بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আকাইদ
প্রিয় শিক্ষার্থী,
তুমি একটি বিষয় অবশ্যই লক্ষ করেছ যে, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতি শ্রেণিতে তোমাদের ইসলাম শিক্ষা বইয়ের প্রথম অধ্যায়টি আকাইদ সংক্রান্ত। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, আকাইদ মানে বিশ্বাসমালা। ইমান ও ইসলামের কিছু মৌলিক বিষয় আছে, সেগুলোতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। এসব বিশ্বাসকে বলা হয় আকাইদ। আকাইদের বিষয়সমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম হলো আল্লাহর ওপর ইমান। এ মুহূর্তে তোমাকে একটু 'ইমান মুজমাল'- এর প্রসঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তোমার কি মনে আছে ইমান মুজমাল নামক ইমানের অঙ্গীকার বাণীটিতে তুমি কী ঘোষণা দিয়েছিলে? হ্যাঁ, আরবি বাক্যে তুমি যা ঘোষণা দিয়েছিলে, তার প্রথম কথাটিই ছিল: 'আমি ইমান আনলাম আল্লাহর ওপর ঠিক তেমনি যেমন আছেন তিনি, তাঁর সকল নাম ও গুণসহ।' এ কথাটি থেকে কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের কাছে একেবারেই সুস্পষ্ট যে, সবার আগে আমাদেরকে আল্লাহ তা'আলার প্রতি ইমান আনতে হবে। আল-কুরআনে তাঁর অনেকগুলো গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ নামসমূহের তাৎপর্য জেনে সেসবের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। তোমাদের মনে আছে, সপ্তম শ্রেণিতে আল্লাহর পরিচয় শিরোনামে তোমরা আল্লাহ তা'আলার সত্তাগত পরিচয় জেনেছিলে। এ ছাড়া ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতি শ্রেণিতে তোমরা আল্লাহ তা'আলার গুণবাচক নামসমূহের মধ্যে বেশ কয়েকটি গুণবাচক নামের পরিচয় জেনেছ। এরই ধারাবাহিকতায় এ শ্রেণিতেও আমরা আল্লাহ তা'আলার আরো কয়েকটি গুণবাচক নাম তথা 'আল-আসমাউল হুসনা' সম্পর্কে জানব এবং তদানুসারে বিশ্বাস ও কাজ করব।
দলগত কাজ তোমরা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক পর্যবেক্ষণ বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে আকাইদ সংক্রান্ত যে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ, তা খাতায় বা পোস্টারে উপস্থাপন করো।
|
আল্লাহর পরিচয়
জোড়ায় কাজ 'পরিবেশিত হামদ থেকে মহান আল্লাহর পরিচয় তথা আসমাউল হুসনা সম্পর্কে কী গুণাবলি প্রকাশ পেয়েছে তা তোমার বন্ধুর সাথে আলোচনা করে চিহ্নিত করো' |
১. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . ২.. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . ৩. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . মহান আল্লাহর অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে। এ সকল গুণবাচক নামের মধ্যেও তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়। আসো আমরা মহান আল্লাহর কয়েকটি গুণবাচক নামের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় জানি। |
আল্লাহু রাউফুন (اَللَّهُ )
রাউফুন অর্থ পরম-স্নেহশীল, সদয়, অতীব দয়ালু, সমবেদনা প্রকাশকারী ইত্যাদি। আল্লাহু রাউফুন অর্থ আল্লাহ অতি দয়ালু, অত্যন্ত স্নেহশীল। এটি আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। আল্লাহর এ নামটি আর-রাহমান ও আর- রাহীম নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত দয়া ও মায়া রয়েছে। তিনি বলেন-
إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ .
অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৩)
মহানবি (সা.) বলেন, 'আল্লাহ তা'আলা দয়া-মায়া, স্নেহ-মমতাকে একশত ভাগ করে নিরানব্বই ভাগ নিজের জন্য রেখে দিয়েছেন, আর এক ভাগ সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছেন।' (বুখারি)
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদিস থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি কতটা দয়ালু, কতটা স্নেহশীল। তবে মহান আল্লাহ কেবল মানুষের ওপরই নন, তিনি তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতিই অতীব স্নেহপরায়ণ। হাদিসের ভাষায় সমগ্র সৃষ্টিই আল্লাহর একান্ত পরিজন। মানুষের পারিবারিক জীবনে পরিবার প্রধান যেমন তার পরিবারের সদস্যদের আদর, স্নেহ, দয়া-মায়া-মমতার বন্ধনে বেঁধে রাখেন, তেমনি জগৎসমূহের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাঁর জগৎসমূহের সকল সৃষ্টিকে পরম মমতা ও স্নেহে লালন-পালন করেন এবং রক্ষা করেন। আসলে মানুষ এবং সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর স্নেহ-মমতা অতুলনীয়।
আমাদের জীবনের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে এমন কোনো ক্ষেত্র ও মুহূর্ত নেই, যেখানে আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর মায়া-মমতা ও দয়ার পরশ নেই। তিনিই দয়া করে অতি যত্নে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। তিনিই আমাদের মাতাপিতার অন্তরে দয়া-মায়া সৃষ্টি করে আমাদের পরম আদর-যত্নে লালন-পালনের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি যেমন এ প্রকৃতি ও পরিবেশকে আমাদের বসবাসের অনুকূল করে তৈরি করেছেন, তেমনি এখানে সুখে- শান্তিতে বসবাসের জন্য আবার নানা জীবনোপকরণ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাদের জন্য সামাজিক পরিবেশেরও ব্যবস্থা করেছেন। ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর মনে আমাদের প্রতি স্নেহ-মমতা সৃষ্টি করে আমাদের জন্য এক সুন্দর মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছেন। আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে মহান আল্লাহ যে আমাদের ওপর অত্যন্ত স্নেহশীল ও পরম দয়ালু, তার অজস্র উদাহরণ খুঁজে পাই।
মহান আল্লাহ আমাদের কাছে তাঁর দেওয়া এসব নিয়ামতের কোনো প্রতিদান চান না। আমরা যদি তাঁর ইবাদাত করি, তাহলে তিনি খুশি হন। আবার যদি তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া প্রকাশ করি, কৃতজ্ঞ হই, তাহলে তিনি তাঁর নিয়ামতকে আমাদের ওপর আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আমাদের একটি ভালো কাজের সাওয়াব তিনি কমপক্ষে দশ গুণ বাড়িয়ে দেন কিন্তু কোনো পাপ করলে কেবল সেই পাপের পরিমাণ শাস্তিই তিনি আমাদের দেন। আর চাইলে সেটাও তিনি মাফ করে দিতে পারেন। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি, মহান আল্লাহ অসীম স্নেহশীল।
মহান আল্লাহর স্নেহ ও দয়ায় আমাদের জন্য কল্যাণের পথ সহজ হয়ে যায়। স্নেহ ও দয়ার মাধ্যমে তিনি আমাদের তাঁর অপছন্দনীয় পথ থেকে সতর্ক করেন। তিনি বান্দাকে অপরাধ ও ফাসাদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে ভয়-ভীতি ও ধমক প্রদান করেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, এর দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করেন। হে আমার বান্দাগণ! তোমরা আমাকে ভয় করো। (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১৬)
وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَاللَّهُ رَءُوفٌ بِالْعِبَادِ
অর্থ: আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩০)
মূলত আমাদের ওপর আল্লাহর স্নেহ ও মায়া-মমতার কোনো সীমা নেই। আমরা তাঁর স্নেহ-মমতার সমুদ্রে বসবাস করছি। আমরাও সকলের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ার্দ্র হব, সকলকে ভালবাসব।
মু'মিনুন অর্থ নিরাপত্তা দানকারী, রক্ষণাবেক্ষণকারী, জামিনদার, সত্য ঘোষণাকারী। আল্লাহু-মু'মিন অর্থ আল্লাহ নিরাপত্তা দানকারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারী। তিনি আপন বান্দাদের মাঝে শান্তি ছড়িয়ে দেন এবং সৃষ্টিজগতের মাঝে নিরাপত্তা বিধান করেন। আর ওহির মাধ্যমে প্রশান্তি অবতীর্ণ করেন। তিনি প্রতিটি সৃষ্টির যথার্থ তদারককারী। সকল বিষয়ের গোপন রহস্য জানেন। মহান আল্লাহ বলেন-
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلْمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَنَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ .
অর্থ: তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। তারা যাকে শরিক স্থির করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র, মহান। (সূরা আল-হাশর, আয়াত: ২৩)
আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির নিরাপত্তা বিধান করেন। তিনি প্রতিটি জীবের সকল কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন। তিনি কারো পুণ্য হ্রাস করেন না। কাউকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত শাস্তি দেন না। একমাত্র তিনিই ভয়ের যোগ্য এবং ক্ষমা করার অধিকারী। মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্তির তিনিই অধিক হকদার। বান্দাকে কল্যাণ ও অনুগ্রহ দানের তিনিই অধিক যোগ্য।
আল্লাহ হলেন নিরাপত্তা বিধায়ক ও তত্ত্বাবধায়ক। নিজ বান্দাদেরকে তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করেন। তিনি সবকিছু দেখেন এবং সবকিছু শোনেন। তিনি তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রেখেছেন। এসব কিছুই তাঁর জন্য সহজ।
উল্লেখ্য, বান্দার সঙ্গে যখন মু'মিন শব্দ সম্পৃক্ত হয়, তখন তার অর্থ বিশ্বাস স্থাপনকারী বান্দা। আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বলে তাকে মু'মিন বলা হয়।
আল-কুরআনে মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর গুণে গুণান্বিত হতে উৎসাহিত করেছেন। তাই আমরা তাঁর আল- মু'মিনুন নামের গুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করব। ব্যক্তিগত, পরিবার ও সমাজ জীবনে আমরা শান্তি ও নিরাপত্তার পথ অবলম্বন করে চলব এবং অন্যের বিপদ- আপদ কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি, সাহায্য-সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দিতে চেষ্টা করব।
ওয়াহহাব' অর্থ অতীব দানশীল, কোনো বিনিময় ছাড়া যিনি সব কিছু দান করে থাকেন। এটি আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। তিনি পরম দানশীল। তিনি বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক রিযিক দান করেন। তিনি তাঁর বান্দার অন্তরে কল্যাণমুখী বিষয় ও প্রজ্ঞা উন্মুক্ত করে দেন। তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন ও দোয়া কবুলের সৌভাগ্য দান করেন।
মহান আল্লাহ উত্তম অভিভাবক। আমাদের কাছে যে সব নিয়ামত আছে, তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তিনিই অন্তরের প্রশস্ততা দানকারী। তিনি সমস্ত সৃষ্টিকে তাঁর রহমত ও জ্ঞান দ্বারা পরিবেষ্টন করে রাখেন। সমস্ত সৃষ্টিই তাঁর দয়া ও দানের মুখাপেক্ষী। এ গুণবাচক নামটি তাঁর ব্যাপক রহমত ও দানের প্রকাশক। তাঁর দয়া দুই ধরনের। প্রথম প্রকারের দয়া সকলের জন্য ব্যাপক। আর অন্যটি তাঁর নির্দিষ্ট বান্দা ও সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য। আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ
অর্থ: আর আমার দয়া প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। (সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ১৫৬)
আল্লাহর বিশেষ রহমত ও নিয়ামত শুধু সৎকর্মশীলদের জন্য। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন, 'নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।' (সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত: ৫৬)
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্বীয় 'ওয়াহহাব' নাম স্মরণ করিয়ে মানব জাতিকে মোনাজাত করতে শিখিয়েছেন। আল্লাহ বলেন-
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লঙ্ঘনে প্রবৃত্ত করবেন না এবং আপনার নিকট হতে আমাদেরকে করুণা দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৮)
প্রকল্প (একক কাজ) তোমার বাস্তব জীবনে আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহ চর্চা বা অনুশীলনের জন্য এক মাস মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তা সফল বাস্তবায়ন শেষে নির্ধারিত ছকে প্রতিবেদন তৈরি করো।
|
শ্রেণি শিক্ষকের নির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী তোমার জন্য সুযোগ ও সামর্থ্যের মধ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবে। এক্ষেত্রে, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের যেমন: মাতা-পিতা/দাদা-দাদি/বড় ভাই-বোন/সহপাঠীর সহায়তা নিতে পারো। প্রকল্পের নাম : বৃক্ষ রোপণ বা বৃক্ষের যত্ন প্রকল্প শুরুর তারিখ : প্রকল্প শেষের তারিখ : সহায়তাকারী : মা-বাবা/ভাই-বোন/সহপাঠী গৃহীত পদক্ষেপ : টব, মাটি, গাছ সংগ্রহ . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .. . . . . . . . . . . . . . . . .. . .. .. .. . .. .. .. . . . . . . . .. . . . .. . . . . .. . . . . .. . অভিভাবকের মতামত/স্বাক্ষর: |
তাওহিদের মর্মবাণী
একজন মু'মিনের কাছে সবচেয়ে বড় এবং অমূল্য সম্পদ তার ইমান। তার ইমানের কাছে এ দুনিয়ার সকল সম্পদ, সামগ্রী ও ক্ষমতা একেবারেই তুচ্ছ। আর এ ইমানের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান বিষয় হলো তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বে দৃঢ় বিশ্বাস। ইসলাম নামক চির শান্তির গৃহের প্রবেশদ্বার হলো তাওহিদে বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই মু'মিনের সকল চিন্তা ও কাজ নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। তাই তাওহিদে বিশ্বাস হচ্ছে মু'মিন জীবনের মূল চালিকাশক্তি।
'লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ' অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই-এটি হচ্ছে তাওহিদে বিশ্বাসের মূলমন্ত্র। এটি ইসলামের একটি কালিমা বা বাণী। এটিকে বলা হয় কালিমাতুত তাইয়্যেবাহ। আবার এটিকে কালিমাতুত তাওহিদও বলা হয়।
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা তাওহিদের বাণীর প্রচার ছিল সকল নবি-রাসুলের প্রধান কাজ। তাঁরা সকলেই মানুষের কাছে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী প্রচার করেছিলেন এবং এককভাবে আল্লাহরই ইবাদাত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ (সা.) রিসালাতের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে আজীবন মানুষের কাছে তাওহিদের বাণী প্রচার করেছেন। তিনি মানুষকে তাওহিদের পথে আহ্বান জানিয়ে বলতেন, 'হে লোক সকল! তোমরা বলো আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।' (আহমাদ)
মহানবি (সা.)-কে আহলে কিতাব তথা পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবের অনুসারীদের নিকট তাওহিদের দাওয়াত দেওয়ার নীতি ও কৌশল সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, 'হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করব না, তাঁর সঙ্গে কোনো শরিক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা মনে করব না'। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৬৪) মূলত সকল নবি-রাসুলের আহ্বানের কালিমা ছিল একটাই। আর তা হলো: আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। দুনিয়াতে যুগে যুগে নবি-রাসুল প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্যও ছিল মানুষের মাঝে তাওহিদের বাণী প্রচার। মহান আল্লাহ বলেন-
