তেরো শতকের শুরুতে তুর্কি বীর ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর- পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ইতিহাসে তিনি বখতিয়ার খলজি নামেই বেশি পরিচিত । তাঁর বংশ পরিচয় সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না । তিনি ছিলেন জাতিতে তুর্কি, বংশে খলজি এবং বৃত্তিতে ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ।
বখতিয়ার খলজি স্বীয় কর্মশক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিজ জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে জীবিকার অন্বেষণে গজনিতে আসেন। সেখানে তিনি শিহাবউদ্দিন ঘোরির সৈন্য বিভাগে চাকরিপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন । দেখতে খাটো, অস্বাভাবিক লম্বা হাত এবং কদাকার চেহারার জন্য বখতিয়ার সেনাধ্যক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হন। এরূপ শারীরিক বৈশিষ্ট্য তুর্কিদের নিকট অমঙ্গল বলে বিবেচিত হতো। গজনিতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লিতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে উপস্থিত হন। এবারও তিনি চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি বদাউনে যান । সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হিজবরউদ্দিন তাকে মাসিক বেতনে সৈন্য বিভাগে নিযুক্ত করেন । কিন্তু উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এ ধরনের সামান্য বেতনভোগী সৈনিকের পদে সন্তুষ্ট থাকতে পারেননি । অল্পকাল পর তিনি বদাউন ত্যাগ করে অযোধ্যা যান। সেখানকার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিনের অধীনে তিনি পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন । বখতিয়ারের সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় সন্তুষ্ট হয়ে হুসামউদ্দিন তাকে বর্তমান মির্জাপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ভাগবত ও ডিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গির দান করেন। সেখানে বখতিয়ার তাঁর ভবিষ্যৎ উন্নতির উৎস খুঁজে পান। ভাগবত ও ডিউলি তার শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
বখতিয়ার অল্পসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজ্য আক্রমণ ও লুণ্ঠন করতে শুরু করেন । এ সময়ে তার বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ভাগ্যান্বেষী মুসলমান তার সৈন্যদলে যোগদান করে। ফলে বখতিয়ারের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এভাবে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে তিনি দক্ষিণ বিহারে এক প্রাচীরঘেরা দুর্গের মতো স্থানে আসেন এবং আক্রমণ করেন। প্রতিপক্ষ কোনো বাধাই দিল না। দুর্গ ভায়ের পর তিনি দেখলেন যে, দূর্গের অধিবাসীরা সকলেই মুণ্ডিত মস্তক এবং দুর্গটি বইপত্রে তরা । জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারলেন যে, তিনি এক বৌদ্ধ বিহার জর করেছেন। এটি ছিল দন্দ বিহার বা ওদন্তপুরী বিহার। এ সময় থেকেই মুসলমানেরা এ স্থানের নাম দিল বিহার। আজ পর্যন্ত তা বিহার নামে পরিচিত।
বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার অনেক ধনরত্নসহ দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতান কর্তৃক সম্মানিত হয়ে তিনি বিহার ফিরে আসেন। অধিক সৈন্য সংগ্রহ করে তিনি পরের বছর নবদ্বীপ বা নদীয়া আক্রমণ করেন। এ সময় বাংলার রাজা লক্ষণ সেন নদীয়ার অবস্থান করছিলেন। গৌড় ছিল তাঁর রাজধানী, আর নদীরা ছিল তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী। বখতিয়ার কর্তৃক বিহার জয়ের পর সেন সাম্রাজ্যে গভীর ভীতি বিদ্যমান ছিল। দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ রাজা লক্ষণ সেনকে রাজধানী ত্যাগ করতে পরামর্শ দেন। তাদের শাস্ত্রে তুর্কি সেনা কর্তৃক বঙ্গ জরের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। এছাড়া বিজয়ীর যে বর্ণনা শাস্ত্রে আছে, তার সঙ্গে বখতিয়ারের দেহের বর্ণনা একেবারে মিলে যায় । কিন্তু তবুও রাজা লক্ষণ সেন নদীয়া ত্যাগ করেননি ।
