আমরা মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে বিভিন্ন প্রকার সার দেই। এই সার মূলত রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি। তোমরা কি জানো? পাউরুটি ফোলানোর জন্য আমরা ময়দার মধ্যে বেকিং সোডা ব্যবহার করি। কোনো খাদ্য দীর্ঘদিন বাড়িতে রেখে দেওয়ার জন্য ভিনেগার বা অন্যান্য ফুড প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করি। এসব কিছুই রাসায়নিক পদার্থ। আবার, শিল্পকারখানার যে সকল বর্জ্য পরিবেশকে দূষিত করে সেগুলোও রাসায়নিক পদার্থ। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকা রয়েছে। এ সকল রাসায়নিক পদার্থ কীভাবে প্রস্তুত করা হয়, এগুলোর ধর্ম, ব্যবহার ইত্যাদি এই অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
আমরা আমাদের বাসায় নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করি। যেমন: খাদ্য লবণ, বেকিং পাউডার, ভিনেগার, কোমল পানীয় ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ।
খাদ্য লবণ
সাগরের পানিতে অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্য লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) এবং তার সাথে খুবই সামান্য পরিমাণে CaCl2 MgCl2 সহ অন্য কিছু লবণ দ্রবীভূত থাকে। আবার, মাটির তলদেশে খনিজ পদার্থ হিসেবেও সোডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া যায়। আমাদের দেশে সমুদ্রের পানি থেকে খাদ্য লবণ সংগ্রহ করা হয়। সমুদ্র উপকূলের লবণ চাষিরা বিভিন্ন আকৃতির বর্গাকার বা আয়তাকার জমির চারপাশে বাঁধ নির্মাণ করে খানিকটা খুলে রাখে। জোয়ারের সময় যখন পানি ঐ জায়গায় প্রবেশ করে তখন পানি প্রবেশের মুখ বন্ধ করে জোয়ারের পানি আটকে দেওয়া হয়। যখন ঐ পানি সূর্যের তাপে শুকিয়ে যায় তখন ঐ জায়গায় লবণ দেখতে পাওয়া যায়। এটাকে সল্ট হারভেস্টিং বলে। সস্ট হারভেস্টিং এর মাধ্যমে পাওয়া এই লবণকে শিল্পকারখানায় বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদন করে খাবার উপযোগী খাদ্য লবণে পরিণত করা হয়।
সস্ট হারভেস্টিং এর মাধ্যমে পাওয়া লবণের সাথে বালু মিশ্রিত থাকে। এই লবণকে কোনো পাত্রে নিয়ে পানি মিশালে লবণ পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায় কিছু বালু পাত্রের তলায় পড়ে থাকে। তখন লবণ পানির প্রবণকে হেঁকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এবার এই দ্রবণকে তাপ প্রয়োগ করলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যায় এবং লবণ পাত্রের তলায় পড়ে থাকে। এভাবে উৎপন্ন লবণকে প্যাকেটে করে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। আমাদের শরীরের যাবতীয় কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবার জন্য বিভিন্ন আয়ন যেমন: Nat, K+ ইত্যাদি দরকার হয়। শরীরে যদি কোনো কারণে Na+ এর ঘাটতি হয় তবে Nacl পানির সাথে মিশিয়ে খেলে সেই ঘাটতি পুরণ হয়।
Nacl এর ব্যবহার: Nacl অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। যেমন :
(i) ভাত-এর সাথে আমরা তরকারি খাই। তরকারিতে Nacl লবণ না দিলে তরকারি সুস্বাদু হয় না।
(ii) শিল্পকারখানায় NaOH যৌগ প্রস্তুত করার জন্য NaCl ব্যবহৃত হয় ।
(iii) ডায়রিয়া বা পানিশূন্যতা পূরণের জন্য ওষুধ শিল্পে স্যালাইনের মধ্যে NaCl প্রয়োজন হয়।
বেকিং পাউডার
বেকিং সোডা বা খাবার সোডার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NaHCO3)। বেকিং সোডা (NaHCO3) তৈরি করে তার মধ্যে টারটারিক এসিড (C4H6O6) মিশালে বেকিং পাউডার তৈরি হয়। সাধারণত কেক বানানোর কাজে বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয়।
বেকিং সোডা প্রস্তুতি
