SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

On This Page
নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

সপ্তম অধ্যায়

নির্বাণ

জীবের জীবন জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং কার্যকারণ সম্বন্ধসঞ্জাত। যেখানে জন্ম-মৃত্যু বা কার্যকারণ সম্বন্ধ আছে সেখানে দুঃখ বার বার আঘাত হানে। নির্বাণ হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খলমুক্ত, কার্যকারণ প্রবাহ রুদ্ধ এবং দুঃখমুক্ত এক সুখকর অবস্থা। নির্বাণ এক অলৌকিক অবস্থা, যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। নির্বাণ কারণসম্ভূত নয় বিধায় অবিনশ্বর। নির্বাণ লাভের পর আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না। ফলে দুঃখও ভোগ করতে হয় না। তাই বৌদ্ধদের পরম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাণ। নির্বাণ তথাগত বুদ্ধ আবিষ্কৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। পণ্ডিত ও দার্শনিক সমাজে বুদ্ধের এই তত্ত্ব ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রদীপ যেমন অন্ধকার বিদূরিত করে সর্বদিক আলোকিত করে তেমনি তথাগত বুদ্ধের নির্বাণতত্ত্ব যুগ যুগ ধরে অসংখ্য মানুষের মনের কালিমা দূর করে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করে আসছে। অসংখ্য মানুষের তৃষ্ণা নির্বাপিত করে দুঃখ নিবৃত্তি করে আসছে। অতএব বলা যায়, নির্বাণের গুরুত্ব অপরিসীম। এই অধ্যায়ে আমরা নির্বাণ সম্পর্কে অধ্যয়ন করব ।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-

* নির্বাণের ধারণা ও প্রকারভেদ ব্যাখ্যা করতে পারব;

* নির্বাণসাধনার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে পারব।

 

 

 

পাঠ : ১ নির্বাণের ধারণা

নির্বাণ শব্দের অর্থ ‘নির্বাপিত হওয়া'। 'নি' উপসর্গের সঙ্গে ‘বাণ' শব্দটি যুক্ত হয়ে 'নির্বাণ' শব্দটি ব্যুৎপন্ন হয়েছে। ‘নি’ উপসর্গটি অভাব, নাই, ক্ষয়, শেষ ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘বাণ' শব্দটির আভিধানিক অর্থ ধনুকের তীর। বৌদ্ধ শাস্ত্রে তৃষ্ণা বোঝাতে ‘বাণ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়। অতএব, ‘নির্বাণ” বলতে তৃষ্ণার ক্ষয় বোঝায়। আমাদের মনে রাগ, ঈর্ষা, মোহ, লোভ, ইত্যাদি ক্ষতিকর প্রবৃত্তির উৎপত্তির কারণ হচ্ছে তৃষ্ণা বা কামনা। তৃষ্ণার কারণেই মানুষ বার বার জন্মগ্রহণ করে দুঃখভোগ করে। যিনি নির্বাণ সাক্ষাৎ করেন তিনি তৃষ্ণামুক্ত হন। তাঁর তৃষ্ণাজাত রাগ-দ্বেষ-মোহাগ্নি নির্বাপিত হয়। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহ নিরুদ্ধ হয়। ফলে তিনি সর্বপ্রকার দুঃখ হতে মুক্ত হন। অতএব, যে-ধর্ম প্রত্যক্ষ করলে তৃষ্ণার ক্ষয় হয়, রাগ-দ্বেষ-মোহাগ্নি নির্বাপিত হয়, জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহ বা কার্যকারণ নিরুদ্ধ হয় এবং সর্ব প্রকার দুঃখের নিরোধ হয় তারই নাম নির্বাণ। সংক্ষেপে, যাবতীয় দুঃখের নিরোধ বা নিবৃত্তি হওয়াকে “নির্বাণ” বলে। তাই বলা হয়, “নির্ব্বাণং পরমং সুখং' অর্থাৎ ‘নির্বাণ পরম সুখ' ।

