ইউক্যারিওটিক (প্রকৃত) কোষের সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত সবচেয়ে গাঢ়, অস্বচ্ছ, ঝিল্লীবেষ্টিত গোলাকার বা উপবৃত্তাকার অংশটি নিউক্লিয়াস (বা প্রাণকেন্দ্র) নামে পরিচিত । নিউক্লিয়াস কোষের অপরিহার্য অংশ। উচি * পরিণত সীভ কোষ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর লোহিত কণিকা ছাড়া সমস্ত প্রকৃত কোষে নিউক্লিয়াস থাকে। আবিষ্কার : ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন (Robert Brown) ১৮৩১ সালে রাষ্ট্রার (একপ্রকার অর্কিড) পাতার কোষ পরীক্ষা করার সময় নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন।। ল্যাটিন শব্দ "Nux-nut" থেকে Nucleus নামের উৎপত্তি।
সংখ্যা ও আকারঃ সাধারণত প্রতিকোষে একটি নিউক্লিয়াস থাকে। Vaucheria, Botrydium, Sphaeroplea প্রভৃতি শৈবাল এবং Penicillinula এই কতিপয় ছত্রাক কোষে বহুসংখ্যক নিউক্লিয়াস দেখা যায়। বহু "নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট এ ধরনের কোষকে সিনোসাইট ব (cocnocyte) বলা হয়। মেরুদণ্ডী প্রাণীর অস্থিকোষেও বহু নিউক্লিয়াস থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিউক্লিয়াস গোলাকার, কোন ক্ষেত্রে উপবৃত্তাকার, চাকুতি-সদৃশ অথবা শাখান্বিত নিউক্লিয়াসও দেখা যায়। শ্বেত রক্তকণিকার নিউক্লিয়াসের কোন নির্দিষ্ট আকার থাকে না। আদি কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে না।
অবস্থান ও আয়তনঃ নিউক্লিয়াস সাধারণত কোষের মাঝখানে অবস্থান করে। কিন্তু কোষ গহ্বর বড় হলে নিউক্লিয়াস গহ্বরের একপাশে চলে আসে। কোষভেদে নিউক্লিয়াসের আয়তন ছোট বড় হতে পারে। সাধারণত একটি কোষে সামগ্রিক আয়তনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে থাকে তার নিউক্লিয়াস।
গঠনঃ নিউক্লিয়াসের রাসায়নিক উপাদান প্রধানত প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড। প্রোটিনগুলো হিস্টোন ও প্রোটামি জাতীয় প্রোটিন। নিউক্লিক এসিডগুলো ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা DNA ও সামান্য পরিমাণ রাইবোনিউক্লিক এসিড বা RNA এছাড়া কিছু সংখ্যক কো-এনজাইম, কো-ফ্যাক্টর, এসিটাইল-CoA ও বিভিন্ন ধরনের ফসফেট এবং কয়েক প্রকার খনিজলবণ সহযোগে নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। নিউক্লিয়াসের ভৌত গঠন পরীক্ষার প্রকৃষ্ট সময় হচ্ছে কোষ বিভাজনের পূর্ব মুহূর্ত । কোষ বিভাজনের পূর্ব মুহূর্তে ইন্টারফেজ ধাপে নিউক্লিয়াসে নিচে বর্ণিত চারটি প্রধান অংশ কোষ দেখা যায়।
