প্রথম অধ্যায়

ষষ্ঠ শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - NCTB BOOK
Please, contribute to add content into প্রথম অধ্যায়.
Content

উপরে কেউ নেই। তিনি পরম পিতা, তিনি পরম স্রষ্টা, পরম ব্রহ্ম, পরমেশ্বর, ভগবান। পরমাত্মা নামেও তিনি পরিচিত। তিনি ঈশ্বর নামেও অভিহিত। তাঁকে দেখা না গেলেও, তিনি সর্বত্র বিরাজিত। তিনি নিরাকার, এই ঈশ্বর বা পরমাত্মাই জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমরা তাঁকে অনুভব করি। কারণ তিনি তাঁর সৃষ্ট জীবের মধ্যে আত্মারূপে অবস্থান করেন। সৃষ্ট জীব-জগতের মধ্য দিয়ে তাঁকে অনুভব করা যায়। সাধকেরা সাধনার মাধ্যমে এবং ভক্তেরা ভক্তির মাধ্যমে তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করে থাকেন।

ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং মানুষের তৈরি 

বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বিজ্ঞানমেলার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে পাশাপাশি দুইটি স্টল আছে। একটি স্টলে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কিছু বস্তু বা বস্তুর ছবি আছে। অন্য স্টলে মানুষের তৈরি কিছু জিনিস বা জিনিসের ছবি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ একজন এগুলো সম্পর্কে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

একটা ছবিতে মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, সৌরজগৎ ইত্যাদি আছে। অন্য একটা ছবিতে টেবিল, চেয়ার, বই-পত্র, ল্যাপটপ ইত্যাদি আছে। প্রথম ছবিটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। দ্বিতীয় ছবিটি মানুষের তৈরি কিছু জিনিসের ছবি। এখন আমরা এই দুইটি ছবির পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করি।

আমরা জানি, এই মহাবিশ্বের সবকিছু ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। আর এই দৃশ্যমান সৃষ্টিকে আমরা প্রকৃতি বলি। ছবিতে দৃষ্ট প্রাকৃতিক ছবিটিই প্রকৃতি। আমরা এই প্রকৃতির একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন- মানুষ, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, চন্দ্র, সূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, সৌরজগৎ তথা সবকিছু। তিনি এই সৃষ্টি করার সময় কিন্তু কারও কোনো সাহায্য নেননি। অথচ মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্টির সহায়তা ছাড়া কোনো কিছুই তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃষ্ট বস্তুর সাহায্যে মানুষ নানা জিনিস-পত্র তৈরি করছে। দ্বিতীয় ছবিতে মানুষের তৈরি জিনিস দেখানো হয়েছে।

আমরা যদি আরও একটু পরিষ্কার করে বলি, তাহলে বলা যায় সবকিছুই ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। ঈশ্বর চাইলে সব কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। মানুষ কিন্তু ঈশ্বরের মতো সব কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন- ঈশ্বর গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, সমুদ্র প্রভৃতি সৃষ্টি করতে পারেন। মানুষ তা পারে না। মানুষ প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের সাহায্যে রোবট তৈরি করতে পারে। কিন্তু মানুষ সেই রোবটের মধ্যে আত্মাকে প্রবেশ করাতে পারে না। মানুষ প্রকৃতি থেকে সৃষ্ট গাছের কাঠ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে পারে। কিন্তু মানুষ নিজে প্রকৃতি সৃষ্টি করতে পারে না। তাই আমরা বলতে পারি ঈশ্বরের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব তা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক

স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসেন, প্রতিপালন করেন। স্রষ্টাকে ছাড়া যেমন সৃষ্টিকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি সৃষ্টি ছাড়া স্রষ্টাকেও ভাবা যায় না। উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। স্রষ্টার সৃষ্টি নানাভাবে আমাদের উপকার করে থাকে। যেমন ঈশ্বরের সৃষ্টি জল, বায়ু, সূর্য প্রভৃতির কারণে জগতের প্রাণিকুল বেঁচে আছে। এদের কারণেই আমরা নানাবিধ শস্য ও ফসল চাষ করতে পারি, এই ফসল আমাদের খাদ্যের যোগান দেয় এবং আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। গাছপালা সূর্যের আলোয় তার খাদ্য প্রস্তুত করে বেড়ে উঠে। জল ছাড়া কোনো প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। নদ-নদীর মাধ্যমে আমরা প্রাকৃতিকভাবে জল পেয়ে থাকি। সৃষ্টিকর্তার এই সৃষ্ট সম্পন্ন মানুষ নানাভাবে ব্যবহার করে। মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি প্রস্তুত করে জীবনযাপন করে। সৃষ্টিকর্তার এসব সৃষ্টি ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব হতো না। এভাবে বলা যেতে পারে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক বিরাজমান।

