ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - NCTB BOOK

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান (১৪ আগস্ট, ১৯৪৭) এবং ভারত (১৫ আগস্ট, ১৯৪৭) নামে দুটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তৎকালীন পূর্ব-বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পরবর্তীকালে এর নাম হয় পূর্ব-পাকিস্তান । পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬% বাংলা ভাষী এবং ৩.২৭% ছিল উর্দু ভাষী। তবুও শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ প্ৰথমেই প্রতিবাদমূখর হয়ে ওঠেন। তাঁরা এই অন্যায় ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। তরুণনেতা শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্র ও যুব নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদ জানান। এভাবেই পূর্ব-বাংলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। ১৯৫২ সালে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই সময়ে আরও গ্রেফতার হয়েছিলেন শামসুল হক, , অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকে। ভাষার জন্য প্রতিবাদী আন্দোলনে পৃথিবীতে প্রথম শহিদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেকেই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পটভূমি রচনা করেছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। যার প্রেরণায় দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

এই অধ্যায় শেষে আমরা-

  • ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট এবং এর মর্যাদা বর্ণনা করতে পারব;
  • নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করতে পারব;
  • যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ মূল্যায়ন করতে পারব;
  • ভাষা আন্দোলনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে আগ্রহী হব;
  • রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে ভাব বিনিময়ে উৎসাহী হব এবং অপরকেও উৎসাহী করব।
Content added By

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের একটি অংশে পরিণত হয় । পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি কোনো কিছুরই মিল ছিল না। হাজার মাইল ব্যবধানের পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) দুইটি ভূখণ্ডকে এক করা হয় শুধু ধর্মের ভিত্তিতে। ফলে পাকিস্তান নামক এই নতুন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই বাঙালিকে শোষণ করার কৌশল হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানে । নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে? এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেই। সে সময় মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মতামত দেন। তখনই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাসহ বাংলার বুদ্ধিজীবী, লেখকগণ এর প্রতিবাদ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিশ গঠিত হয়। এটিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংগঠন। এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় ।

তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপদানের জন্য ৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ', যার আহ্বায়ক মনোনীত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঞা। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পাশাপাশি পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গ বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। সব কিছুকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বর মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করে । ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে । এ সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুতে কার্যক্রম শুরু হলে পূর্ব বাংলা কংগ্রেস পার্টির সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলাকেও অধিবেশনের অন্যতম ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু, মুসলিম লীগের সকল সদস্য এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে । এ ঘটনায় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে। ২৬ ও ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয় । ২রা মার্চ দেশের ছাত্রসমাজ বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় বারের মতো 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করে ।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নতুন কমিটির আহ্বানে ১১ই মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা । ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগানসহ মিছিল করার সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকেই গ্রেফতার হন । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩-১৫ই মার্চ আবার ধর্মঘট পালিত হয়। এবার শুধু ঢাকা নয়, দেশের সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ই মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আইন পরিষদে উত্থাপন প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত ছিল ।

১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন । ২১শে মার্চ রমনার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এবং ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য রাখেন। দুটি বক্তব্যেই তিনি বাংলা ভাষার দাবি অগ্রাহ্য করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন । সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' । উপস্থিত ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদে ‘না না' ধ্বনি দিয়ে ওঠে। এ সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে । ১৯৪৮ সালের ১৮ই নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় এসে বক্তৃতাকালে আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন । ছাত্ররা 'না না' বলে প্রতিবাদ করে ওঠে ।

১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে বাংলা ভাষা আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয় । ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এর প্রতিবাদ করেন । আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা হিসেবে বাংলা ভাষা সংস্কারের নামে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে 'পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি' গঠন করা হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির সুপারিশে বলা হয়, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। দেশজুড়ে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ চলতে থাকে । পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হলে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন । ১৯৫২ সালে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বক্তব্যে জিন্নাহর কথার প্রতিধ্বনি হলে ভাষা আন্দোলন নতুন মাত্রা ও সর্বাত্মক রূপ লাভ করে । এভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা হয় ।