অ্যামোনিয়া গ্যাস, খাদ্য লবণ, পানি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে বেকিং সোডা প্রস্তুত করা যায়। প্রথমে পানির মধ্যে NaCl কে দ্রবীভূত করে NaCl এর সম্পৃক্ত দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। এবার এই সম্পৃক্ত দ্রবণের মধ্যে NH, গ্যাস প্রবাহিত করে NH, দ্বারা সম্পৃক্ত করা হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে NH, সম্পৃক্ত NaCl দ্রবণের মধ্যে প্রবাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে CO2, NH3, H2O একত্র হয়ে প্রথমে অ্যামোনিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NH HCO3) উৎপন্ন হয়। এরপর অ্যামোনিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট সোডিয়াম ক্লোরাইড-এর সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইড্রোজেন কার্বনেট (NaHCO3) বা বেকিং সোডা উৎপন্ন করে ।
বেকিং সোডাকে বিক্রিয়া পাত্র থেকে পৃথক করে তার সাথে টারটারিক এসিড মেশানো হয়৷ এ মিশ্রণকে বেকিং পাউডার বলে।
বেকিং সোডার ব্যবহার: কেক প্রস্তুতির সময় ময়দার মধ্যে বেকিং পাউডার মিশিয়ে তাপ প্রদান করা হয়। বেকিং সোডা মিশ্রণের টারটারিক এসিডের (C4H6O6) সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম টারটারেট (C4H4 Na2O6), CO2 গ্যাস এবং H2O উৎপন্ন করে। এই CO2 গ্যাস এর জন্য কেক ফুলে উঠে।
বাড়িতে কিংবা বেকারিতে পাউরুটি ফোলানোর জন্য ইস্ট নামক ছত্রাকও ব্যবহার করা হয়। এ জন্য প্রথমে চিনির দ্রবণে ইস্ট মেশানো হয়। এই মিশ্রণ দিয়ে ময়দা মাখিয়ে দলা করে উষ্ণ জায়গায় রেখে দিলে ইস্টের সবাত শ্বসনের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের উৎপন্ন হয় যা পাউরুটিকে ফুলতে সাহায্য করে। পাউরুটি ফুলে ওঠার পর ওভেনে বেকিং করা হলে উত্তাপে ইস্ট মারা যায়, তখন পাউরুটির ফোলা বন্ধ হয় ৷
সিরকা বা ভিনেগার
ইথানয়িক এসিডের 49%-10% জলীয় দ্রবণকে ভিনেগার বলা হয়। ভিনেগার তরল পদার্থ। সাধারণত আচার তৈরি করার সময় ভিনেগার যোগ করা হয়।
ভিনেগারের প্রস্তুতি
25 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে 35 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখা একটি স্টিলের পাত্রে ইথানল (CH3CH2OH) এবং অ্যাসিটোব্যাকটর নিয়ে এর মধ্যে অক্সিজেন গ্যাসের বুদবুদ প্রবাহিত করলে ভিনেগার বা অ্যাসিটিক এসিড বা ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) প্রস্তুত হয়। অ্যাসিটোব্যাকটর এমন এক ধরনের এনজাইম নিঃসৃত করে যা ইথানলকে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করতে সাহায্য করে।
খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগারের ভূমিকা
আচারকে যদি ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে তবে আচার পচে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। আচার-এর মধ্যে ভিনেগার দিলে আচারকে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না। ভিনেগারের মূল উপাদান ইত্থানয়িক এসিড। ভিনেগারকে যখন আচারের মধ্যে দেওয়া হয় তখন ইথানয়িক এসিড কর্তৃক ত্যাগকৃত প্রোটন, H+ ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে এবং খাদ্য দীর্ঘকাল ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এভাবে ভিনেগার দিয়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়।
কোমল পানীয়
ঠাণ্ডা অবস্থায় ও উচ্চ চাপে পানিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস দ্রবীভূত করে কোমল পানীয় তৈরি করা হয়। কোমল পানীয়তে কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানি বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড (H2CO3) উৎপন্ন করে। খাদ্য হজম বা পরিপাক হবার জন্য মানুষ কোমল পানীয় পান করে থাকে।