নির্বাণ এক লোকোত্তর অভিজ্ঞতা। সাধারণ উপলব্ধি বা ভাষা দিয়ে নির্বাণের প্রাপ্তি ‘পরম সুখ' বুঝতে পারা সম্ভব নয়। ধরা যাক কোনো ব্যক্তি জীবনে কখনো 'মিষ্টি' খায়নি। তাকে ‘মিষ্টি’র স্বাদ কি শুধু বর্ণনা দিয়ে বোঝানো সম্ভব? অনুরূপভাবে নির্বাণ-এর প্রকৃত অবস্থা সাধারণের পক্ষে বোঝা কঠিন । যেমন-কোন ব্যক্তির পক্ষে নিজ চেষ্টায় হিমালয় পর্বতে আরোহণ করা সম্ভব কিন্তু হিমালয় পর্বত নিয়ে এসে অন্যদের দেখানো অসম্ভব। একইভাবে সাধনার দ্বারা বুদ্ধ নির্দেশিত মার্গ অনুসরণ করে পরম প্রাপ্তি নির্বাণ সাক্ষাৎ সম্ভব কিন্তু এর অনির্বচনীয় স্বাদ সাধারণকে বোঝানো সম্ভব নয়। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে ন্যূনপক্ষে স্রোতাপত্তি ফল অর্জন না করলে নির্বাণের স্বরূপ অবগত হওয়া যায় না ।

নির্বাণ সহজবোধ্য না হলেও বুদ্ধ নির্বাণ লাভের উপায় প্রদর্শন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে শিষ্যদের ধর্ম দেশনার মাধ্যমে তিনি নির্বাণের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন । তিনি বলেছেন,

বিজ্ঞজ্ঞানস্স নিরোধের তণহায় বিমুক্তিনো, পজ্জোতসেব নিব্বাণং বিমোক্‌খ হোতি চেতসো ।

অর্থাৎ জ্বলন্ত আগুন নিভে যাওয়ার মতো তৃষ্ণা ক্ষয় পায়। বিমুক্ত পুরুষের বিজ্ঞান নিরোধের সাথে সাথে তাঁর চিত্ত মোক্ষবোধ (বা মুক্তি লাভ করে। এতে সেই বিমুক্ত পুরুষের পুনর্জন্ম সম্পূর্ণরূপে নিরোধ হয়। মহাপরিনির্বাণ সূত্রে বুদ্ধ আরও বলেছেন,

যো, ইমস্মিং ধম্ম বিনযে অপমত্তো বিহেস্সতি; পহায জাতি সংসারং দুখস'ন্তং করিস্সতী তি ।

অর্থাৎ যিনি এই (বুদ্ধ-প্রদর্শিত) ধর্ম ও বিনয়ে অপ্রমত্ত হয়ে বিচরণ করবেন, তিনিই জন্ম এবং সংসারের চক্র অতিক্রম করে দুঃখের অন্ত সাধন করতে পারবেন । 

 

 

 

 

 

নির্বাণ অনুধাবনের জন্যে এখানে একটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া হলো : প্রদীপ জ্বলতে তেল, মোম, সলতে ইত্যাদি উপাদান প্রয়োজন হয়। যতক্ষণ উপাদানসমূহের সরবরাহ অব্যাহত থাকে ততক্ষণ প্রদীপ জ্বলতে থাকবে। একটি প্রদীপ থেকে আরেকটি প্রদীপ এভাবে অসংখ্য প্রদীপ জ্বালানো যায়। কিন্তু প্রদীপ প্রজ্বলনের উপাদানসমূহ ক্ষয় বা নিঃশেষ হলে প্রদীপ নির্বাপিত হবে। অনুরূপভাবে মানবজীবনকে প্রদীপের সাথে তুলনা করা যায়। লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনা, রাগ-অনুরাগ, মায়া এসব তৃষ্ণাজাত প্রবৃত্তির কারণে মানুষ বার বার জন্মগ্রহণ করে। এসমস্ত উপাদান ক্ষয় করা হলে দুঃখের কারণ জন্মনিরোধ বা নির্বাণ লাভ সম্ভব।

অনুশীলনমূলক কাজ

'নির্বাণ' শব্দের অর্থ কী?

কে নির্বাণ লাভ করতে পারেন?

