মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু ও মুসলমান এই দুইটি ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল । বস্তুত এই দুই ধর্মকে কেন্দ্র করেই মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক রীতি-নীতি গড়ে উঠেছিল ।
মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি:
মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান শাসনকালে সুলতান ছিলেন সমাজ জীবনে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী । মুসলমান সমাজ জীবনে সুলতানকে কতকগুলো বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হতো। জুমা এবং ঈদের নামাজে খুতবা পাঠ মুসলমান শাসকের একটি বিশেষ কর্তব্য ছিল। তাঁকে মুসলমান সমাজের নেতা হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হতো । মুসলমানদের ঐক্য ও ধর্মীয় চেতনা প্রসারের জন্য শাসক নিজ নিজ রাজ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ্ ইত্যাদি নির্মাণ করতেন। মুসলমান শাসকরা জমকালো প্রাসাদে বাস করতেন। তাঁদের রাজধানীও নানারকম মনোমুগ্ধকর অট্টালিকায় সুসজ্জিত থাকত । ঐশ্বর্য ও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও রাজদরবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ । শাসকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান সমাজ ব্যবস্থায় উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন – এই তিনটি পৃথক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। সৈয়দ, -- উলেমা প্রমুখ শ্রেণি সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল । ধর্মপরায়ণ ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণকে জনগণ যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত। মুসলমান শাসকগণও তাঁদের বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে ভাতা এবং জমি বরাদ্দ করা হতো। উলেমাগণ ইসলামি শিক্ষায় অভিজ্ঞ হতেন । তাঁদের মধ্য থেকে কাজি, ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং ধর্মবিষয়ক অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করা হতো । শেখগণ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতেন। মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
মধ্যযুগে বাংলার মুসলমান সমাজে একটি অভিজাত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল । যোগ্যতা, প্রতিভা ও জ্ঞানের দ্বারা তারা নিজেদের সাধারণ মানুষের তুলনায় একটি আলাদা শ্রেণি হিসেবে গড়ে তুলেছিল । যেকোনো ব্যক্তি তার যোগ্যতা ও প্রতিভা দ্বারা রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদে বসতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি ও সুবাদার মুর্শিদ কুলি খানের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য । অবশ্য পরবর্তী সময়ে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। উত্তরাধিকার সূত্রে মর্যাদাপূর্ণ সরকারি পদ লাভের নীতি প্রচলিত হয় । এ যুগে সামরিক ও বিচার বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে সরকারি অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। নিম্ন শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয় । কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে তৃতীয় শ্রেণি গঠিত ছিল। কৃষকদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু । কতকগুলো পেশা মুসলমানদের জন্য একচেটিয়া ছিল ।