বিহার থেকে বাংলায় প্রবেশ করতে হলে তেলিয়াগড় ও শিড়িপড়—এই দুই গিরিপথ দিয়ে আসতে হতো। এ গিরিপথ দুটো ছিল সুরক্ষিত। তিনি প্রচলিত পথে অগ্রসর হলেন না। কিন্তু অরণ্যময় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়াতে বখতিয়ারের সৈন্যদল খণ্ড খণ্ড ভাবে অগ্রসর হয়। শত্রুপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে বখতিয়ার এলজি যখন নদীয়ার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিল মাত্র ১৭ কিংবা ১৮ জন অশ্বারোহী সৈনিক। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খলজির পক্ষে বঙ্গ বিভার কী করে সম্ভব হলো? কথিত আছে, তিনি এ ক্ষিপ্রগতিতে পথ অতিক্রম করেছিলেন যে, মাত্র ১৭/১৮ জন সৈনিক তাঁকে অনুসরণ করতে পেরেছিল। আর মূল সেনাবাহিনীর বাকি অংশ তাঁর পশ্চাতেই ছিল ।
তখন দুপুর। রাজা লক্ষণ সেন মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত; প্রাসাদ-রক্ষীরা তখন আরাম-আয়েশ করছে: নাগরিকগণও নিজেদের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত। বখতিয়ার খলজি বণিকের ছদ্মবেশে নগরীর দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছান। রাজা লক্ষণ সেন তাদের অশ্ব ব্যবসায়ী মনে করে নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেন। কিন্তু এ ক্ষুদ্র দল রাজপ্রাসাদের সম্মুখে এসে হঠাৎ তরবারি উন্মুক্ত করে প্রাসাদ রক্ষীদের হত্যা করে । অকস্মাৎ এ আক্রমণে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যায়। প্রাসাদ অরক্ষিত রেখে সকলে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় । ইতোমধ্যে বখতিয়ারের দ্বিতীয় দল নগরের মধ্যে এবং তৃতীয় দল তোরণ-দ্বারে এসে উপস্থিত হয়। সমস্ত নগরী তখন প্রায় অবরুদ্ধ । নাগরিকগণ ভীত-সন্ত্রস্ত। এ অবস্থায় রাজা লক্ষণ সেন হতাশ হয়ে পড়েন । শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কোনো উপায় নেই দেখে তিনি পিছনের দরজা দিয়ে সপরিবারে খালি পায়ে গোপনে নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গের মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন । অল্প সময়ের মধ্যে বখতিয়ার খলজির পশ্চাদ্গামী অবশিষ্ট সৈন্যদলও এসে উপস্থিত হলো । বিনা বাধায় নদীয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। বখতিয়ার খলজির নদীয়া জয়ের সঠিক তারিখ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে বর্তমানে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দই নদীয়া জয়ের সময় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ।
এরপর বখতিয়ার নদীয়া ত্যাগ করে লক্ষণাবতীর (গৌড়) দিকে অগ্রসর হন । তিনি লক্ষণাবতী অধিকার করে সেখানেই রাজধানী স্থাপন করেন । লক্ষণাবতীই মুসলমান আমলে লখনৌতি নামে পরিচিত হয় । গৌড় জয়ের পর বখতিয়ার আরও পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার বিস্তার করেন । এখানে উল্লেখ্য যে, বখতিয়ার খলজি নদীয়া ও গৌড় বিজয়ের পর একটি স্বাধীন রাজ্যের অধিপতি হলেও তিনি সমগ্র বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে পারেননি । পূর্ববঙ্গে লক্ষণ সেনের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল । মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা আরও কিছুদিন পূর্ববঙ্গ শাসন করেছিলেন।
গৌড় বা লখনৌতি বিজয়ের দুই বছর পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে বের হন। এ তিব্বত অভিযানই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমর অভিযান। কিন্তু তাঁর এ অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি দেবকোটে ফিরে আসেন । সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। অনুমান করা হয় আলি মর্দান নামে একজন আমির তাকে হত্যা করেছিল।
বাংলায় মুসলমান শাসনের ইতিহাসে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তাঁর প্রচেষ্টার ফলেই এদেশে প্রথম মুসলমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় । এ শাসন প্রায় সাড়ে পাঁচশ' বছরের অধিক স্থায়ী হয়েছিল (১২০৪-১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)। রাজ্য জয় করেই বখতিয়ার খলজি ক্ষান্ত ছিলেন না । বিজিত অঞ্চলে তাঁর শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যও তিনি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সংস্কৃতি বিকাশের জন্য তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য । তাঁর শাসনকালে বহু মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ নির্মিত হয়েছিল ।
আরও দেখুন...