পাঠ : ২

নির্বাণের প্রকারভেদ ও বর্ণনা

নির্বাণের প্রকারভেদ :

নির্বাণ দুই প্রকার । যথা :

১. সোপাদিসেস নির্বাণ ।

২. অনুপাদিসেস নির্বাণ ।

১. সোপাদিসেস নির্বাণ :

রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পাঁচটি উপাদানকে বৌদ্ধ পরিভাষায় পঞ্চস্কন্ধ বলা হয়। পঞ্চস্কন্ধ

বিদ্যমান অবস্থায় দুঃখসমূহের বিনাশ করে কোনো সাধকপুরুষ নির্বাণের জ্ঞান উপলব্ধি করলে তাকে বলে সোপাদিসেস নির্বাণ। জীবিত অর্হৎ সোপাদিসেস নির্বাণ লাভ করেন। তিনি নির্বাণ প্রত্যক্ষ করেন, তৃষ্ণামুক্ত হন, কিন্তু জীবিত থাকেন বিধায় জরা, ব্যাধি, আনন্দ-বেদনা রহিত নন। তবে বর্তমান জন্মই তাঁর শেষ জন্ম । তিনি চতুরার্য সত্য সম্যকরূপে প্রত্যক্ষ করেছেন, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করে ধ্যান-সমাধি দ্বারা সাধনার মাধ্যমে মার্গফল লাভ করেছেন ।

উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ছয় বছর কঠোর সাধনার দ্বারা গয়ার বোধিবৃক্ষমূলে দুঃখ ও তৃষ্ণার ক্ষয় করে গৌতম বুদ্ধ যে-নির্বাণ জ্ঞান লাভ করেছিলেন তার নাম সোপাদিসেস নির্বাণ ।

 

 

 

 

 

২. অনুপাদিসেস নির্বাণ :

নির্বাণদর্শী মুক্ত পুরুষ পঞ্চস্কন্ধের বিনাশ করে যখন পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন তখন তাকে বলে অনুপাদিসেস নির্বাণ। এ নির্বাণ হলো সম্পূর্ণভাবে নির্বাপিত হওয়া। এ নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তি পুনরায় প্রজ্বলিত হবেন না। অর্থাৎ তিনি আর জন্মগ্রহণ করবেন না। তিনি সম্পূর্ণরূপে জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছেন। এ-প্রকার নির্বাণের কোনো পরিণাম নেই, এ-অবস্থা বর্ণনাতীত। এতে সুখ-দুঃখের উপশম হয়। সুখ-দুঃখের উপশমই পরম সুখ। অনন্ত সংসার প্রবাহের এখানেই অবসান হয়। এজন্যেই বুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ‘নিব্বানং পরমং সুখং' অর্থাৎ নির্বাণই পরম সুখ । আচার্য নাগার্জুন নির্বাণের নিম্নরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন :

অপ্রতীতম্ অসম্প্রাক্তম্ অনুচ্ছিন্নম্ অশাশ্বতম্, অনিরুদ্ধম্ অনুৎপন্নম্ এব নিব্বানং উচ্যতে।

অর্থাৎ চরম বিজ্ঞান নিরোধের পর চিত্তসন্ততির যে-অবস্থা হয়, তা প্রতীতির অতীত। কোনো প্রকারে লভ্য নহে। কোনো শাশ্বত পদার্থের উচ্ছেদও নহে। অথবা ভঙ্গুর অবস্থায় শাশ্বতভাব প্রাপ্তি নহে। এর বিনাশ নেই, যেহেতু উৎপত্তি হয় নাই। এসকল লক্ষণযুক্ত অবস্থাকে অনুপাদিসেস নির্বাণ বলে ।

উদাহরণস্বরূপ, বুদ্ধত্বলাভের পর গৌতম বুদ্ধ সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে ধর্মপ্রচার করেন। তারপর আশি

বছর বয়সে কুশীনগরের যমক শাল বৃক্ষের নিচে এই অনুপাদিসেস নির্বাণ লাভ করেছিলেন ।

নির্বাণের বর্ণনা :

নির্বাণের স্বরূপ বুঝতে হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সব রকম জীব ও জড় বস্তু সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। কেননা প্রত্যেক জীব ও জড়বস্তুতে আছে ভিন্ন ভিন্ন গুণের সমাবেশ। আবার এই গুণাবলি স্থির বা শাশ্বত নয়, নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতা কখনো সুখকর নয়, বরং দুঃখময়। মানুষের দেহ ও মন কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সেজন্য আত্মার চিরস্থায়ী অস্তিত্ব স্বীকার করা যায় না। এজন্য বুদ্ধ বলেছেন, সংসার অনিত্য, দুঃখময় এবং অনাত্ম। তাই তিনি এই দুঃখময় সংসারচক্র থেকে বিপথগামী চঞ্চল চিত্তকে সংযত করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। কীভাবে তা সম্ভব? বুদ্ধের নির্দেশিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সাধনা, ব্রহ্মচর্য পালন এবং ধ্যান-সমাধির অনুশীলনই হলো চিত্ত সংযমের প্রধান উপায়