ক.নিউক্লিয়ার মেমব্রেন (Nuclear membrane) : নিউক্লিয়াস সজীব দুটি ঝিরি দিয়ে আবৃত থাকে- বহিঃঝিল্লি ও অন্তঃঝিল্লি। ঝিল্লিদুটোকে একসাথে নিউক্লিয়ার মেমব্রেন বা নিউক্লিয়ার ঝিল্লী বলে। নিউক্লিয়াসের বহিঃঝিল্লিতে রাইবোজোম ও এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম সংলগ্ন থাকে। প্রতিটি মেমব্রেন দ্বিস্তরী ফসফোলিপিড বাইলেয়ার দিয়ে গঠিত। দুই ঝিল্লির মধ্যবর্তী, তরল পদার্থ পূর্ণ এবং ১০-১৫ nm চওড়া স্থানের নাম পেরিনিউক্লিয়ার স্পেস (perinuclear space)। এর অন্তঃস্তরটি ছিদ্রবিহীন কিন্তু বহিঃস্তরটি অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত। এসব ছিদ্রের নাম নিউক্লিয়ার রন্ধ্র। প্রতিটি রন্ধ্রের অভ্যন্তরে আটটি বৃত্তাকার ছোট ছোট কণা অবস্থিত। এসব কণার উপস্থিতির কারণে বুদ্ধগুে সংকুচিত ও প্রসারিত হতে পারে। নিউক্লিয়ার মেমব্রেন এর রাসায়নিক উপাদান বিশুদ্ধ প্রোটিন।
কাজঃ নিউক্লিয়াসের রক্ষণাবেক্ষণ করাই নিউক্লিয়ার ঝিল্লির প্রধান কাজ। তা ছাড়া এটি নিউক্লিওপ্লাজম, নিউক্লিওলাস ও ক্রোমোজোমকে সাইটোপ্লাজম থেকে পৃথক করে রাখে এবং সাইটোপ্লাজমের সাথে নিউক্লিয়াসের বিভিন্নকোষ ও এর গঠন ও বস্তুর যোগাযোগ রক্ষা করে। এটি এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের সাথে নিউক্লিয়াসকে সংযুক্ত রাখে এবং নিউক্লিয়ার বন্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুর আগমন ও নির্গমন নিয়ন্ত্রিত হয়।
খ.নিউক্লিওপ্লাজম (Nucleoplasm) : নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরস্থ ও নিউক্লিয়ার মেমব্রেন নিয়ে আবৃত স্বচ্ছ, দানাদার ও জেলার মতো অর্ধতরল পদার্থটির নাম নিউক্লিওপ্লাজম বা ক্যারিওলিম (Karyolymph ) | নিউক্লিওপ্লাজম মূল প্রোনে দিয়ে তৈরি। এতে RNA, বিভিন্ন এনজাইম ও কিছু খনিজ লবণ থাকে। কাজ : নিউক্লিওলাস ও ক্রোমোজোমের ম্যাট্রিক্স বা ধারক হিসেবে কাজ করে এবং নিউক্লিয়াসের জৈবনিক কার্য নিয়ন্ত্রণ করে।
গ.নিউক্লিওলাস (Nucleplus) : নিউক্লিয়াস এর অভ্যন্তরে অবস্থিত ক্ষুদ্র, গোল, উজ্জ্বল ও অপেক্ষাকৃত মন দুইটি, নিউক্লিওলাস নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী ফন্টানা (Fontana) ১৭৮১ সালে সর্বপ্রথম এটি দেখতে পান। প্রাণিবিদ বোম্যান (Bowman) ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে নিউক্লিওলাস-এর নামকরণ করেন। প্রত্যেক প্রকৃত কোষে সাধারণত একটি নিউরিলোস থাকা অপরিহার্য। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ও প্রজাতিভেদে নিউক্লিওলাস-এর সংখ্যা দুই বা ততোধিক হতে পারে। অন্যদিকে শুক্রাণু, শ্বেতকণিকা প্রভৃতি কোষে যেখানে প্রোটিন সংশ্লেষণ হয় না সে সব কোষে নিউক্লিওলাস অনুপস্থিত। যে সব কোষ বেশি মাত্রায় প্রোটিন সংশ্লেষণ করে সে সব কোষে নিউক্লিওলাসের আকার বড় এবং ক্ষেত্রবিশেষে সংখ্যা একাধিক। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ক্রোমোজোমের নির্দিষ্ট স্থানে নিউক্লিওলাস সংযুক্ত থাকে। নির্দিষ্ট ক্রোমোজোমের এ কোষ বিভাজনের মেটাফেজ ধাপে নিউক্লিওলাস অদৃশ্য হয় এবং বিভাজনের শেষ ধাপে প্রতিটি অপত্য নিউক্লিয়াসে নিউক্লিওলাসের আবির্ভাব ঘটে। নিউক্লিওলাস বহিঃস্থ পার্স অ্যামরফা, মধ্যভাগে দানাদার নিউক্লিওলোনিমা এবং কেন্দ্রীয় তরল মাতৃকা এ তিনটি পৃথক অংশ নিয়ে গঠিত।
