বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই সৃষ্টি হয় শরণার্থী সমস্যা। ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু হলে প্রাণভয়ে ও নিরাপত্তার সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন পথে পাশের দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলোতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। বাকিরা ত্রিপুরা ও আসামে। ১৯৭১ সালের ৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন। শরণার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু । শরণার্থী শিবিরগুলোতে ছিল খাদ্য, পানীয় জল, ওষুধপত্রের স্বল্পতা। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রধান প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থী সমস্যাকে জাতিসংঘের সামনে সমসাময়িক কালে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। বস্তুত, জাতিসংঘ সৃষ্টির পর বাংলাদেশ সংকটে জাতিসংঘ সবচেয়ে বড় মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। শরণার্থী ইস্যুর ব্যাপকতাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে সহানুভূতির জন্ম দিয়েছিল। শরণার্থীদের নিয়ে সরকারি পর্যায়ে ভারতের নীতির প্রধান দুটি দিক ছিল। প্রথমতঃ মানবিক কারণ, দ্বিতীয়তঃ জাতীয় স্বার্থ। অবশ্য ভারতের সুশীল সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল একান্তই মানবিক।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৬ই মে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় বেশ কিছু শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। ১৮ই মে রানীক্ষেতে এক জনসভায় ভাষণদানকালে ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী সমস্যার ব্যাপকতা অনুধাবনের জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ভারত শরণার্থীদের নিজে যেমন সাহায্য করেছে, তেমনি বহির্বিশ্বকেও সাহায্য করতে আহবান জানিয়েছিল। জুন ১৯৭১ পর্যন্ত জাতিসংঘ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত ও প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার। জাতিসংঘের ইতিহাসে এটা ছিল আকাশপথে সবচেয়ে বৃহৎ সাহায্য। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোও সাহায্য পাঠান। ভারত তার নিজস্ব কোষাগার থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ শরণার্থীদের জন্য ব্যয় করে। এজন্য ভারতীয় জনগণকে ১৯৭১-৭২ সালে অতিরিক্ত কর দিতে হয়। ভারতে শরণার্থীদের অস্বাভাবিক আগমণে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে। শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হওয়ায় অন্যরা খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, ফুটপাতে ও রেলস্টেশনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ত্রিপুরায় ১৪ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নেয়, যা গোটা ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সমান ছিল। সেখানে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। সন্তানদের চরম ক্ষতি স্বীকার করেও অভিভাবকেরা শরণার্থীদের আশ্রয়হীন করতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারত প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
আরও দেখুন...