সুস্থ দেহের সুস্থ মনকেই স্বাস্থ্য বলা হয়। স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য আমরা আমাদের শরীরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। আমাদের শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও ভালো থাকে। আমাদের শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমরা প্রসাধনী সাবান ব্যবহার করি। আমাদের পোশাক বা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার রাখার জন্য আমরা কাপড় কাচা সোডা, ব্লিচিং পাউডার ইত্যাদি ব্যবহার করি। ঘরের জানালার কাচ বা অন্যান্য কাচদ্রব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য আমরা গ্লাস ক্লিনার ব্যবহার করি। টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করি। এসব পরিষ্কার সামগ্রীর প্রস্তুতি এবং পরিষ্কারকরণের ক্রিয়াকৌশল নিম্নে আলোচনা করা হলো:
কাপড় কাচা সোডা
সোডিয়াম কার্বনেট (Na2CO3) কে সোডা অ্যাস বলা হয়। সোডা অ্যাসের 1 অণুর সাথে 10 অণু পানি রাসায়নিকভাবে যুক্ত হলে তাকে কাপড় কাচা বা ওয়াশিং সোডা বলে। কাপড় কাচা সোডার রাসায়নিক নাম সোডিয়াম কার্বনেট ডেকা হাইড্রেট (Na2CO3.10H2O) ।
কাপড় কাচা সোডা প্রস্তুতি
গাঢ় NaOH এর দ্রবণের মধ্যে CO2 কে অধিক পরিমাণে চালনা করলে সোডিয়াম কার্বনেট উৎপন্ন হয় যা পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। বিক্রিয়া পাত্রের মধ্যে Na2CO3 এবং পানি থাকে। সোডিয়াম কার্বনেট 10 অণু পানির সাথে যুক্ত হয়ে কাপড় কাচা সোডা (Na2CO3.10H2O) উৎপন্ন হয়৷
কাপড় কাচা সোডার ব্যবহার
কাপড় পরিষ্কার করতে কাপড় কাচা সোডা ব্যবহার করা হয়।
টয়লেট ক্লিনার
টয়লেট ক্লিনারের মূল উপাদান সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH)। টয়লেট ক্লিনারে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড এর সাথে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (NaOCl) মিশ্রিত থাকে। বেসিন, কমোড ইত্যাদি পরিষ্কার করার জন্য টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। টয়লেট, বেসিন, কমোড ইত্যাদিতে চর্বি জাতীয় পদার্থ, প্রোটিন জাতীয় পদার্থ, বিভিন্ন রং এর জৈব পদার্থ, অজৈব পদার্থ, রোগজীবাণু ইত্যাদি থাকে। যখন টয়লেট, বেসিন, কমোড ইত্যাদিতে টয়লেট ক্লিনার যোগ করা হয়, তখন সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড চর্বি জাতীয় পদার্থ, প্রোটিন জাতীয় পদার্থ ইত্যাদির সাথে বিক্রিয়া করে এবং সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট বিভিন্ন রং এর পদার্থ এবং রোগজীবাণুর সাথে বিক্রিয়া করে এদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।
টয়লেট ক্লিনার দ্বারা টয়লেট পরিষ্কারের কৌশল
টয়লেট ক্লিনারকে যখন টয়লেটের উপর ঢালা হয় তখন টয়লেট ক্লিনারের বিভিন্ন উপাদান বিভিন্নরূপে বিক্রিয়া করে। টয়লেট ক্লিনারের মূল উপাদান NaOH এর ক্ষারধর্মী ধর্মের জন্য টয়লেট পরিষ্কার হয়।
টয়লেট ক্লিনারের সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (NaOCl) পানির সাথে বিক্রিয়া করে হাইপোক্লোরাস এসিডে (HOCl) পরিণত হয় যা ভেঙে জায়মান অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই জায়মান অক্সিজেন রঙিন পদার্থকে বর্ণহীন করে এবং জীবাণুকে ধ্বংস করে। এভাবে টয়লেট ক্লিনার রঙিন পদার্থকে বর্ণহীন করে এবং জীবাণুকে ধ্বংস করে। (তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে জায়মান অক্সিজেনকে বোঝানো হয়। জায়মান অক্সিজেন = [O])
সাবান
সাধারণত সাবান হলো উচ্চতর ফ্যাটি এসিডের সোডিয়াম লবণ (R-COONa) বা উচ্চতর ফ্যাটি এসিডের পটাশিয়াম লবণ ( R-COOK ) । এখানে R কে অ্যালকাইল মূলক বলা হয়। R এর সাধারণ সংকেত CnH2n+1 এবং n এর মান 12 থেকে 18 পর্যন্ত। যেমন: সোডিয়াম স্টিয়ারেট সাবানের সংকেত C17H35COONa এবং পটাশিয়াম স্টিয়ারেট সাবানের সংকেত C17H35COOK। তেল বা চর্বির সাথে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড বিক্রিয়া করে সাবান এবং গ্লিসারিন তৈরি হয়৷ সাবান ও গ্লিসারিন তৈরির এই প্রক্রিয়াকে সাবানায়ন বলে। সাবানায়ন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত সাবান এবং গ্লিসারিনের মিশ্রণের মধ্যে NaCl যোগ করলে গ্লিসারিন পাত্রের নিচে অবস্থান করে এবং সাবানের অণুগুলো NaCl কে ঘিরে একত্র হয়ে পাত্রের উপরের দিকে কেকের আকারে ভেসে উঠে। একে সোপ কেক বলে। সোপ কেককে ছাঁকনির সাহায্যে ছেঁকে পৃথক করে বিভিন্ন আকৃতির ছাঁচে ঢেলে বিভিন্ন আকৃতির সাবান তৈরি করা হয়।
