আন্তঃআণবিক বল ও পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - পদার্থবিদ্যা - পদার্থবিজ্ঞান – ১ম পত্র | NCTB BOOK

এরকম ঘটছে কারণ কোনো বস্তুর উপর বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করলে যদি বস্তুটি গতিশীল না হয় তাহলে এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে আপেক্ষিক সরণ হয় বা বলা যেতে পারে অণুগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্বের পরিবর্তন ঘটে, ফলে বস্তুটির আকার বা আয়তন বা উভয়ের পরিবর্তন হয়। এ অবস্থায় বস্তুর ভেতরের আন্তঃআণবিক বল এ পরিবর্তনকে বাধা দিতে চেষ্টা করে। ফলে বল প্রয়োগ বন্ধ করলে বস্তু আবার আগের অবস্থা ফিরে পায়। পদার্থের এ ধর্মের নাম স্থিতিস্থাপকতা।

স্থিতিস্থাপকতা বল প্রয়োগে যদি কোনো বস্তুর আকার বা আয়তন বা উভয়ের পরিবর্তন ঘটে অর্থাৎ বস্তু বিকৃত হয় তাহলে প্রযুক্ত বল সরিয়ে নিলে যে ধর্মের ফলে বিকৃত বস্তু আগের আকার ও আয়তন ফিরে পায় তাকে স্থিতিস্থাপকতা বলে।

যে বস্তুর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা বেশি তার স্থিতিস্থাপকতাও বেশি হবে। লোহা ও রবারের মধ্যে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা লোহার বেশি তাই লোহা রবারের চেয়ে বেশি স্থিতিস্থাপক।

পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু : 

বাহ্যিক বল অপসারিত হলে যদি বিকৃত বস্তু ঠিক আগের আকার ও আয়তন ফিরে পায় তাহলে ঐ বস্তুকে পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তু বলে।

স্থিতিস্থাপক সীমা : 

বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা গুণের জন্য বাহ্যিক বল অপসারিত হলে বিকৃত বস্তু ঠিক আগের আকার বা আয়তন ফিরে পায়। কিন্তু বস্তুর এ আকার বা আয়তন পুনঃপ্রাপ্তির ক্ষমতা অসীম নয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রত্যেক বস্তুই বাহ্যিক বলের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পূর্ণ স্থিতিস্থাপক বস্তুর ন্যায় আচরণ করে। এই সীমাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলা হয় । 

সংজ্ঞা : যে মানের বল পর্যন্ত কোনো বস্তু পূর্ণ স্থিতিস্থাপক থাকে অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বেশি যে বল প্রয়োগ করে বল অপসারণ করলে বস্তুটি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায় তাকে স্থিতিস্থাপক সীমা বলে ।

 নমনীয় বস্তু : 

 কোনো বস্তুর উপর বাহ্যিক বল প্রয়োগ করে তাকে বিকৃত করলে যদি বল অপসারণের পর বস্তুটি ঐ বিকৃত অবস্থা পুরোপুরি বজায় রাখে তাহলে বস্তুটিকে নমনীয় বা পূর্ণ প্লাস্টিক বস্তু বলা হয় ।

পূর্ণ দৃঢ় বস্তু : 

বাইরে থেকে যেকোনো পরিমাণ বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর যদি আকারের কোনো পরিবর্তন না ঘটে তাহলে বস্তুটিকে পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বলা হয়। পূর্ণ দৃঢ় বস্তু বাস্তবে পাওয়া যায় না।

বিকৃতি (Strain) : 

কোনো বস্তু যদি পূর্ণ দৃঢ় না হয় তাহলে বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে বস্তুটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে আপেক্ষিক সরণ হয়; ফলে বস্তুটির আকার বা আয়তনের পরিবর্তন হয়। বস্তুর এ অবস্থাকে রূপবিকৃতি (Deformation) বলে এবং বস্তুটি বিকৃত হয়েছে বলা হয়। আনুপাতিক রূপবিকৃতি বা রূপবিকৃতির হারকে বিকৃতি বলে। 

সংজ্ঞা : বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর একক মাত্রায় যে রূপবিকৃতি বা পরিবর্তন হয় তাকে বিকৃতি বলে ।

ব্যাখ্যা, : কোনো বস্তুর আদিমাত্রা A এবং বল প্রয়োগের ফলে মাত্রা B হলে মাত্রার পরিবর্তন হবে BA

সুতরাং বিকৃতি  =B~AA

বিকৃতি একটি স্কেলার রাশি।

মাত্রা ও একক : যেহেতু বিকৃতি একই প্রকার দুটি রাশির অনুপাত তাই এর কোনো মাত্রা ও একক নেই।

বিকৃতির তাৎপর্য :

কোনো বস্তুর বিকৃতি 0.002 বলতে বোঝায় বস্তুর একক মাত্রার পরিবর্তন হয়েছে 0.002 একক । 

পীড়ন (Stress) : 

কোনো বস্তুকে বিকৃত করা হলে এই বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা ধর্মের জন্য বস্তুর ভেতর একটি প্রতিরোধ বলের উদ্ভব হয়। এই বল বস্তুকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়। একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে যে প্রতিরোধ বলের উদ্ভব হয় তাই হচ্ছে পীড়ন।

সংজ্ঞা : বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে কোনো বস্তুর আকার বা দৈর্ঘ্য বা আয়তনের পরিবর্তন ঘটলে স্থিতিস্থাপকতার জন্য বস্তুর ভেতর থেকে এই বলকে বাধাদানকারী একটি বলের উদ্ভব হয়। বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে উদ্ভূত এই বিকৃতি প্রতিরোধকারী বলের মানকে পীড়ন বলে ।

ব্যাখ্যা : যেহেতু প্রযুক্ত বল ও প্রতিরোধকারী বল পরস্পর সমান সেজন্য প্রযুক্ত বল দ্বারাই প্রতিরোধকারী বলের পরিমাপ করা হয়। অতএব পীড়নের মান হচ্ছে একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বিকৃতি সৃষ্টিকারী বলের মানের সমান। অর্থাৎ,

পীড়ন = প্রতিরোধকারী বল/ক্ষেত্রফল= প্রযুক্ত বল/ক্ষেত্রফল

A ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট কোনো বস্তুতে লম্বভাবে F বল প্রয়োগ করা হলে,

পীড়ন =FA

পীড়ন একটি স্কেলার রাশি।

মাত্রা ও একক : পীড়নের মাত্রা হবে,

পীড়ন=বল/ক্ষেত্রফল এর মাত্রা অর্থাৎ ML-1T-2

তাৎপর্য :কোনো বস্তুর পীড়ন 5 x 105 N m-2 বলতে বোঝায় বস্তুর প্রতি 1 m2 ক্ষেত্রফলের ওপর লম্বভাবে বিকৃতি প্রতিরোধকারী বলের মান 5 x 105 N

বিকৃতি সৃষ্টি করতে প্রতি 1 m2 ক্ষেত্রফলের ওপর লম্বভাবে প্রযুক্ত বলের মানও তাই ।

অসহ বল বা ভার :

 স্থিতিস্থাপক সীমার বাইরে বল প্রয়োগ করা হলে বল অপসারণ করার পর বস্তুটি আর পূর্বাবস্থায় সম্পূর্ণ ফিরে আসে না। প্রযুক্ত বলের মান আরো বেশি হলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যায়। সবচেয়ে কম যে বল প্রয়োগ করলে বস্তুটি ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ বল বলে। অসহ বলকে অসহ ভার বা ওজনও বলা হয়।

সংজ্ঞা : সর্বাপেক্ষা কম যে বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তু ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ বল বলে।

অসহ পীড়ন : অসহ বলের জন্য যে পীড়ন হয় তাই অসহ পীড়ন । 

সংজ্ঞা : প্রতি একক ক্ষেত্রফলের উপর লম্বভাবে প্রযুক্ত সর্বাপেক্ষা কম যে বলের ক্রিয়ায় কোনো বস্তু ছিঁড়ে বা ভেঙে যায় তাকে অসহ পীড়ন বলে ।

অসহ পীড়ন = অসহ বল/ক্ষেত্রফল  (7.3)

তাৎপর্য : তামার অসহ পীড়ন 3.5 x 10-8 Nm-2 বলতে বোঝায় তামার তৈরি কোনো বস্তুর প্রতি বর্গমিটার ক্ষেত্রফলের উপর ন্যূনতম 3.5 x 108 N বল লম্বভাবে প্রয়োগ করলে বস্তুটি ছিড়ে বা ভেঙে যাবে।

৭.৫। পদার্থের স্থিতিস্থাপক ধর্ম ও আন্তঃআণবিক বল

 Elastic Properties of Matter and Intermolecular Forces

পদার্থের আণবিক গড়ন বিবেচনা করলে এর স্থিতিস্থাপক ধর্ম সহজে বোঝা যায়। আমরা জানি যে, সকল পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে আন্তঃআণবিক বল ক্রিয়া করে। কঠিন পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে ক্রিয়াশীল এ বলকে সংসক্তি বল (cohesive force) বলে । এটা জানা গেছে যে, স্বাভাবিক অবস্থায় কেলাসের অণুগুলো নিম্নতম বিভব শক্তি অবস্থানে অবস্থান করে থাকে। এ অবস্থা এদের সাম্যাবস্থা। এরকম অবস্থানে কোনো অণুর উপর ক্রিয়াশীল নিট আন্তঃআণবিক বল শূন্য। অণুগুলোর মধ্যকার দূরত্ব পরিবর্তনের সাথে আন্তঃআণবিক বলের পরিবর্তন ঘটে।

আণবিক দূরত্ব যত বেশি হবে, আন্তঃআণবিক বল তত বেশি আকর্ষণধর্মী হবে এবং আন্তঃআণবিক দূরত্ব যত কম হবে আন্তঃআণবিক বল তত বেশি বিকর্ষণধর্মী হবে। স্বাভাবিক অবস্থায় আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বল পরস্পরকে নিষ্ক্রিয় করে ফলে নিট বল হয় শূন্য ।

কোনো বস্তুতে দৈর্ঘ্য বা টান পীড়ন প্রয়োগ করা হলে অণুগুলোর মধ্যবর্তী আন্তঃআণবিক দূরত্ব বৃদ্ধি পায় ফলে অণুগুলো আকর্ষণ বল অনুভব করে বা পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হয়। বহিস্থ বল সরিয়ে নিলে আকর্ষণ বলের প্রভাবে অণুগুলো তাদের সাম্যাবস্থানে ফিরে আসে। অপরদিকে দেখা যায় যে, বহিস্থ বল প্রয়োগে কোনো বস্তুকে যদি সঙ্কুচিত করা হয় তাহলে আন্তঃআণবিক দূরত্ব হ্রাস পায় ফলে তাদের মধ্যে বিকর্ষণ বলের উদ্ভব ঘটে। বহিস্থ বল সরিয়ে নিলে বিকর্ষণ বল অণুগুলোকে পুনরায় তাদের সাম্যাবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কোনো নির্দিষ্ট টান বলের জন্য কোনো স্বতন্ত্র অণুর কী পরিমাণ সরণ ঘটবে তা আন্তঃআণবিক বলের সবলতার উপর নির্ভর করে। আন্তঃআণবিক বল যত বেশি সবল হবে অণুগুলোর সরণ তত কম হবে। এ রকম অবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট পীড়নের দরুন আনুষঙ্গিক বিকৃতি কম হবে বলে স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান বেশি হবে ।

৭.৬। বিভিন্ন প্রকার বিকৃতি ও পীড়ন

 Different Types of Strain and Stress

আমরা ৭.৪ অনুচ্ছেদে বিকৃতি ও পীড়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি । পরিবর্তনের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বিকৃতি ও পীড়ন তিন রকমের হতে পারে।

(ক) দৈর্ঘ্য বা টান বিকৃতি ও দৈর্ঘ্য বা টান পীড়ন (Longitudinal or Tensile Strain and Longitudinal or Tensile Stress)

দৈর্ঘ্য বিকৃতি : কোনো বস্তুর উপর বাইরে থেকে বল প্রয়োগের ফলে যদি এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটে তাহলে একক দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনকে দৈর্ঘ্য বিকৃতি বলে।

ব্যাখ্যা : L দৈর্ঘ্যের কোনো বস্তুর উপর দৈর্ঘ্য বরাবর বল প্রয়োগ করলে যদি এর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন । হয় (চিত্র : ৭-৬),

তাহলে দৈর্ঘ্য বিকৃতি =IL

দৈর্ঘ্য পীড়ন : দৈর্ঘ্য বিকৃতি প্রতিরোধ করার জন্য বস্তুর একক ক্ষেত্রফলে লম্বভাবে যে প্রতিরোধ বলের সৃষ্টি হয় অর্থাৎ দৈর্ঘ্য বিকৃতি ঘটাতে বস্তুর একক ক্ষেত্রফলের উপর দৈর্ঘ্য বরাবর যে বল প্রযুক্ত হয় তাকে দৈর্ঘ্য পীড়ন বলে ।

 

 

ব্যাখ্যা : দৈর্ঘ্য বিকৃতি ঘটাতে যদি কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য বরাবর A প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের উপর F বল লম্বভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তাহলে দৈর্ঘ্য পীড়ন  =FA

তারের নিচের প্রান্তে যদি M ভরের বস্তু ঝুলিয়ে বল প্রয়োগ করা হয়, তাহলে F = Mg এবং তারের ব্যাসার্ধ r হলে A =πr2 

সুতরাং দৈর্ঘ্য পীড়ন = FA =mgπr2...  ...  (7.5)

 

 

 

 

Content added || updated By
Promotion