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
অর্থ: আল্লাহর 'ইবাদাত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠিয়েছি। (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, 'আমি আপনার পূর্বে এমন কোনো রাসুল পাঠাইনি তার কাছে এ ওহি ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদাত করো'। (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫)।
তাওহিদে বিশ্বাসের প্রভাব
মানব জীবনে তাওহিদে বিশ্বাসের প্রভাব অপরিসীম। তাওহিদে বিশ্বাসের ফলে মানুষের চরিত্রে অনেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তাওহিদে বিশ্বাস তাকে সৎকর্মশীল করে তোলে। কারণ, সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে তাকে পরকালে আল্লাহর কাছে দুনিয়ার জীবনের ভালো-মন্দ সব কাজের হিসাব দিতে হবে। তার কোনো মন্দ কাজ দুনিয়ার কেউ না দেখলেও তা মহান আল্লাহর দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না। তিনি সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। তাই সে পরকালে তার রবের সমীপে হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং এ কারণে প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে খেয়াল-খুশিমত কোনো কাজ করতে পারে না। আল-কুরআনের ভাষায়: 'পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।' (সূরা আন-নাযি'আত, আয়াত: ৪০-৪১)
তাওহিদের চেতনা মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্তি দিয়ে মানবতার মহিমাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে। তাই তাওহিদে বিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের আত্মার প্রকৃত মুক্তি ঘটে। ফলে একজন প্রকৃত তাওহিদে বিশ্বাসী ব্যক্তি সকল নীচতা, হীনতা, ভীরুতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভীক, অকুতোভয় ও সাহসী মানুষে পরিণত হয়। সে যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত করে না, তেমনি সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনাও করে না। সে আনুগত্য ও দাসত্ব করে মহামহিম আল্লাহর-যিনি বিশ্ব জাহানের একচ্ছত্র মালিক, সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ। পক্ষান্তরে যারা তাওহিদে বিশ্বাসী নয়, আল্লাহকে রেখে তারা আল্লাহরই সৃষ্ট অন্যান্য বস্তুর কাছে মাথা নত করে, যা মানুষের আত্মমর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করে। তাই তাওহিদে বিশ্বাস মানুষকে আত্মসচেতন ও আত্মসম্মানবোধে উদ্দীপ্ত করে।
তাওহিদের বাণী এমন এক অমিয় সুধা, যা পান করে একজন তাওহিদবাদী পরম প্রশান্তি লাভ করে। তখন দুনিয়ার সকল চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-দুর্দশার ঊর্ধ্বে উঠে সে কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হযরত ইবরাহিম (আ.) যখন তাওহিদের বাণী প্রচার শুরু করেন, তখন নমরুদের রোষানলে পড়ে তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হন। কিন্তু তাওহিদের চেতনায় তিনি এমন বলীয়ান ছিলেন যে তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি; বরং এমন বিপদের মুহূর্তেও তিনি ছিলেন নিশ্চিন্ত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তিনি যে এক ও একক সত্তার ওপর ইমান এনেছেন তিনিই তাঁকে রক্ষা করবেন। তিনি ছাড়া কেউ তাঁর ক্ষতি করতে পারবে না। আবার তিনি যদি তাঁকে রক্ষা না করেন তাহলে দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাঁকে রক্ষা করতে পারবে না। এ জন্য হযরত জিরাঈল (আ.) তাঁর কাছে এসে তাঁর ডানা দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাঁর সাহায্যের প্রস্তাব গ্রহণ না করে এক আল্লাহর ওপর ভরসা করলেন। তাঁর ইচ্ছার ওপর নিজেকে পুরোপুরি সোপর্দ করলেন। ফলে আল্লাহর হুকুমে সে আগুন তাঁর জন্য শীতল ও আরামদায়ক হয়ে গেল। তিনি রক্ষা পেলেন। এটি ছিল তাঁর তাওহিদে দৃঢ় বিশ্বাসেরই ফল।
তাওহিদে প্রকৃত বিশ্বাসী ব্যক্তি এক আল্লাহকে স্বীয় রব (প্রভু) হিসেবে পেয়ে খুশি হয়। হাবশি ক্রীতদাস হযরত বেলাল (রা.) ইসলাম গ্রহণ করায় তাঁর জীবনে শুরু হয় তিক্ততা ও বঞ্চনার এক নতুন অধ্যায়। তাঁর মনিব তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় অমানবিক নির্যাতন শুরু করে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে রেখে তাঁর বুকের উপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো। তাঁর গলায় রশি বেঁধে মক্কার রাজপথে তাঁকে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে টেনে নেওয়া হতো, পাথরের আঘাতে তাঁর দেহ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে! তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরে আসতে বলা হয়। ইসলাম থেকে ফিরলেই তাঁর মুক্তি। নতুবা তাঁকে আরো ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করতে হবে। কিন্তু তাওহিদের অমিয় সুধা পানকারী হযরত বেলাল (রা.) সকল ব্যথা, যন্ত্রণা সহ্য করে মুখে অনবরত 'আহাদ, আহাদ' অর্থাৎ, আল্লাহ এক, আল্লাহ এক উচ্চারণ করতেন। কী আশ্চর্য! এত অত্যাচারের পরেও তিনি আল্লাহর একত্বে অটল। মুমূর্ষু পরিস্থিতিতেও তিনি অত্যাচারীদের জানিয়ে দিলেন: 'তোমরা যদি আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করেও ফেলো, তবুও আমি ইমানের পথ ত্যাগ করব না'। তাওহিদের কী অপরিসীম শক্তি! একসময় অত্যাচারীদের সকল প্রচেষ্টা বিফল হয় এবং ইমানের জয় হয়। এভাবে তাওহিদের শক্তির বিপরীতে কোনো কিছুই টিকে থাকতে পারে না।
তাওহিদ মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে। জাতিভেদ, বর্ণভেদসহ মানুষে মানুষে সকল ভেদাভেদ দূর করে সকল মানুষকে এক কাতারে শামিল করে। কারণ, তাওহিদ মানুষকে শিক্ষা দেয় যে সকল মানুষকে মহান আল্লাহ একজন নর ও নারী অর্থাৎ আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) থেকে সৃষ্টি করে তাঁদের দু'জন থেকেই মানব সম্প্রদায় ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছেন। তাই সকল মানুষ সমান। বিশেষ মর্যাদার মাপকাঠি গোত্র বা বংশ নয়; বরং মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত তাঁরাই, যাঁরা আল্লাহভীরু। এ বিশ্বাস জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিশ্ব মানব সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
মানব প্রবৃত্তির একটি সাধারণ প্রবণতা হলো সে শক্তি বা ক্ষমতাকে ভয় করে এবং এদের কাছে মাথা নত করে। এ জন্য কোনো কোনো ধর্মের অনুসারীরা প্রকৃতি ও জীবজগতের বিভিন্ন বাহ্যিক শক্তির উপাসনা ও আরাধনা করে থাকে। কিন্তু তাওহিদে বিশ্বাসী ব্যক্তি দুনিয়ার কোনো শক্তি ও ক্ষমতাকে ভয় পান না এবং এসবের নিকট আত্মসমর্পণও করেন না। সে কেবল সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী এমন এক অদৃশ্য সত্তার ইবাদাত করে যিনি এক ও একক, যিনি সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস। তাঁর প্রভুত্ব সর্বত্র বিরাজমান। তিনি মহান আল্লাহ। তিনি সর্বশক্তিমান।
জোড়ায়/দলগত কাজ তাওহিদে বিশ্বাসের ফলে ব্যক্তির জীবন ও কর্মে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে (পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত বিষয়গুলো ব্যতীত) জোড়ায় বা দলে আলোচনা করে তুমি/তোমরা একটি তালিকা প্রস্তুত করে উপস্থাপন করো। (শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা জোড়ায় বা দলে পর্যালোচনা করে তাওহিদে বিশ্বাসের ফলে কী কী পরিবর্তন হয় তা ছোট কাগজে/ভিপ কার্ডে লিখবে।)
|
তাওহিদের চেতনা
তাওহিদের বাণী 'লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' একটি চেতনা সঞ্চারী এবং বিপ্লবী ঘোষণা। এটি হক ও বাতিলের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী এক শাশ্বত বাণী। এ বাণীর ধ্বনি এর বিশ্বাসীদের দেয় এক অপরিমেয় শক্তি, সাহস ও মনোবল। আবার অন্যদিকে এ ধ্বনির উচ্চারণ অবিশ্বাসীদের হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে দেয়। এ বাণীর ঘোষণার মাধ্যমে দুনিয়ার সকল কাল্পনিক ও নকল উপাস্যকে অস্বীকার করা হয়। আবার এ বাণী আল্লাহর জমিনে কেবল আল্লাহর কালিমাকে উর্ধ্বে তুলে ধরার প্রেরণা দেয়। সে কারণে এ বাণীর প্রচার-প্রসার ও এর মহিমাকে সমুন্নত রাখতে সমকালীন তাওহিদ বিরোধী শক্তির মোকাবিলায় যুগে যুগে ইমানদারদের অবর্ণনীয় প্রতিকূলতা ও ইমানের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভিক সময়ে তাওহিদের দাওয়াতে সাড়া দেওয়া যে কত কঠিন ছিল, এর অনেক ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে বিদ্যমান। এমনকি আমাদের প্রিয় নবি (সা.) বাল্যকাল থেকে যিনি আল-আমিন হিসেবে সুবিখ্যাত এবং সর্বজন প্রিয় ছিলেন, তিনিই যখন রিসালাতের দায়িত্ব পেয়ে তাওহিদের দাওয়াত প্রদান শুরু করলেন, তখন তিনি তাওহিদ বিরোধীদের কাছে চরম অপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। কেবল তাওহিদের বাণী প্রচারের কারণে তাঁর ওপরেও ইসলাম বিরোধীদের পক্ষ থেকে নেমে আসে নানা লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, অপবাদ, বয়কট আর অত্যাচার-অবিচারের স্টিম রোলার। আবার সাহাবিদের মধ্যে কেবল হযরত বেলাল (রা.) নন, শিরক ছেড়ে তাওহিদে আসার জন্য ধনি-গরিব বহু সাহাবিকে নানা বর্বর ও বীভৎস নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। হযরত আম্মার (রা.) ও তাঁর পরিবার চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁদেরকে উত্তপ্ত রোদে মরুভূমির ওপর শুইয়ে রাখা হতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আম্মার (রা.) এর পিতা ইয়াসার (রা.) ইন্তেকাল করেন। আর তাঁর মা সুমাইয়া (রা.)-কে আবু জাহল বর্বর নির্যাতন করে শহিদ করে দেয়। এভাবে তাঁরা জীবন দিয়েছেন, কিন্তু তাওহিদ থেকে এক বিন্দুও বিচ্যুত হননি।
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন (বাড়ির কাজ) যেসব বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে আমরা তাওহিদ মজবুত করব' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে নির্ধারিত ছকটি তুমি বাড়ি থেকে পূরণ করে আনবে। এ ক্ষেত্রে, তুমি তোমার পরিবারের সদস্য বা ধর্মীয়জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির সহায়তা নিতে পারো।)
|
বিশ্বাসসমূহ | কাজসমূহ |
| |
|
আখিরাতের প্রতি ইমান
প্রিয় শিক্ষার্থী, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ইমানের মৌলিক সাতটি বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করা হয়েছে এবং সে শ্রেণিতে আখিরাত জীবনের স্তরগুলো সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। তারপর, সপ্তম শ্রেণিতে ইমানের সাতটি বিষয়ের মধ্যে আল্লাহর প্রতি ইমান, ফেরেশতাগণের প্রতি ইমান এবং কিতাবসমূহের প্রতি ইমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় অষ্টম শ্রেণিতে রাসুলগণের প্রতি ইমান এবং আখিরাতের প্রতি ইমান শিরোনামের আওতায় কিয়ামত, পুনরুত্থান এবং হাশর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সে শ্রেণিতে তাকদিরের প্রতি ইমান এবং শাফা'আত সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। বর্তমান শ্রেণিতে আখিরাতের প্রতি ইমান শিরোনামের আওতায় আমরা আখিরাত জীবনেরই অংশ জান্নাত ও • - জাহান্নাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
জান্নাত (اَلْجَنَّةُ)
প্যানেল আলোচনা পরকালে জান্নাত লাভের জন্য আল্লাহর ইবাদাতের সাথে আমাদের নৈতিক চরিত্রের যেসব দিক উন্নয়ন করা অত্যাবশ্যক' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল বা দলে আলোচনা করে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)
|
জান্নাত আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ বাগান, উদ্যান, নয়নাভিরাম ও মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, সৎকর্মশীলদের চূড়ান্ত আবাসস্থল। ইসলামি পরিভাষায়, আখিরাতে ইমানদার ও নেককার বান্দাদের জন্য যে চিরশান্তির আবাসস্থল তৈরি করে রাখা হয়েছে, তাকে জান্নাত বলা হয়। জান্নাতিরা যা কিছু কামনা করবে, সেখানে তার সব কিছুই পাবে। জান্নাত হলো এমন জায়গা, যেখানে বান্দার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকবে না। আল-কুরআনে আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-
وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُوْنَ * نُزُلًا مِّنْ غَفُورٍ رَّحِيمٍ
অর্থ: সেখানে (জান্নাতে) তোমাদের জন্য রয়েছে যা কিছু তোমাদের মন চায় এবং সেখানে তোমাদের জন্য রয়েছে যা তোমরা আকাঙ্ক্ষা কর। এটি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়ন। (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত: ৩১-৩২)
আল-কুরআনে আটটি জান্নাতের নাম পাওয়া যায়। কুরআনে বর্ণিত জান্নাতের নামসমূহ:
১. জান্নাতুল ফিরদাউস
২. দারুল মাকাম
৩. দারুল কারার
৪. দারুস সালাম
৫. জান্নাতুল মাওয়া
৬. জান্নাতুন নাঈম
৭. দারুল খুলদ
৮. জান্নাতু আদন
এ আটটি জান্নাতের মধ্যে জান্নাতুল ফিরদাউস হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।
জান্নাত এক চিরন্তন শান্তির আবাসস্থল। জান্নাতিরা সেখানে কখনো কোনো দুঃখ-কষ্ট ও ক্লান্তির সম্মুখীন হবে না। সেখানে তারা চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। মৃত্যু কখনো তাদেরকে স্পর্শ করবে না। তাদের পোশাক পুরাতন হবে না এবং তারুণ্যও কোনোদিন শেষ হবে না। তারা সেখানে চিরস্থায়ী নিয়ামত ও সুখ-শান্তিতে থাকবে। সেখানে তারা কোনো অপ্রয়োজনীয়, অশালীন ও মিথ্যা কথা শুনবে না। তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা ইমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে, তারাও তাদের সঙ্গে থাকবে। ফেরেশতাগণ তাদের কাছে উপস্থিত হবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে এবং বলবে, 'তোমাদের প্রতি সালাম'। আখিরাতের এ জীবন কতই না উত্তম!
