গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর ষষ্ঠ শতকে ‘পরবর্তী গুপ্ত বংশ' বলে পরিচিত গুপ্ত উপাধিধারী রাজাগণ উত্তর বাংলা, পশ্চিম বাংলার উত্তরাংশ ও মগধে ক্ষমতা বিস্তার করেছিলেন। ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ অঞ্চলই গৌড় জনপদ নামে পরিচিতি লাভ করে । মৌখরি ও পরবর্তী গুপ্তবংশীয় রাজাদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর পুরুষানুক্রমিক সংঘর্ষ এবং উত্তর থেকে তিব্বতীয় ও দাক্ষিণাত্য থেকে চালুক্যরাজগণের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে বাংলায় গুপ্তবংশীয় রাজাগণ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে সামন্তরাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে গৌড় অঞ্চলে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীন গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন ।
শশাংক : শশাংকের পরিচয়, তাঁর উত্থান ও জীবন-কাহিনি আজও পণ্ডিতদের নিকট পরিষ্কার নয় । গুপ্ত রাজাদের অধীনে বড় কোনো অঞ্চলের শাসককে বলা হতো 'মহাসামন্ত'। ধারণা করা হয় শশাংক ছিলেন গুপ্ত রাজা মহাসেনগুপ্তের একজন ‘মহাসামন্ত' এবং তাঁর পুত্র অথবা ভ্রাতুষ্পুত্র । শশাংকের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ । তিনি গৌড়ে অধিকার স্থাপন করে প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার শুরু করেন । তিনি দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), উড়িষ্যার উৎকল (উত্তর উড়িষ্যা) ও কঙ্গোদ (দক্ষিণ উড়িষ্যা) এবং বিহারের মগধ রাজ্য জয় করে তাঁর রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন । তাঁর রাজ্য পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কামরুপের (আসাম) রাজাও শশাংকের হাতে পরাজিত হন । এরপর তিনি পশ্চিম সীমান্তের দিকে মনোযোগ দেন । উত্তর ভারতে এ সময় দুইজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন । একটি পুষ্যভূতি রাজবংশের অধীনে থানেশ্বর এবং অন্যটি মৌখরি রাজবংশের অধীনে কান্যকুব্জ (কনৌজ)।
শশাংক এরপর উত্তর ভারত জয়ের চিন্তা করেন। উত্তর ভারতে এ সময় দুইটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল। একটি পুষ্যভূতি রাজবংশের অধীনে থানেশ্বর এবং অন্যটি মৌখরী। রাজবংশের অধীনে কান্যকুব্জ (কনৌজ । মৌখরীরাজ গ্রহবর্মা পুষ্যভূতিরাজ প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজশ্রীকে বিয়ে করেন। ফলে এ দুই রাজ্যের সাথে বন্ধুত্ব হয়। রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন ছিলেন রাজশ্রীর দুই ভাই। শশাংক গুপ্তদের চিরশত্রু মৌখরীদের উৎখাত করার সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হন। এ জন্য তিনি মালবরাজ দেবগুপ্তের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন।
শশাংক উত্তর ভারতে পৌঁছার পূর্বেই দেবগুপ্তের হাতে গ্রহবর্মণ পরাজিত ও নিহত হন। রাজশ্রীকে বন্দী করা হয়। দেবগুপ্ত এবার থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হন। থানেশ্বরের রাজা তখন রাজ্যবর্ধন। তিনি পথিমধ্যে দেবগুপ্তকে বাধা দেন। দেবগুপ্ত যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। রাজ্যবর্ধন এবার অগ্রসর হন কনৌজের দিকে। তিনি পথিমধ্যে শশাংকের মুখোমুখি হন। যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয় ।
রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন কনৌজ ও থানেশ্বরের অধিপতি হন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি শশাংকের বিরুদ্ধে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। এ লক্ষ্যে তিনি আসামের (কামরূপ) রাজা ভাস্কর বর্মণের সাথে মিত্রতা করেন। কিন্তু এ সংঘর্ষের ফলাফল বা আদৌ কোনো সংঘর্ষ হয়েছিল কি-না সে বিষয়ে সঠিকভাবে জানা যায় না। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দের কিছু আগে শশাংক মৃত্যুবরণ করেন। শশাংক শৈব ধর্মের উপাসক ছিলেন। হিউয়েন-সাং তাঁকে বৌদ্ধধর্ম বিদ্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছেন । তবে এ ব্যাপারে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। সপ্তম শতকে বাংলার ইতিহাসে শশাংক একটি বিশিষ্ট নাম । প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে তিনিই প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম শাসক ।
আরও দেখুন...