ভাষা আন্দোলন
বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও, বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে। অন্যদিকে, এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভা করার পক্ষে প্রস্তাব করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ বেশ কিছু বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় 'পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রক করেন। এখানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক ভাষণে বলেছিলেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালি'।
গণপরিষদে বাংলার দাবি
১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদে বক্তৃতা প্রদানের এবং রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানান কুমিল্লার সাংসদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। সেই দিন অধিবেশনে বাংলার পক্ষে ভোট পড়ে ১৫টি এবং বিপক্ষে ভোট পড়ে ৫১টি।
দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ভাষা দিবস
জিন্নাহ'র ঘোষণা ও ছাত্রদের প্রতিবাদ
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন "Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan" এছাড়াও ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কার্জন হলে পুনরাবৃত্তি করলে ছাত্ররা না না বলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন খাজা নাজিমুদ্দীন।
নাম | গঠনের সময়কাল | আহ্বায়ক |
---|---|---|
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ১ অক্টোবর, ১৯৪৭ | নূরুল হক ভূঁইয়া |
২য় বার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ (সংস্কার) | ২ মার্চ, ১৯৪৮ | আহ্বায়ক শামসুল আলম |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ১১ মার্চ, ১৯৫০ | আব্দুল মতিন |
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ | ৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২ | কাজী গোলাম মাহবুব |
আন্দোলন সংগ্রামে অন্যান্য সংগঠন
ভাষা আন্দোলনকালীন পাক-নেতৃত্ব | |
---|---|
পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী | নুরুল আমিন |
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী | খাজা নাজিমুদ্দিন |
পাকিস্তানের গভর্নর | মালিক গোলাম মোহাম্মদ |
পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি
১৯৪৯ সালের ৯ই মার্চ পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে মাওলানা আকরাম খাঁ সভাপতি করে ১৬ সদস্যের একটি 'পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি' গঠন করে দেয়। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান মৃত্যুবরণ করলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন খাজা নাজিমুদ্দীন।
তমুদ্দুন মজলিস
" পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” পুস্তিকার লেখক ৩ জন
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সূচনাকারী। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা: বাংলা না উর্দু' শিরোনামের ঘোষনাপত্রে সর্বপ্রথম বাংলাকে রাষ্টভাষা করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
অধ্যাপক আবুল কাশেম বুঝতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলার মানুষের সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আবুল কাশেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসভবনই ছিল তমদ্দুন মজলিসের অফিস।
এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ তাঁর 'জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-৭৫ বইয়ে লিখেছেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপকদ্বয় আবুল কাশেম ও নুরুল হক ভূঁইয়া ধূমায়িত অসন্তোষকে সাংগঠনিক রুপদানের প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস গঠন করেন। নবগঠিত তমদ্দুন মজলিসই ভাষা-আন্দোলনের গোড়াপত্তন করে।"
১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এক জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে গঠিত হয় "সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” (All Parties State Language Movement Committee) ৩১ শে জানুয়ারি, ১৯৫২ সালে। কমিটিতে সদস্য ছিল ২২ জন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আব্দুল মতিন এবং আহ্বায়ক কাজী গোলাম মাহবুব।
জেনে নিই
৩১ জানুয়ারি ১৯৫২
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
৩০ জানুয়ারি ১৯৫২
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান গণপরিষদ | ১৯৫৪ সালে |
উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয় জাতীয় পরিষদ | ১৯৫৬ সালে |
বঙ্গবন্ধু সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ জারি করেন | ১৯৭৫ সালে |
জাতীয় সংসদে বাংলা ভাষা আইন পাস করা হয়। | ১৯৮৭ সালে |
১৯৯৮ সালের ১৭ই নভেম্বর ১৮৮ দেশের সমর্থনে ইউনেস্কোর ৩০তম উদ্যোক্তা সাধারণ অধিবেশনে ২১শে | ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে। জাতিসংঘ ২০০৮ সাল থেকে মাতৃভাষা দিবস পালন করা আরম্ভ করে।
উদ্যোক্তাঃ রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম (কানাডা প্রবাসী)।
সংগঠনঃ The Mother Language Lovers of World
চেতনা '৭১' মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য যা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। এটি বৃহত্তর সিলেটের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য। ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ২০০৯ সালের ২৬ মার্চ মিনি অডিটোরিয়ামের পশ্চিম পাশে চেতনা ‘৭১’ নামে একটি অস্থায়ী ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। চেতনা ‘৭১’ এর স্থপতি মোবারক হোসেন।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে বাংলাদেশ সরকার একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে ১৯,৪৯,০০,০০০ টাকার "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্প" সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরুতে ১২ তলা ভবনের উল্লেখ থাকলেও প্রাথমিকভাবে ৫ তলা নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়; তাতে একটি মিলনায়তন, চারটি সম্মেলন কক্ষ, কম্পিউটার ল্যাব, জাদুঘর, আর্কাইভ, ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য ১০টি শ্রেণীকক্ষসহ প্রয়োজনীয় অফিসকক্ষের ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর সরকার বদলের পরে ভবনের নির্মাণ কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে সরকার প্রকল্প সংশোধন করে নির্মাণকাজ শেষ করার উদ্যোগ নেয়। সংশোধিত প্রকল্পের অধীনে ৩ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ শেষ হয় ২০১০ খ্রিস্টাব্দে। সেবছর ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভবনটির উদ্বোধন করেন। ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের ৯ বছর পর ভবনটি উদ্বোধন করা হয়।
জেনে নিই
১৯৫৪
১৯৬৪
১৯৬২
১৯৫২
চৌধুরী মাহবুব উল আলম (১৯২৭-২০০৭) কবি, সাংবাদিক, লেখক, ভাষা সৈনিক এবং ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতার রচয়িতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) আন্দোলনকারী ভাষা সৈনিকদের ওপর পুলিশের গুলি এবং ছাত্র নিহত হওয়ার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ স্বরূপ কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ’একুশে’ শিরোনামে রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ’কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ যা ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা হিসেবে স্বীকৃত।
জহির রায়হান এর একুশের কর্ম
আলতাফ মাহমুদ এর একুশের কর্ম
গাজীউল হক এর একুশের কর্ম
অধ্যাপক আবুল কাশেম এর একুশের কর্ম
মুনীর চৌধুরী এর একুশের কর্ম
আরও দেখুন...