 

সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান

ঈশ্বর আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন। আমরা তাঁরই একটা অংশ। কারণ সৃষ্টিকর্তাকে পরমাত্মা বলা হয়। আর আমাদের মধ্যে যে আত্মা বিরাজিত সেই আত্মা পরমাত্মারই অংশ। তাই ব্যাপকার্থে জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। এখন প্রশ্ন হতে পারে তাহলে মানুষ কেন ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ায়? সে কেন ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য কঠোর সাধনা করে? এর সহজ উত্তর হলো, ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য সাধনাই যথেষ্ট নয়। তাঁকে পেতে হলে আগে জীবের সেবা করতে হবে। ভালোবাসতে হবে তাঁর সৃষ্টিকে। তাঁর সৃষ্টিকে ভালোবাসলেই তিনি খুশি হন আর তাতেই তিনি ভক্তের প্রতি সদয় হন। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? 

জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। "

এজন্য আমাদেরকে সকল জীবের প্রতি সদয় হতে হবে। সকল জীবকে ভালোবাসতে হবে। তবেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। এই জীব বলতে প্রধানত বিভিন্ন প্রাণীকে বোঝানো হয়েছে। আমাদের যেমন সকল মানুষকে ভালোবাসতে হবে তেমনি গৃহপালিত পশু-পাখিসহ সকল প্রাণীর যত্ন নিতে হবে। তাদেরকে সেবা করতে হবে। পাশাপাশি বাড়ির চারপাশের গাছ-পালারও পরিচর্যা করতে হবে। অর্থাৎ, সৃষ্টিকর্তার সকল সৃষ্টিকে ভালোবাসতে হবে। তবেই হবে ঈশ্বরকে ভালোবাসা। তবেই হবে প্রকৃতপক্ষে ধর্মপালন।

 

ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য যে বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্বন্ধে জানলাম এবং আমাদের পিতামাতা, শিক্ষক এবং পুরুজনদের নিকট থেকে যা শিখলাম তার উপর ভিত্তি করে একটি সুন্দর দেয়াল পত্রিকা তৈরি করব দেয়াল পত্রিকাটি আমাদের শ্রেণিকক্ষের সামনে নোটিশ বোর্ডে স্থাপন করব যেন সকলে দেখতে পায়। 

তবে কিভাবে একটি সুন্দর দেয়াল পত্রিকা তৈরি করা যায় তা শিক্ষকের নিকট থেকে জেনে নেব।

 

দেয়াল পত্রিকা

দেয়াল পত্রিকা হলো বিভিন্ন তথ্যের এক ধরনের নান্দনিক প্রদর্শনী। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে কোনো একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষকের সহায়তায় আলোচনা, মতবিনিময়, উপস্থাপনের সাপেক্ষে লেখা, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, ছবি, ইত্যাদি রচনা এবং নির্বাচন করে। এগুলোই শিক্ষার্থীরা বোর্ডে নিজ হাতে লিখে বা এঁকে আকর্ষণীয় এবং সুপাঠ্য করে অন্য দর্শক বা পাঠকের সামনে তুলে ধরে।

দেয়াল পত্রিকা করতে যা যা লাগবে তা এক নজরে দেখো।

 

Content added By

ঈশ্বরের স্বরূপ -নিরাকার ও সাকার

 

এই যে আমরা বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি আঁকলাম এর প্রতিটি ঈশ্বরের একেকটি রূপ। ঈশ্বরকে এইভাবে আমরা বিভিন্নরূপে আরাধনা করে থাকি।

ঈশ্বর নিরাকার তাই আমরা তাঁকে দেখতে পাই না। তবে তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে অনুভব করি। এই নিরাকার ব্রহ্মরূপে তিনি সর্বত্র বিরাজিত। বিশ্বের সবকিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি জ্ঞানীর কাছে ব্রহ্ম, যোগীর কাছে পরমাত্মা এবং ভক্তের কাছে ভগবান রূপে পরিচিত। ঈশ্বরকে বলা হয় "স্বয়ম্ভু'। কারণ তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিতা, শুষ্ক ও পরম পবিত্র। তিনি সকল কর্মের ফলদাতা। যে যেমন কাজ করে তিনি তাকে সেই কাজ অনুসারে ফল প্রদান করেন। ঈশ্বরের রূপের অন্ত নাই। অনন্তরূপ তাঁর। তিনি সর্বব্যাপী।

