কর্ম ও কর্মফল

পঞ্চম শ্রেণি (প্রাথমিক) - বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

বৌদ্ধধর্মের মূল ভিত্তি হলো কর্মবাদ। ভালো কর্ম সুফল এবং মন্দ কর্ম কুফল প্রদান করে। এরূপ দৃষ্টি বা ধারণাকে কর্মবাদ বলে। কর্মের গতি বিচিত্র ও বহুমুখী। জীবন কর্মময়। প্রাণীরা কর্মফলের কারণে সুখ-দুঃখ ভোগ করে ৷

বুদ্ধ কর্মবাদ সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন:

প্রাণীগণ নিজ নিজ কর্মের অধীন। কর্মই প্রাণীদের একান্ত আপন। সকলেই কর্মের উত্তরাধিকারী। কর্মই জীবের পুনর্জন্মের হেতু। কর্মই বন্ধু, কর্মই আশ্রয়। ভালো-খারাপ যে যেরূপ কর্ম করে সে সেরূপ ফল ভোগ করে। কর্ম জীবকে হীন-শ্রেষ্ঠ, উচ্চ-নিচ নানাভাবে বিভক্ত করে।

ভগবান বুদ্ধ কুশল কর্মের কথা বলেছেন। ভালো কাজ করলে সকলের প্রশংসা পায়। পুণ্য লাভ হয়। জীবন সুন্দর হয়। সুখী হয়। মৃত্যুর পর স্বর্গে গমন করে। সুকর্ম সুখকর ও আনন্দদায়ক। পুণ্যবান ব্যক্তিরা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। তাঁদের নির্বাণ লাভের পথ প্রশস্ত হয়। দীর্ঘায়ু হয়। ভালো কাজকে কুশল কর্ম বলে।

খারাপ কাজ করলে সবাই নিন্দা করে। পাপ উৎপন্ন হয়। পাপীরা দুঃখে পতিত হয়। কুকর্ম অনিষ্টকর ও দুঃখদায়ক। পাপীরা কুকর্মে লিপ্ত থাকে। তারা সকলের নিন্দার পাত্র হয়। লোভ, দ্বেষ ও মোহ এগুলো দুষ্কর্মের অন্তর্গত। পাপীরা মানুষের হিত ও মঙ্গল কামনা করে না। দুষ্কর্মের ফল ভোগ করে। মৃত্যুর পর নরকে গমন করে। তাই খারাপ কাজকে অকুশল কর্ম বলে।

জীবনের অপূর্ণতা ও দুর্ভাগ্যের জন্য কাউকে দোষ দেওয়া ঠিক নয়। যার দুঃখ সে নিজেই সৃষ্টি করে। নিজের সুকর্মের জন্য নিজেই সুখ ভোগ করে। কুকর্মের জন্য দুঃখ ভোগ করে। মা-বাবা,আত্মীয়-স্বজন কেউ তাকে রক্ষা করতে পারে না। ছেলেমেয়েরা সৎজীবন গঠন করলে মা-বাবা আনন্দিত ও প্রশংসিত হয়। তাই বুদ্ধ বলেছেন— নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, অপর কেউ নয়। স্বর্গ-নরক নিজেদেরই পরিণতি। সেজন্য বলা হয়েছে— 

সুকর্ম কুকর্ম হেথা উভয় প্ৰধান, 

তাদের সহযোগে জীব সদা ভাসমান। 

একদিকে পূর্ণ শান্তি পূর্ণতার দ্বার, 

বিনিমুক্ত; অন্যদিকে নিরয় অপার। 

যার যেদিকে ভার সেদিকে প্রয়াণ, 

কর্ম অনুযায়ী গতি নিয়তি বিধান

তোমরা আপন কর্মে সংযত ও দায়িত্ববান হবে। নিজের দুঃখের জন্য অপর কাউকে দোষ দেবে না। অপরের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। প্রতিদানে তোমাকে ভালোবাসবে। কাউকে ঘৃণা করবে না। সর্বদা সত্য ও ধর্মপথ অনুসরণ করবে।

আমরা সুন্দর জীবন গঠন করলে পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করতে পারি। পুণ্যবান ও শীলবান ব্যক্তিকে সবাই শ্রদ্ধা করে। এটা ধার্মিক ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ধার্মিক ব্যক্তিদের জন্য স্বর্গের দ্বার খোলা থাকে। আর যারা কুকর্মে লিপ্ত হয় তারা সমাজে অবহেলিত ও নিন্দিত হয়। কুকর্মের ফল ইহজীবনে ভোগ করতে হয়। তাই কবি বলেছেন-

কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর, 

মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতে সুরাসুর।

সেজন্য বুদ্ধ চেতনাকে কর্ম বলেছেন। এ চেতনা কায়, বাক্য ও মনোদ্বারে সংঘটিত হয়। তাই কুশল চিত্ত উৎপন্ন করতে হয়। সৎচেতনা দ্বারা সৎকর্ম উৎপন্ন হয়। কর্ম ও কর্মফল জীবন প্রবাহের অবস্থামাত্র। তাই সুখের ক্ষেত্রে স্বর্গ, দেবলোক, ব্রহ্মলোক যেমন রয়েছে, তেমন দুঃখের ক্ষেত্রে রয়েছে তির্যক, প্রেত, অসুর, নরক ইত্যাদি।

এবার কর্ম ও কর্মফল সম্পর্কে তোমাদের দুটি নীতিগল্প বলব। একটি হচ্ছে পুণ্যবান ব্যক্তির কাহিনী এবং অন্যটি হচ্ছে পাপের পরিণাম। তোমরা মনোযোগ সহকারে পাঠ করবে।