জান্নাতের সবকিছুই অনিন্দ্য সুন্দর ও পরম আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা সুসজ্জিত। এর ঘর-বাড়ি, আসন, আসবাবপত্র সবকিছু স্বর্ণ-রৌপ্য, মণি-মুক্তা দ্বারা নির্মিত। সেখানে থাকবে অসংখ্য বাগান। খেজুর, আঙ্গুর আর থোকা-থোকা অপূর্ব সব ফলের সমাহার থাকবে। এমন সুস্বাদু ফল, যার স্বাদ কেউ কখনো কল্পনাও করতে পারবে না। সারি সারি পান-পাত্রে রাখা থাকবে অমৃত সুধা।
জান্নাতে মোট চার ধরনের নদী বা নহর প্রবাহিত রয়েছে। এগুলো হলো নির্মল পানির নহর, দুধের নহর, পবিত্র পানীয়র নহর এবং মধুর নহর। এ সকল নদী বা নহর ছাড়াও আরো তিন ধরনের ঝরনা জান্নাতে চিরকাল প্রবাহিত থাকবে। সেগুলো হলো-
ক. 'কাফুর' নামক ঝরনা, যার পানি সুগন্ধময় ও সুশীতল।
খ. 'সালসাবিল' নামক ঝরনা, যার পানি সুগন্ধময় ও উত্তপ্ত থাকবে।
গ. 'তাসনিম' নামক ঝরনা, যার পানি থাকবে নাতিশীতোষ্ণ।
মহান আল্লাহ বলেন, 'মুত্তাকিদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হলো, তাতে আছে নির্মল পানির নহর, আছে দুধের নহর যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু পানীয়র নহর, আছে পরিশোধিত মধুর নহর এবং সেখানে তাদের জন্য থাকবে বিবিধ ফলমূল।' (সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৫)
জান্নাতিরা দুই ভাগে বিভক্ত হবে। ডান দিকের লোক এবং অগ্রবর্তী লোক। ডান দিকের লোকেরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আর অগ্রবর্তী লোকেরা তো সকল ব্যাপারে অগ্রবর্তী। তারাই হবে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'আল্লাহ তা'আলা জান্নাতে একশ'টি মর্যাদার স্তর প্রস্তুত রেখেছেন। দুটি স্তরের ব্যবধান আসমান ও জমিনের দূরত্বের মতো। তোমরা আল্লাহর কাছে চাইলে ফিরদাউস চাইবে। কেননা, এটিই হলো সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। এর উপরে রয়েছে রহমানের আরশ। আর সেখান থেকেই জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে।' (বুখারি)
মুত্তাকিদের দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা সেখানে পৌঁছাবেন, জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। আর জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবেন, 'তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখী হও এবং চিরস্থায়ী বাসস্থান জান্নাতে প্রবেশ করো।' তারা বলবেন, 'সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদের প্রতি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে এ ভূমির উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা বসবাস করবো।' সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতই না উত্তম।
জান্নাতিরা স্বর্ণের সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসবেন। সেখানে তাঁরা রোদের তাপ ও শীতের ঠাণ্ডা অনুভব করবেন না। গাছের ছায়া তাদের ওপর ঝুঁকে থাকবে এবং ফলগুলো তাদের আয়ত্তে রাখা হবে। স্বর্ণ ও রূপায় নির্মিত স্বচ্ছ স্ফটিকের পানপাত্রে তাদের জন্য পানীয় পরিবেশন করা হবে। সেখানে তাদেরকে পান করানো হবে, 'যানজাবিল' মিশ্রিত পানপাত্র থেকে। এটা জান্নাতে অবস্থিত 'সালসাবিল' নামক একটি ঝরনা। তারা যেদিকেই তাকাবেন দেখতে পাবে নিয়ামতরাজি আর বিশাল রাজ্য। তাঁদের পোশাক হবে চিকন সবুজ রেশম ও মোটা সবুজ রেশমের। তাঁদের অলংকার হবে রূপার কঙ্কণ আর তাদের পালনকর্তা তাদেরকে পান করাবেন 'শরাবান- তহুরা'।'''
মুত্তাকিরা থাকবেন উদ্যান ও ঝরনার মাঝে। তাঁদের রব তাঁদেরকে যা দেবে সানন্দে তাঁরা তা গ্রহণ করতে থাকবেন। সেখানে রয়েছে কাঁটাহীন কুলগাছ, সারি সারি সাজানো কলাগাছ, বিস্তৃত ছায়া, সর্বদা প্রবহমান পানি আর রঙ-বেরঙের নানা প্রজাতির পাখি। আর থাকবে প্রচুর পরিমাণে ফলমূল; যা কখনো শেষ হবে না এবং কখনো নিষিদ্ধও হবে না। নেক বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমন নিয়ামত তৈরি করে রাখা হয়েছে, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন-
فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ .
অর্থ: কেউই জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী লুকিয়ে রাখা হয়েছে তাঁদের কৃতকর্মের পুরস্কারস্বরুপ! (সূরা আস-সাজদা, আয়াত: ১৭)
পুণ্যবান লোকেরা থাকবেন অফুরন্ত নিয়ামতের মাঝে। তারা এবং তাদের স্ত্রীরা ছায়ার মধ্যে স্বর্ণের আসনে হেলান দিয়ে বসবেন। তাদের সামনে চক্রাকারে সোনার থালা ও পান পাত্র পরিবেশন করা হবে। সেখানে থাকবে মন ভোলানো ও চোখ জুড়ানো জিনিস। তাঁরা পান করবেন অতি উৎকৃষ্ট পানীয়, যার মিশ্রণ হবে কাফুর। আল্লাহর বান্দারা এমন এক ঝরনা থেকে পান করবেন, যা তাঁরা ইচ্ছেমতো প্রবাহিত করবেন। আর তাঁদের জন্য সেখানে থাকবে সব রকমের ফলমূল, পাখির মাংস এবং যা তাঁরা চাইবেন। তাঁরা চারদিকে সবকিছু দেখতে থাকবেন। তাঁদের চেহারায় থাকবে প্রশান্তির উজ্জ্বলতা। বলা হবে, 'তোমরা এখানে চিরকাল থাকবে'।
বাড়ির কাজ 'জান্নাত লাভের জন্য এখন থেকে যেসব কাজ আমি অভ্যাসে পরিণত করব' (এই শিরোনামের আলোকে তুমি ইসলামি আকিদাহ দৈনন্দিন চর্চার ক্ষেত্রেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করো।)
|
জাহান্নাম (جَهَنَّمُ)
জাহান্নাম আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, শাস্তির স্থান, দুঃখময় স্থান, নিকৃষ্টতম স্থান, দুর্গন্ধময় স্থান ইত্যাদি। জাহান্নাম গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বিপদসংকুল, অতি সংকীর্ণ এক নিকৃষ্ট স্থান। সব সময় এতে আগুন প্রজ্বলিত থাকবে। এটি পাপীদের আবাসস্থল।
জাহান্নামের সাতটি স্তর রয়েছে। প্রতিটি স্তরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দল নির্ধারিত আছে। জাহান্নামের সাতটি স্তরের নাম হচ্ছে- ১. হাবিয়া, ২. জাহিম, ৩. সাকার, ৪. লাযা, ৫. সাঈর, ৬. হুতামাহ ও ৭. জাহান্নাম। পাপের ধরন অনুযায়ী পাপীরা বিভিন্ন স্তরে শাস্তি ভোগ করবে। তারা সেখানে যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। জাহান্নামিদের অবস্থা হবে চূড়ান্ত অপমানজনক আর শোচনীয় পরাজয়ের। পাষাণ হৃদয়, কঠোর স্বভাব ও ভয়ংকর চেহারাবিশিষ্ট ফেরেশতাগণ জাহান্নামের রক্ষী হবেন। যাদের চেহারা দর্শনও শাস্তির ওপর অতিরিক্ত শাস্তি হিসেবে গণ্য হবে। সর্বনিকৃষ্ট জাহান্নাম হাবিয়া।
জাহান্নাম এক গভীর আগুনের গর্ত। পাপীদের সেখানে নিক্ষেপ করা হবে। তাদের ৭০ হাত দীর্ঘ শিকল দিয়ে বাঁধা হবে। তাদের জন্য সেখানে রয়েছে বিষধর সাপের দংশন আর জ্বলন্ত আগুন। তাদের কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ করা হবে না। তাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। তারা চিৎকার করবে আর মৃত্যুকে আহ্বান করতে থাকবে। তাদের বলা হবে- 'আজ তোমরা এক মৃত্যুকে ডেকো না, অনেক মৃত্যুকে ডাকো।' তখন তারা বলবে, শিক্ষাবর্ষ হায় আফসোস! যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তাহলে আমরা জাহান্নামি হতাম না।'
