খাদ্য গ্রহণের উদ্দেশ্য শুধু ক্ষুধা নিবারণ নয়। খাদ্য গ্রহণের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো যেসব খাদ্য খাওয়া হয় তা যেন শরীরকে কর্মক্ষম রাখে, ক্ষয়পূরণ করে ও বৃদ্ধিসাধন অব্যাহত রাখে এবং শরীরকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলে। এ জন্য প্রয়োজন খাদ্যের সব উপাদানসমৃদ্ধ সুষম খাদ্যের। সুষম ও পুষ্টিকর আহারই দেহের প্রতিটি অবস্থায় প্রয়োজন অনুযায়ী শক্তি সরবরাহ করে দেহকে সুস্থ রাখতে পারে। এ জন্য বয়স (শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ) পরিশ্রমের ধরণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য ব্যবস্থার পরিকল্পনা করতে হয়। এই পরিকল্পনার উপায় হলো ‘মেনু তৈরি। ’
প্রতিদিনের আহারে কী কী খাদ্য পরিবেশন করা হবে তার জন্য মেনু পরিকল্পনা করা উচিত। মেনু পরিকল্পনায় পরিবারের বাজেট বা আয় অনুযায়ী প্রত্যেক সদস্যের রুচি, চাহিদা, বয়স, খাদ্য প্রস্তুত পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে ।
পরিবারের তিন বেলার আহার ছাড়া শিশুর পরিপূরক খাবার, রোগীর পথ্য, বিয়ে, জন্ম দিন, অতিথি আপ্যায়ন ইত্যাদি যে কোনো উপলক্ষেই খাদ্য প্রস্তুতের আগেই একটা পরিকল্পনা করে নেওয়া ভালো। মেনু তৈরির মাধ্যমে খাদ্য ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে খাদ্যের তালিকা তৈরি করা হয়। মোটকথা মেনু পরিকল্পনা খাদ্যের একটি তালিকা বিশেষ। অর্থাৎ যে কোনো খাদ্য ব্যবস্থায় কী খাবার পরিবেশন করা হবে তা স্থির করে যে লিখিত খাদ্য তালিকা তৈরি করা হয় তাকেই মেনু বলে। মেনু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুষম, আকর্ষণীয় এবং পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন করা যায়।
মেনু তৈরির বিবেচ্য বিষয়
মেনু তৈরির মাধ্যমে যাতে পরিবারের খাদ্য ব্যবস্থা সুষম হয় সে জন্য কতোগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হয়। সেগুলো নিম্নরূপ—
আয়— মেনুতে পুষ্টিকর খাদ্য সংযোজনের বিষয়টি একটা বাজেটের উপর নির্ভর করে। আয়ের উপর ভিত্তি করে পরিবারের জন্য সম্পূর্ণ মাসব্যাপী পুষ্টিকর খাদ্য যোগান দিতে হয়। সুষম খাদ্যের উপাদান অল্প মূল্যের খাদ্য থেকে সংগ্রহ করে স্বল্প ব্যয়ে মেনু পরিকল্পনা করা যুক্তিযুক্ত। খাদ্যের মূল্য কমানোর জন্য সুষম খাদ্যের উপাদানসমূহ বাদ দেওয়া চলবে না। তাই দামি খাবারের পাশাপাশি তুলনামূলক সস্তা অথচ পুষ্টিকর খাদ্যের সমন্বয় থাকা বাঞ্ছনীয়।
আবহাওয়া ও মৌসুম— আমাদের দেশে ঋতু ভেদে বিভিন্ন ফলমূল, তরিতরকারির সমাগম ঘটে। এগুলো পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সহজলভ্য হয়ে থাকে। খাদ্য তালিকায় মৌসুমি খাদ্যদ্রব্য সংযোজন করলে স্বাদেও বৈচিত্র্য আসে এবং মূল্য সাশ্রয়কারী খাদ্য তালিকাও বানানো যায় ।
লিঙ্গ— ছেলে-মেয়েভেদে খাদ্যের চাহিদা ভিন্ন হয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের দেহের আয়তন, ওজন ও পেশির পরিমাণ কম। এ জন্য মেয়েদের ক্যালরি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের চাহিদাও অপেক্ষাকৃত কম হয়।
উপলক্ষ— পরিবারের সদস্যসংখ্যা, আর্থিক সঙ্গতি, রুচি ইত্যাদি বিবেচনা করে দৈনিক খাদ্য তালিকা তৈরি করা যায়। তবে ছোট বা বড় যে কোনো অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মেনু একটি আকর্ষণের বিষয়। কেননা এতে সাধারণ খাবারের কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে থাকে। যেমন: বিয়ে, জন্মদিন, মিলাদ, ঈদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মেনু
তৈরিতে বতিক্রম থাকে ।
বৈচিত্র্য সৃষ্টি— মেনুতে নানা রং, নানা আকার, নানা প্রকৃতি এবং নানা পদ্ধতিতে রান্না করা খাবার দিয়ে আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করা যায়। মেনুতে সব খাবারই যদি সাদা বা একই রংয়ের হয় তাহলে দেখতে
আকর্ষণীয় হয় না। তেমনি সব খাবারই যদি নরম ও শুকনা হয় তাহলে খেয়ে পরিতৃপ্ত হওয়া যায় না । বিভিন্ন রঙের খাবার— যেমন : টমেটো, গাজর, কলা, মটরশুঁটি, দুধ, দই, ভাত, জর্দা ইত্যাদি। বিভিন্ন আকারের খাবার— যেমন : সিঙ্গারা, স্যান্ডউইচ, পাউরুটি, কেক, নিমকি ইত্যাদি । বিভিন্ন প্রকৃতির খাবার— যেমন: সুপ, ক্ষীর, হালুয়া, কাস্টার্ড, পুডিং, পাপড়, চিপস ইত্যাদি।
এক পরিবেশন পরিমাপ— মেনুতে তালিকাভুক্ত খাবারগুলো কতোজন লোক গ্রহণ করবে তার উপর খাবারের মোট পরিমাণ নির্ভর করে। মেনুতে যেসব খাদ্য রাখা হয় তার প্রতিটি প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্তত এক পরিবেশন পরিমাণ বরাদ্দ করতে হয়। যেমন: রান্না করা শাক এক পরিবেশন = ১/৩ কাপ ।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য এক পরিবেশন পরিমাণ—
টাটকা দুধ ১ কাপ
দই ১ কাপ
১ কাপ
১/২ কাপ
১/২ কাপ
আইসক্রিম
১ টা
রসগোল্লা
প্রোটিন জাতীয় খাদ্য এক পরিবেশন পরিমাণ—
কাঁটা ছাড়া মাছ
৩০ গ্রাম
৩০ গ্রাম
ডিম
ডাল
১ টা
২৫ গ্রাম
শাক-সবজি, ফল এক পরিবেশন পরিমাণ—
রান্না করা শাক
১/৩ কাপ
রান্না করা সবজি
১/২ কাপ
১/২ কাপ
সালাদ
১টি
ফল মাঝারি আকার
শস্য জাতীয় খাদ্য এক পরিবেশন পরিমাণ—
ভাত
১ কাপ
আটার রুটি
২টি
পাউরুটি
২ টুকরা
১৮০ গ্রাম
আলু
এ ছাড়া মেনু তৈরি করার সময় পরিবেশনের ধরন, সঠিক রেসিপির ব্যবহার, তৈজসপত্র ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদির সুবিধা, দক্ষ রন্ধনকারী, উদ্বৃত্ত খাদ্যের ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হয় ।
নমুনা : একটি পরিবারের এক দিনের মেনু।
পরিবেশন সংখ্যা ৫
সময়
স্বল্প মূল্যের খাবার
দামি খাবার
সকালের নাশতা
আটার রুটি, সবজি ভাজি, কলা, চা
পরোটা, ডিম ভাজা, আপেল, কফি
দুপুরের খাবার
সাধারণ চালের ভাত, ডাল, শাক, ছোট মাছ, লেবু, কাঁচা মরিচ
বিকাল
মুড়ি মাখা, চা
চিকন চালের ভাত, বড় মাছের তরকারি, সালাদ
ফলের রস/কফি, কেক
রাতের খাবার
ভাত, ডিমের তরকারি, ডাল, আলু ভর্তা
ভাত, মুরগির ঝোল, আলুর চপ, সালাদ
আরও দেখুন...