সাবান একটি পরিষ্কারক দ্রব্য যা তেল বা চর্বি এবং ক্ষার থেকে প্রস্তুত করা হয়। ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে সাবানকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রসাধনী সাবান এবং লন্ড্রি সাবান:
প্রসাধনী সাবান: আমাদের ত্বককে পরিষ্কার করার জন্য যেসব সাবান ব্যবহার করি তাদেরকে প্রসাধনী সাবান বলে৷
লন্ড্রি সাবান: কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার জন্য আমরা যেসব সাবান ব্যবহার করি তাদেরকে কাপড় কাচা সাবান বা লন্ড্রি সাবান বলা হয়।
সাবান তৈরির সময় সাবানের সাথে গ্লিসারিনও তৈরি হয়। সাবান এবং গ্লিসারিনের মিশ্রণের সাথে তেল, চর্বি বা ক্ষার ইত্যাদি থেকে যেতে পারে। এগুলো থেকে সাবানকে আলাদা করা হয়৷ এই আলাদা করার সময় যদি সাবানের মধ্যে অধিক তেল বা চর্বি থেকে যায় তখন সাবানের মধ্যে তৈলাক্ত ভাব থেকে যায়। এই সাবান ব্যবহারের সময় তেমন কোনো ফেনা উৎপন্ন করে না। যদি সাবানের মধ্যে অধিক পরিমাণে ক্ষার থেকে যায় তবে এই সাবান ব্যবহার করলে ত্বকের ক্ষতি হয়। এজন্য সাবান তৈরি কারখানায় সঠিক অনুপাতে তেল বা চর্বি এবং ক্ষার যোগ করতে হয় যাতে তেল বা চর্বি এবং ক্ষার সম্পূর্ণরূপে বিক্রিয়া করতে পারে। কার্বক্সিল গ্রুপ অনেক বড় কার্বন শিকলের সাথে যুক্ত থাকলে ঐ যৌগকে উচ্চতর ফ্যাটি এসিড বলে। ফ্যাটি এসিড অ্যালকোহল বা গ্লিসারিনের সাথে বিক্রিয়া করে এস্টার উৎপন্ন করে। উচ্চতর ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারিনের ট্রাই এস্টার তরল অবস্থায় থাকলে তাকে তেল এবং কঠিন অবস্থায় থাকলে তাকে চর্বি বলা হয়৷
স্টিয়ারিক এসিড হলো প্রাণীদেহের ফ্যাট থেকে প্রাপ্ত সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডে কার্বন-কার্বন একক বন্ধন থাকে। কোনো দ্বিবন্ধন বা কোনো ত্রিবন্ধন থাকে না।
জলপাই থেকে যে তেল পাওয়া যায় তাকে অলিভ অয়েল বলে। অলিভ অয়েল থেকে অলিক এসিড পাওয়া যায়। অলিক এসিড হলো অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডে কার্বন-কার্বন দ্বিবন্ধন বা কার্বন-কার্বন ত্রিবন্ধন থাকে। লন্ড্রি সাবানে ক্ষার বা অন্যান্য অপদ্রব্য তুলনামূলক বেশি থাকে এবং এতে সুগন্ধি বা জীবাণুনাশক পদার্থ যোগ করা হয় না। প্রসাধনী সাবানে ক্ষার এবং অন্যান্য অপদ্রব্যের পরিমাণ তুলনামূলক কম থাকে। প্রসাধনী সাবানে সুগন্ধিকারক পদার্থ বা জীবাণুনাশক পদার্থ যোগ করা হয়।
ডিটারজেন্ট
ডিটারজেন্ট সাবানের মতোই এক প্রকার পরিষ্কারক দ্রব্য। ডিটারজেন্ট সাধারণত পাউডারের মতো হয় এবং তরল আকারেও পাওয়া যায়। লরাইল অ্যালকোহলের (C12H2O) সাথে সালফিউরিক এসিড (H2SO4) বিক্রিয়া করে লরাইল হাইড্রোজেন সালফেট (C12H2SO4) এবং পানি উৎপন্ন করে। এই লরাইল হাইড্রোজেন সালফেট (C12H26SO4) এর সাথে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) বিক্রিয়া করে সোডিয়াম লরাইল সালফেট (C12H25SO4Na) এবং পানি (H2O) উৎপন্ন হয়। সোডিয়াম লরাইল সালফেট (C12H25SO4Na) ডিটারজেন্ট নামে পরিচিত।
ডিটারজেন্টকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য ডিটারজেন্টের মধ্যে বিভিন্ন পদার্থ যোগ করা হয়। ডিটারজেন্টকে পাউডার আকৃতির করার জন্য সোডিয়াম সালফেট (Na2SO) যোগ করা হয়।
সাবান ও ডিটারজেন্ট দ্বারা ময়না পরিষ্কার করার কৌশল
সাবান ও ডিটারজেন্ট এর মূল কাজ হলো কাপড়-চোপড় থেকে তেলকে অপসারণ করা এবং পানি দিয়ে ধুয়ে ধুলাবালিকে অপসারণ করা। আমাদের শরীর থেকে তৈলাক্ত পদার্থ বের হয়ে কাপড়ে লেগে যায়। এছাড়া বাতাস থেকে কিছু তৈলান্ত পদার্থ কাপড়ে লেগে যায়। এরপর ধুলাবালি এই তৈলান্ত পদার্থের উপর লেগে মরলা তৈরি করে৷