নিশ্চয়ই জাহান্নাম সমস্ত দিক থেকে কাফিরদের বেষ্টন করে রাখবে। তাদের নিচে থাকবে আগুনের বিছানা আর ওপরে থাকবে আগুনের চাদর। যখনই তাদের চামড়া পুড়ে যাবে, তখনই অন্য চামড়া দিয়ে তা পাল্টে দেওয়া হবে। সেখান থেকে কোথাও পালাবার জায়গা থাকবে না। বলা হবে- 'তোমরা শান্তি আস্বাদন করো। তোমাদের জন্য শাস্তি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করা হবে না।' তারা জাহান্নামের রক্ষীদের বলবে, 'তোমরা তোমাদের রবকে বলো, তিনি যেন আমাদের থেকে এক দিনের আযাব হালকা করে দেন।' রক্ষীরা বলবে: 'তোমাদের কাছে কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে তোমাদের রাসুলগণ আসেনি?' তারা বলবে: 'অবশ্যই এসেছিল'; তখন তারা বলবে: 'তবে তোমরাই আহ্বান করো।' আর কাফিরদের আহ্বান কোনো কাজে আসবে না।
জাহান্নামিদের পোশাক হবে আগুনের। তাদের মুখমন্ডল আগুনে দগ্ধ হবে আর চেহারা হবে বীভৎস। মাথার ওপর গরম পানি ঢালা হবে। চামড়া ও উদরে যা আছে তা গলে যাবে। আর তাদের লোহার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হবে। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যখনই তারা জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে আবার তাতে ঠেলে দেওয়া হবে।
জাহান্নামিদের খাবার হবে যাক্কুম নামক কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ। তাদের পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধার সৃষ্টি হবে। তারা খাবারের জন্য ফরিয়াদ করতে থাকবে। তখন তাদেরকে যাক্কুম খেতে দেওয়া হবে। যাক্কুম ভক্ষণের ফলে তা গলিত তামার মতো পেটে ফুটতে থাকবে। মনে হবে যেন ফুটন্ত পানি। যাক্কুম গাছ আরবের তিহামা অঞ্চলে জন্মে। এর স্বাদ তিক্ত, গন্ধ অসহ্য। এ গাছ থেকে দুধের মতো সাদা কষ বের হয়, যা গায়ে লাগলে সঙ্গে সঙ্গে ফোসকা পড়ে ঘা সৃষ্টি হয় এবং ফুলে ওঠে। পৃথিবীর যাক্কুম গাছের তুলনায় আখিরাতের যাক্কুম গাছ অতি নিকৃষ্ট ও বিষাক্ত। নবি কারীম (সা.) বলেন; 'যদি যাক্কুমের এক ফোঁটা কষ পৃথিবীতে পড়ে, তবে তা সারা বিশ্বের প্রাণিকুলের খাদ্যবস্তুকে বিকৃত করে ফেলবে। সে ব্যক্তির অবস্থা কেমন হবে, যার খাদ্যই হবে যাক্কুম'? (তিরমিযি)
জাহান্নামে পান করার জন্য আছে টগবগে ফুটন্ত পানি ও গলিত পুঁজ। জাহান্নামিরা প্রচন্ড তৃষ্ণায় ছটফট করে পানির জন্য ফরিয়াদ করতে থাকবে। তাদেরকে এমন পানি দেওয়া হবে, যা তাদের নিকটবর্তী করা হলে তাদের চেহারা জ্বলে যাবে। তারা তৃষ্ণার্ত উটের মতো টগবগে ফুটন্ত পানি পান করবে। আর যখনই তারা তা পান করবে, তখনই তাদের নাড়ি-ভুঁড়ি গলে মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে।'
জাহান্নামিরা জান্নাতবাসীদের ডেকে বলবে, 'আমাদেরকে একটু পানীয় বস্তু দাও, অথবা আল্লাহর পক্ষ হতে যে রিযিকপ্রাপ্ত হয়েছ, তা হতে সামান্য আমাদের দিকে নিক্ষেপ করো। তখন জান্নাতবাসীরা বলবেন, 'এ দুই জিনিসই মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের জন্য হারাম ঘোষণা করেছেন।' জান্নাতিরা জাহান্নামিদের জিজ্ঞাসা করবে, 'কীসে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করালো?' তারা বলবে, 'আমরা সালাত আদায়কারী ছিলাম না। আর মিসকিনদের খাবার খাওয়াতাম না।'
জাহান্নামের জ্বালানি হবে মানুষ, জ্বিন ও পাথর। মহান আল্লাহ বলেন, 'তবে তোমরা সে আগুনকে ভয় করো, মানুষ ও পাথর হবে যার ইন্ধন, কাফিরদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।' (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৪) নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকেও বাঁচানোর জন্য মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'হে মু'মিনগণ! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো আগুন হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর।' (সূরা আত-তাহরীম, আয়াত: ৬)
একটু চিন্তা করো সেই জগতের কথা, যখন জাহান্নামিরা সর্বশেষ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে মৃত্যু কামনা করবে। সর্বদিক থেকে তাদের কাছে আসবে মৃত্যু, অথচ তারা মরবে না। তারা জাহান্নামের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাকে ডেকে বলবে, 'হে মালেক! তোমার রব যেন আমাদের শেষ করে দেন।' তাদেরকে বলা হবে, 'নিশ্চয় তোমরা এখানে চিরকাল অবস্থান করবে। তোমরা ধিকৃত ও নিন্দিত অবস্থায় এখানেই পড়ে থাকো। কোনো কথা বলো না।' এ কথা শোনার পর নৈরাশ্য আর হতাশা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে নেবে। রুদ্ধ হয়ে যাবে তাদের কণ্ঠ, বন্ধ হয়ে যাবে তাদের সকল কথোপকথন। শুধু চিৎকার, আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ সর্বত্র ভেসে বেড়াবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'কিয়ামতের দিন মৃত্যুকে কালো মেষ আকৃতিতে জান্নাত-জাহান্নামের মাঝখানে হাজির করা হবে। অতঃপর বলা হবে, হে জান্নাতবাসী! তোমরা একে চেনো? তারা উঁকি দিয়ে তাকাবেন এবং বলবেন, হ্যাঁ, এ হলো মৃত্যু। এরপর তাকে জবাই করার নির্দেশ দেওয়া হবে। অতঃপর বলা হবে, হে জান্নাতিগণ, তোমরা চিরস্থায়ী, আর মুত্যু নেই। হে জাহান্নামিরা! তোমরা এখানেই চিরকাল থাকবে, আর মৃত্যু নেই।' (বুখারি ও মুসলিম)
এ দুনিয়ার জীবনের পর, আখিরাত জীবন জান্নাত-জাহান্নাম ভিন্ন অন্য কোনো স্থান নেই। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের প্রত্যেককেই জাহান্নামের ওপর স্থাপিত পুলসিরাত দিয়ে পথ অতিক্রম করে ওপারে যেতে হবে। তবে সে-ই ভাগ্যবান যে এর থেকে মুক্তি পাবে। আল-কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, 'এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত। পরে আমি মুত্তাকিগণকে উদ্ধার করব এবং যালিমদের সেখানে নতজানু অবস্থায় রেখে দেবো।' (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৭১-৭২)
দলগত আলোচনা 'আখিরাত দিবসে কল্যাণ লাভের জন্য আমরা যেসব কাজ নিয়মিত চর্চা করবো' (শ্রেণি শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো)।
|
কুফর (كُفر)
ইমানের সর্বপ্রথম বিষয় হচ্ছে তাওহিদ বা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস। এ তাওহিদসহ ইমানের অন্যান্য মূল বিষয়গুলোকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করার নাম কুফর।
কুফর (كُفر) শব্দের আভিধানিক অর্থ গোপন করা, আচ্ছাদন করা, ঢেকে রাখা, অকৃতজ্ঞ হওয়া, অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় মহান আল্লাহর অস্তিত্বকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করা কুফর। এছাড়া যে সকল ইসলামি বিধান কুরআন মাজিদ ও হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তার কোনো একটিকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করাও কুফরের শামিল। কুফরে লিপ্ত ব্যক্তিকে 'কাফির' ( كَافِرُ )বলা হয়।
কুফরের ক্ষেত্র