নির্বাণের স্বরূপ সম্পর্কে ‘মিলিন্দ প্রশ্ন' গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, নির্বাণ অনিবচনীয়, তুলনাবিহীন । স্থান-কাল- পাত্র, যুক্তি, প্রমাণ, কিংবা উপমা দ্বারা নির্বাণ প্রকাশযোগ্য নয়। নির্বাণ শান্ত সুখদায়ক। ধর্মপদ গ্রন্থে নির্বাণ সম্পর্কে এরূপ উল্লেখ আছে –

আরোগ্য পরমা লাভা, সন্তুঠি পরমং ধনং, বিস্সাস পরমাঞাতি, নিব্বানং পরমং সুখং ।

অর্থাৎ আরোগ্য পরম লাভ, সন্তুষ্টি পরম ধন, বিশ্বাস পরম জ্ঞাতি এবং নির্বাণ পরম সুখ।

গাথায় বর্ণিত এই পরম সুখই সকল মানুষের কাম্য। কিন্তু সুখ পেতে হলে দুঃখকে নির্মূল করা প্রয়োজন । দুঃখ নির্মূল করার উপায় কী? নির্বাণ লাভ করাই এর একমাত্র উপায় । কারণ নির্বাণে দুঃখ সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়,

 

 

 

আসে মুক্তি। এই মুক্তির জন্যই সিদ্ধার্থ গৌতম কঠোর সাধনা করেছিলেন। সাধনার শেষে সিদ্ধিলাভ করে তিনি নির্বাণ সাক্ষাৎ করেছিলেন।

এখন আমরা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত 'নির্বাণ পরম সুখ' কথাটির অর্থ বোঝার চেষ্টা করব। মঝিম নিকায়ের ‘অরিয়পরিয়েসন' সূত্রে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “আমি স্বয়ং জন্ম, জরা, ব্যাধি, শোক ইত্যাদির পরিণতি উপলব্ধি করেছি। এগুলো থেকে অজন্ম , অব্যাধি, অমৃত্যু, অশোক (শোকহীনতা), অক্লেশ ইত্যাদি জেনে নির্বাণ সাক্ষাৎ করেছি।” অর্থাৎ নির্বাণ লাভের মাধ্যমে তিনি সব দুঃখের অবসান ঘটিয়েছেন। সুতরাং নির্বাণ হচ্ছে সকল দুঃখের অন্তসাধন অবস্থা। নির্বাণ পরম শুভ ।

বিশ্বের সকল বস্তু সংস্কৃত ও অসংস্কৃত ভেদে দুরকম । যেসব বস্তুর কার্যকারণ আছে ও পরিবর্তনশীল তা সংস্কৃত । যেসব বস্তুর হেতু বা কার্যকারণ নেই তা হলো অসংস্কৃত, নির্বাণও অসংস্কৃত, অর্থাৎ কার্যকারণরহিত । এর পরিবর্তন নেই। নির্বাণ শান্ত এবং শাশ্বত। সকল পার্থিব বস্তুর অস্থায়িত্ব বা পরিবর্তনশীলতা দুঃখময়। কিন্তু নির্বাণের আনন্দের স্থায়িত্ব অবিনশ্বর। এজন্য বুদ্ধ বলেছেন, 'নির্বাণ পরম সুখ'। নির্বাণ কারণহীন। এর উৎপত্তি বা বিলয় কোনোটিই নেই। নির্বাণ ধ্রুব, নির্বাণ পরম সুখকর। এজন্য যা কিছু দৃষ্টিগোচর বা অদৃশ্য অথবা কল্পনা-বহির্ভূত তাদের মধ্যে নির্বাণ সর্বশ্রেষ্ঠ। মানুষের সাধনার মধ্যে এর চেয়ে উত্তম কাম্য আর কিছুই নেই । এজন্যই ধ্যানী ও বিজ্ঞ পুরুষ নির্বাণলাভের জন্য নিরলস সাধনায় প্রবৃত্ত হন।