সামান (R-COONa) ডিটারজেন্ট (C12H2SONa) একটি দীর্ঘ কার্বন শিকলৰিশিষ্ট অণু । পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় এরা ঋণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট সাবান (R-COO) বা ডিটারজেন্ট আয়ন (C12H2SO4) এবং ধনাত্মক সোডিয়াম আয়নে (Na') ভাগ হয়ে যায়। সাবান বা ডিটারজেন্ট আয়নের এক প্রান্তে ঋণাত্মক চার্জ যুক্ত থাকে। এই প্রান্ত পানিকে আকর্ষণ করে বলে হাইড্রোফিলিক বা পানি আকর্ষী বলে। সাবান বা ডিটারজেন্ট আয়নের অন্য প্রান্ত তেল বা প্রিজে দ্রবীভূত হয়, এই প্রান্তকে হাইড্রোফোবিক বা পানি বিকর্ষী বলে।
সাবান কিংবা ডিটারজেন্টকে যখন পানির উপস্থিতিতে তেল বা গ্রিজ জাতীয় ময়লাযুক্ত কাপড়ের সংস্পর্শে আনা হয় তখন তার হাইড্রোফোবিক প্রান্ত তেল বা গ্রিজের দিকে আকর্ষিত হয় এবং এতে দ্রবীভূত হয়। অন্যদিকে হাইড্রোফিলিক অংশ পানির দিকে আকর্ষিত হয় পানির স্তরে প্রসারিত হয়। এ অবস্থায় কাপড়কে ঘষা দিলে বা মোচড়ানো হলে তেল বা গ্রিজের মরলার কণা চারদিক থেকে সাবান বা ডিটারজেন্টের ঋণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট আরন দিয়ে আবৃত হয়ে পড়ে এবং তেল বা গ্রিজের ময়লার কণার চারপাশে ঋণাত্মক চার্জের একটা বলয় সৃষ্টি হয়। তখন এগুলো একটি আরেকটি থেকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ দূরত্বে থাকতে চায় এবং তেল, সাবান এবং পানির সাথে একত্র হয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে। এই মিশ্রণ ফেনা নামে পরিচিত। ফেনাতে আরো পানি যোগ করলে ফেনা অপসারিত হবার সাথে তেল ও ধুলাবালি কাপড় থেকে অপসারিত হয়। এভাবেই সাবান ময়লা পরিষ্কার করে।
সাবান ও ডিটারজেন্টের পার্থক্য
সাবান | ডিটারজেন্ট |
1. সাবান হলো দীর্ঘ কার্বন শিকলবিশিষ্ট ফ্যাটি | 1. ডিটারজেন্ট হলো দীর্ঘ কার্বন শিকলবিশিষ্ট এসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ। বেনজিন সালফোনিক এসিডের সোডিয়াম লবণ |
2. সাবান খর পানিতে ভালো কাজ করতে পারে না। | 2. ডিটারজেন্ট খর পানিতেও ভালো কাজ করতে পারে। |
3. ডিটারজেন্ট এর চেয়ে পরিষ্কারকরণের ক্ষমতা সাবানের কম। | 3. সাবানের চেয়ে পরিষ্কারকরণের ক্ষমতা ডিটারজেন্টের বেশি। |
অতিরিক্ত সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারের কুফল
সাবানের মধ্যে কিছু পরিমাণ ক্ষার, গ্লিসারিন, তেল, চর্বি ইত্যাদি থেকে যায়। অতিরিক্ত সাবান ব্যবহার করলে ক্ষার হাতের ক্ষতি করে। আবার পুকুর বা জলাশয়ের ধারে বা নদীর তীরে কাপড় কাচা হলে সাবানের ফেনা পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে পানির মধ্যে যে সকল জলজ উদ্ভিদ এবং মাছ রয়েছে সেগুলো মারা যায়। এভাবেই অতিরিক্ত সাবান ব্যবহারে পানি দূষিত হয় ৷ আবার ডিটারজেন্টের মধ্যে ট্রাইসোডিয়াম ফসফেট (Na3PO4) থাকে। এই ট্রাইসোডিয়াম ফসফেট উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য ভালো সার হিসেবে কাজ করে। এতে পুকুরে উদ্ভিদের পরিমাণ বেড়ে যায়। উদ্ভিদ তার বেঁচে থাকার জন্য পানির মধ্যে দ্রবীভূত অক্সিজেন খরচ করে ফেলে, ফলে পানিতে অক্সিজেনের অভাবে মাছ মরে যায়। এভাবেই অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট ব্যবহারে পানি দূষিত হয়।
প্রসাধনী ব্যবহারে
মানুষ ত্বক পরিষ্কার করতে, ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায়, চুল পরিষ্কার করতে এবং বিভিন্ন কাজে প্রসাধনী (সাবান, ক্রিম, শ্যাম্পু) ব্যবহার করে। তোমরা আগেই জেনেছো ত্বকের pH 4.8 থেকে 5.5 এর মধ্যে। অর্থাৎ ত্বক অম্লীয় প্রকৃতির যা ত্বকে জীবাণুর আক্রমণ বা বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। কাজেই প্রসাধনীর pH 4.8 থেকে 5.5 এর বেশি থাকলে সেই প্রসাধনী ব্যবহারের কারণে ত্বকের স্বাভাবিক অম্লত্ব কমে যাবে, যার কারণে ত্বকের সৌন্দর্য নষ্ট হবে এবং জীবাণু থেকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে৷ তাই প্রসাধনীর pH এবং ত্বকের pH এর সামঞ্জস্য থাকতে হয়।
