও পেটে বর্ম থাকে না। লেজে দুসারি খাড়া আঁইশ উপর দিকে একীভূত হয়ে একটি একক সারি নির্মাণ করে শীর্ষ পর্যন্ত পৌঁছে। তরুণ কুমির কাঁকড়া, চিংড়ি, বিভিন্ন পোকা, শামুক-ঝিনুক, ছোট মাছ ইত্যাদি, এমনকি নিজ প্রজাতির সদস্যকেও alis ধরে খায়। পরিণত বয়সে বড় বড় মাছ, উভচর, সরিসৃপ (প্রধানত সাপ ও কচ্ছপ), জলচর পাখি, পানির কাছে পাওয়া যায় এমন স্তন্যপায়ী (যেমন- বানর, হরিণ, মোষ) শিকার করে। ছয় বছরেই জননক্ষম হয়ে উঠে। শীতকাল হচ্ছে জনন ঋতু। বসতির ঢালু তীরে গর্ত খুঁড়ে ২৫-৩০টি ডিম পাড়ে, ওগুলো পাহাড়া দেয় এবং ডিম ফুটলে শাবকগুলোকে মুখে নিয়ে পানিতে ছাড়ে। কুমির মিঠাপানির নদী, হ্রদ ও জলাশয়ে বাস করে। মানুষের নির্মিত জলাধার, নালা ও পুকুর-দিঘীতেও বাস করে। কখনওবা উপকূলীয় মোহনায়ও পাওয়া যায়। পাঁচ মিটারের বেশি গভীর নয় এমন অগভীর জলাশয় এদের পছন্দ,স্রোতস্বীনি নদীও অপছন্দ ।

৩. রাজশকুন, বৈজ্ঞানিক নাম: Sarcogyps calvus Scopoli, 1786 মাথা, গলা, উরু ও পা হলদে-লাল। পালকের রং কালো, তাই দেখতে কালো। ঘাড়ের নিচে ও উরুর উপর দিকে সাদা দাগ। ওড়ার সময় ডানার নিচে সুস্পষ্ট সাদা ফোঁটা দেখা যায়। ঠোঁট কালচে-বাদামি, নিচের ঠোঁটের গোড়া হলদে এবং ঘাড়ে লাল ঝুলন্ত লতিকা । রাজশকুন লম্বায় ৮৪ সেন্টিমিটার (২.৭৫ ফুট)। এরা একা কিংবা জোড়ায় থাকে উঁচুগাছে। শান্ত স্বভাবের শকুন। প্রধান খাবার গলিত শব। খরকুটো, লতাপাতা দিয়ে ছোট মাচার মতো বাসা বানিয়ে ডিসেম্বর এপ্রিলের মধ্যে একটি মাত্র সাদা রংয়ের ডিম পাড়ে। এদের বসতি মানববসতির কাছাকাছি আম, বট প্রভৃতি গাছে এক সময় গলিত শবকে ঘিরে থাকা অন্য প্রজাতির শকুনের সঙ্গে একটি করে রাজশকুন দেখা যেত। এখন প্রায় বিলুপ্ত বলা যেতে পারে। মাঝে-মধ্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বাইরে এ শকুন ভুটান, কম্বোডিয়া, চায়না, ইন্ডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে পাওয়া যায়। এদের সংকটের প্রধানতম কারণ হচ্ছে গবাদিপশুর রোগ নিরাময়ে ডাইক্রোফেনাক জাতীয় একটি ওষুধের প্রয়োগ । ওসব পশু যখন মারা যায় আর সেখানে যেখানে ফেলা হয় সেগুলো খেয়ে শকুন বন্ধীয় জটিলতায় ভুগে মারা যায়।