মুসলমান সমাজে কতকগুলো সামাজিক উৎসব পালন করা হতো। এগুলো এখনও মুসলমানরা পালন করে । মুসলমানরা নবজাত শিশুর নামকরণকে কেন্দ্র করে ‘আকিকা' নামক বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করে। ‘খতনা’ মুসলমান সমাজের একটি অতি পরিচিত সামাজিক প্রথা ছিল । বিয়ে মুসলমান সমাজের একটি বিশেষ উৎসবমুখর অনুষ্ঠান । মৌলবিরা মুসলমান রীতি-নীতি অনুযায়ী বিবাহকার্য সম্পন্ন করে থাকেন। মৃতদেহ সৎকার এবং মৃতের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানরা কতকগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতি পালন করে। তারা মৃতদেহকে কবর দেয় এবং তার আত্মার শান্তির জন্য কোরআন পাঠ করে এবং মিলাদ পড়ায় । ধর্মীয় উৎসবাদি এবং বিয়ে-শাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে মৌলবিদের উপস্থিতি অপরিহার্য । মুসলমান সমাজে সুফি ও দরবেশ নামে পরিচিত পির বা ফকির সম্প্রদায়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাধারণ মানুষ তাদের দেয়া তাবিজ-কবজ ব্যবহার করত । বাংলার বিশাল সংখ্যক হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা অনেকেই তাদের পূর্ববর্তী ধর্মের কোনো কোনো বিশ্বাস ও সংস্কার ত্যাগ করতে পারেনি। এভাবে হিন্দু সমাজের ‘গুরুবাদ’ মুসলমান সমাজে প্রবেশ করে । পিরের দরগায় সন্ধ্যায় আলো জ্বালানো এবং শিরনি প্রদান অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা ছিল ।
অভিজাত মুসলমানরা ছিল ভোজনবিলাসী। তাদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন মাছ-মাংসের সঙ্গে আচারের নামও পাওয়া যায় । এসব খাবারের পাশাপাশি কাবাব, রেজালা, কোর্মা আর ঘিয়ে রান্না করা যাবতীয় মুখরোচক খাবার জায়গা করে নেয় । ভাত, মাছ, শাক-সবজি বাঙালি মুসলমানদের প্রতিদিনের খাদ্য ছিল। খাদ্য হিসেবে রুটির ব্যবহারের কথাও জানা যায় । খিচুড়ি তখনকার সমাজে একটি প্রিয় খাদ্য ছিল । অভিজাত মুসলমানরা পায়জামা ও গোল গলাবন্ধসহ জামা পরত। তাদের মাথায় থাকত পাগড়ি, পায়ে থাকত রেশম ও সোনার সুতার কাজ করা চামড়ার জুতা । তারা তাদের আঙ্গুলে অনেক মণি-মুক্তা বসানো আংটি ব্যবহার করত । মোল্লা ও মৌলবিরাও পায়জামা, জামা এবং টুপি ব্যবহার করত। গরিব বা নিম্ন শ্রেণির মুসলমানরা লুঙ্গি ও টুপি পরত। অভিজাত মহিলারা কামিজ ও সালোয়ার ব্যবহার করত । তারা প্রসাধনী ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল না । তারা বাহু ও কব্জিতে সোনার অলঙ্কার এবং আঙ্গুলে সোনার আংটি পরত ।
এ যুগের প্রথম দিকে চারিত্রিক গুণাবলি ও সততার জন্য মুসলমানরা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল । পরবর্তী সময়ে তারা ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে কঠোর ও নৈতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে মুসলমান সমাজে দুর্নীতি ও অনৈসলামিক কার্যাবলির অনুপ্রবেশ ঘটে। সামাজিক জীবনে মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন শাসন ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল । বাংলার নবাবি শাসনের অবসানের পেছনে শাসকবর্গের নৈতিক অবনতি যথেষ্ট দায়ী ছিল।
হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি:
মধ্যযুগে বাংলার মুসলমানদের প্রভাব, রীতিনীতি ও ভাবধারা হিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল । তথাপি হিন্দু সমাজের মূল নীতিগুলো এবং সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ যুগেও হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল । বিভিন্ন পেশাকে ভিত্তি করেই এ প্রথার সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সমাজে এ চারটি উল্লেখযোগ্য বর্ণ ছিল । এ চার বর্ণের মানুষের মধ্যে সামাজিক মেলামেশা ছিল না। বর্ণপ্রথা কঠোরভাবে পালিত হতো । ফলে এক বর্ণের সঙ্গে অন্য বর্ণের বিয়ে বা আদান-প্রদান নিষিদ্ধ ছিল । ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের একক কর্তৃত্ব ছিল।
মধ্যযুগের বাংলায় জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যু উপলক্ষে হিন্দুরা বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি পালন করতো । তখনকার যুগের প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলো বর্তমানকালেও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে লক্ষ্য করা যায়। সন্তান জন্মের পর তাকে গঙ্গাজল দিয়ে ধৌত করা হতো । ষষ্ঠ দিনে ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হতো। ব্রাহ্মণ শিশুর কোষ্ঠী গণনা করতেন । এক মাস পর বালক উত্থান পর্ব পালন করা হতো। ছয় মাসের সময় করা হতো অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থা । অধিকাংশ হিন্দু রমণী নিয়মিত উপবাস ও একাদশী পালন করতো।
