স্থিতিশক্তির দুটি সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে :
যেমন ছাদের উপর রক্ষিত একখণ্ড ইট, পানির ট্যাংকে রক্ষিত পানি ইত্যাদি কম-বেশি শক্তি প্রাপ্ত হয়। এরূপ সকল শক্তিই স্থিতিশক্তি। স্থিতিশক্তির আরও কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে দেয়া হল :
(খ) হাত ঘড়িতে স্থিতিস্থাপক স্প্রিং-এর সাথে ঘড়ির চাকা যুক্ত থাকে [চিত্র ৬১০ ]। এই স্প্রিং-এ দম দিলে তা আকারে ছোট হয়। এই আকার পরিবর্তন তথা দম দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করি যা স্প্রিং-এর মধ্যে স্থিতিশক্তিরূপে সঞ্চিত হয়। স্প্রিং-এর সাথে ঘড়ির কাঁটার এমন একটি সংযোগ থাকে যে স্প্রিং প্যাঁচ খুলে উল্টা দিকে ঘুরে আগের অবস্থায় ফিরে আসার সময় ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকে। স্প্রিং-এর স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে পরিণত হয়।
এরূপ ধনুকের ছিলাতে তীর লাগিয়ে টানলে, ধাতব পাতকে বাঁকালে, রবারকে প্রসারণ করলে সকলেই আকার পরিবর্তনের জন্য স্থিতিশক্তি লাভ করে।
(গ) উচ্চে অবস্থিত পানিতে, পাহাড়ের চূড়ায় বরফে এবং আকাশের মেঘে অবস্থান পরিবর্তনের জন্য স্থিতিশক্তি সঞ্চিত থাকে।
স্থিতিশক্তি বা বিভব শক্তি বিভিন্ন প্রকার, যথা :
(১) অভিকর্ষীয় স্থিতিশক্তি বা অভিকর্ষীয় বিভব শক্তি (Gravitational potential energy)
(২) স্থিতিস্থাপক বিভব শক্তি (Elastic potential energy)
(৩) তড়িৎ বিভব শক্তি (Electric potential energy)_
কোন একটি বস্তুকে অভিকর্ষের বিরুদ্ধে উপরে তুলতে বাইরের কোন উৎস বা এজেন্টের প্রয়োজন হয়। এই কাজ বস্তুর মধ্যে স্থিতিশক্তি বা বিভব শক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে। এর নাম অভিকর্ষীয় বিভব শক্তি। এক্ষেত্রে ভূ- পৃষ্ঠকে প্রমাণ্য তল (reference level) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এখন শক্তির পরিমাপ করা যাক-
মনে করি m ভরের একটি বস্তুকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে অতি ক্ষুদ্র উচ্চতা dh পর্যন্ত উঠানো হল। এতে কৃত কাজ
বা, dw = Fdh
এখানে F = বাহ্যিক উৎস কর্তৃক প্রযুক্ত বল এবং F ও dh-এর মধ্যবর্তী কোণ শূন্য ।
একটি বস্তুকে উপরে উঠাতে হলে এর ওজনের সমপরিমাণ বল উপর দিকে প্রয়োগ করতে হবে।
সুতরাং, বস্তুটিকে h উচ্চতায় A স্থানে উঠাতে হলে মোট কৃত কাজের পরিমাণ সমীকরণ (25)-এ প্রদত্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের সমষ্টির সমান।
অভিকর্ষীয় বিভব শক্তি = বস্তুটিকে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে h উচ্চতায় তুলতে মোট কৃত কাজ।
স্বল্প উচ্চতার জন্য g-এর মান ধ্রুব ধরে আমরা লিখতে পারি,
অর্থাৎ অভিকর্ষীয় বিভব শক্তি
P.E. = mgh
= ভর x অভিকর্ষীয় ত্বরণ × উচ্চতা
উল্লেখ্য বস্তু যতই নিচে নামতে থাকবে h-এর মান ততই কমবে এবং অভিকর্ষীয় বিভব শক্তিও কমতে থাকবে। ভূ-পৃষ্ঠে h = শূন্য হওয়ায় অভিকর্ষীয় বিভব শক্তি শূন্য হবে।
কোন বস্তুর অভিকর্ষীয় বিভব শক্তির মান প্রামাণ্য তলের সাপেক্ষে বস্তুর অবস্থানের উপরে নির্ভর করে। সমুদ্র পৃষ্ঠকে প্রামাণ্য তল বিবেচনা করে কোন অবস্থানের বিভব শক্তি এবং কোন উঁচু পাহাড়ের চূড়া প্রামাণ্য তল বিবেচনা করলে ঐ একই অবস্থানের বিভব শক্তি এক হবে না, ভিন্নতর হবে। প্রকৃতপক্ষে কোন স্থানের বিভব শক্তির পরম মান নির্ণয় করা যায় না, বিভব প্রমাণ তল বা প্রসঙ্গ তল সাপেক্ষে বিভব শক্তির পরিবর্তন নির্ণয় করা হয়।
বিভব শক্তির মান ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক উভয়ই হতে পারে। এটা নির্ভর করে প্রসঙ্গ বা প্রামাণ্য তলের উপরে। ভূ-পৃষ্ঠকে প্রামাণ্য তল বিবেচনা করলে উপরের দিকে বিভব শক্তি ধনাত্মক হবে আবার ভূগর্ভে বা খনিতে বিভব শক্তি ঋণাত্মক হবে।
স্থিতিস্থাপক সীমার মধ্যে একটি বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করা হলে বস্তুর বিকৃতি ঘটে। -বিকৃতি ঘটাতে বস্তুর উপর কাজ সাধিত হয়। এই কাজ বস্তুর মধ্যে স্থিতি বা বিভব শক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে। এর নাম স্থিতিস্থাপক বিভব শক্তি।
নিম্নে স্প্রিং-এর বিভব শক্তি আলোচনা করা হল।
স্প্রিং-এর বিভব শক্তি ঃ ধরি একটি অনুভূমিক আদর্শ স্প্রিং-এর এক প্রান্ত দেওয়ালের সাথে আটকানো এবং অপর প্রান্তে । ভরবিশিষ্ট একটি বস্তু যুক্ত আছে। বস্তুটি অনুভূমিক ও ঘর্ষণহীন তলের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে [চিত্র ৬-১২]। বস্তুটিকে টেনে স্প্রিংটি দৈর্ঘ্য বরাবর বিকৃত করলে স্থিতিস্থাপক ধর্মের দরুন প্রযুক্ত বলের বিপরীতে স্প্রিং-এ প্রত্যায়নী বলের উদ্ভব ঘটবে।