কুফর ইমানের বিপরীত। আল্লাহর একত্ববাদ, ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, নবি-রাসুল, আখিরাত, তাকদির (ভাগ্য), মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নাম, কিয়ামত এসব বিষয়ের কোনো একটিকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করা কুফর। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনার পর তাঁদের আদেশ-নিষেধ মেনে না চলা ফিসক বা পাপাচার, যা মানুষকে কুফরের দিকে ধাবিত করে। বিশ্বাসের যথার্থতা কাজের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। আবার ইসলামের আদেশ-নিষেধসমূহ অবিশ্বাস করাও কুফর। সালাত, সাওম, হজ, যাকাত এগুলো ইসলামে ফরয ইবাদাত। এগুলো অবশ্যপালনীয়। এগুলোকে অস্বীকার করাও কুফর। এমনিভাবে মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ, অন্যায়ভাবে হত্যা ইত্যাদি হারাম কাজের কোনো একটিকে হালাল মনে করাও কুফরের অন্তর্ভুক্ত। তেমনি আবার হালাল জিনিস ও কাজকে হারাম মনে করাও কুফরের শামিল।
জোড়ায় আলোচনা আমাদের যেসব কথা ও কাজ কুফরির পর্যায়ে পড়ে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করো। (পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত কুফরের পর্যায়ভুক্ত কথা ও কাজ ব্যতীত আরো যেসব কথা ও কাজ কুফরের পর্যায়ভুক্ত তা জোড়ায় আলোচনা করে শ্রেণি শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো)।
|
কুফরের কুফল ও পরিণতি
কুফরের কুফল অনেক এবং এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। প্রথমত কাফির ব্যক্তি পরম দয়াময় আল্লাহর প্রতি চরম অকৃতজ্ঞ। কারণ, সে আল্লাহর রাজত্বে বসবাস করে এবং আল্লাহর দেওয়া সকল নিয়ামত ভোগ করে আবার সেই আল্লাহকেই সে অস্বীকার করে। তাই এটি নৈতিক, মানবিক ও বিবেকের পরিপন্থী একটি ঘৃণিত কাজ।
আবার কুফর কেবল অকৃতজ্ঞতাই নয়, এর মাধ্যমে মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হয়। তাই কাফির আল্লাহ বিদ্রোহী। কেননা, মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা ও রক্ষাকর্তা। তিনিই সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক। কিন্তু কাফির আল্লাহর সত্তা, তাঁর মালিকানা এবং তাঁর গুণাবলিকে অস্বীকার করে এবং তাঁর বিধি-বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে। এটি ন্যায় ও দয়াবান মালিকের মালিকানায় থেকে অন্যায়ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য ও বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ।
সর্বোপরি, কুফর জঘন্য পাপের কাজ। পরকালে এর শাস্তি হবে অনেক কঠোর। কুরআন মাজিদের বিভিন্ন আয়াতে কুফরের ভয়াবহ শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, 'যারা কুফরি করে তাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে আগুনের পোশাক, তাদের মাথার ওপর ঢেলে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি, যা দিয়ে তাদের উদরে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া বিগলিত করা হবে এবং তাদের জন্য থাকবে লোহার মুগুর (হাতুড়ি)। যখনই তারা যন্ত্রণাকাতর হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাইবে তখনই তাদেরকে তাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, আস্বাদন করো দহন-যন্ত্রণা।' (সূরা আল-হাজ, আয়াত: ১৯-২২) অন্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِأَيْتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خُلِدُونَ .
অর্থ: যারা কুফরি করে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে, তারাই জাহান্নামি, সেখানে (জাহান্নামে) তারা স্থায়ী হবে। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৩৯)
কুফর থেকে বেঁচে থাকার জন্য আমরা আমাদের কথা, কাজ ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সদা সতর্ক থাকব এবং আল্লাহ তা'আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করব।
বাড়ির কাজ 'আল্লাহ তা'আলার নির্দেশনা মেনে চলি, কুফর থেকে নিজেকে দূরে রাখি' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা কুফর থেকে নিজেকে দূরে রাখার কৌশল বর্ণনা করে ২০০ শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরি করো)।
|
নিফাক
নিফাক আরবি শব্দ। এর অর্থ কপটতা, ভণ্ডামি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও দ্বিমুখীভাব পোষণ করা। অর্থাৎ অন্তরে একরকম চিন্তাধারা বা বিশ্বাস গোপন রেখে বাইরে তার বিপরীত আচরণ বা ভাব প্রকাশ করা। শব্দটির মূল অর্থ খরচ করা, গোপন করা, চালু করা, অস্পষ্ট করা ইত্যাদি।
ইসলামি পরিভাষায় নিফাক বলতে অন্তরে কুফর ও ইসলাম বিরোধিতা গোপন রেখে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য মুখে ইমানদারসুলভ কথা বলা এবং লোক দেখানো ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান পালন করাকে বোঝায়। নিফাকে লিপ্ত ব্যক্তিকে বলা হয় মুনাফিক। মহান আল্লাহ বলেন-
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِيْنَ هُ يُخْدِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُوْنَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ * فِي قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ
অর্থ: আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান এনেছি। কিন্তু তারা মু'মিন নয়। আল্লাহ এবং মু'মিনগণকে তারা প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদের ভিন্ন অন্য কাকেও প্রতারিত করে না, তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরে রোগ আছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের রোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ, তারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৮-১০)
নিফাক দুই ধরনের। যথা-
১. বিশ্বাসের নিফাক
২. কর্মের নিফাক।
বিশ্বাসের নিফাক
বিশ্বাসের নিফাক হলো-অন্তরের মধ্যে অবিশ্বাস গোপন রেখে মুখে বিশ্বাসের প্রকাশ করা। কুরআন-হাদিসে এ ধরনের নিফাকের আলোচনা বেশি এসেছে। এরূপ নিফাক কুফরেরই নামান্তর; বরং নিফাক কুফর ও শিরকের চেয়েও নিকৃষ্টতম। এরূপ নিফাকে লিপ্ত ব্যক্তি যদিও পার্থিব স্বার্থ লাভের জন্য নিজেকে ইমানদার বলে দাবি করে; কিন্তু তার অন্তরে অন্যান্য কাফিরের মতোই অবিশ্বাস বিদ্যমান।
কর্মের নিফাক
কর্মের নিফাক বলতে বাহ্যিক কাজ-কর্মের মাধ্যমে নিফাকের প্রকাশকে বোঝায়। এটি যেমন প্রকৃত মুনাফিকদের দ্বারা সংঘটিত হয়, তেমনি কখনো কখনো ইমান ও তাকওয়ার ঘাটতি বা দুর্বলতার কারণে মু'মিনদের কাজ- কর্মের মাঝেও প্রকাশ পায়। যেমন: এ ধরনের নিফাক প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, 'চারটি বিষয় যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে নির্ভেজাল মুনাফিক। আর যার মধ্যে এসবের কোনো একটি স্বভাব বিদ্যমান থাকবে, তার মধ্যে নিফাক বা কপটতার একটি দিক বিদ্যমান থাকবে, যতক্ষণ না সে তা পরিত্যাগ করে:
১. যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয়, সে তা খিয়ানত করে,
২. যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে,
৩. যখন সে চুক্তি বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, তখন তা ভঙ্গ করে এবং
৪. যখন সে ঝগড়া করে তখন সে অশ্লীল কথা বলে।'
উল্লেখ্য, ইমানের দুর্বলতাবশত কোনো মু'মিনের কাজের মধ্যে যদি মাঝে মধ্যে উক্ত কর্মের দু' একটি প্রকাশিত হয় তাতে সে প্রকৃত মুনাফিকদের দলভুক্ত হবে না। তবে এটা জঘন্য পাপের কাজ হিসেবে গণ্য হবে। এটি তার কর্মের নিফাক।
মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ইসলাম ও ইমানের কথা মুখে বললেও এবং ইমানদারদের মতো ইবাদাত পালন করলেও অন্তরের দিক দিয়ে তারা ইমানদার নয়। তারা ইসলামবিরোধী। তারা মিথ্যাবাদী, ধোঁকাবাজ ও অবাধ্য। তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
إِذَا جَاءَكَ الْمُنْفِقُونَ قَالُوْا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنْفِقِينَ لَكَذِبُونَ
অর্থ: যখন মুনাফিকরা আপনার নিকট আসে তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয়ই তাঁর রাসুল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত: ১)
অন্য আয়াতে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে ধোঁকাবাজি করে; বস্তুত, তিনি তাদেরকে এর শাস্তি দেন আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায়, তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়, কেবল লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে। দোটানায় দোদুল্যমান, না এদের দিকে, না ওদের দিকে! এবং আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, আপনি তার জন্য কখনো কোনো পথ পাবেন না।' (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২-১৪৩)
মুনাফিকরা অন্তরে বিরোধিতা গোপন রেখে বাইরে আনুগত্য প্রদর্শন করে মাত্র। তাই তারা দ্বিমুখী চরিত্রের অধিকারী। পার্থিব জীবনের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা কাফির ও মুসলমান উভয় দলের সঙ্গেই থাকে। সমাজে তারা নিজেদের ইমানদার বলে জাহির করে। কিন্তু গোপনে তারা ইসলামকে অস্বীকার করে এবং ইমানদারদের সঙ্গে চরম শত্রুতা পোষণ করে। এ জন্য তারা চরম ধোঁকাবাজ। তাদের চরিত্রের স্বরূপ উন্মোচন করে মহান আল্লাহ বলেন
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيْطِيْنِهِمْ قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُونَ
অর্থ: যখন তারা মু'মিনদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, আমরা ইমান এনেছি। আর যখন তারা গোপনে তাদের শয়তানদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তারা বলে, আমরা তো তোমাদের সাথেই আছি। আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪)অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে, যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ইমান এনেছি। অথচ, আদৌ তারা ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে প্রতারিত করে না, তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরে রোগ রয়েছে। এরপর আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাচারী। (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ৮-১০)
মহানবি (সা.) মুনাফিকদের পরিচয় ও চরিত্র প্রসঙ্গে বলেন-
آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثَ : إِذَا حَدَّثَ كَذِبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ
অর্থ: মুনাফিকের চিহ্ন তিনটি- যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা খেলাপ করে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, তা খিয়ানত করে। (বুখারি ও মুসলিম)
মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জঘন্য শত্রু। কারণ, তারা মুখে মুসলমান দাবি করলেও আসলে তারা কাফিরদেরই দোসর। এদের প্রতারণা মুসলমানদের বিপদে ফেলে। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে মুসলমানদের দুর্বলতা ও গোপন কথা কাফিরদের নিকট প্রকাশ করে দেয়। এরা সর্বদা মুসলমানদের মাঝে মতানৈক্য ও ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় রত থাকে। সমাজে এরা নানা অপকর্মের নেপথ্যে থাকে। এদের অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ 'সূরা মুনাফিকূন' নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুনাফিকরা গোপন ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা করে মুসলমানদের অনেক ক্ষতি সাধন করেছে। মহানবি (সা.) কেও মুনাফিকরা বারবার ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে।
প্যানেল/দলগত আলোচনা ' মুনাফিক আমাদের সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তোমরা প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।)
|
নিফাকের কুফল ও পরিণতি
নিফাক জঘন্যতম পাপ। যেহেতু মুনাফিকরা তাদের অন্তরে অবিশ্বাস ও অবাধ্যতা লুকিয়ে রাখে, তাই তারা কাফির। এমনকি তারা কাফির অপেক্ষা মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ, কাফির, মুশরিকরা ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু। অন্যদিকে মুনাফিকরা গোপন শত্রু। গোপন শত্রু প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে সব সময়ই বেশি ক্ষতিকর। কারণ, যে প্রকাশ্য শত্রু তার বিরুদ্ধে সচেতন থাকা যায় এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। কিন্তু যে গোপনে শত্রুতা করে তার থেকে বেঁচে থাকা কষ্টকর ব্যাপার।
পরকালে মুনাফিকদের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাদের পরিণতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
إِنَّ الْمُنْفِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَ لَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا
অর্থ: মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য আপনি কখনো কোনো সাহায্যকারী পাবেন না। (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে নিফাক জঘন্যতম পাপ। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও নিফাকের কুফল অত্যন্ত মারাত্মক। মুনাফেকি স্বভাব মানুষের মনুষ্যত্ব ও চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মানুষ মিথ্যাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মুনাফিক তার স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা অন্যায় ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। আবার অনেক সময় সমাজের মানুষের মাঝে বিবাদ, বিসম্বাদ, অনৈক্য ও অশান্তির জন্যও মুনাফিকের মুনাফেকি দায়ী।
নিফাক থেকে বেঁচে থাকতে আমরা সদা সত্য কথা বলব এবং মিথ্যা পরিহার করে চলব; ওয়াদা পালন করব, আমানত রক্ষা করব, কারো সঙ্গে ঝগড়া করব না এবং অশ্লীল ভাষায় কথা বলব না।
আকাইদের শিক্ষা বাস্তবায়ন: আত্ম-মূল্যায়ন চেকলিস্ট
|
তুমি তোমার প্রতিফলন ডায়েরিতে নিম্নোক্ত নমুনা অনুসারে এক মাসের একটি আত্ম-মূল্যায়ন চেকলিস্ট তৈরি করবে এবং এ চেকলিস্টের বাম পাশের কলামে বর্ণিত মূল্যবোধগুলো চর্চার প্রযোজ্য তারিখে টিক চিহ্ন দিবে। যে তারিখে কোনও একটি মূল্যবোধ চর্চা করা হবে না বা যে মূল্যবোধ গুলো নিয়মিত চর্চা প্রযোজ্য হবে না, সে ঘরটি/গুলো খালি থাকবে। প্রযোজ্য তারিখে নিম্নোক্ত নিয়মে টিক চিহ্ন দিবে। চেকলিস্টের তথ্যের আলোকে মাস শেষে শিক্ষার্থী আত্ম- সমালোচনা ও অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে।
|