বৌদ্ধ ধর্ম যুক্তির ধর্ম, জ্ঞানের ধর্ম এবং জ্ঞানীর ধর্ম। জ্ঞানীর দ্বারাই নির্বাণলাভ সম্ভব হয়। এজন্যে সম্যক জ্ঞানের দ্বারা বস্তুর গুণাগুণ সম্পূর্ণরূপে জানতে হয়। বুদ্ধের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে সংস্কারসমূহ বিনাশ করতে হয়। বস্তুগুণাগুণ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করলে তবেই নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। প্রজ্ঞা ও ধ্যান ছাড়া নির্বাণ সাক্ষাৎ করা সম্ভব নয়। ‘ধর্মপদ' গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,

‘নখি ঝানং অপঞঞস পঞঞা নখি অঝাযতো, যম্‌হি ঝানঞ্চ পঞঞা চ স বে নিব্বানসন্তিকে।

অর্থাৎ যার প্রজ্ঞা নেই তার ধ্যান হয় না। যার ধ্যান নেই তার প্রজ্ঞা লাভ হয় না। যাঁর প্রজ্ঞা এবং ধ্যান দুই-ই আছে তিনি নির্বাণের নিকটে অবস্থান করেন ।

সুতরাং শীলবান ও প্রজ্ঞাবান ভিক্ষু কিংবা বিজ্ঞ লোককে প্রথমে সাধনার দ্বারা দ্বেষ-মোহহীন হতে হয়। তারপর তিনি সাধনা করে নিস্পৃহ, নিরুপদ্রব, নির্ভয় কল্যাণকামী হবেন। ফলে তাঁর পক্ষে নির্বাণ উপলব্ধি করা সম্ভব।

অনুশীলনমূলক কাজ

নির্বাণের প্রকারভেদ আলোচনা কর (দলীয় কাজ)

 

 

 

 

 

 

পাঠ : ৩ নির্বাণ সাধনার প্রয়োজনীয়তা

লোভ, দ্বেষ, কামনা, বাসনার কারণে সৃষ্ট অকুশল কর্ম থেকে বিরত হয়ে কুশল কর্মের মাধ্যমে শান্তিময় জগৎ নির্মাণ এবং জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধির শৃঙ্খলে আবদ্ধ দুঃখময় জীবনপ্রবাহ থেকে মুক্তিলাভের জন্যে নির্বাণ সাধনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জগৎ দুঃখময়। তৃষ্ণা থেকে দুঃখের উৎপত্তি। তৃষ্ণার কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যার কারণে মানুষ অকুশল চেতনার বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন প্রকার অপকর্মে লিপ্ত হয়। এতে অজ্ঞানী মানুষ নিজের ক্ষতি যেমন করে অন্যদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে সংসার ও জগতে শান্তি বিঘ্নিত হয়। নির্বাণ সাধনায় রত ব্যক্তিকে সবসময় কুশল কর্ম করতে হয়। চারি আর্যসত্য সম্যকভাবে উপলব্ধি করে দুঃখের কারণ তৃষ্ণা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে হয়। অক্লান্ত সাধনায় লোভ-দ্বেষ-মোহহীন হয়ে অবিদ্যা দূর করতে হয় । অবিচ্ছিন্ন নির্বাণ সাধনায় তিনি নির্ভয় ও কল্যাণকামী হন । ফলে তিনি নিজের ও সকলের কল্যাণ সাধন করেন এবং জগৎ-সংসারের সর্ব প্রকার মঙ্গলের কারণ হন । অপরের ক্ষতি সাধনের ইচ্ছা, অহংকার ইত্যাদি ত্যাগ করেন। আত্মসংযম অনুশীলন করেন। সকলের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন হন। নির্বাণ সাধনা এভাবেই নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই সকলের নির্বাণসাধনা করা উচিত। স্বল্প সময় বা স্বল্প চেষ্টায় নির্বাণলাভ সম্ভব নয়। এজন্য কঠোর অনুশীলন করতে হয়।

‘নির্বাণ” বুঝতে এবং বোঝাতে কষ্টকর হলেও মানুষের পক্ষেই নির্বাণলাভ সম্ভব। বুদ্ধ বলেছেন মানবজন্ম দুর্লভ। কারণ মানুষের বিবেক আছে। মানুষ ভাল মন্দ বিচার করতে পারে। কুশলকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানবজন্ম লাভ করতে হয়। দেবতারা শুধু সুখ ভোগ করে। প্রেতরা শুধু দুঃখ ভোগ করে । পশু-পাখিরা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। একমাত্র মানুষই এ-জগতে দুঃখ এবং সুখ উভয় প্রকার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। জগতে মানুষের পক্ষে কুশল কাজ করা সম্ভব। মানুষ অপেক্ষা ইতর প্রাণীর জীবনধারণ কষ্টকর ও অনিশ্চিত, অকুশল কর্ম করলে ইতর প্রাণীরূপে জন্ম নিতে হবে। নির্বাণ লাভের ইচ্ছা ও চেতনা মনে জাগ্রত করে কুশলকর্ম সম্পাদন করলে ইতর কুলে জন্মের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়। এজন্য 'নির্বাণ' সাধনা করা উচিত ।