Content added By

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়

নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানে ঘোষণা দেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এর প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন নতুন করে শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০শে জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান করে। ৩১শে জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সর্বদলীয় সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। এ সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সময় হঠাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ করেন। সরকারি এ ঘোষণা পাওয়া মাত্রই ঢাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা কিছুতেই ১৪৪ ধারা মেনে নিতে পারেননি। ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে । আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে এ সভায় ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে দ্বিমত দেখা দেয়। অধিকাংশ সদস্য প্রথমে ১৪৪ ধারা অমান্য করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু আবদুল মতিন, অলি আহাদ, গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতা ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্তে অটুট থাকেন। অবশেষে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চত্বরে) ছাত্রদের সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সমাবেশে যোগ দেন । কতিপয় নেতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করে । তবে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সভায় ছোট ছোট দলে ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ।

ছাত্র-ছাত্রীরাও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে সমবেত হয়ে গণপরিষদের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায় । পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার ঘটনাস্থলে শহিদ হন। আব্দুস সালাম ঐদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ই এপ্রিল শহিদ হন । সে সময় গণপরিষদের অধিবেশন চলছিল। গুলির খবর পেয়ে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ আইন পরিষদের কয়েকজন সদস্য অধিবেশন ত্যাগ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন ।

বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ শুরু হয়। জনতা শহিদদের জন্য শোক মিছিল বের করে। আবারও মিছিলের ওপর পুলিশ ও মিলিটারি লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট ব্যবহার করে। এতে শফিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন শহিদ হন এবং অনেকে গ্রেফতার হন । যেস্থানে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সেখানে ছাত্ররা সারারাত জেগে ২৩শে ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনার নির্মাণ করেন। পরে পুলিশ শহিদ মিনারটি ভেঙে দেয় । ১৯৬৩ সালে অস্থায়ী শহিদ মিনারের স্থলে শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা ও পরিকল্পনায় শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহিদ মিনারটি ভেঙে দিলে ১৯৭২ সালে সে নকশা অনুযায়ী বর্তমান শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয় ।

তারপরও ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জাতীয় পরিষদে বাংলা ভাষা বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে এর সদস্য আদেলউদ্দিন আহমদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিল পাস করা হয় । ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় ।

Content added By

রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৪৭ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ছিল ২৭ বছর। তরুণ ও আদর্শিক নেতা শেখ মুজিব পূর্ব-বাংলার অধিকার সংশ্লিষ্ট এবং ন্যায়সঙ্গত সকল আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় থাকতেন। বিষয়টি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরও চোখ এড়ায়নি। ফলে সামনের সারির প্রবীণ নেতাদের রেখে গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের উপর সে সময়ের পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের গোপননথি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্যা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' ১ম ও ২য় খণ্ড। প্রথম খণ্ডটির সময়কাল ১৯৪৮-১৯৫০ এবং দ্বিতীয় খণ্ডটির সময়কাল ১৯৫১-১৯৫২। বই দু'টোর গোয়েন্দা রিপোর্টেই ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্পষ্ট।

১৯৪৮ সালের ২ মার্চ, বাংলা ভাষা-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিশ ও মুসলিম লীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এখানে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । ৪ মার্চ ঢাকা জেলা গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমানসহ যারা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে কাজ করেছে তারাই বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে লিফলেট ছড়াচ্ছে' । ১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। ১১ মার্চের হরতাল কর্মসূচি চলাকালে তিনি গ্রেফতার হন। মোনায়েম সরকার সম্পাদিত বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি' শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই তাঁর প্রথম গ্রেপ্তার।

গোপন দলিলের ২৭ নং এন্ট্রিতে ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে 'আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ ও চালু করার বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একাধিক ভাষণে জোর দিয়েছেন।’ জাতীয় নেতা সোহরাওয়ার্দীর উর্দুর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিবৃতি (২৯ জুন, ১৯৫২, ইত্তেফাক) বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাষা সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ায় আমরা বেশ অসুবিধায় পড়ি। তাই ঐ বছর জুন মাসে আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য করাচি যাই এবং তাঁর কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বাংলার দাবির সমর্থনে তাকে একটি বিবৃতি দিতে বলি।' তিনি সোহরাওয়ার্দী মিশনে সফল হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মওলানা ভাসানীর একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার পক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত পরিবর্তনে মুজিব সক্ষম না হলে শুধু ভাষা আন্দোলন নয়-আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।”

অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ভাষার অধিকার চেয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এরপর আর থেমে থাকেননি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । আমৃত্যু তিনি বাংলা ভাষার গৌরব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর প্রথম বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেন ।

