সূরা আদ-দুহা ( سُوْرَةُ ) |
সূরা আদ-দুহা কুরআন মাজিদের তিরানব্বই নম্বর সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হযেছে। এর আয়াত সংখ্যা এগারো। সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে সূরা ফাজরের পর এবং সূরা ইনশিরাহ এর আগে। রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর মাক্কি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে সূরাটি অবতীর্ণ হয়।
শানে নুযূল
এ সূরার শানে নুযুল সম্পর্কে হযরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, ওহি অবতীর্ণের প্রাথমিক সময়ে কিছু দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওহি আসা বন্ধ ছিল। এতে মহানবি (সা.) খুব চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে পড়েন। মক্কার কাফির এবং মুশরিকরা তখন বলতে শুরু করল, মুহাম্মাদের (সা.) প্রভু তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন আল্লাহ তা'আলা সূরা আদ-দুহা অবতীর্ণ করেন। সহিহ বুখারি এবং সহিহ মুসলিমে সূরা আদ-দুহার আরেকটি শানে নুযূল বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কয়েকদিন জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে আসেননি। তখন আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল (উরওয়া বিনতে হারব) এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলল, 'হে মুহাম্মাদ! আমার মনে হয় তোমার সঙ্গে যে শয়তানটা থাকত, সে তোমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। দুই বা তিন রাত আমি তাকে তোমার কাছে আসতে দেখছি না।' তখন আল্লাহ তা'আলা এ সূরাটি নাযিল করেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে |
وَالضُّحَى :
| ১. শপথ পূর্বাহ্ণের। |
وَالَّيْلِ إِذَا سَجَى :
| ২. শপথ রাতের, যখন তা নিঝুম হয়। |
مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى
| ৩. আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি বিরূপও হননি। |
وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْأُولَى
| ৪. নিশ্চয়ই আপনার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়। |
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
| ৫. আর অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে অনুগ্রহ দান করবেন, আর আপনি সন্তুষ্ট হবেন। |
أَلَمْ يَجِدُكَ يَتِيمًا فَأَوْى | ৬. তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম অবস্থায় পাননি? এর পর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। |
وَوَجَدَكَ ضَالَّا فَهَدَى 6
| ৭. এবং তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, তারপর তিনি পথের নির্দেশ দিয়েছেন। |
وَوَجَدَكَ عَابِلًا فَأَغْنَى
| ৮. এবং তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব অবস্থায়, এর পর তিনি অভাবমুক্ত করেন। |
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ
| ৯. অতএব আপনি ইয়াতিমদের প্রতি কঠোর হবেন না। |
وَأَمَّا السَّابِلَ فَلَا تَنْهَرْ
| ১০. এবং কোনো প্রার্থীকে ধমক দেবেন না। |
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثُ :
| ১১. আর আপনি আপনার প্রতিপালকের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। |
ব্যাখ্যা
নবি-রাসুলগণ আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। তাঁরা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। আল্লাহ তা'আলা নবি- রাসুলগণের প্রতি তাঁদের জন্মলগ্ন থেকেই অবিরত ধারায় করুণা দান করে থাকেন। এ সূরায় মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি প্রদত্ত বিভিন্ন অনুগ্রহের বিবরণ দিয়েছেন। মহানবি (সা.) ইয়াতিম ছিলেন। জন্মের পূর্বেই তাঁর বাবা ইন্তেকাল করেন। আর মা মারা যান ছয় বছর বয়সে। তাকে লালন- পালন করার মতো কেউ ছিল না। মহান আল্লাহ তাকে লালন-পালনের সুব্যবস্থা করেছেন। প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিবের ও পরে চাচা আবু তালিবের অন্তরে তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ফলে তারা নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি যত্নসহকারে তাঁকে লালন-পালন করেছেন।
ওহি লাভের পূর্বে তিনি মহান আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। মানব জাতির দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও পরকালীন মুক্তির জন্য চিন্তাক্লিষ্ট ছিলেন। তিনি সত্যের সন্ধানে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। মহান আল্লাহ তখন তাঁকে নবুওয়াত দান করে সত্য ও সুন্দরের পথনির্দেশনা প্রদান করেন। হেদায়াতের আলোকবর্তিকা দান করেন। তিনি দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত ছিলেন। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে সচ্ছল ও ধনবান করেন। তাঁকে অভাবমুক্ত করেন। হযরত খাদিজা (রা) এর ধনসম্পদ দ্বারা অংশীদারী ব্যবসা করার মাধ্যমে এর সূচনা হয়। পরবর্তীতে মহান আল্লাহর হুকুমে খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ করার ফলে তাঁর সমস্ত সম্পত্তিই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য উৎসর্গিত হয়। এভাবে মহান আল্লাহ পার্থিব জীবনে মহানবি (সা.)- কে বহু নিয়ামত ও অনুগ্রহ দান করেন।
মহান আল্লাহ পার্থিব নিয়ামতের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)- কে পরকালীন বিভিন্ন নিয়ামত দান করার সুসংবাদ দান করেছেন এ সূরায়। মহান আল্লাহ মহানবি (সা.) কে সুসংবাদ প্রদান করেন যে, আপনার পরকালীন জীবন পার্থিব জীবনের তুলনায় বহুগুণ উত্তম হবে। দুনিয়াতে যত নিয়ামত দেওয়া হয়েছে আখিরাতে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রদান করা হবে।
মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পরকালে এমন কিছু দান করবেন যা পেয়ে তিনি খুশি হবেন। আর হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ততক্ষণ পর্যন্ত খুশি হবেন না, যতক্ষণ না তাঁর সকল উম্মতকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সন্তুষ্ট করবেন।
এ সূরায় মহানবি (সা.)-এর প্রতি আল্লাহ তা'আলার প্রদত্ত ইহকালীন ও পরকালীন এসব অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন ইয়াতিমদের প্রতি কঠোর না হন। কোনো ভিক্ষুককে যেন ধমক না দেন। সর্বদা আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা এ সূরা থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়- ১. মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের কখনো পরিত্যাগ করেন না এবং তাদের প্রতি বিরূপও হন না। ২. বিপদ যতই কঠিন হোক না কেন তিনিই তাঁদের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। ৩. তাঁদের পরকালীন জীবন পার্থিব জীবনের তুলনায় বহুগুণ উত্তম ও কল্যাণময় করে দেন। ৪. ধনী ব্যক্তিদের উচিত গরিব-দুঃখী ও অসহায় ব্যক্তিদের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসা। ৫. ভিক্ষুক ও সাহায্যপ্রার্থীদের ধমক বা তিরস্কার না করে যথাসম্ভব সাহায্য করা। কারণ, আল্লাহ ধনীদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের অংশ রেখেছেন। ৬. ইয়াতিমদের ধমক না দিয়ে সব সময় তাদের সাথে কোমল আচরণ করতে হবে। ৭. ধন-সম্পদ মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। যখন তিনি এ নিয়ামত কাউকে দান করেন, তখন তার উচিত কৃপণতা পরিহার করে এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। |
একক কাজ 'সূরা আদ-দুহার শিক্ষা আমার জীবনে যেভাবে চর্চা বা অনুশীলন করব' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে সূরা আদ-দুহার শিক্ষা আমার জীবনে চর্চার কৌশল বা উপায় চিহ্নিত করে তা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)
|
আরও দেখুন...