নিউক্লিওলাসের রাসায়নিক উপাদান হচ্ছে RNA, প্রোটিন ও DNA। এছাড়া কয়েক ধরনের এনজাইম, সামান্য লিপিড, ফসফরাস, সালফার, পটাশিয়াম প্রভৃতি খনিজ লবণও নিউক্লিওলাসে দেখা যায়। কাজ :নিউক্লিওলাস নিউক্লিক এসিড-এর ভান্ডার হিসেবে কাজ করে, রাইবোজোম সৃষ্টি করে এবং প্রোটিন ও RNA সংশ্লেষ করে।
ঘ.ক্রোমাটিন তন্তু (Chromatin fibre) বা নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম (Nuclear reticulum) : কোষের বিশ্রাম অবস্থায় (যখন কোষ বিভাজনে অংশ নেয় না) নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে জালিকার আকারে কিছু তন্তু দেখা যায়। এই জালিকাকে ক্রোমাটিন তন্তু বা নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম বলে। নিউক্লিয়াসের বিভাজনরত অবস্থায় বা পর্যায়-মধ্যক অবস্থায় যে অংশ বা বস্তু ফুলজিন রং গ্রহণ করে সেই বস্তুকে বলা হয় ক্রোমাটিন (গ্রিক, chroma = colour)। ক্রোমাটিন বস্তু DNA ও হিস্টোন ধরনের প্রোটিন নিয়ে গঠিত। DNA হিস্টোনের চারপাশ পেঁচিয়ে থাকে। ফলে যে মালার মতো আকৃতি গঠন করে তার নাম নিউক্লিওজোম (nucleosome) । ক্রোমোজোম আসলে পুঁতির আকারে সাজানো অনেকগুলো নিউক্লিওজোমযুক্ত ক্রোমাটিন DNA- সূত্র দিয়ে তৈরি। পাশাপাশি দুটি নিউক্লিওজোম যা দিয়ে যুক্ত থাকে তাকে লিংকার বলে।) নিউক্লিয়াসের বিভাজনের সময় পানি বিয়োজিত হওয়ায় ক্রোমাটিন আরও বেশি রঙিন, খাটো ও মোটা হয়ে ক্রোমোজোম ক্রোমোজোম DNA, RNA, প্রোটিন (হিস্টোন ও নন-হিস্টোন) দিয়ে গঠিত। এছাড়া এতে কিছু ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম ধাতু রয়েছে। প্রজাতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রতিটি নিউক্লিয়াসেই নির্দিষ্ট সংখ্যক (chromosome) সূত্রকে পরিণত হয়। রাসায়নিকভাবে প্রতিটি হিস্টোন-
কাজঃ কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোেজাম গঠন করা এবং বংশগতির রাসায়নিক পদার্থ DNA বহন করা ক্রোমোজোম থাকে।
নিউক্লিয়াস এর কাজঃ
*কোষের সকল জৈবনিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। একে কোষের প্রাণকেন্দ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়।
*এটি মাইটোসিস ও মিয়োসিস বিভাজনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে।
* জীবের বংশগতি নিয়ন্ত্রণ নিউক্লিয়াসের মাধ্যমেই ঘটে।