Content added By

ভাষা আন্দোলনে নারী

আটচল্লিশ ও বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন এদেশের নারী সমাজের প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল । মিছিল, স্লোগান, সভা-সমিতিতে তারাও পুরুষের পাশাপাশি সংগ্রাম করেছেন । ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, বিশেষ করে কামরুন্নেসা স্কুল এবং ইডেন কলেজের ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল সংগ্রামী। মিছিল মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে নাদিরা বেগমসহ আরও অনেকে পোস্টার, ফেস্টুন লিখন এবং নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন । ঢাকার বাইরেও নারী সমাজের ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং প্রতিবাদী । যশোরে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন হামিদা রহমান । বগুড়ার বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন রহিমা খাতুন, সালেহা খাতুনসহ অনেকে । ভাষা আন্দোলনে সিলেটের নারীদেরও ব্যাপক ভূমিকা ছিল । এ আন্দোলনে সংগ্রামী ভূমিকা রাখেন হাজেরা মাহমুদ, যোবেদা খাতুন চৌধুরী, শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেছা খাতুন, সৈয়দা নাজিরুন্নেছা খাতুন, রাবেয়া খাতুনসহ আরও অনেকে । পোস্টার ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আন্দোলন সচল রাখার তৎপরতা চালানোর সময় ১৯৪৯ সালের ১৩ই আগস্ট গ্রেফতার হন লিলি চক্রবর্তী। এসব সংগ্রামী ভূমিকার পাশাপাশি ঐ সময় বিভিন্ন স্থানে নারীরা ভাষা আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করেন । তাঁদের মধ্যে নিবেদিতা নাগ, সারা তৈফুর মাহমুদ, সাহেরা বানু উল্লেখযোগ্য ।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যাঁরা পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশন বর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে আনোয়ারা খাতুন ছিলেন অন্যতম। তিনি ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ভাষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন । বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে ছাত্রীরাও দুঃসাহসী ভূমিকা রাখেন । ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গায় যাঁরা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা হলেন শামসুন্নাহার, রওশন আরা, সুফিয়া ইব্রাহিমসহ অনেকে । তাছাড়া নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের নেত্রী মমতাজ বেগম গ্রেফতার হলে পুলিশ- জনতার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছিল ।

Content added || updated By

ভাষা আন্দোলনেরর তাৎপর্য

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা । পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে এটি ছিল বাঙালি জাতির প্রথম প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রেরণা । ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের অবহেলা, বঞ্চনা, শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল । মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবমাননা বাঙালির মনকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল । তারা বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তানিদের হাতে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি কিছুই নিরাপদ নয় । এভাবেই বাঙালির মাঝে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ বপিত হয় ।

Content added By

শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের গুরুত্ব

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরের বছর থেকে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির একুশে দিনটি বাঙালির শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে ভাষাশহিদদের প্রতি পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন । একুশের প্রভাতফেরি ও প্রভাতফেরির গান বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয় । এদিন শহিদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি চেতনাকে লালন করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা হয় ।

Content added By

শেখ হাসিনার নেতৃতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি

মানুষের ব্যক্তিত্বের, নেতৃত্বের এবং নাগরিককে আকৃষ্ট করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার বিশুদ্ধ ভাষা ও সুস্পষ্ট উচ্চারণ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের (১৯৭১) ভাষণ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া জাতিসংঘের মতো বিশ্ব দরবারে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এভাবেই বাঙালি বিভিন্নভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে বিশ্ব দরবারে বাংলাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান আমলে, সে ধারারই সার্থক পরিণতি হলো আমাদের মাতৃভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি আদায়ের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার-এ বসবাসরত Mother Language Lover of the World নামের একটি বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী গ্রুপ ১৯৯৮ সালের ২৮ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান-এর কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করে। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগী আব্দুস সালাম। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ২৭ ধারার উপর ভিত্তি করে তাঁরা আবেদনপত্রে উল্লেখ করেন যে, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের অসংখ্য জাতিগোষ্ঠীকে মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য, মাতৃভাষা ভুলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে; বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা ‘সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ'-এর সরাসরি লঙ্ঘন। পত্রে তারা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য বাঙালির ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত পটভূমি তুলে ধরেন। যা সারা পৃথিবী জুড়ে অনন্য ।