৪. নীল গাই। বৈজ্ঞানিক নাম : Boselaphus tragocamelus Pallas, 1766 নীলগাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় এশীয় অ্যান্টিলোপ। পুরুষ সদস্যের উচ্চতা সাধারণত ১৩০-১৪০ সে.মি. (৫২-৫৬ইঞ্চি), স্ত্রী নীলগাই আকারে একটু ছোট হয়। দেখতে অনেকটা বিদঘুটে চেহারার ঘোড়ার মতো। লেজের দিক কাঁধ থেকে উঁচু, কারণ সামনের পা পেছনের পায়ের চেয়ে লম্বা; ঘাড়ে কুঁচির মতো গাঢ় লোম, লেজের ডগায় একগোছা চুল; পুরুষ সদস্যের গায়ের রং ধুসর, খুরের উপরের লোম সাদা এবং প্রত্যেক গালে চোখের নিচে ও পেছনে দুটি সাদা চোপ, ঠোঁট, খুঁতনি, কানের ভেতরের দিক ও লেজের নিচের তল সাদাটে; পুরুষেরই শুধু শিং হয়, শিং দুটি মসৃণ ছোট কোণাকার ও সামনের দিকে সামান্য বাঁকানো; শিংয়ের গোড়া ত্রিকোণা, ডগা বৃত্তাকার; এবং স্ত্রী নীলগাই ও বাচ্চা লালচে-বাদামী রংয়ের কিন্তু বয়স্ক পুরুষ প্রায় কালো। নীলগাই ছোট ছোট পাহাড়ে এবং ঝুপী জঙ্গলপূর্ণ মাঠে চরতে ভালবাসে, ঘন জঙ্গল এড়িয়ে চলে। গাছে ঢাকা উঁচু- নিচু সমতলে বা তৃণভূমিতে যেমনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে তেমনি আবার হুট করে শস্যক্ষেতে নেমে ব্যাপক ক্ষতি করতেও পটু। সকাল আর বিকেলে খাওয়ার পাট চুকিয়ে দিনের বাকি সময়টা গাছের ছায়ায় বসে কাটায়। মহুয়া গাছের রসালো ফুল নীলগাইয়ের দারুণ পছন্দ। এ ফুল যখন ফোটে তখন আকৃষ্ট হয়ে আরও অনেক জন্তুই গাছের নিচে এসে হাজির হয় পানি ছাড়া নীলগাই দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়, এমনকি গরমের দিনেও ওরা নিয়মিত পানি খায় না। আত্মরক্ষার প্রধান উপায় হচ্ছে দৌড়ে পালানো। দ্রুতগামী ও শক্তিশালী ঘোড়ার পিঠে না চড়ে নীলগাই ধরা প্রায় অসম্ভব। গন্ডারের মতো নীলগাই ও এক নির্দিষ্ট জায়গায় মলত্যাগ করে, উঁচু ঢিবি বানিয়ে ফেলে। এ অভ্যাসের ফলে নানান জায়গায় ছড়িয়ে থাকা সদস্যদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের পর্বটাও সম্পন্ন হয়। চার থেকে দশ সদস্যের দল নিয়ে নীলগাই ঘুরে বেড়ায়। শিশু, যুবা, বৃদ্ধ সবাই এক সঙ্গে থাকে।

৫. শুশুক। বৈজ্ঞানিক নাম : Platanista gangetica Roxburgh, 1801

পূর্ণবয়স্ক শুশুকের দেহের দৈর্ঘ্য ১.৫-২.৫ মিটার পর্যন্ত, ওজন প্রায় ৭০-৯০ কেজি। দেহের আকৃতি টর্পেডোর মতো। স্ত্রী ডলফিন আকারে পুরুষের চেয়ে বড়। গাঙ্গেয় শুশুক একটি লম্বা চঞ্চু, স্থূল শরীর, গোল পেট ও বড় স্লিপার বিশিষ্ট জলচর স্তন্যপায়ী। চোখে লেন্স নেই বলে একে অন্ধ শুশুকও বলে। চোখ দর্শন কাজের চেয়ে দিক নির্ণয়ের কাজে লাগে। গায়ের রং ধূসর বাদামী, তলদেশ কখনওবা গোলাপী রংয়ের। এদের বসতি মিঠা পানির নদী ও হ্রদ। বাংলাদেশের সমতল জুড়ে প্রবাহিত নদীতে যেমনি পাওয়া যায়, তেমনি চট্টগ্রামের মতো পাহাড়ি অঞ্চলের কর্ণফুলি ও হালদা নদীতেও পাওয়া যায়। ঘূর্ণি পানি, সাপিল নদী সবখানে এরা বাস করে। শুশুক বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সাঙ্গু, কর্ণফুলি, হালদা নদীর শাখা-প্রশাখায় পাওয়া যায় । বুড়িগঙ্গ নদীতে এক সময় অনেক ডলফিন ছিল। ধারণা করা হয়ে থাকে, সারা পৃথিবীতে এ প্রজাতির সদস্য সংখ্যা ৪০০০-৫০০০টি হতে পারে। বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্ডিয়া, নেপাল ও পাকিস্তানে শুশুক বিস্তৃত ।

Content added By
Promotion