কোনো বিশেষ শক্তির প্রকাশ ঘটাতে সাকার রূপে ঈশ্বর পৃথিবীতে আসেন। ঈশ্বরের কোনো বিশেষ গুণ বা শক্তির সাকার রূপ হলো দেবতা বা দেব-দেবী। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর কথা উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া ঈশ্বর আত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন।

ঈশ্বর কখনো কখনো জীবদেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন। তাঁর এই আসা বা অবতীর্ণ হওয়াকে বলে অবতার। তিনি অবতীর্ণ হন দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের জন্য। পৃথিবীতে শান্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাকার রূপ ধারণ করেন। সাকার রূপে আবির্ভূত হয়ে তিনি নানা কর্মের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করেন।

তবে নিরাকার এবং সাকার রূপ মূলত সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরেরই ভিন্ন প্রকাশ মাত্র।

 

দেব-দেবী রূপে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ

ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। 'একনের অদ্বিতীয়ম্'। অনন্ত তাঁর গুণ ও শক্তি। তাঁর এই গুণ বা শক্তি দেখা যায় না। তবে অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। যেমন- আলো, বাতাস, শব্দ, গন্ধ ইত্যাদি দেখা যায় না। শুধু অস্তিত্ব বা উপস্থিতি অনুভব করা যায়। তেমনি ঈশ্বরকেও দেখা যায় না, অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। তিনি নিরাকার, সর্বশক্তিমান। নিরাকার ঈশ্বরের বিভিন্ন শক্তির সাকার রূপই হচ্ছেন দেব-দেবী। অর্থাৎ দেব-দেবীরা ঈশ্বরের বিশেষ গুণ বা শক্তিরই মূর্ত প্রকাশ মাত্র। আমরা ঈশ্বরের সাকাররূপী বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করি। যেমন- ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণুরূপে ঈশ্বর জীবজগৎকে রক্ষা ও প্রতিপালন করেন, শিবরূপে তিনি ধ্বংস করে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেন। বিদ্যাশক্তির সাকার রূপ সরস্বতী দেবী, ধনসম্পদের শক্তির রূপ লক্ষ্মীদেবী, সকল শক্তির সম্মিলিত রূপ দুর্গাদেবী। এই দেব-দেবীদের পূজা করার মধ্য দিয়ে আমরা মূলত সেই এক ঈশ্বরেরই পূজা করে থাকি।

অবতার হিসেবে নিরাকার ঈশ্বরের সাকার রূপ

ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু তিনি সর্বত্র অদৃশ্যভাবে অবস্থান করেন। তবে ঈশ্বর কখনো কখনো বিশেষ রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হোন। অনেক সময় তিনি মানুষের মতো দেহ ধারণ করেন। এই দেহ ধারণের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে। তিনি দেহ ধারণ করে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন। এ সম্পর্কে

শ্রীনন্তগবদ্গীতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। 

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্। ৪/৭

পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।

 ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। ৪/৮

শব্দার্থ যদা যদা হি যখন যখনই; ধর্মস্য গ্লানিঃ- ধর্মের অবনতি; ভবতি হয়; ভারত- হে ভারত (অর্জুন); অভ্যুত্থানম্ - বৃদ্ধি; অধর্মস্য অধর্মের তদা তখন; আত্মানং- নিজেকে; সৃজামি- সৃষ্টি করি; অহম্-আমি। পরিত্রাণায়- রক্ষার জন্য; সাধুনাং সৎ ব্যক্তিদের বিনাশায় বিনাশের জন্য; এবং দুষ্কৃতাম্ অসৎ বা দুষ্টদের; ধর্মসংস্থাপনার্থায়ন ধর্ম সংস্থাপনের জন্য সম্ভবামি অবতীর্ণ হই; যুগে যুগে- যুগে যুগে।

সরলার্থ: পৃথিবীতে যখনই ধর্মের অবনতি হয় ও অধর্ম বেড়ে যায়, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সং ব্যক্তিদের রক্ষা, অসৎ বা দুষ্ট ব্যক্তিদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।

পৃথিবীতে ঈশ্বরের এরূপ অবতরণকে অবতার বলা হয়। তিনি নানারূপে অবতীর্ণ হন। এই অবতারগণ মানুষের এবং জগতের মঙ্গল করেন। বিভিন্ন যুগে ভগবানের বিশেষ দশটি অবতারের কথা বর্ণিত হয়েছে। যথা- মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুধ ও কল্কি

  • এখানে সংক্ষেপে চারজন অবতারের পরিচয় দেওয়া হলো-

 

মৎস্য অবতার:

ভগবান বিষ্ণুর প্রথম অবতার হলো মৎস্য অবতার। এই অবতারের শরীরের উপরের অংশ দেখতে মানুষের মতো। নিচের অংশ মাছের মতো। অনেক বছর আগে সত্যব্রত নামে একজন রাজা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে হঠাৎ পৃথিবীতে অনেক দুর্যোগ দেখা দেয়। ধর্মের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। অধর্মের মাত্রা বেড়ে যায়। রাজা তখন ঈশ্বরের করুণা কামনা করেন। একদিন স্নানের সময় রাজা সতারতের নিকট এসে একটি ছোট পুঁটি মাছ প্রাণ ভিক্ষা চায়। রাজা কমন্ডলুতে করে মাছটিকে বাড়ি নিয়ে এলেন। কিন্তু অবাক কান্ড। মাছটির আকার ক্রমশ বাড়তে থাকে। মাছটিকে পুকুর, নদী কোথাও রাখা যাচ্ছিল না। মাছটি আকারে বাড়তেই থাকে। তখন রাজা ভাবলেন, এটা আসলে মাছ নয়। নিশ্চয়ই ভগবান নারায়ণের কোনো গ্রুপ। রাজা তখন মৎস্যরূপী নারায়ণের স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন। স্তব-স্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে মৎস্যরূপী নারায়ণ বললেন, সাত দিনের মধ্যে এ জগতের প্রলয় হবে। সে সময় তোমার ঘাটে একটি স্বর্ণতরী ভিড়বে। তুমি বেদ, সব রকমের জীবদম্পতি, খাদ্য-শস্য ও যুদ্ধবীজ সংগ্রহ করে তাদের নিয়ে সেই নৌকায় উঠবে। আমি তখন শৃঙ্গধারী মৎস্যরূপে আবির্ভূত হব। তুমি তোমার নৌকাটি আমার শৃঙ্গের সঙ্গে বেঁধে রাখবে।

মহাপ্রলয় শুরু হলো। মৎস্যরূপী নারায়ণের নির্দেশ অনুসারে রাজা কাজ করলেন। ধ্বংসের হাত থেকে রাজা, তার সঙ্গী-সাথি এবং অন্যান্য দ্রব্য-সামগ্রী রক্ষা পেল। এভাবে মৎস্যরূপী ভগবান বিষ্ণু সৃষ্টিকে রক্ষা করলেন। রক্ষা পেল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদ।

নৃসিংহ অবতার

নৃসিংহ বা নরসিংহ রূপ হচ্ছে বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। নৃ বা নর অর্থ মানুষ। নৃসিংহ হচ্ছে মানুষ ও সিংহের মিলিত রূপ। মাথা সিংহের মতো আর শরীর মানুষের মতো। আবার নখগুলো সিংহের মতো। নিজের ভাই হিরণ্যাক্ষকে বরাহরূপী বিষ্ণু হত্যা করেন। এতে হিরণ্যকশিপু প্রচণ্ড রেখে বিষ্ণু বিরোধী হয়ে উঠেন। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। হিরণ্যকশিপু নানা কৌশলে প্রহ্লাদকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। প্রতিবারেই বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পায়।

একদিন প্রচণ্ড রেগে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞেস করলেন বল তোর বিষ্ণু কোথায় থাকে?

প্রহ্লাদ উত্তর দিল- ভগবান বিষ্ণু সব জায়গায়ই থাকেন।

তখন হিরণ্যকশিপু তার প্রাসাদের এক স্ফটিকস্তম্ভ দেখিয়ে জানতে চাইলেন- এর মধ্যেও কি তোর বিষ্ণু আছে?

প্রহ্লাদ বিনীতভাবে বললেন হ্যাঁ বাবা, শ্রীবিষ্ণু এখানেও আছেন। হিরণ্যকশিপু রেগে পায়ের আঘাতে সে স্তম্ভ ভেঙ্গে ফেললেন। তখনই স্তম্ভের ভিতর থেকে ভগবান বিষ্ণু ভয়ঙ্কর নৃসিংহ রূপ ধারণ করে আবির্ভূত হলেন। তিনি নখ দিয়ে হিরণ্যকশিপুর উদর বিদীর্ণ করলেন। হিরণ্যকশিপুর অত্যাচার থেকে পৃথিবী রক্ষা পেল।

 

Content added By

আত্মার অবিনাশিতা, জন্মান্তর ও কর্মফল

আমরা জন্ম মৃত্যু সম্পর্কে জানি। এবার জন্মান্তর নিয়ে পুরাণের সুন্দর একটি গল্প পড়ব।

জড়ভরতের কাহিনি: অনেক কাল আগে বিষ্ণুভক্ত এক রাজা ছিলেন। তাঁর নাম ছিল ভরত। রাজা ভরত পুত্রদের মধ্যে রাজ্য ভাগ করে দিয়ে তপস্যার জন্য বনে চলে যান। সাধনার ফলে রাজা ভরতকে বলা হয় সাধক ভরত বা মুনিভরত। একদিন তিনি নদীতে স্নান করতে গেলেন। সেখানে সদ্যোজাত মাতৃহারা একটি হরিণশাবক দেখতে পান। তিনি তাকে রক্ষা করার জন্য আশ্রমে নিয়ে আসেন। হরিণশাবকের যত্নে, আদরে তাঁর সময় কাটে। এর ফলে মুনির তপস্যা আর রইল না। এমনকি মৃত্যুর সময়ও এই হরিণ শিশুর কথা চিন্তা করতে করতে তিনি দেহত্যাগ করেন। শাস্ত্রে আছে মানুষ যেরূপ চিন্তা করতে করতে মৃত্যুবরণ করবে তার সেই রূপেই পুনর্জন্ম হবে। তাই ভরতমুনিকেও হরিণরূপে জন্মগ্রহণ করতে হলো।

তবে হরিণ হয়ে জন্মলাভ করলেও তিনি ছিলেন জাতিস্মর। পূর্ব জন্মের কথা তাঁর স্মরণে ছিল। তাই হরিণ জীবনেও তপস্বীদের আশ্রমের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতেন আর ধর্মকথা শুনতেন। এভাবে তপস্যার কথা শুনতে শুনতে তিনি দেহত্যাগ করে পুনরায় মানবজন্ম লাভ করেন। মানুষ রূপে জন্মলাভ করে তিনি সবসময় ঈশ্বরচিন্তা করতেন। কারও সাথে বেশি কথা বলতেন না। জড়ের মতো থাকতেন। এজন্য তাঁকে জড়ভরত বলা হতো।

  • এইযে জন্মান্তর নিয়ে যে সুন্দর গল্পটি জানলাম এবার এ সম্পর্কে আরেকটু জানব।

জন্মান্তরের সাথে কর্মবাদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কর্মফল অবশ্যই মানুষকে ভোগ করতে হয়। যে যেরকম কর্ম করে সে সেই রূপেই পুনর্জন্ম লাভ করে। খারাপ কাজ করলে খারাপ রূপে এবং ভালো কাজ করলে ভালো রূপে পুনর্জন্ম লাভ করবে। সুতরাং আমরা সবাই ভালো কাজ করব।

আম্মার অবিনাশিতা আমাদের মধ্যে আত্মা আছে। এই আত্মার কোনো বিনাশ নেই। আত্মার কখনও জন্ম হয়।

না। মৃত্যুও হয় না। পুনঃ পুনঃ তার উৎপত্তি বা বৃদ্ধিও হয় না। তিনি জন্ম রহিত, শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন।

শরীরের বিনাশ হলেও আত্মার কোনো বিনাশ নেই। শুধু এক দেহ থেকে অন্য দেহে গমনাগমন আছে।

জন্ম ও কর্মফল : আমাদের আত্মার কোনো জন্ম নেই, মৃত্যু নেই। শুধু দেহ থেকে দেহান্তর হয়। এ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়

নবানি গৃহাতি নরোহপরাণি। 

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণ-

 নান্যানি সংযাতি নবানি নেহী 2/22

 

শব্দার্থ : বাসাংসি বস্তু, কাপড়; জীর্ণানি, জীর্ণ, ছেঁড়া; যথা- যেমন; বিহায় পরিত্যাগ করে; নবানি- নতুন গৃহাতি- গ্রহণ করে; নরঃ- মানুষ; অপরাদি অন্য তথা, সেরূপ, তেমনি; শরীরাণি শরীর সমূহ; বিহায় ত্যাগ করে; জীর্ণানি- জীর্ণ বা পুরাতন; অন্যানি অন্য সংযাতি গ্রহণ করে; নবানি - নতুন দেহ; দেহী- দেহ ধারী, আত্মা।

 

সরলার্থ: মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করে।

এই জন্মান্তরের সাথে কর্মফলের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। জীবের কর্ম অনুসারে তার পুনর্জন্ম হয়। এমনকি মৃত্যুকালে যিনি যে ভাব স্মরণ করে দেহত্যাগ করেন, তিনি সেই ভাবে ভাবিত রূপেই জন্মলাভ করেন। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের একটি কাহিনিটি জেনেছি।

 

Content added By
Promotion