তারা ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন জানান ৷ যাতে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিবস পাবে। এ আবেদনে বিভিন্ন ভাষাভাষী ১০ জন স্বাক্ষর করেন। এ আবেদনের বিষয়টি বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত হলে এ ব্যাপারে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। ফলে অতি দ্রুততার সাথে বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন, শিক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে প্রস্তাবটি যথাসময়ে পেশ করে। ইউনেস্কো তথা জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি মেনে নেয়। ২৮টি রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাবে লিখিতভাবে সমর্থন জানায় এবং Draft Resolation - 35 হিসেবে চিহ্নিত করে এক্সিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণ করে ।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সর্বসম্মতিক্রমে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং সকল সদস্য রাষ্ট্রকে দিবসটি উদ্যাপনের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে ১৯৫২ সাল থেকে যে ২১ শুধু আমাদের ছিল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অহংকার বাঙালির ভাষা বিশ্বসভায় আসন করে নেয়। বাংলাদেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট'। ২০১০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হচ্ছে। এখন ২১শে ফেব্রুয়ারি বা বাংলাভাষা শুধু বাংলাদেশের মানুষের কথা বলে না, কোনো একটি জাতি-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার কথা বলে না। সকল দেশ, সকল জাতির মাতৃভাষারও প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাভাষা।

Content added By

১৯৪৭ সালে বাংলার বিদ্যমান রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ব বাংলায় প্রধানত তিনটি রাজনৈতিক দল বা ধারা বিদ্যমান ছিল । যথা:

১. ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ,

২. অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক ধারার দল জাতীয় কংগ্রেস,

৩. বিপ্লবী সাম্যবাদী ধারার কমিউনিস্ট পার্টি ।

 

মুসলিম লীগ ও তার অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড:
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান মুসলিম লীগ । নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসক দল হিসেবে মুসলিম লীগের যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকেই উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবর্গের পকেট দলে পরিণত হয় মুসলিম লীগ । পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙালি নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ নেতারা বাঙালির বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে, বাঙালির প্রতি চালায় দমননীতি । শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমদের মতো মুসলিম লীগের ত্যাগী বাঙালি নেতারা উপেক্ষিত হন । শাসক দল হিসেবে মুসলিম লীগ শুরু থেকেই অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিকভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকে । ধীরে ধীরে মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে ।

১৯৪৭ সাল পরবর্তী পূর্ব বাংলায় শুরু থেকেই মুসলিম লীগ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে । দ্বিমুখী ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে এসময় দলটি। একটি ধারা ছিল সোহরাওয়ার্দী-হাশিমপন্থী, অন্যটি ছিল খাজা নাজিমুদ্দীন- মওলানা আকরম খাঁপন্থী । প্রথম ধারাটি ছিল উদার, গণতান্ত্রিক, সংস্কারপন্থী এবং দ্বিতীয় ধারাটি ছিল রক্ষণশীল পশ্চিম পাকিস্তানিদের আজ্ঞাবহ দোসর। ফলে এ অন্তর্কোন্দল দলটিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সংস্কারপন্থী ধারার নেতাদের সবসময় কোণঠাসা এবং দমন করার চেষ্টা করত। মুসলিম লীগের এই ভ্রান্তনীতির কারণে দেশে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয় । মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার উন্নতির দিকে সামান্যতম দৃষ্টিপাত করত না। পূর্ব বাংলার প্রতি তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ ক্রমেই প্রকট হতে থাকে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি - প্রতিটি ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ছিল লক্ষণীয়। ১৯৪৮ সাল থেকে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের জনসমর্থন দ্রুত কমতে থাকে ।

নতুন নতুন রাজনৈতিক দল:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, দমননীতি, সীমাহীন বৈষম্য, বাংলা ভাষার অবমাননা ইত্যাদি কারণে মুসলিম লীগেরই অনেক নেতা মর্মাহত হন । মুসলিম লীগের বিরোধী পক্ষরা রাজনৈতিক দল গঠনে এগিয়ে আসেন । এসময় পূর্বের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়াও পিপলস ফ্রিডম লীগ, গণ আজাদী লীগ, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, নেজামে ইসলাম, খিলাফত-ই-রাব্বানি পার্টি, কৃষক-শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি সংগঠন গড়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে বড় পটপরিবর্তন ছিল খোদ মুসলিম লীগের মধ্যে ভাঙন । বাংলার মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী নেতারা মুসলিম লীগ ত্যাগ করে গড়ে তোলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ । এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলায় মুসলিম লীগবিরোধী এক বা একাধিক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে ।

আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ:
দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম লীগের যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও সংস্কারপন্থী ছিল তাদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি মদদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল অপর অংশ নানাভাবে দমন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। দেশ শাসনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে এই প্রতিক্রিয়াশীল অংশ জনগণ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে । অন্যদিকে মুসলিম লীগের বঞ্চিত নেতাদের প্রতি জনসমর্থন বাড়তে থাকে । জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ অনেকে মুসলিম লীগের প্রচলিত নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন । ১৯৪৮ সালের মে মাসে ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী একটি বিরোধী দল গঠনের জন্য আলোচনায় বসেন । এরই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগ বিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথেও নতুন দল গঠন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে । নতুন দল গঠনের তৎপরতা ও প্রস্তুতির পর ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪শে জুন ঢাকার রোজ গার্ডেন নামের একটি বাড়িতে কর্মী সম্মেলন হয়। ৩০০ জন শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধি এতে অংশ নেন ।

সভায় সর্বসম্মতভাবে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার আরমানিটোলায় ২৪শে জুন সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ সময়ে তাদের প্রধান দাবির মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, একজনের এক ভোট, গণতন্ত্র, একটি সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। বাংলার ইতিহাসে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথম সফল বিরোধী দল । এ দলটি গঠনের মাধ্যমে বিরোধী রাজনীতিতে যে শূন্যতা ছিল তা পূরণ হয়। মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের কুশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে অচিরেই দলটি জনগণের আস্থা অর্জনে সমর্থ হয় । ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জয়লাভে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এরপর মুসলিম লীগ একটি নামসর্বস্ব দলে পরিণত হয় ।

জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী মুসলিম লীগ অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিল । ফলে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' নাম ধারণ এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য এর দ্বার খুলে দেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালে 'ছয় দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রকৃতই আওয়ামী বা জনগণের দলে পরিণত হয় । এরপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্ৰণ পুরোটাই আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে । ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে দলটি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে । আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ।

Content added || updated By

যুক্তফ্রন্ট এবং প্রাদেশিক নির্বাচন (১৯৫৪ সালে)

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচন ছিল বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । মূলত এ নির্বাচন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তার দোসরদের শোষণের বিরুদ্ধে এক 'ব্যালট বিপ্লব' । পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিভিন্ন উপদল, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যর্থ শাসন, অঞ্চলভেদে বৈষম্যমূলক নীতি প্রভৃতির কারণে নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন আবশ্যক হয়ে পড়ে । বিশেষ করে এ সময় পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের চরম ব্যর্থতার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক- শ্রমিক পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। আগে থেকেই ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও মুসলিম লীগ সরকার পরাজয়ের আশঙ্কায় নানা টালবাহানা করে নির্বাচনের তারিখ বারবার পিছিয়ে দেয় । অবশেষে সরকার পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ।

 

যুক্তফ্রন্ট গঠনের পটভূমি এবং ২১ দফা কর্মসূচি: 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ছিল পুরাতন ও বড় দল । এছাড়া পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করত মুসলিম লীগ। ফলে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম লীগকে পরাজিত করার কৌশল হিসেবে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার পরিকল্পনা নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যুক্তফ্রন্ট মূলত পাঁচটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় । ১. মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ২. শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক- শ্রমিক পার্টি, ৩. মওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, ৪. হাজী দানেশের বামপন্থী গণতন্ত্রী দল ও ৫. খিলাফত-ই-রাব্বানি। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল 'নৌকা'। আওয়ামী মুসলিম লীগের নির্বাচনী কর্মসূচির ৪২ দফার প্রধান প্রধান দাবি নিয়ে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হয় । পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে প্রণীত এই ২১ দফা কর্মসূচির মুখ্য রচয়িতা ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ । প্রধান দফাগুলো সংক্ষেপে বর্ণিত হলো :

  • বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ;
  • বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা ;
  • পাটশিল্পকে জাতীয়করণ করা ;
  • কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করা ;
  •  অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা ;
  •  মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ;
  •  '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের স্মরণে শহিদ মিনার নির্মাণ ;
  •  ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা ;
  •  ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ;
  •  আইন পরিষদের মেয়াদ কোনোভাবেই বৃদ্ধি না করা ;
  •  আইন পরিষদের আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন দিয়ে তা পূরণ করা ;

নির্বাচনের ফলাফল:
১৯৫৪ সালের ৮ই মার্চের নির্বাচন ছিল পূর্ব বাংলায় প্রথম অবাধ ও সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন । নির্বাচনে শতকরা ৩৭.১৯ ভাগ ভোটার ভোট দেয়। ২রা এপ্রিল সরকারিভাবে নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয় । মোট ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে । ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন ।