শ্রাবস্তীতে একজন ধার্মিক উপাসক ছিলেন। তিনি সপরিবার সৎপথে জীবনযাপন করতেন। সৎকর্ম করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তিনি সব সময় পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমীতে উপোসথ পালন করতেন। তাঁর গুণাবলি দেখে সবাই মুগ্ধ হতো। উপাসক বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন। তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, বাবা বিহারে যাও।

ভগবান বুদ্ধকে নিবেদন কর, আমার ধর্মশ্রবণের ইচ্ছা হয়েছে। কমপক্ষে পাঁচজন ভিক্ষুর প্রয়োজন। বুদ্ধ ভিক্ষু পাঠালেন। ভিক্ষুগণ উপাসকের বাড়িতে এসে পাশে বসে সূত্র পাঠ আরম্ভ করলেন। উপাসক একাগ্র মনে শুনছিলেন। এ সময় ছয় দেবলোক থেকে ছয়জন সারথি রথসহ তাঁর নিকট উপস্থিত হলেন। তাঁরা স্ব স্ব দেবলোকের সুখের বর্ণনা দিয়ে উপাসককে রথে ওঠার অনুরোধ জানালেন। উপাসক সারথিকে বললেন— আপনারা অপেক্ষা করুন। আমি ধর্মশ্রবণ করছি। ধর্মশ্রবণ শেষে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।

‘পাপের পরিণাম’ সম্পর্কে কাহিনীটি নিম্নরূপ :

একদা মৌদ্‌গল্যায়ন স্থবির রাজগৃহের গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর বাসস্থানের পাশে একটি বিরাট অজগর প্রেত বাস করত। তার শরীর অগ্নিতে দগ্ধ হচ্ছিল। স্থবির অজগরের অবস্থা দেখে সে স্থান ত্যাগ করলেন।

মৌদ্‌গল্যায়ন স্থবির বেণুবন বিহারে এসে এ বিষয়ে বুদ্ধকে জানালেন। তখন বুদ্ধ স্থবিরকে এ প্রেতের পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত বললেন।

অজগর প্রেত কাশ্যপ বুদ্ধের সময় মানবকুলে জন্ম নিয়েছিল। সে অধার্মিক ছিল। দস্যুবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করত। তাই সে দুর্বৃত্ত নামে পরিচিত হলো। তখন সুমঙ্গল নামে এক শ্রেষ্ঠী বুদ্ধ ভক্ত ছিলেন। দুর্বৃত্ত শ্রেষ্ঠীর সবকিছু লুণ্ঠন করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সে পাপের ফলে অজগর প্রেতরূপে জন্ম নিয়ে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ উপদেশ স্বরূপ বললেন :

মূর্খ ব্যক্তি যখন পাপকর্ম করে তখন তা বুঝতে পারে না। কিন্তু যখন সে দুষ্কর্মের ফলে নরকে গমন করে তখন অনুতাপ করে।

দেখ, সৎকর্মের ফল কী সুখাবহ। দুষ্কর্মের ফল কী ভয়াবহ। তোমরা সব সময় সৎকর্মে রত থাকবে। তাহলে ধর্মীয় ও আদর্শ জীবন গঠন করতে পারবে। কখনো খারাপ কাজ করবে না। সৎ ও পুণ্যবান ব্যক্তির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। সত্যধর্ম অনুশীলন করবে। নিজেদের আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবে।

Content added By

শূন্যস্থান পূরণ কর :

১. কর্মের গতি ___ ও বহুমুখী ।

২. তাই খারাপ কাজকে ___ কর্ম বলা হয় ৷

৩. ধার্মিক ব্যক্তিদের জন্য ___ দ্বার খোলা থাকে।

৪. কর্ম ও কর্মফল জীবন ___ অবস্থামাত্র।

৫. তখন বুদ্ধ স্থবিরকে এ প্রেতের ___ বৃত্তান্ত বললেন।

৬. সৎ ও ___ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে।

 

বাম পাশের বাক্যাংশের সাথে ডান পাশের বাক্যাংশের মিল কর :

বামডান

১. প্ৰাণীগণ নিজ নিজ

২. খারাপ কাজ করলে

৩. নিজের সুকর্মের জন্য

৪. মূর্খ ব্যক্তি যখন পাপকর্ম করে,

৫. মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক

৬. উপাসক বৃদ্ধ বয়সে

১. নিজেই সুখ ভোগ করে ৷

২. মানুষেতে সুরাসুর।

৩. মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন ।

৪. সবাই নিন্দা করে।

৫. কর্মের অধীন।

৬. তখন তা বুঝতে পারে না।

৭. দেবলোকে নিয়ে যেতে এসেছেন।

 

নিচের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :

১. কর্মবাদ কাকে বলে ? 

২. কুশল কর্ম বলতে কী বোঝ ? 

৩. খারাপ কাজকে কী বলা হয় ? 

৪. ধার্মিক উপাসক কখন উপোসথ পালন করতেন? 

৫. মৌদ্‌গল্যায়ন স্থবিরের বাসস্থানের পাশে কে বাস করত? 

৬. কে দস্যুবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করত?

 

নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

১. সুকর্ম ও দুষ্কর্মের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। 

২. ‘বৌদ্ধ কর্মবাদ’ সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ রচনা লেখ । 

৩. কুশল কর্ম ও অকুশল কর্মের ফলাফল বর্ণনা কর । 

৪. সুকর্ম ও কুকর্মের পদ্যাংশটি উদ্ধৃত কর। 

৫. ধার্মিক উপাসকের কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা কর । 

৬. অজগর প্রেতের পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা কর।

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion