যে বস্তুটি ছাড়া আর্ক ওয়েল্ডিং কোনো ক্রমেই সম্ভব নয় তা হলো ইলেকট্রোড। ইলেকট্রোড একটি তার বা চিকন রড যার এক প্রান্ত হোল্ডারের সাথে যুক্ত থেকে কার্য বস্তু পর্যন্ত ওয়েল্ডিং এর জন্য প্রয়োজনীয় কারেন্ট সরবরাহ করে, আর্ক সৃষ্টি করে এবং কোন কোন সময় নিজে গলে জোড়া স্থানের জন্য পরিপুরক ধাতু সরবরাহ করে। একটি ইলেকট্রোড এর সাইজ কী হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা খানিকটা কঠিন কারণ বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তথা বিভিন্ন ইলেকট্রোড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব মাপ অনুসারে ইলেকট্রোড তৈরি করে। আই, আই, ডবিউ (ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওয়েল্ডিং) এর নির্ধারিত মাপ অনুসারে একটি ইলেকট্রোডের দৈর্ঘ্য ২৫০ মিলিমিটার হতে ৪৫০ মিলিমিটার এবং ব্যাস ১.৭৫ মিলিমিটার হতে ৭.০০ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে ।
ওয়েল্ডিং কার্যে ব্যবহৃত ইলেকট্রোডসমূহকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
১। ক্ষয়িষ্ণু ইলেকট্রোড (Consumable Electrode )
(ক) খোলা বা ফ্ল্যাক্সের আবরণ বিহীন
(খ) ফ্ল্যাক্সের অল্প আবরণ যুক্ত
(গ) ফ্ল্যাক্সের মধ্যম আবরণ যুক্ত
(ঘ) ফ্ল্যাক্সের ভারী আবরণ যুক্ত
২। অক্ষয়িষ্ণু ইলেকট্রোড (Non Consumable Electrode )
(ক) কার্বন বা গ্রাফাইট ইলেকট্রোড
(খ) টাংস্টেন ইলেকট্রোড
(গ) থোরিয়াম মিশ্রিত টাংস্টেন ইলেকট্রোড
(ঘ) জির কোনিয়াম মিশ্রিত, টাংস্টেন ইলেকট্রোড
উল্লেখ্য যে, কনজুমঅ্যাবল ইলেকট্রোড নিজে গলে জোড়াস্থান তৈরি করে, এটা ক্ষয় হয় বা খরচ হয় বলে এর এমন নাম হয়েছে। অপরপক্ষে নন কনজুমঅ্যাবল ইলেকট্রোড নিজে ক্ষয় হয় না শুধু আর্ক সৃষ্টি করে, সে আর্ক এর উত্তাপে অতিরিক্ত ফিলারমেটাল গলিয়ে জোড়াস্থান তৈরি করো।
১। ওয়েল্ডিং এর সময় ফ্ল্যাক্স বহুবিধ কাজ করেঃ যেমন ফ্ল্যাক্স ওয়েল্ডিং জোড়ার চারিদিকে এমন গ্যাসীয় আবরণ সৃষ্টি করে যাতে জোড়া স্থানে বায়ুর অক্সিজেন ক্ষতিকারক অক্সাইড তৈরি করতে পারে না।
২। জব এবং ফিলার মেটালকে দ্রুত গলাতে সাহায্য করে।
৩। ধাতুমল তৈরিতে সহায়তা করে।
৪। ভালো পেনিট্রেশন অর্থাৎ জবের দুই প্রাপ্ত গলে একটির মধ্যে আর একটি প্রবেশ করাতে সহায়তা করে, যাতে জোড়ার শক্তি বেশি হয়।
৫। ফ্ল্যাক্স ওয়েল্ড করা স্থানে স্ল্যাগের আবরণ সৃষ্টি করে যা জোড়া স্থানকে ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে সহায়তা করে, ফলে; জোড়াস্থান নমনীয় হয় এবং এর শক্তি বেশি হয়।
৬। ফ্ল্যাক্স ব্যবহারের ফলে গলিত ধাতু জবের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে না। তাই জোড়াস্থান সুন্দর হয়।
৭। ফ্ল্যাক্স মূল ধাতু এবং ফিলার মেটাল অর্থাৎ ওয়েল্ডিং এর জোড়া স্থানে যে মেটাল দেওয়া হয় তাকে ভালোভাবে গলিয়ে সঠিক স্থানে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে।
ইলেকট্রোড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ইলেকট্রোড প্যাকেট কতগুলো কোড মার্ক ব্যবহার করে সেগুলো হতে ইলেকট্রোডের গুণাগুণসহ তার ব্যবহার কৌশল, প্রয়োগ ক্ষেত্র অর্থাৎ কোন অবস্থানে ব্যবহার করা যাবে ইত্যাদি তথ্য জানা যায়। আমেরিকান ওয়েল্ডিং সোসাইটি (AWS) পদ্ধতি অনুসারে ইলেকট্রোড শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া বুঝান হলো।
১ম এবং ২য় অংকঃ প্রথম এবং দ্বিতীয় অংক ইলেকট্রোড দিয়ে ওয়েল্ড করা ধাতুর টানা শক্তি হাজারে প্রকাশ করে যেমন ১ম এবং ২য় অংক যদি ৬০ হয় তবে এর অর্থ হয় ঐ ইলেকট্রোড দিয়ে ওয়েন্ডিং করলে ওয়েল্ড মেটালের শক্তি হবে ৬০,০০০ পাউন্ড/বর্গইঞ্চি। (যদি ৪র্থ অংকের পর আর একটি অংক কোড মার্কে থাকে তাহলে ০২টি অংকের স্থলে তিনটি অংক হবে এবং ওয়েন্ড মেটালের শক্তি পূর্বের মতই হাজারে প্রকাশ করতে হবে)।
শেষ অংকের পূর্বের অংকটিঃ এ অংকটি ওয়েন্ডিং এর পজিশন নির্দেশ করে, এটি ১, ২, এবং ৩ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ১ থাকলে বুঝা যাবে ইলেকট্রোডটি দিয়ে সকল পজিশনে ওয়েল্ডিং করা যাবে। ২ থাকলে বুঝা যাবে এ ইলেকট্রোড দিয়ে ফ্ল্যাট এবং হরিজেন্টাল অবস্থানে ওয়েল্ডিং করা যাবে। ৩ থাকলে বুঝা যাবে এ ইলেকট্রোড দিয়ে শুধু ফ্ল্যাট পজিশনে ওয়েন্ডিং করা যাবে।
শেষ অংকটিঃ শেষ অংকটি ০, ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি হতে পারে। এ অংকগুলোর প্রত্যেকটির জন্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করবে, এ শেষ অংকটি হতে জানা যায় ইলেকট্রোড এর উপরের আবরণের প্রকৃতি কেমন, কোন ধরনের কারেন্ট ব্যবহার করতে হবে, পেনিট্রেশন কেমন হবে ইত্যাদি তথ্য জানা যাবে।
সর্বশেষ অংক | আবরণ | ওয়েল্ড কারেন্ট এবং পোলারিটি | শুয়েন্ডের বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|---|
০ | সেলুলোজ সোডিয়াম | ডিসি, রিভার্স পোলারিটি | ডিপ পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড, ফাস্ট ফিল |
১ | সেলুলোজ সোডিয়াম | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি | ডিপ পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড, ফাস্ট ফিল |
২ | টাইটেনিয়া সোডিয়াম | এসি/ডিসি স্ট্রেইট পোলারিটি | মিডিয়াম পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড |
৩ | টাইটেনিয়া পটাশিয়াম | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি ডিসি স্ট্রেইট পোলারিটি | কম পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড |
৪ | টাইটেনিয়া আয়রন পাউডার | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি ডিসি স্ট্রেইট পোলারিটি | কম পেনিট্রেশন ফাস্ট ডিপোজিট |
৫ | লো-হাইড্রোজেন সোডিয়াম | ডিসি, রিভার্স পোলারিটি | মিডিয়াম পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড, হাই সালফার কনটেন্ট |
৬ | লো-হাইড্রোজেন পটাশিয়াম | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি | মিডিয়াম পেনিট্রেশন, কনভেক্স বিড, হাই সালফার কনটেন্ট |
৭ | আয়রন পাউডার আয়রন অক্সাইড | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি পোলারিটি | মিডিয়াম পেনিট্রেশন, ফ্লাট বিড |
৮ | আয়রন পাউডার লো- হাইড্রোজেন | এসি/ডিসি রিভার্স পোলারিটি | কম পেনিট্রেশন, কনভেক্সবিড |
E 6012 ইলেকট্রোডের ক্ষেত্রে প্রথম অক্ষর E দিয়ে বুঝায় এটি এমন ইলেকট্রোড যা ইলেকট্রিক আর্ক ওয়েল্ডিং এর জন্য ব্যবহৃত হয়। প্রথম ২টি অংক অর্থাৎ ৬০ দিয়ে বুঝা যায় ওয়েল্ড মেটালের সর্বনিম্ন টানশক্তি হবে ৬০,০০০ পাউন্ড/বর্গইঞ্চি। শেষের পূর্বে অংকটি অর্থাৎ ১ দিয়ে বুঝা যায় ইলেকট্রোড সকল অবস্থানে ওয়েল্ডিং করার জন্য উপযুক্ত। শেষ অংকটি ২ দিয়ে বুঝা যায় ইলেকট্রোডটির উপরের আবরণে টাইটেনিয়া সোডিয়াম আছে। এটি দিয়ে ওয়েল্ড করার সময় এসি বা ডিসি ব্যবহার করা যাবে, তবে ডিসি ব্যবহার করলে স্ট্রেইট পোলারিটিতে কাজ করতে হবে। এই ইলেকট্রোড ওয়েল্ড হবে মিডিয়াম পেনিটেশন ও কনভেক্স বিড।
ফ্ল্যাক্স এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ পদার্থ যা ওয়েল্ডিং এর সময় জবে অক্সিজেনের যৌগ গঠনে বাধা প্রদান করে এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক বিক্রিয়া হতে জবকে রক্ষা হবে। নিখুঁত এবং দ্রুত ওয়েল্ডিং এর জন্য এটি বিশেষ প্রয়োজন। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকারের ফ্লাক্স পাউডার, পেস্ট, কঠিন এবং তরল আকারে পাওয়া যায়। এদের কতগুলো জোড়া স্থানের ক্ষয় করে, কতকগুলি জোড়াস্থানের কম ক্ষয় করে, আবার কতকগুলি ক্ষয় করে না। এ বিচারে ফ্লাক্সগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।
১। হাইলি করোসিভ ফ্লাক্স : এদেরকে কাজ শেষ হওয়ার পর দ্রুত জোড়া স্থান হতে পরিষ্কার করা দরকার। কারণ এরা জোড়া স্থানের ক্ষয় করে।
২। ইন্টারমিডিয়েট করোসিভ ফ্লাক্স : এরা জোড়া স্থানের কম ক্ষয় করে
৩। নন-করোসিভ ফ্লাক্স : এটি জোড়া স্থানের কোন ক্ষয় করে না।
ফ্লাক্স হিসেবে যে সকল রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয় এদের মধ্যে কতকগুলো উল্লেখযোগ্য ফ্লাক্স হলো :
(ক) বোরাক্স
(খ) বোরিক এসিড
(গ) ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেট
(ঘ) লাইম বা চুন ইত্যাদি ।
বিভিন্ন ধাতুর ওয়েল্ডিং কাজে বিভিন্ন রকমের ফ্লাক্স ব্যবহার করতে হয় নিচের টেবিলে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাতুর ওয়েল্ডিং কাজে ব্যবহৃত ফ্লাক্সের নাম দেওয়া হলো ।
ধাতুর নাম | ফ্লাক্স এর নাম |
---|---|
ভামা | ফ্লাক্স ছাড়া ওয়েল্ডিং করা যায়, তবে ভালো ফল পেতে বোরাক্স ব্যবহার করা উচিত। |
ভাষার সংকর | বোরাক্স, বোরিক এসিড, ফসফেট, (ব্রাশ, বোঞ্জ) ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকেট, চুন ইত্যাদি। |
অ্যালুমিনিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়াম সংকর | লিথিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড |
কাস্ট আয়রন | বোরেট, সোডা অ্যাস, সোডিয়াম ক্লোরাইড ইত্যাদি |
স্টেইনলেস স্টিল | বোরাক্স, বোরিক এসিড, ফ্লোরস্পার ইত্যাদি |
আবার অলৌহ জাতীয় ধাতু জোড়ের ক্ষেত্রেও আবরণযুক্ত ইলেকট্রোড ব্যবহৃত হয়। অ্যালুমিনিয়াম ইলেকট্রোড, অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় ধাতু জোড়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ফসফরাস ধাতু জোড়ের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচ্য বিষয় হলো, ইলেকট্রোড নির্বাচন। সঠিক ধাতুর জন্য সঠিক ইলেকট্রোড নির্বাচন করতে না পারলে ধাতু জোড় দেওয়া সম্ভব হবে না, আবার অনেক ক্ষেত্রে জোড় দেওয়া সম্ভব হলেও তা সঠিক হবে না। তাই ধাতুর গুণাগুণ ও ইলেকট্রোডের গুণাগুণ জেনেই ধাতুজোড় দিতে হবে, তবেই মানসম্পন্ন ধাতুর জোড় পাওয়া যাবে।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১। আই, আই, ডবিউ এর পূর্ণ অর্থ লেখ।
২। আই, আই,ডবিউ এর নির্ধারিত মাপ অনুসারে একটি ইলেকট্রোড এর মাপ কত হবে?
৩। ইলেকট্রোডের শ্রেণিবিন্যাস কর এবং বিভিন্ন শ্রেণির ইলেকট্রোডের নাম লেখ ।
৪। কনজুমাবল এবং নন কনজুমাবল ইলেকট্রোড বলতে কী বুঝায়?
৫। ফ্লাক্স কী? এটির কাজ কী?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
৬। ফ্লাক্স হিসেবে ব্যবহৃত হয় এরূপ কয়েকটি রাসায়নিক পদার্থের নাম লেখ ।
৭। কাস্ট আয়রন ওয়েল্ডিং এর জন্য কোন কোন ফ্লাক্স ব্যবহৃত হয়?
৮। ব্রাশ এবং ব্রোঞ্জ ওয়েল্ডিং করতে যে ফ্লাক্সগুলো ব্যবহৃত হয় সেগুলোর নাম লেখ।
৯। ভিজা স্থানে ইলেকট্রোড রাখলে কী হবে।
১০। ইলেকট্রোড কিছুটা আর্দ্রতা শোষিত হলে কী করতে হবে?
রচনামূলক প্রশ্ন
১১। ফ্ল্যাক্স এর প্রকারভেদ আলোচনা কর ।
১২। ওয়েল্ডিং এর জন্য সঠিক ইলেকট্রোড নির্বাচন কৌশল লেখ।
১৩। ফ্ল্যাক্সের বহুবিধ কাজ আলোচনা কর।