নির্বাচনের তাৎপর্য:
১৯৫৪ সালের নির্বাচন ছিল মুসলিম লীগের অন্যায়, বৈষম্যমূলক ও ব্যর্থ শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ । বাঙালি জাতি এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগকে বুঝিয়ে দেয় যে, তারা পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগকে আর চায় না । যুক্তফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে তরুণ নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম করে। কারণ অনেক তরুণ নেতার কাছে মুসলিম লীগের বড় বড় নেতার পরাজয় ঘটে । এছাড়া যুক্তফ্রন্টের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ আসন লাভ ভবিষ্যতে তাদের পূর্ব বাংলায় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বহন করে । এ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ ধারার সৃষ্টি হয় ।

সর্বোপরি এ নির্বাচনের মাধ্যমে মুসলিম লীগ ও অবাঙালি নেতৃত্বের প্রতি বাঙালির মনে ব্যাপক অনাস্থা জন্মায় । তারা বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা বাঙালির প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদীর আদর্শের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাবাসী স্বায়ত্তশাসনের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করে ।

Content added By

নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন:
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে । প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তিনি অর্থ, রাজস্ব ও স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব নেন। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আবু হোসেন সরকার বিচার, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার; সৈয়দ আজিজুল হক শিক্ষা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল্লি উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন ।

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল ও পূর্ব বাংলায় কেন্দ্ৰীয় শাসন:
যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয় শুরু থেকেই মুসলিম লীগ সুনজরে দেখেনি । তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে । এ সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কলকাতা সফরে এসে দুই বাংলা নিয়ে আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরাগভাজন হন । নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ও বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিলে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকার সুযোগ খুঁজতে থাকে যে কোনো অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করতে । এমতাবস্থায় মে মাসে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে কারা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনগণের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও বিহারি শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ হয় । ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ বলে দায়ী করতে থাকে ।

একই সময় ‘নিউইয়র্ক টাইমস'-এ ফজলুল হকের এক সাক্ষাৎকার বিকৃত করে প্রকাশিত হয় যে, তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চান। এতে মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে ঘোষণা দেয় । অবশেষে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে। এ শাসন ১৯৫৫ সালের ২রা জুন পর্যন্ত বহাল থাকে। মাত্র ৫৬ দিনের শাসনের পর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অবসান হয় । মূলত মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র এবং যুক্তফ্রন্টের শরিক দলের মধ্যে কোন্দলের কারণে ঘন ঘন সরকার বদল হতে থাকে। মাত্র চার বছরে সাত মন্ত্রিসভার পতন হয় । কেন্দ্ৰীয় সরকার তিনবার গভর্নরের শাসন জারি করে । যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি ।

১৯৫৬ সালের সংবিধান:
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন । সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয় । ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে দ্রুত সংবিধান রচনার দাবি ওঠে । পূর্ব বাংলা থেকে এ দাবি ছিল আরও জোরালো । পূর্ব বাংলার জন-দাবিই ছিল নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যেন অর্জিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করতে চাইল। প্রথম অবস্থায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ গঠন করা হয়। এই গণপরিষদের দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা । কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অনীহায় গণপরিষদের কাজ ব্যাহত হতে থাকে ।

অবশেষে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ কর্তৃক একটি মূলনীতি কমিটি গঠন করা হয় । এ মূলনীতি কমিটিতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ছিল নগণ্য । সময়ক্ষেপণ করে মূলনীতি কমিটি ১৮ মাস পরে তার সুপারিশ ও প্রতিবেদন পেশ করে । এ কমিটির সুপারিশে পূর্ব বাংলার জনগণকে সব দিক থেকে বঞ্চিত করা হয় । ফলে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে এবং তারা কমিটির সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে । এরপর মূলনীতি কমিটি ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় এবং ১৯৫৩ সালে তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে । কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে যায়। অবশেষে ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে গভর্নর জেনারেল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন । পশ্চিম ও পূর্ব অংশের নেতারা একটি সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন । তারই ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হয় । এই সংবিধান দুই বছর পর্যন্ত কার্যকর ছিল । ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দর মির্জা সামরিক শাসন জারি করলে সংবিধান স্থগিত করা হয় এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসনের অবসান ঘটে।

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion