— অদৃশ্য প্রতিবেশী!! এটা আবার কী? এগুলো হচ্ছে এক প্রকার অণুজীব যা আমাদেরকে ঘিরে রাখে। যেমন—ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, শৈবাল ইত্যাদি। আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান অনেক প্রতিবেশীর পাশাপাশি এরা আমাদের জীবনকে ঘিরে রেখেছে। অনেক অণুজীব যেমনি আমাদের ক্ষতি করছে, তেমনি কিছু কিছু অণুজীব আমাদের উপকারও করছে। মানুষের সাথে এসব অদৃশ্য অণুজীব কেমন আচরণ, বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, সেসব আমরা এই শিখন অভিজ্ঞতায় খুঁজে দেখব।
— প্রথম সেশন শুরুর আগেই তোমাদের একটা কাজ করতে হবে। আগের সেশন শেষেই তোমরা এলাকাভিত্তিক জোড়ায়/দলে বিভক্ত হবার জন্য তোমাদের বাড়ির ঠিকানা লিখে জমা দাও। শিক্ষকের সহায়তায় তোমরা এলাকাভিত্তিক কয়েকটি জোড়ায়/দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেকটি জোড়া/দলের একটি করে সুন্দর নাম দেবে।
— এখন কাজ হল তোমাদের এলাকায় কী কী সংক্রামক রোগ আছে সেগুলো খুঁজে বের করা। তোমাদের এলাকায় কী কী সংক্রামক রোগ বালাই দেখা যায়? কী কী কারণে এসব রোগ ছড়ায়? কী কী করলে এসব রোগ থেকে দূরে থাকা যায়? আপাতত এই তথ্যগুলো জোগাড় করতে হবে তোমার চারপাশ থেকেই। তোমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, বাবা মা বা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বা পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারো।
— তোমাদের প্রত্যেক জোড়ার/দলের একজন সদস্যের এলাকার এমন একটি সংক্রামক রোগ বাছাই করে নিবে যেটা তার এলাকায় বিদ্যমান। যার এলাকার সংক্রামক রোগ বাছাই করা হয়েছে তার এলাকায় সুবিধাজনক সময়ে উক্ত সংক্রামক রোগের তথ্য জোড়ায়/দলে সংগ্রহ করবে।
— তথ্য সংগ্রহে তোমরা তথ্য ছক-১ ব্যবহার করবে। তথ্য ছকটি বুঝতে অসুবিধা হলে প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তা নিবে।
ছক-১
জোড়া/দলের নাম: | ||||
---|---|---|---|---|
এলাকার ঠিকানা: | ||||
সংক্রামক রোগের নাম | এ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা | কোন অণুজীব এ রোগের জন্য দায়ী? | এ সংক্রামক রোগের লক্ষণ কী কী? | কীভাবে এ সংক্রামক রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা যায়? |
|
— নিজ এলাকার সংক্রামক রোগের তথ্য সংগ্রহের পর শ্রেণিতে জোড়ায়/দলে আলোচনা করবে। তোমরা যারা একই ধরনের সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করেছে, তারা নতুন দল গঠন করে পুনরায় আলোচনা করবে।
— দলগত আলোচনার পর তোমাদের প্রাপ্ত তথ্য শ্রেণির বাকিদেরকে জানাও। মুক্ত আলোচনায় যোগ দিয়ে অন্য রোগগুলো সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করো। অন্যদের কাছ থেকে নতুন কোন রোগের কথা কি জেনেছ?
— এত সংক্রামক রোগের নামের ভিড়ে জলাতঙ্ক রোগের নাম কি এসেছে? তুমি কি জানো একসময় এই জলাতঙ্ক রোগে অনেক মানুষ মারা যেত? সেই সময়ে এই রোগের কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি, জলাতঙ্ক মানেই ছিল তখন নিশ্চিত মৃত্যু।
কিভাবে এই প্রতিষেধক এলো? চলো আজকে সেই গল্প শোনা যাক-
১৮৮৫ সালের এক দিনে ফ্রান্সের এক ছোট শহরে জোসেফ মাইস্টার নামের নয় বছর বয়সী একটা ছেলে স্কুলে যাচ্ছিল, তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্য মানুষদের সহায়তায় ছেলেটা তখনকার মতো প্রাণে বেঁচে গেলো বটে, কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক দুর্ভাগ্য। এই পাগল কুকুরটা ভুগছিল জলাতঙ্ক রোগে, আর কে না জানে- এই রোগে ভোগা কুকুর কোন মানুষকে কামড়ালে তার জলাতঙ্ক নিশ্চিত! rabies বা জলাতঙ্ক (Hydrophobia) তখন গোটা পৃথিবীতেই এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই, এটা যে ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও তখনো কেউ জানত না। প্রথমে জ্বর দিয়ে শুরু হয়, তারপর অস্বাভাবিক এক বিষণ্ণতা, তারপর আস্তে আস্তে ভয়ানক খিঁচুনি। পানির তেষ্টায় বুক ফেটে যেতে চায়, কিন্তু পানি মুখে দিলেই ভয়ঙ্কর খিঁচুনি। ভয়ঙ্কর কষ্টের মৃত্যু হচ্ছে এই রোগের শেষ পরিণতি । জোসেফ মাইস্টারের ভাগ্যেও একই পরিণতি হতে পারত, কিন্তু ঠিক ওই সময়ে প্যারিসে বসে একজন বিজ্ঞানী জলাতঙ্ক রোগের উপর গবেষণা করছিলেন, তার নাম লুই পাস্তুর। লুই পাস্তুরের তখন বয়স হয়েছে, স্ট্রোক করার ফলে শরীরের অর্ধেক অবশ। এই শরীর নিয়েই তিনি তখন জলাতঙ্কের কারণ আর প্রতিষেধক নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসকে দেখা না গেলেও রোগের ধরন দেখে লুই পাস্তুর অনুমান করলেন এটা স্নায়ু সংক্রান্ত রোগ। জলাতঙ্ক আক্রান্ত খরগোশের মেরুদণ্ডের ভেতরে থাকা স্পাইনাল কর্ডকে ভাইরাসের আবাস হিসেবে ধারণা করে তিনি সেটাকে পরীক্ষাগারে বেশ কিছুদিন অক্সিজেনের সংস্পর্শে রেখে দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করলেন। এরপর সেই ভাইরাস ঢুকানো হল সুস্থ খরগোশের শরীরে। দেখা গেলো এই পুরনো দুর্বল ভাইরাস খরগোশকে কাবু করতে পারল না। তারপর দিন আগের চেয়ে একটু সবল, নতুন জীবাণু দিয়েও খরগোশটা টিকে রইল। এভাবে প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে একটু সতেজ জীবাণু দিয়ে দিয়ে একসময় দেখা গেল একেবারে খাঁটি টগবগে জীবাণু দিয়েও খরগোশটা বহাল তবিয়তে বেঁচে রইলো! ঠিক এই সময়ে লুই পাস্তুরের কাছে আকুল হয়ে ছুটে এলেন জোসেফ মাইস্টারের মা তার ছেলেকে নিয়ে। যেকোনোভাবে হোক, তার ছেলেকে বাঁচাতে হবে। লুই পাস্তুর পড়লেন মহা সংকটে। প্রথমত, এই চিকিৎসা এখন পর্যন্ত কোন মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন সুস্থ খরগোশের ওপর, এদিকে এই ছেলেটির শরীরে ইতোমধ্যে জলাতঙ্কের জীবাণু ঢুকে গেছে। এর উপর কি এই চিকিৎসা কাজ করবে? কিন্তু কিছু না করলে ছেলেটির মৃত্যু একরকম নিশ্চিত। অনেক ভেবেচিন্তে লুই পাস্তুর ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। খরগোশের মতোই, জোসেফ মাইস্টারের শরীরে প্রথমে ঢোকানো হল দুই সপ্তাহ পুরনো জীবাণু। তারপরের দিন, তেরো দিনের পুরনো জীবাণু, তারপরের দিন বারোদিনের, এভাবে চৌদ্দতম দিনে তাকে দেয়া হল একেবারে ভয়ঙ্কর তাজা জীবাণু; যা শরীরে ঢুকলে যেকোন স্বাভাবিক মানুষ এক সপ্তাহে মারা যাবে। লুই পাস্তুরের মাথায় তখন শুধুই দুশ্চিন্তা, এই ছেলেটি বাঁচবে তো? জোসেফ মাইস্টার বেঁচে গিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর প্রথম জলাতঙ্ক রোগী বেঁচে উঠল, বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা! জোসেফ মাইস্টার তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাকি জীবন লুই পাস্তুরের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল। বড় হয়ে সে লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরির দ্বাররক্ষীর দায়িত্ব নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নাৎসি বাহিনী লুই পাস্তুরের ল্যাবরেটরি দখল করতে এসেছিল। জোসেফ মাইস্টার গেটের দরজায় দাঁড়িয়ে এই ল্যাবরেটরি রক্ষার চেষ্টা করে। জার্মান সেনার গুলিতে জোসেফ মাইস্টারের মৃত্যু হওয়ার আগে সে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেয় নি । |
— সবার পড়া শেষে এ গল্পটা নিয়ে আলোচনা করো। জলাতঙ্ক রোগের কথা তোমরা যা শুনেছ, তার সাথে মিলিয়ে দেখো।
আগের সেশনের আলোচনার মূলকথা স্মরণ করবে। সংগ্রহীত সংক্রামক রোগের তথ্য, লুই পাস্তুরের জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের ঘটনা নিয়ে পুনরায় আলোচনা করে নাও।
জলাতঙ্ক, কোভিড ইত্যাদি ভাইরাসবাহিত রোগ নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তোমরা ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই থেকে ভাইরাসের গঠন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পড়ে জানবে এবং কীভাবে তারা বিভিন্ন রোগ ছড়ায় সে বিষয়ে ধারণা গঠন করবে। একইসাথে অন্যান্য অণুজীবের গঠন ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে তাদের মধ্যে একই ধরনের প্যাটার্ন অনুসন্ধান করবে।
অণুজীব কি শুধুই আমাদের ক্ষতির কারণ, নাকি আমাদের বন্ধু হিসবেও ভূমিকা রাখে? হ্যাঁ ঠিক বলেছ, কিছু কিছু অণুজীবের (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক) কিছু প্রজাতির বৈশিষ্ট্য বা আচরণ আমাদের উপকারে আসে। যেমন- দই, মাশরুম ইত্যাদি।
তোমরা এবার প্রকৃতিতে অণুজীবের ভূমিকা এবং কীভাবে মানুষের কাজে আসে তা নিয়ে আলোচনা করবে। অণুজীব যে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতোই প্রকৃতির অংশ তা অনুসন্ধান করবে।
এ সেশনে তোমরা অনুসন্ধানী পাঠ, অনুশীলন বই ও নিজেদের আলোচনা মাধ্যমে বিভিন্ন অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, শৈবাল ও ভাইরাস) গঠন, বংশবৃদ্ধি ও পরিবেশগত গুরুত্ব সম্পর্কিত ধারণা স্পষ্ট করে নিবে। প্রয়োজনে শিক্ষকের সহায়তা নাও।
— তোমরা অণুজীব সম্পর্কে যে নতুন ধারণা পেয়েছ, তার ভিত্তিতে তোমাদের এলাকায় যেসব সংক্রামক রোগের কথা তোমরা জেনেছ সেগুলোকে আবার দলে বিশ্লেষণ করবে।
— বিশ্লেষণে কোন অণুজীব কোন রোগের জন্য দায়ী তা অনুমান করার চেষ্টা করবে। বিশ্লেষণের তথ্য দিয়ে ছক-২ পূরণ করে নাও।
ছক-২
জোড়া/দলের নাম: | ||||
---|---|---|---|---|
সংক্রামক রোগের নাম | কোন অণুজীব এ সংক্রামক রোগের জন্য দায়ী | এ সংক্রামক রোগের লক্ষণ কী কী? | কীভাবে এ সংক্রামক রোগের প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা যায়? | এ সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে কী কী স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত? |
| ||||
| ||||
|
— বিশ্লেষণের তথ্য নিয়ে বিভিন্ন দল বিভিন্ন সংক্রামক রোগ নিয়ে দলগত আলোচনা করবে। এসব সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে কী করা যায় নিজেরা চিন্তা করো। পরিকল্পনা করে সবার সাথে আলোচনা করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নাও।
— সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতামূলক প্রচার ধাপে ধাপে করতে পারো। প্রথম ধাপে বিদ্যালয়ের সকল শ্রেণিতে সচেতনাতামূলক লিফলেট পোস্টার বিতরণ করবে। এভাবে সকল শিক্ষার্থীর মাধ্যমে পুরো এলাকায় সচেতনাতামূলক খবর পৌঁছানো যায়। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের সহায়তা নিবে।
— এলাকার সবাইকে জানানোর জন্য দ্বিতীয় ধাপে সচেতনাতামূলক লিফলেট পোস্টার নিয়ে র্যালি/লিফলেট বিতরণ করার পরিকল্পনা করবে। শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহায়তায় সুবিধাজনক সময়ে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। আরও ভালো হয় যদি স্বাস্থ্য সচেতনাতামূলক ক্যাম্প করা যায়।
— তোমাদের তৈরি সকল লিফলেট পোস্টার শ্রেণিতে শিক্ষকের সহায়তায় সংরক্ষণ করবে।
— লুই পাস্তুর আর জোসেফ মাইস্টারের ঘটনাটা শুনে তোমার কী মনে হলো?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
— এ কাজে তোমরা নতুন কী কী শিখেছ?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও দেখুন...