বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অবদান অপরিসীম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন । নানা অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন । রাজনীতিবিদগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন বাজি রেখে রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেছেন ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তাঁর সারা জীবনের কর্মকাণ্ড,আন্দোলন-সংগ্রাম নিবেদিত হয়েছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে । ১৯৪৮ সালের ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলনের মাধ্যমে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' গঠন করা হয়। সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক এবং যুগ্ম সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে দলের নাম 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই দলটি বাঙালিদের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় ।
'৪৮ ও '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দীদের মধ্যে অন্যতম। কী সংসদ, কী রাজপথ, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষে তাঁর কণ্ঠ ছিল সর্বদা সোচ্চার । ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদান, ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা' কর্মসূচি পেশ ও ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতা অর্জনে একচ্ছত্র ভূমিকা পালন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।
পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের মধ্যে ১২ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন । ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়লে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ সালের প্রথম প্রহরে (২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর) তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন । সংগ্রামের পথ ধরে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন । তাঁর নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় । তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি । তাঁর বলিষ্ঠ ও আপোসহীন নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন স্বাধীনতার মহানায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ।
তাজউদ্দীন আহমদ: মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহচর। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত মুজিবনগর সরকারের (১০ই এপ্রিল, ১৯৭১) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এই মহান নেতা ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল তিনি বেতার ভাষণে মুজিবনগর সরকার গঠনের কথা প্রচার করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তিনি সফলভাবে নেতৃত্ব প্রদান করেন । মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত উপদেষ্টা কমিটির তিনি আহ্বায়ক ছিলেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম: সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা । তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন । বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও সফল করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান । সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ও পরিচালক ।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী: ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধকালীন খাদ্য, বস্ত্র, অস্ত্র প্রশিক্ষণের অর্থের সংস্থান প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল । তিনি সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন ।
এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান: এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের আর একজন শীর্ষ নেতা । মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ছিলেন । সে সময়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নেয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ সংগ্রহ, ত্রাণশিবিরে ত্রাণ বিতরণ এবং পরবর্তী সময়ে শরণার্থীদের পুনর্বাসন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পালন করেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান অপরিসীম ।
অন্য নেতৃবৃন্দ: অন্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য । তিনি ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (১৯৬৮-৬৯) থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও '৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থান করে বিভিন্ন দেশের প্রতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন আদায় ও পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান । এছাড়া অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ (ন্যাপ-মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মণি সিংহ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত ‘উপদেষ্টা কমিটি'তে এই তিন নেতা সদস্য ছিলেন ।
আরও দেখুন...