হিন্দু সমাজে বিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। বাংলায় হিন্দু সমাজে একান্নবর্তী পরিবারই ছিল অধিক । পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্রই সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করত। স্বামীভক্তি হিন্দু সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।
এ সময়ে বাংলার হিন্দু সমাজে নারীদের তেমন কোনো অধিকার ছিল না। স্বামী স্ত্রীকে তার সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করত। কন্যা মাতা-পিতার ওপর, স্ত্রী স্বামীর ওপর, বিধবারা সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পত্তির ওপর স্ত্রীদের কোনো অধিকার ছিল না। সমাজে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল । তবে বাংলায় সর্বত্র এ প্রথা বাধ্যতামূলক ছিল না । তথাপি এ যুগে অনেক নারী নিজ যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত করতে সমর্থ হয়েছিল । সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এ যুগের নারীদের কৃতিত্ব কম ছিল না । বিত্তশালী পরিবারে নিয়মিত শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা হতো । বীণা, তানপুরা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রে এ যুগের নারীরা পারদর্শী ছিল ।
পোশাক ও অলঙ্কার হিসেবে মেয়েরা পাট ও তুলার কাপড়, আংটি, হার, নাকপাশা, দুল, সোনার ব্রেসলেট, সোনার শাঁখা, কানবালা, নথ, অনন্ত, বাজু প্রভৃতি ব্যবহার করতো। বিত্তবান নারীরা অলঙ্কার ব্যবহার করতো। এ সকল অলঙ্কার সোনা, রুপা, হাতির দাঁত দ্বারা নির্মিত হতো এবং মণিমাণিক্য খচিত থাকতো । বিবাহিত স্ত্রীলোকেরা প্রসাধনী হিসেবে সিঁদুর, কাজল, চন্দন মিশ্রিত কস্তুরী প্রভৃতি ব্যবহার করতো। অনেকে পায়ে নূপুর পরতো। কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানে এ সকল অলঙ্কার ও প্রসাধনী ব্যবহার করা হতো। সাধারণ মেয়েরা নিজেদের গৃহে সাধারণ বেশভূষায় সজ্জিত থাকতো। শাড়ি তাদের নিত্যদিনের পোশাক ছিল। পুরুষদের সাধারণ পোশাক ছিল ধুতি । অভিজাত এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা চাদর ও পাগড়ি ব্যবহার করতো। ধনী ব্যক্তিরা বিশেষত ব্যবসায়ীরা গলায় হার, কানে দুল এবং আঙ্গুলে আংটি পরতো।
মধ্যযুগের বাংলার হিন্দু সমাজের খাদ্যের সঙ্গে বর্তমান হিন্দু সমাজের খাদ্যের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই । ভাত ছিল প্রধান খাদ্য। এছাড়া খাদ্য তালিকায় ছিল মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি। চাল থেকে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল। বাঙালি ব্রাহ্মণরা আমিষ খেত । তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত । পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল । তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, কাঁকরোল, কচু উৎপন্ন হতো। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। উল্লেখ্য, তখনকার সময়ে হিন্দু-মুসলমানদের খাদ্য তালিকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে গরুর মাংস খাওয়া হিন্দুদের নিকট চরম অধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতো ।
হিন্দু সমাজে কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল । ফলে সমাজে নানা অনাচার অনুপ্রবেশ করেছিল । ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের মধ্যে এ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল । কৌলীন্য প্রথার ফলে সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত হয় । মধ্যযুগে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজ জীবনে কতকগুলো সামাজিক বিশ্বাস জন্মলাভ করেছিল । জ্যোতিষী পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে শুভক্ষণ নির্ধারণ করত। এ সময় জনগণ ইন্দ্রজাল এবং জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করতো।
আরও দেখুন...