নির্বাণ বৌদ্ধদের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত। পরম সুখ নির্বাণ লাভের জন্য জন্ম-জন্মান্তর ব্যাপী কুশল কর্ম করে পুণ্যফল অর্জন করতে হয়। চারি আর্যসত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানপ্রাপ্ত হতে হয়। অনুসরণ করতে হয় আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করলে নির্বাণের পথে প্রবেশ সম্ভব। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ মানুষকে সৎ পথে চলতে নির্দেশনা দেয়। বলা হয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম জ্ঞানের ধর্ম, জ্ঞানীর ধর্ম, কাজেই জ্ঞানী ব্যক্তিই প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করেন যে জগৎ দুঃখময়। তৃষ্ণাই দুঃখের কারণ। তৃষ্ণার ফলেই বার বার জন্মগ্রহণ করতে হয়। জন্ম নিলেই জরা, ব্যাধি, প্রিয়বিচ্ছেদ, অপ্রিয় সংযোগ, মৃত্যু ইত্যাদি বিবিধ প্রকার দুঃখ ভোগ করতে হয়। তৃষ্ণা থেকে মুক্তি লাভ করা সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এজন্যই জ্ঞানী ব্যক্তির নির্বাণ সাধনা করা প্রয়োজন।

 

 

 

অনুশীলনমূলক কাজ

নির্বাণ সাধনার জন্য কী কী অনুশীলন করতে হয়? নির্বাণ সাধনার মাধ্যমে কীভাবে সুন্দর জীবন গঠন করা যায়? যুক্তিসহকারে তোমার

মতামত বিশ্লেষণ কর (অর্পিত কাজ)

অনুশীলনী

শূন্যস্থান পূরণ কর

১. নির্বাণ ............এক অবস্থা।

২. নির্বাণ তথাগত বুদ্ধ ............ অন্যতম শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব।

৩. নির্বাণ এক............ অভিজ্ঞতা ।

৪. একটি প্রদীপ থেকে আরেকটি প্রদীপ এভাবে অসংখ্য............ জ্বালানো যায় ।

৫. যার ধ্যান নেই তার............ লাভ হয় না।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন

১. নির্বাণ শব্দটির অর্থ কী ?

২. অনুপাদিসেস নির্বাণ বলতে কী বোঝ ?

৩. সোপদিসেস নির্বাণ-এর বৈশিষ্ট্য কী ?

৪. “মিলিন্দ প্রশ্ন' গ্রন্থে নির্বাণ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে ?

বর্ণনামূলক প্রশ্ন

১. নির্বাণ সম্পর্কে তোমার ধারণা আলোচনা কর ।

২. 'নির্বাণ বৌদ্ধদের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত' ব্যাখ্যা কর।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

নির্বাণ কী ?

ক. জাগতিক জ্ঞান

খ. আকাঙ্ক্ষা রোধ

গ. চিত্তের সুখ

ঘ. তৃষ্ণার ক্ষয়

 

 

 

 

২। বিমুক্ত পুরুষের পুনর্জন্ম সম্পূর্ণরূপে নিরোধের কারণ

i. তৃষ্ণার ক্ষয় করা

ii. চিত্তমুক্তি লাভ করা

iii. লোভ, দ্বেষ, মোহ ধ্বংস করা

নিচের কোনটি সঠিক ?

ক. i ও ii

খ. ii ও iii

গ. i ও iii

ঘ. i, ii ও iii

নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও

ধর্মপুর আর্যবিহারের বিহারাধ্যক্ষ কল্যাণশ্রী মহাস্থবির সুপরিকল্পিতভাবে বিহার পরিচালনা করেন বিধায় তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সাধনার দ্বারা সম্যক সম্বুদ্ধের প্রদর্শিত ধর্ম ও বিনয়ে অপ্রমত্ত হয়ে বিচরণ করেন এবং এক পর্যায়ে তিনি পঞ্চস্কন্ধ বিদ্যমান অবস্থায় দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

৩। কল্যাণশ্রী মহাস্থবির গৌতম বুদ্ধের কোন নির্বাণ জ্ঞান উপলব্ধি করেন ?

ক. প্রাপ্তি নির্বাণ সাক্ষাৎ খ. সোপাদিসেস নির্বাণ জ্ঞান

গ. অনুপাদিসেস নির্বাণ জ্ঞান

ঘ. সোপাদিসেস ও অনুপাদিসেস নির্বাণ

৪। উক্ত নির্বাণ জ্ঞান লাভের দ্বারা সম্ভব-

i. জন্ম-মৃত্যু প্রবাহ নিরোধ করা

ii. পঞ্চ ইন্দ্রিয়সমূহের দমন করা

iii. দুঃখ ও তৃষ্ণা বিনাশ করা

নিচের কোনটি সঠিক ?

খ. i ও ii

ক. i

ঘ. i, ii ও iii

গ. ii ও iii

 

সৃজনশীল প্রশ্ন

১। অনিল বিকাশ চাকমা একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। গৃহীজীবনে বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক পড়ে বুদ্ধের সুত্ত, বিনয় ও ধর্মনীতি বিষয়ে বিশদভাবে বুঝতে পারলেন। তাই তিনি সংসারের মায়া ত্যাগ করে বিহারে ভন্তের নিকট প্রব্রজ্যিত হলেন। প্রথমে তিনি ধর্ম প্রত্যক্ষ করে তৃষ্ণার ক্ষয়, রাগ-দ্বেষ-মোহ নির্বাপিত করা; জন্ম-মৃত্যুর প্রবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে জাগতিক জ্ঞান অর্জন করেন। শ্রমণ থেকে ভিক্ষুত্বে উপনীত হয়ে তিনি ত্রিপিটক গ্রন্থের জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে বুদ্ধের ‘নিব্বানং পরমং সুখং’-এই বাণীটি বুঝতে সক্ষম হলেন।

ক. তৃষ্ণা থেকে কী উৎপত্তি হয় ?

খ. আর্য-অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে হয় কেন ? সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর ।

গ. অনিল চাকমা শ্রমণ অবস্থায় বুদ্ধের কোন তত্ত্ব বুঝতে পারলেন ? ব্যাখ্যা কর ।

ঘ. ভিক্ষুত্ব লাভের পর অনিল চাকমার অর্জিত শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ব্যাখ্যা কর।

২। ভিক্ষু সম্মেলনের এক দেশনায় শ্রদ্ধেয় ধর্মকীর্তি স্থবির বললেন, “প্রথমত ধর্মপদ গ্রন্থে নির্বাণ সম্পর্কে এরূপ উল্লেখ” আছে – ‘আরোগ্য পরমা লাভা, সন্তুঠি পরমং ধনং বিস্সাস পরমাঞাতি, নিব্বানং পরমং সুখং।”

বুদ্ধ বলেছেন—“মানবজন্ম দুর্লভ। মানুষের বিবেক আছে। ভালোমন্দ বিচার করে কুশলকর্ম সম্পাদন

করে মানব জন্ম হয়।”

ক. গৌতম বুদ্ধ কত বছর যাবৎ ধর্ম প্রচার করেন ?

খ. নির্বাণ লাভের পর আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না কেন ? 

গ. ধর্মকীর্তি স্থবির তাঁর দেশনায় কোন ধরনের নির্বাণের ইঙ্গিত করেছেন – ব্যাখ্যা কর।

ঘ. উদ্দীপকে বর্ণিত বুদ্ধের দেশনায় নির্বাণের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? পাঠ্যবইয়ের আলোকে বিশ্লেষণ কর।

Content added By
নির্বাপিত হওয়া
সুখলাভ করা
স্বর্গে গমন করা
পরিভ্রমণ করা
অর্থলাভ
নির্বাণ লাভ
স্রোতাপত্তি লাভ
লোভ থেকে বিরত থাকে
পরিবারের বন্ধনে
মায়ার বাঁধনে
জন্ম-মৃত্যর শৃঙ্খলে
অর্থের শৃঙ্খলে
জন্মের নিরোধ
মৃত্যুর নিরোধ
জন্ম-মৃত্যুর নিরোধ
সুখ-দুঃখের নিরোধ

Promotion

Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.