ধ্বনির উচ্চারণ
উচ্চারণ ঠিক রেখে কবিতা পড়ি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যের মধ্যে আছে 'সোনার তরী', 'চিত্রা', 'বলাকা', 'পুনশ্চ' ইত্যাদি। তিনিই প্রথম বাংলা ছোটোগল্প রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাসের মধ্যে আছে 'গোরা', 'ঘরে-বাইরে', 'যোগাযোগ', 'শেষের কবিতা' ইত্যাদি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক 'অচলায়তন', 'ডাকঘর', 'রক্তকরবী', 'রাজা' ইত্যাদি।
এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতা দেওয়া হলো। কবিতাটি কবির 'কাহিনী' কাব্য থেকে নেওয়া। কবিতাটি প্রথমে নীরবে পড়ো; এরপর সরবে পাঠ করো। সরবে পাঠ করার সময়ে খানির উচ্চারণে সতর্ক থাকতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিথে-দুই ছিল মোর তুই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন?
এ জমি লইব কিনে।' কহিলাম আমি,
'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।'
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিষে প্রন্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা-
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলান, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য-
কত হেরিলাম মনোহর ধান, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারিনে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমতো কাটে বছর পনেরো-যোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হলো।
ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার-এই কি জননী তুমি।
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা।
আজ কোন রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ-
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ।
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী,
হাসিয়া কাটাস দিনা ধনীর আদরে গরব না ধরে। এতই হয়েছ ভিন্ন-
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন।
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী-হলে দাসী।
বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি-
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ একি।
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের কড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন-
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা
হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এলো মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব-
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ-
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুন।
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়।'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি,
এই ছিল মোরে ঘটে- তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ,
আমি আজ চোর বটে।
(সংক্ষেপিত)
শব্দের অর্থ
উড়ে: ওড়িশার লোক।
উদিল: উদয় হলো।
ক্রুর: নিষ্ঠুর; নির্দয়।
ক্ষুধাহরা: ক্ষুধা দূর করে এমন।
খত: ঋণের দলিল।
ঘটে থাকা: ভাগ্যে থাকা
ঠাই: স্থান
ঠেকানু: ঠেকালাম।
ডিক্রি: আদালতের নির্দেশপত্র
দিযে: দৈর্ঘ্যে
ধ্যান: তীর্থস্থান
হেরিলাম: দেখলাম
সপ্তম সুরে: চড়া গলায়।
লক্ষ্মীছাড়া: দুর্ভাগা।
একেকটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থা একেক রকম হয়। 'দুই বিঘা জমি' কবিতা থেকে কিছু শব্দ নিচের তালিকায় দেওয়া হলো। শব্দগুলো বার বার উচ্চারণ করো এবং সহপাঠীদের সাথে আলোচনা করে ছকে থাকা প্রশ্নগুলোর ভিত্তিতে সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দাও। এরপর শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে উত্তরগুলো মিলিয়ে নাও। নিচে প্রথমটি করে দেখানো হলো।
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ | শব্দে থাকা স্বরধ্বনি | ঘরখানিটি উচ্চারণে জিভ কতটুকু উঁচু হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে জিভ সাসনে না পিছনে উঁচু হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট গোল না প্রসারিত হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট কতটুকু খোলে? |
---|---|---|---|---|---|
নিলাজ, বিলাস, দাসী | ই |
|
|
|
|
সেই, বটে, হেনকালে, এ জমি | এ |
|
|
|
|
একদিন, একে একে, গেছে | অ্যা |
|
|
|
|
আমি, আনচান, আঁচল | আ |
|
|
|
|
অস্র অবারিত, | অ |
|
|
|
|
ওটা, চোর, মোর | ও |
|
|
|
|
ফুল, দুপুর, বাবু | উ |
|
|
|
|