F অনুভূমিক বল প্রয়োগে বস্তুটিকে বাম হতে ডানদিকে “দৈর্ঘ্য অনুভূমিক বরাবর তার দৈর্ঘ্য x পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে স্প্রিং-এ-kx পরিমাণ প্রত্যায়নী বা উৎপন্ন হবে। এখন বস্তুটিকে x দূরত্ব সরাতে তার উপর এর সমান ও বিপরীতমুখী F = kx বল প্রয়োগ করে কাজ করতে হবে। এই সম্প্রসারণে প্রযুক্ত বল দ্বারা কৃত কাজই হবে বস্তুটির মধ্যে সঞ্চিত বিভব শক্তি।
সুতরাং বিভব শক্তি,
স্প্রিটিকে দৈর্ঘ্য x পরিমাণ সংকুচিত করলেও সঞ্চিত বিভব শক্তি হবে।
মহাবিশ্ব জুড়ে শক্তি বিভিন্ন রূপে বিরাজিত। বিভিন্ন প্রকার শক্তি পরস্পরের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। এক শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তর সম্ভব। এর নামই শক্তির রূপান্তর (Transformation of energy)।
শক্তি রূপান্তরের কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হল।
(১) পানি উচ্চ স্থান হতে নিম্ন স্থানে প্রবাহিত হয়। উচ্চ স্থানে থাকার সময় তার শক্তি স্থিতিশক্তি। নিম্ন স্থানে প্রবাহিত হবার সময় স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই গতিশক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করা হয়। অর্থাৎ যান্ত্রিক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(২) বিদ্যুৎ শক্তি যখন বৈদ্যুতিক বাতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন আমরা আলো পাই। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তি আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৩) বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিতে তড়িৎ বা বিদ্যুৎ চালনা করে তাপ উৎপন্ন করা হয়। এই তাপের সাহায্যে কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করা হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তি তাপ শক্তিতে এবং তাপ শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
বৈদ্যুতিক পাখার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে পাখা ঘুরতে থাকে। এ স্থলেও বৈদ্যুতিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৪) একটি কাঁচা লোহার উপর অন্তরীত (insulated) তামার তার জড়িয়ে বিদ্যুৎ চালনা করলে লোহার পাতটি চুম্বকে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তি চুম্বক শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৫) ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, রুবিডিয়াম প্রভৃতি ধাতুর উপর আলো পড়লে ইলেকট্রন নির্গত হতে দেখা যায়। ফটো-ইলেকট্রিক কোষ এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এরূপ একটি কোষে আলো ফেলে বিদ্যুৎ প্রবাহ তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে আলোক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৬) দুই হাতের তালু পরস্পরের সাথে ঘষলে তাপ উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে যান্ত্রিক শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৭) ফটোগ্রাফিক ফিল্মের উপর আলোক সম্পাত করে রাসায়নিক ক্রিয়ার মাধ্যমে আলোক চিত্র তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে আলোক শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(৮) ওষুধের কারখানায় শ্রবণোত্তর বা শব্দোত্তর তরঙ্গের সাহায্যে জীবাণু ধ্বংস করা হয় এবং কপূরকে পানিতে দ্রবণীয় করা হয়। এ ছাড়া শব্দোত্তর তরঙ্গ দ্বারা বস্ত্রাদির ময়লাও পরিষ্কার করা হয়। এসব ক্ষেত্রে শব্দ শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হন।
(৯) আমরা জানি বৈদ্যুতিক ঘণ্টা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। টেলিফোনও বিদ্যুতের সাহায্যে চলে। দুই ক্ষেত্রেই আমরা শব্দ শুনতে পাই। এস্থলে বিদ্যুৎ শক্তি শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(১০) কয়লা পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে এটি ঘটে। এক্ষেত্রে রাসায়নিক শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
(১১) বিদ্যুৎ কোষে রাসায়নিক দ্রব্যের বিক্রিয়ার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এক্ষেত্রে রাসায়নিক শক্তি তড়িৎ বা বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হল।
শক্তি যখন একরূপ হতে অন্যরূপে পরিবর্তিত হয় তখন এর কোন ঘাটতি বা বাড়তি ঘটে না। অর্থাৎ শক্তির বিনাশ ও সৃষ্টি উভয়ই অসম্ভব। যখন এক প্রকার শক্তি বিলুপ্ত হয় তখন তা অন্যরূপে কোথাও আত্মপ্রকাশ করে। এর নাম শক্তির নিত্যতা বা শক্তির অবিনশ্বরতা (Conservation of Energy)। এ সম্পর্কে একটি সূত্র বা বিধি আছে। এর নাম শক্তির নিত্যতা সূত্র বা শক্তির নিত্যতা বিধি। একে শক্তির সংরক্ষণ সূত্রও বলা হয়।