ব্লিচিং পাউডার
ব্লিচিং পাউডার এর রাসায়নিক নাম ক্যালসিয়াম ক্লোরো হাইপোক্লোরাইট, Ca(OCl)Cl। বলপেন এর কালি বা অন্য কোনো রং যেগুলো সাবান এবং ডিটারজেন্ট দিয়ে তোলা যায় না সেগুলোকে কাপড় থেকে উঠানোর জন্য তথা বর্ণহীন করার জন্য ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মেঝে, কমোড, বেসিন ইত্যাদি জায়গা থেকে জীবাণু ধ্বংস করার কাজেও ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। 40°C তাপমাত্রায় কঠিন ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মধ্যে ক্লোরিন গ্যাস চালনা করলে ব্লিচিং পাউডার, Ca(OCl)Cl উৎপন্ন হয়।
ব্লিচিং পাউডার দ্বারা কাপড়ের রঙিন দাগ উঠানোর কৌশল
ব্লিচিং পাউডার কাপড়ের রঙিন দাগকে বর্ণহীন করে। এজন্য ব্লিচিং পাউডারকে বিরঞ্জক বলা হয়৷ কাপড়ের দাগ ও ব্লিচিং পাউডার উভয়ই রাসায়নিক পদার্থ। ব্লিচিং পাউডারকে যখন কোনো কাপড়ের দাগের উপর রেখে পানি যোগ করা হয় তখন ব্লিচিং পাউডার প্রথমে পানির সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl2) এবং হাইপোক্লোরাস এসিড (HOCl) তৈরি হয়।
রঙিন পদার্থের সাথে জায়মান অক্সিজেনের (O) বিক্রিয়া করে রঙিন পদার্থকে বর্ণহীন করে।
ব্লিচিং পাউডার দ্বারা জীবাণু ধ্বংস করার কৌশল ঘরের মেঝে, কমোড, বেসিন ইত্যাদি জায়গা থেকে জীবাণু ধ্বংস করার কাজে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। ব্লিচিং পাউডারকে যখন কোনো ঘরের মেঝে, কমোড, বেসিন ইত্যাদির উপর রেখে পানি যোগ করা হয় তখন ব্লিচিং পাউডার প্রথমে পানির সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl2) এবং হাইপোক্লোরাস এসিডে (HOCl) পরিণত হয়।
হাইপোক্লোরাস এসিড ভেঙে গিয়ে জায়মান অক্সিজেন [O] তৈরি করে যা জীবাণুকে ধ্বংস করে।
গ্লাস ক্লিনার
গ্লাস পরিষ্কার করার জন্য যে পরিষ্কারক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় তাকে গ্লাস ক্লিনার বলে। কাচের গায়ে যদি তেল, চর্বি বা গ্রিজ লাগে তবে এগুলোর উপর ধুলাবালি পড়ে কাচে ময়লা তৈরি হয়৷ কাচ পরিষ্কারকরণে এমন একটি পরিষ্কারক পদার্থ ব্যবহার করতে হবে যা তেল, চর্বি বা গ্রিজের সাথে বিক্রিয়া করে কিন্তু কাচের উপাদান সোডিয়াম সিলিকেট বা ক্যালসিয়াম সিলিকেট এর সাথে বিক্রিয়া করে না। সাধারণত অ্যামোনিয়া গ্যাসকে পানিতে দ্রবীভূত করে তৈরিকৃত আমোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NH4OH) এর সাথে আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, CH, CH (OH) CH, মিশিয়ে গ্লাস ক্লিনার প্রস্তুত করা হয়। অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইডকে অ্যামোনিয়া দ্রবণ বলেও উল্লেখ করা হয়।
গ্লাস ক্লিনার দ্বারা কাচ পরিষ্কার করার কৌশল গ্লাস ক্লিনারকে যখন কাচের গায়ে দেওয়া হয় তখন NH, OH কাচের তেল, চর্বি বা গ্রিজের সাথে বিক্রিয়া করে তেল বা চর্বি বা গ্রিজকে কাচ থেকে অপসারণ করে। যদি কাচের গায়ে কোনো জৈব পদার্থ লেগে থাকে তবে আইসো-প্রোপাইল অ্যালকোহল সেই জৈব পদার্থকে দ্রবীভূত করে জৈব পদার্থকে কাচ থেকে অপসারিত করে। গ্লাস ক্লিনার দিয়ে যখন কাচ পরিষ্কার করা হয় তখন নাকে ও মুখে মাস্ক পরে নিতে হয়। কারণ গ্লাস ক্লিনারের মধ্যে যে আমোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড থাকে সেই অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড গ্যাস বের হয়ে নাকে ও মুখে যেতে পারে। অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরীক্ষাগার প্রস্তুতি পরীক্ষাগারে সাধারণত দুইটি পদ্ধতিতে অ্যামোনিরা গ্যাস প্রস্তুত করা হয়। পরীক্ষাগারে একটি টেস্টটিউবে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড (NHCl) এবং ক্যালসিয়াম অক্সাইড করা হয়। (CaO) মিশিয়ে উত্তপ্ত করে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন অথবা পরীক্ষাগারে একটি টেস্টটিউবে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড এবং কলিচুন Ca (OH), মিশিয়ে উক্ত করলে অ্যামোনিরা গ্যাস, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড এবং পানি উৎপন্ন হয়।
শিল্পকারখানার অ্যামোনিরা গ্যাস প্রস্তুতি
শিল্পকারখানায় হেবার পদ্ধতিতে অ্যামোনিরা গ্যাস উৎপাদন করা যায়। হেবার পদ্ধতিতে N2 এবং H2 গ্যাস 1:3 অনুপাতে মিশ্রিত করে এর মধ্যে Fe প্রভাবক যোগ করে যদি মিশ্রণকে 450-550°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয় তবে NH, গ্যাস উৎপন্ন হয়। (1:3 অনুপাতে N2 H2 দ্বারা বোঝায় N2 যত লিটার নেওয়া হবে তার 3 গুণ H, নেওয়া হবে।) NHg গ্যাস উৎপাদনের সমর কিছু তাপ উৎপন্ন হয়। এই বিক্রিয়াটি উভমুখী বিক্রিয়া। একদিকে N2 এবং H, বিক্রিয়া করে NH, তৈরি হয়, অপরদিকে কিছু NH, গ্যাস ভেঙে N2 এবং H2 গ্যাসে পরিণত হয়। এই বিক্রিয়ায় উভমূখী তীর চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
শিল্পকারখানায় উৎপন্ন বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে প্রয়োগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা হয়। চুনাপাথর (CaCO3) একটি মূল্যবান খনিজ সম্পদ। আমাদের দেশে সুনামগঞ্জ জেলায় এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়। চুনাপাথর দ্বারা অনেক পদার্থ তৈরি করা যায়। যেমন: সিমেন্ট তৈরি করার প্রধান উপাদান হিসেবে চুনাপাথর ব্যবহার করা হয়। কোনো কারণে মাটি যদি অম্লীয় হয় অর্থাৎ মাটিতে যদি H এর পরিমাণ বেড়ে যায় তবে মাটির অম্লত্ব কমানোর জন্য সেই মাটিতে চুনাপাথর প্রয়োগ করা হলে চুনাপাথর H' এর সাথে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম আয়ন (Ca2+), কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং পানি তৈরি করে। ফলে মাটির অম্লত্ব কমে যায়।
ইউরিয়া (Urea)
ইউরিয়া মূল্যবান পদার্থ। কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের মিশ্রণকে উচ্চ চাপে এবং 130°-150°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করলে প্রথমে অ্যামোনিয়াম কার্বামেট (NH2COONH4) উৎপন্ন হয়। পরবর্তীতে অ্যামোনিয়াম কার্বামেট ভেঙে ইউরিয়া (NH2-CO-NH2) প্রস্তুত হয়।
শিল্পক্ষেত্রে এবং কৃষিক্ষেত্রে ইউরিয়ার ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে ইউরিয়া থেকে ম্যালামাইন পলিমার তৈরি করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে ইউরিয়াকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জমিতে ইউরিয়া সার দেওয়া হয় যাতে গাছ ইউরিয়া সার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নাইট্রোজেন গ্রহণ করতে পারে। উদ্ভিদ সরাসরি N2 গ্রহণ করে না। মাটিতে ইউরিয়েজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ইউরিয়া পানির সাথে বিক্রিয়া করে NH+, OH- এবং CO2 তৈরি করে। উদ্ভিদ এই NH4+ শোষণ করে।
অ্যামোনিয়াম সালফেট (Ammonium Sulphate)
অ্যামোনিয়া এবং সালফিউরিক এসিড বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম সালফেট [(NH4)2SO4] এবং পানি উৎপন্ন হয় ৷ কৃষিক্ষেত্রে অ্যামোনিয়াম সালফেট এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। অ্যামোনিয়াম সালফেট ক্ষারকের সাথে বিক্রিয়া করতে পারে কাজেই মাটিতে ক্ষারকের পরিমাণ বেড়ে গেলে অ্যামোনিয়াম সালফেট প্রয়োগ করে ক্ষারকের পরিমাণ কমানো হয়। এটি উদ্ভিদের অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এ থেকে উদ্ভিদ নাইট্রোজেন ও সালফার গ্রহণ করে।
কৃষিদ্রব্য প্রক্রিয়াকরণে রাসায়নিক দ্রব্য
ফলমূল, শাকসবজি, মাছ ইত্যাদিকে কৃষিদ্রব্য বলা হয়। যে প্রক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে কোনো কৃষিজাত দ্রব্যকে দীর্ঘদিন ভালো রাখা বা পচনের হাত থেকে রক্ষা করা হয় সেই প্রক্রিয়াকে কৃষিদ্রব্য প্রক্রিয়াকরণ বলা হয়। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ভালো এবং খারাপ উভয় দিকই রয়েছে। ব্যবসায়ীরা পাকা আম বাস, ট্রাক বা ট্রেনে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবার সময় আমের গায়ে দাগ লাগে। এই দাগ যুক্ত আম মানুষ কিনতে চায় না। এজন্য অসাধু ব্যবসায়ী অনেক সময় কাঁচা আম কিনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়, ফলে আমের গায়ে দাগ পড়ে না। এরপর এই কাঁচা আমের উপর অসাধু ব্যবসায়ী ক্যালসিয়াম কার্বাইডের জলীয় দ্রবণ ব্যবহার করে ফলে আম পেকে যায়। আবার, ক্যালসিয়াম কার্বাইড (CaC2) এর মধ্যে পানি যোগ করে অ্যাসিটিলিন গ্যাস তৈরি করা হয়।
এছাড়া এই ইথিলিন গ্যাস দ্বারাও কাঁচা আম পাকানো হয়। ইথিলিনও আমদের শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কার্বাইড দিয়ে আম পাকানো বলতে অ্যাসিটিলিন দ্বারা আম পাকানোর পদ্ধতিকেই বোঝানো হয়।
কৃষিদ্রব্য সংরক্ষণে রাসায়নিক দ্রব্য
কৃষিদ্রব্য যাতে দুর্গন্ধ না হয় বা যাতে এগুলোতে পচন না ধরে সেজন্য বরফ, খাদ্য লবণ, ভিনেগার ইত্যাদি দ্বারা কৃষিদ্রব্য সংরক্ষণ করা হয়। বরফ দ্বারা মাছ সংরক্ষণ করা হয়। টমেটো, কাঁচা আম ইত্যাদি কৌটাতে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য ভিনেগার ব্যবহৃত হয়। খাদ্যের সাথে আমাদের শরীরে ভিনেগার প্রবেশ করলেও আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। ফরমালিন দ্বারা খাদ্য সংরক্ষণ করা হয় না। কারণ ফরমালিন মানুষ এবং প্রাণী সকলের জন্য বিষাক্ত পদার্থ। আমাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করে আমাদের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। অতএব, ফরমালিন দ্বারা কৃষিপণ্য সংরক্ষণ করা উচিত না।
কয়েকটি অনুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ
যেসব রাসায়নিক দ্রব্য খাদ্যসামগ্রীতে দিলে খাদ্যসামগ্রীতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না, দুর্গন্ধ হয় না, পচন হয় না সেসব রাসায়নিক দ্রব্যকে ফুড প্রিজারভেটিভ বলে। যেসব ফুড প্রিজারভেটিভ আমাদের শরীরে গেলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না এবং সেগুলোকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে সেসব ফুড প্রিজারভেটিভকে অনুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ বলা হয়। যেসব ফুড প্রিজারভেটিভ আমাদের শরীরে গেলে আমাদের শরীরের ক্ষতি হয় সেগুলোকে অননুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ বলা হয়। সোডিয়াম বেনজোয়েট, বেনজোয়িক এসিড, ভিনেগার, লবণের দ্রবণ, চিনির দ্রবণ ইত্যাদি অনুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ। ইথিলিন, আসিটিলিন ইত্যাদি অননুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ।
শিল্প বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণ
শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থ পরিবেশকে দূষিত করে। বাংলাদেশে চামড়া শিল্প, রং শিল্প, কীটনাশক শিল্প থেকে বর্জ্য হিসেবে বিভিন্ন প্রকার ভারী ধাতু যেমন: ক্রোমিয়াম (Cr), লেড (Pb), মার্কারি (Hg) এবং ক্যাডমিয়াম (cd) ইত্যাদি নির্গত হয়। এসব ভারী ধাতু বা বর্জ্য পদার্থ মাটি এবং পানিতে প্রবেশ করে। এসব মাটিতে যেসব উদ্ভিদ জন্মে সেসব উদ্ভিদের মধ্যে এসব ধাতু প্রবেশ করে। এসব উদ্ভিদের ফলমূল খেলে আমাদের শরীরে এসব ভারী ধাতু প্রবেশ করে আমাদের কিডনি ও লিভারের ক্ষতি করে এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে। আবার সাবান ও ডিটারজেন্ট কারখানা থেকে প্রচুর পরিমাণে কস্টিক সোডা (NaOH) মাটি এবং পানিতে নির্গত হয়। পানিতে NaOH গেলে পানিতে ক্ষারকের মাত্রা বেড়ে যায়, ফলে পানিতে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ ভালোভাবে বাঁচতে পারে না।
আরও দেখুন...