বাংলা স্বরবর্ণ এগারোটি। কিন্তু মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা সাতটি। যথা: ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা বাতাস বাক্যন্ত্রের কোথাও বাধা পায় না। কিন্তু একেকটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থা একেক রকম হয়।
ই, 'ই' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ উঁচু হয়; তাই এটি উচ্চ স্বরধানি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধানি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রস্তুত স্বরধানি। ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
'এ' ঘরখানি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধানি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রসূত স্বরধ্বনি। ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
অ্যা: 'অ্যা' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধ্বনি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রসূত স্বরধ্বনি। ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিবৃত স্বরধ্বনি।
আ: 'আ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ নিচু থাকে; তাই এটি নিম্ন স্বরধানি। জিভ মাঝখানে নিচু থাকে; তাই এটি মধ্য স্বরধানি।
ঠোঁট গোল ও প্রসারিত হয়; তাই এটি গোলাকৃত ও প্রসূত স্বরধ্বনি।
ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিকৃত স্বরধ্বনি।
জ: 'জ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; তাই এটি গোলাকৃত অরখানি।
ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিকৃত স্বরধ্বনি।
ও: 'ও' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধানি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; তাই এটি গোলাকৃত স্বরধানি।
ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
উ: 'উ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ উঁচু হয়; তাই এটি উচ্চ স্বরধানি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়, তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; ভাই এটি গোলাকৃত স্বরধানি।
ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
স্বরধ্বনির ছক
জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থার ভিত্তিতে স্বরধ্বনিগুলোকে এভাবে ছকে দেখানো যায়
সম্মুখ | মধ্য | পশ্চাৎ | |
---|---|---|---|
উচ্চ | ই | উ | |
উচ্চ-মধ্য | এ | ও | |
নিম্ন-মধ্য | অ্যা | অ | |
নিম্ন | আ |
জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে স্বরধ্বনি
ই' উচ্চারণের সময়ে জিভ সামনে উঁচু হয়; তাই উপরের ছকে 'ই' স্বরধানিকে সম্মুখ অবস্থানে দেখানো হয়েছে। এর মানে জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে 'ই' সম্মুখ স্বরধ্বনি। একইভাবে 'এ', 'অ্যা'-এগুলোও সম্মুখ স্বরধানি। আবার 'উ' উচ্চারণের সময়ে জিভ পিছনে উঁচু হয়; তাই 'উ' স্বরধানিকে পশ্চাৎ অবস্থানে দেখানো হয়েছে। এর মানে জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে 'উ' পশ্চাৎ স্বরধানি। একইভাবে 'ও', 'অ'-এগুলোও পশ্চাৎ স্বরধানি। 'আ' উচ্চাদের সময়ে জিভের অবস্থান মাঝখানে থাকে; তাই 'আ' মধ্য স্বরধানি।
যেসব স্বরধানি উচ্চারণে জিভ বেশি উঁচু হয়, সেগুলো উচ্চ স্বরধ্বনি। ই, উ-এ দুটি উচ্চ স্বরধানি। আবার 'আ' উচ্চারণে জিভ নিচু থাকে; তাই এটি নিম্ন স্বরধ্বনি। বাকি স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময়ে জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এ, অ্যা, অ, ও মধ্য স্বরধানি।
ঠোঁটের অবস্থার ভিত্তিতে দরকানি
যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট প্রসারিত হয়, সেগুলোকে বলে প্রসূত স্বরধানি। 'ই', 'এ', 'অ্যা'-এগুলো প্রসূত স্বরধানি। যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট গোল হয়, সেগুলোকে বলে গোলাকৃত স্বরধ্বনি। 'উ', 'ও', 'অ'-এগুলো গোলাকৃত স্বরধানি।
যেসব স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট কম খোলে, সেগুলোকে বলা হয় সংবৃত স্বরধ্বনি। 'ই', 'এ', 'উ', 'ও'- এগুলো সংবৃত স্বরধ্বনি। আর যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট বেশি খোলে, সেগুলোকে বলে বিবৃত স্বরধানি। 'অ্যা', 'আ', 'অ'-এগুলো বিবৃত স্বরধ্বনি।
জিভের জড়তা কাটানোর জন্য সাতটি মূল স্বরধ্বনি উচ্চারণের অনুশীলন করো। স্বরধ্বনিগুলো পরপর কয়েকবার সঠিকভাবে এই ক্রমে উচ্চারণ করো: ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। এরপর বিপরীতক্রমে স্বরধানিগুলো কয়েকবার উচ্চারণ করো: উ, ও, অ, আ, অ্যা, এ, ই।
কোনো কোনো স্বরধানি উচ্চারণে আমাদের ভুল হয়ে থাকে। অপর পৃষ্ঠার সারণিতে কিছু শব্দের প্রমিত উচ্চারণ দেখানো হলো।
আরও দেখুন...