কুরআন ও হাদিস শিক্ষা |
মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ইসলামি শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায় এই ইবাদাত পালন করতে হবে। ইসলামি শরিয়তের প্রথম উৎস হচ্ছে আল কুরআন। এ গ্রন্থের অপর নাম ফুরকান। হক ও বাতিলের মধ্যে এ ঐশী গ্রন্থ যেহেতু পার্থক্য নির্ণয় করে, সেহেতু একে ফুরকান হিসেবে অভিহিত করা হয়। কুরআনের প্রতিটি শব্দ আল্লাহ প্রদত্ত। কুরআন পড়া ও অনুধাবন করার সময় আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। কুরআন নির্দেশিত পথে চলা আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির একমাত্র পথ। কুরআন মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক জ্ঞানের আঁধার। তাই কুরআন পাঠ এবং অনুধাবন বান্দার একান্ত কর্তব্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনাচার হচ্ছে সুন্নাহ। যা ইসলামি শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। রাসুলুল্লাহ (সা.) যা বলেছেন, যা করেছেন এবং যে পথে চলেছেন তা অনুসরণ করলে কুরআনের নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করা হয়। সুন্নাহ বা হাদিস ছাড়া কুরআন অনুধাবন করা ও মেনে চলা অসম্ভব। চলো শরিয়তের উৎস হিসেবে আল কুরআন ও আল হাদিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।
পবিত্র কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধান (প্রিয় শিক্ষার্থী, তুমি ধর্মীয় গ্রন্থ, অনলাইন সোর্স অনুসন্ধান বা পরিবারের সদস্য, ধর্মীয়জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি, সহপাঠী এর সাথে আলোচনা/মতবিনিময়ের মাধ্যমে পবিত্র কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করো। তোমার সংগৃহীত তথ্যগুলো খাতায় লিখে নাও)। |
পবিত্র কুরআনের পরিচয়
মহাবিশ্বের বিস্ময়কর গ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত সর্বশেষ আসমানি কিতাব। কুরআন শব্দটি চ (কিরাআতুন) থেকে উদ্ভূত। যার অর্থ পাঠ করা, আবৃত্তি করা, তিলাওয়াত করা ইত্যাদি। আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী কুরআন শব্দটি পঠিত অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যা পাঠ করা হয়, তা-ই পঠিত গ্রন্থ। তবে কারো কারো মতে, কুরআন শব্দটি قُرْن )কারনুন) থেকে উদ্ভুত, যার অর্থ মিলিত।
পরিভাষায়, কুরআন হচ্ছে মহান আল্লাহর বাণী, যা মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। পবিত্র কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআনের সর্বপ্রথম সূরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাযিল হয়। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে। এ ছাড়াও আল কুরআন তিলাওয়াতের সুবিধার্থে ৭টি মনজিল ও ৩০টি পারায় বিভক্ত করা হয়েছে। ৫৪০টি রুকু ও ১৪টি সিজদা আছে। কেবল সূরা তাওবা ব্যতীত প্রতিটি সূরার শুরুতে 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম' বাক্যটির উল্লেখ রয়েছে। মোট আয়াতের সংখ্যা প্রায় ৬,২৩৬ মতান্তরে ৬.৬৬৬টি।
বিশ্বজনীন এ গ্রন্থের আবেদন ও উপযোগিতা সব যুগে এবং সব স্থানেই কার্যকর রয়েছে। কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এ গ্রন্থ দুই পর্যায়ে নাযিল হয়েছে। প্রথমে সম্পূর্ণ কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে 'বাইতুল ইজ্জাহ' নামকস্থানে নাযিল হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের ২৩ বছর ব্যাপী ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনা ও কারণ উপলক্ষ্যে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে নাযিল হয়েছে। কুরআনের সূরাগুলো মহান আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সাজানো হয়েছে। এক্ষেত্রে অবতরণের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করা হয়নি।
যখন ওহি অবতীর্ণ হতো, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরাঈল (আ:)-এর সঙ্গে সঙ্গে তা বারবার পড়তে থাকতেন যাতে করে মুখস্থ হয়ে যায়। সাহাবিদেরকেও মুখস্থ করার নির্দেশ দিতেন। কুরআন মাজিদ যেহেতু একসঙ্গে অবতীর্ণ হয়নি; বরং বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ হয়েছে, সেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) -এর যুগে একত্রে গ্রন্থাকারে লিখে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য কুরআন মুখস্থ করে রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। আসমানি গ্রন্থগুলোর মধ্যে আল্লাহ তা'আলা আল কুরআনকে এ বিশেষত্ব দান করেছেন যে, কলম-কাগজের চেয়েও একে অগণিত সংখ্যক হাফেজে কুরআনের স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করেছেন।
ওহি (الْوَحْى) |
ওহি শব্দটি আরবি। এর অর্থ হলো গোপনে কোনো কিছু জানিয়ে দেওয়া। এ ছাড়াও শব্দটি ইঙ্গিত করা, লেখা এবং গোপন কথা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নবি- রাসুলদের ওপর অবতারিত বাণীকে ওহি বলে।
ওহির প্রকারভেদ
ওহি দুই প্রকার। যথা:
১. ওহি মাতলু (আল কুরআন)
২. ওহি গায়রে মাতলু (আল হাদিস)
১. ওহি মাতলু : মাতলু অর্থ পঠিত, যা পাঠ করা হয়। যে ওহির ভাব, ভাষা, অর্থ, বিন্যাস সকল কিছুই মহান আল্লাহর এবং মহানবি (সা.) তা হুবহু আল্লাহর ভাষায় প্রকাশ করেছেন, তাকে ওহি মাতলু বলে। এটিকে 'ওহি জলি' বা প্রত্যক্ষ ওহি বলা হয়। কুরআন মাজিদ যেহেতু সালাতে তিলাওয়াত করা হয়, তাই আল কুরআনকে ওহি মাতলু বলে।
২. ওহি গায়রে মাতলু: গায়রে মাতলু অর্থ অপঠিত। যে ওহির ভাব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, কিন্তু রাসুল (সা.) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন তাকে ওহি গায়রে মাতলু বলে। একে ওহি খফি বা প্রচ্ছন্ন ওহিও বলা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস এ প্রকার ওহির উদাহরণ। এটি সালাতে কিরআত হিসেবে তিলাওয়াত করা হয় না বলে এটিকে অপঠিত ওহি বলা হয়।
কুরআন মাজিদের বিভিন্ন স্থানে প্রথম প্রকার ওহিকে 'কিতাব' বা গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় প্রকার ওহিকে 'হিকমাহ' বা প্রজ্ঞা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, 'আল্লাহ মু'মিনদের প্রতি অবশ্য অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হিকমাহ তাদেরকে শিক্ষা দেন, যদিও তারা পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যেই ছিল।' (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৪)
দ্বিতীয় প্রকারের ওহি 'হাদিস' বা 'সুন্নাত' নামে পৃথক ভাবে সংকলিত ও সংরক্ষিত হয়েছে।
ওহি অবতরণের পদ্ধতি
মহানবি (সা.) এর ওপর বিভিন্ন পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। প্রসিদ্ধ মতে মহানবি (সা.) এর ওপর সাত পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হয়েছে, যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. ঘণ্টা ধ্বনির ন্যায়: এটা ওহি নাযিলের প্রথম পদ্ধতি। রাসুলের নিকট অধিকাংশ সময় এ পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। ওহি নাযিলের পূর্বে প্রথমে বিরতিহীনভাবে ঘণ্টাধ্বনির মতো শব্দ আসতে থাকত। মহানবি (সা.) নিজ কানে শুনতেন। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) তীব্র শীতের মধ্যেও ঘর্মাক্ত হয়ে পড়তেন। তিনি আরোহী অবস্থায় থাকলে শক্তিশালী উটও ওহির ভার বহন করতে না পেরে বসে পড়ত। ওহি নাযিলের এ পদ্ধতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর ছিল।
২. মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতার আগমন: হযরত জিবরাইল (আ.) কখনো কখনো মানুষের আকৃতিতে ওহি নিয়ে আসতেন। অধিকাংশ সময় বিশিষ্ট সাহাবী হযরত দাহিয়াতুল কালবি (রা.)-এর আকৃতিতে জিবরাইল (আ.) আগমন করতেন। এ পদ্ধতিতে ওহি রাসুল (সা.) এর জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল।
হাদিসে এসেছে
وَأَحْيَانًا يَتَمَثَّلُ لِيَ الْمَلَكُ رَجُلًا
অর্থ: আর কখনো কখনো আমার কাছে ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে আসতেন। (বুখারি)
৩. জিবরাইল (আ.)- এর নিজস্ব আকৃতিতে আগমন: কখনো কখনো হযরত জিবরাইল (আ.) অন্য কোনো রূপ ধারণ না করে সরাসরি নিজ আকৃতিতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ওহি নিয়ে আগমন করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনে এরূপ ঘটনা তিন বার ঘটে। প্রথমবার হেরা গুহায় কুরআনের প্রথম ওহি নিয়ে নিজ আকৃতিতে আগমন করেন। দ্বিতীয়বার মি'রাজ রজনীতে, তৃতীয়বার মহানবি (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে আসল রূপে দেখার ইচ্ছা পোষণ করায় তিনি নিজস্ব আকৃতিতে আগমন করেছিলেন।
৪. সত্য স্বপ্ন যোগে: মহানবির প্রতি ওহি নাযিলের সূচনা হয়েছিল সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। কুরআন নাযিলের পূর্বে তিনি যা স্বপ্নে দেখতেন, তা-ই ছিল ওহি। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, 'রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওহির সূচনা হয়েছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। তিনি যখনই কোনো স্বপ্ন দেখতেন, তা প্রত্যুষের আলোর ন্যায় বাস্তবে প্রতিফলিত হতো।'
৫. আল্লাহ তা'আলার সরাসরি কথোপকথন: ওহি নাযিলের আর একটি পদ্ধতি ছিল, কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ। এই পদ্ধতিকে বলা হয় কালামে ইলাহি। মি'রাজ রজনীতে মহানবি (সা.) সরাসরি মহান আল্লাহর সঙ্গে বাক্যালাপ করেছেন। এ সময়ই উম্মাতে মুহাম্মাদির প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করা হয়েছে।
৬. সরাসরি হৃদয়পটে ওহি ঢেলে দেওয়া: হযরত জিবরাইল (আ.) কখনো সামনে না এসে কোনো মাধ্যম ছাড়া সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্তরে আল্লাহর বাণী ফুঁকে দিতেন। এক হাদিসে মহানবি (সা.) নিজেই বলেছেন, 'হযরত জিবরাইল (আ.) আমার মানসপটে ফুঁকে দিয়েছেন।'
৭. হযরত ইসরাফিল (আ.)- এর মাধ্যমে ওহি প্রেরণ: কখনো কখনো আল্লাহ তা'আলা হযরত ইসরাফিল (আ.)- এর মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর ওপর ওহি নাযিল করতেন।
ওহির গুরুত্ব
ওহির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয। এতে অবিশ্বাস বা সন্দেহ পোষণ করা কুফরি। ওহি মানব জাতির ইহকাল ও পরকালের শান্তি এবং কল্যাণের বার্তা নিয়ে আসে। এ বার্তা গ্রহণকারীর জন্য ওহি কল্যাণকর পথ সহজ করে দেয়। আর যারা ওহিকে অবিশ্বাস করে কিংবা অবজ্ঞা করে তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। হযরত আদম (আ.) থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত অগণিত নবি-রাসুল আগমন করেছেন। নবি-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার মতো ওহির প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করা আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি মুহাম্মাদ (সা.)- এর মতো পূর্ববর্তী নবিদের ওপর অবতীর্ণ ওহিকেও সত্যবাণী হিসেবে মেনে নেওয়া ইমানের অংশ।
আল কুরআনের মু'জিযা |
আল্লাহ তা'আলা যুগে যুগে মানবজাতিকে সঠিক পথের সন্ধান এবং তাঁর বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশের জন্য অসংখ্য নবি-রাসুলকে মু'জিযা দিয়ে প্রেরণ করেন। মু'জিযা আরবি শব্দ। এর অর্থ-অলৌকিক বা বিশেষ ক্ষমতা, অন্যকে অক্ষম করে দেওয়া। মহাগ্রন্থ আল কুরআন প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সবচেয়ে বড় মু'জিযা। প্রত্যেক নবির গোত্রের অবস্থা অনুপাতেই তার মু'জিযা হয়ে থাকে। ফির'আউন সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদু বিদ্যার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তাই মুসা (আ.)-কে আল্লাহ তা'আলা একটি লাঠি দিয়ে পাঠালেন, যা যাদুকরদের সাপ সদৃশ সব লাঠি গিলে ফেলল। এতে যাদুকররা বিস্মিত হলো। তারা বিশ্বাস করে নিলো যে, মুসা (আ.) যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্য-সঠিক; যাদু নয়।
হযরত ঈসা (আ.)-এর যুগে মানুষ যখন চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিল, তখন আল্লাহ তা'আলা তাকে এমন মুজিযা দিয়ে পাঠালেন, যা দেখে সে যুগের চিকিৎসকগণ বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি মৃতদের আল্লাহর হুকুমে জীবিত করতেন এবং জটিল ও কঠিন রোগ ভালো করতেন। যেমন, তিনি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করতে পারতেন এবং মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে আল্লাহর নামে ফুঁ দিলেই তা পাখি হয়ে যেত। এতে চিকিৎসকদের বিবেক-বুদ্ধি স্বীকার করে নিল যে, এগুলো আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতেই।
আল্লাহ তা'আলা সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-কে আরব জাতির নিকট প্রেরণ করেন। আরবরা বিশুদ্ধ আরবি ভাষায় পারদর্শী ছিল। আরবি ভাষা চর্চার মাধ্যমে সাহিত্যের ক্ষেত্রে উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিল। বাকপটুতা ও উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান দিয়ে ভাষণ-বক্তৃতা দিত। তারা বর্তমান যুগের মতো ভাষাচর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিযোগিতা করত এবং বিজয়ীদের বিশেষ সম্মান দিত ও পুরস্কৃত করত। এ সময় আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি সর্বোৎকৃষ্ট আরবি সাহিত্য শেষ আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করেন। আল-কুরআনের ভাষাশৈলী দেখে কাফির-মুশরিকরা এর তাৎপর্য অনুধাবন করলেও সাধারণ মানুষের কাছে অপপ্রচার চালাতে লাগল যে, মুহাম্মাদ (সা.) যাদুকর। তাঁর কাছে গেলে কুরআনের মাধ্যমে সে মানুষদের মোহগ্রস্ত করে ফেলবে। তারা মানুষের কাছে অপপ্রচার করলেও নিজেরা কুরআনের ভাষার অলংকার, বর্ণনা ভঙ্গি ও বাক্য গঠন প্রণালি অনুধাবন করে লুকিয়ে লুকিয়ে রাতের আঁধারে তা শোনার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘরের আশেপাশে অবস্থান করত। আবার দিনের বেলায় তারা প্রচার করত যে, আমরাও কুরআনের মতো আয়াত রচনা করতে পারি। তাদের এমন উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন,
وَإِن كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَى عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّنْ مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُمْ مِّنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ صَدِقِينَ . فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَنْ تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَفِرِينَ
অর্থ: আর যে কিতাবটি আমি আমার বান্দার ওপর নাযিল করেছি, তাতে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ করো, তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং আল্লাহকে ছাড়া নিজেদের সমস্ত সমর্থক গোষ্ঠীকে ডেকে আনো। তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো। কিন্তু তোমরা যদি এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনোই তোমরা এটা করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর যা তৈরি করে রাখা হয়েছে কাফিরদের জন্য। (সূরা আল বাকারা, আয়াত: ২৩-২৪)
আল্লাহ তা'আলা মানুষ ও জিনকে কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব অথবা কুরআনের সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করেছেন। আজ পর্যন্ত কুরআনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও ইসলামে অবিশ্বাসীরা কখনো কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব কিংবা কুরআনের সূরার মতো একটি সূরা রচনা করে আনতে পারবে না। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,
قُلْ لَبِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا .
অর্থ: হে নবি আপনি বলুন, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত: ৮৮)
মানুষ যেহেতু কুরআনের অনুরূপ কালাম রচনা করতে পারেনি, তাই বুঝা যায় যে, কুরআন একটি চিরন্তন মু'জিযা। বিভিন্ন পদ্ধতিতেই কুরআনুল কারিমের মু'জিযা প্রমাণ করা যায়, কুরআনের শব্দমালা, গ্রন্থনা, অলংকারপূর্ণ শব্দের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর প্রতি নির্দেশনা প্রদান, আদেশ-নিষেধ, আল্লাহ তা'আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলির সংবাদ প্রদান, তার ফেরেশতাদের খবরাদি, ভবিষ্যৎ ও অতীতের গায়েবি বিষয়- সম্পর্কিত খবর, পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্ত খবর, ইমান ও ইয়াকিনের দলিল-প্রমাণাদি।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা'আলা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, আর্ন্তজাতিক, অর্থনৈতিক, সংস্কৃতিসহ বিজ্ঞানের সকল বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, মুসলিম জাতি আজ এ চিরন্তন মু'জিযা আল-কুরআনকে পরিত্যাগ করার কারণে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নিগৃহীত জীবনযাপন করছে। অথচ আল-কুরআনের প্রথম নির্দেশই হচ্ছে 'পড়ো তোমার প্রভুর নামে'। আল্লাহ তা'আলা কুরআনকে পড়তে, বুঝতে ও তা থেকে উপকার গ্রহণ করতে বলেছেন। তাই মানবজাতির হেদায়াত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচনের জন্য সকলকে কুরআন পড়তে হবে।
প্যানেল আলোচনা ' আল-কুরআন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ' কুরআন-হাদিসের নির্দেশনা আমি/আমরা যেভাবে অনুশীলন করতে পারি' (উল্লিখিত শিরোনামগুলোর আলোকে তোমরা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক প্যানেল আলোচনা
|
জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল কুরআন
মহাগ্রন্থ আল কুরআন জ্ঞানের ভাণ্ডার। কুরআন যারা মানেন এবং যারা মানেন না, সকলে কুরআনের বিভিন্নমুখী হেদায়াত থেকেই আলো নিয়েছেন। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎসই হলো আল-কুরআন। অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থের এই বৈশিষ্ট্য নেই। এতে রয়েছে ভ্রূণতত্ত্ব বিদ্যা, শরীর তত্ত্ববিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রাণিবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, সমরবিজ্ঞান ও মহাকাশ বিজ্ঞান প্রভৃতি। আরো রয়েছে জীবনের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখাগত বিজ্ঞান। সে হিসাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াতই বিজ্ঞান বহন করে। মহান আল্লাহ বলেন, 'বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ।' (সূরা ইয়াসিন, আয়াত: ২) যেহেতু কুরআন হলো সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস, তাই এখানে বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ করে এর গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। কুরআন থেকে বিজ্ঞানের চর্চা করেই মুসলমানরা কয়েক শতাব্দীব্যাপী বিশ্বে বিজ্ঞানের অগ্রনায়ক ছিল। অতঃপর বাগদাদ ও স্পেনের রাজনৈতিক পতনের ফলে বিজ্ঞানেরও পতন ঘটে এবং তাদেরই রেখে যাওয়া বিজ্ঞান অনুসরণ করে বস্তুবাদী ইউরোপ আজ উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। শিক্ষার্থীরা এখানে আল কুরআন যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস তার কয়েকটি নমুনা আলোচনা করা হবে।
ভ্রূণতত্ত্ববিদ্যা ভ্রূণতত্ত্বের মূলে আল্লাহ পাকের ওহি হলো, 'পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে।' (সূরা আলাক্ব, আয়াত: ১-২) আরবি শব্দ 'আলাক' অর্থ জমাট রক্ত। অন্য অর্থ দৃঢ়ভাবে আটকে থাকে এমন আঠালো জিনিস। যেমন, জোঁক কামড় দিয়ে আটকে থাকে। এভাবেই ভ্রূণতত্ত্ব সম্পর্কে অজানা অনেক জ্ঞান কুরআন থেকে পাওয়া যায়।
মানুষের সৃষ্টি রহস্য
মানুষের সৃষ্টিতে আল্লাহ তা'আলার দেওয়া তত্ত্বের উল্লেখ করে কুরআনের সূরা তারিক এর ৫-৭ আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, 'সুতরাং মানুষের ভেবে দেখা উচিত যে, কোন বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে। তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সবেগে বের হয়ে আসা পানি থেকে। যা বের হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষ পাঁজরের মাঝখান থেকে।'
সকল প্রাণীর সৃষ্টি রহস্য
এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পানি থেকেই প্রাণিজগতের উদ্ভব। অথচ কুরআন এ কথা আগেই বলেছে,
وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيْ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ
অর্থ: আমরা প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করেছি পানি থেকে। তবুও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না? (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩০)।
বিজ্ঞানের উৎস অনুমিতি
বিজ্ঞানের উৎস অনুমিতি যা যেকোনো সময় ভুল প্রমাণিত হতে পারে। যেমন বিজ্ঞানীরা বলেন, Science gives us but a partial knowledge of reality 'বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়'। তারা শুধু অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তাঁরা বলেন, 'আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্তুকে দেখি না'। যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ আগুনের সন্ধানে ছুটে থাকে। কিন্তু আল্লাহর ওহি হিসেবে কুরআন বিজ্ঞানের উৎস। যেখানে ভুলের কোনো অবকাশ নেই। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,
لَّا يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِّنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ .
অর্থ: সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকে এর মধ্যে মিথ্যার কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এটি ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হতে। (সূরা হা-মীম-আস্-সাজদা, আয়াত: ৪১-৪২)
জগত সৃষ্টির রহস্য
বিশ্বজগৎ সৃষ্টি সম্পর্কে বিজ্ঞান বলে, 'কোটি কোটি বছর পূর্বে বিশ্বজগৎ একটি অখণ্ড জড়বস্তুরূপে বিদ্যমান ছিল। পরে তার কেন্দ্রে একটি মহাবিস্ফোরণ ঘটে, যাকে Big-Bang বলা হয়। সেই মহা বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সৌরজগৎ, ছায়াপথ, তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এ তথ্য প্রদান করেছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
أَوَلَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَوتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَهُمَا
অর্থ: অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরে মিলিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৩০)
জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির রহস্য
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি প্রাণসত্তার মধ্যে রয়েছে বিপরীতধর্মী দুটি শক্তির জোড়। যার একটি পজিটিভ বা প্রোটন এবং অপরটি নেগেটিভ বা ইলেকট্রন। এমনকি বিদ্যুতের মতো প্রাণহীন বস্তুর মধ্যেও রয়েছে এই জোড়ার সম্পর্ক। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এ তথ্য দিয়ে বলেছে, 'মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি ভূ-উৎপন্ন সকল বস্তু এবং মানুষ ও তাদের অজানা সবকিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছে' (সূরা ইয়াসিন, আয়াত: ৩৬)।
উদ্ভিদের প্রাণ থাকা
উদ্ভিদের জীবন আছে, একথা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খ্রি.) মাত্র কিছুদিন পূর্বে আবিষ্কার করলেন। অথচ এর বহু পূর্বেই একথা কুরআন বলে দিয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'নক্ষত্ররাজি ও উদ্ভিদরাজি আল্লাহকে সিজদাহ করে' (সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানে পাথর ও বৃক্ষসমূহ ঝুঁকে পড়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে এবং তাঁকে সালাম দিয়েছে। এ সবই উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, তার প্রমাণ বহন করে।
নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে প্রাণের অস্তিত্ব
কুরআন এমন বিস্ময়কার তথ্য প্রকাশ করেছে, যা বিজ্ঞানীরা আজও প্রমাণ করতে পারেনি। আর তা হলো, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রাণ আছে এবং আছে বোধশক্তি। এমনকি এরা সর্বদা আল্লাহর গুণগান করে। যেমন আল্লাহ বলেন, 'অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে। (সূরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াত: ১১)
আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের সঙ্গে কুরআনের কোনো বিরোধ নেই, বিজ্ঞানের আবিষ্কারে যত উৎকর্ষ সাধিত হবে কুরআন যে বিজ্ঞানের উৎস তা দ্রুত বাস্তব উপলব্ধিতে আসবে। নতুন প্রজন্মকে যথাযথ উৎসাহ, সাহস এবং প্রযুক্তির সঠিক জ্ঞান দিলে তাঁরাই জাবির ইবনে হাইয়ান, ইবনে সিনা, মূসা আল খাওয়ারিজমি, আল- রাজির মতো বিশ্ববরেণ্য ইসলামিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখার সৌভাগ্য দান করুন।
একক কাজ জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল-কুরআনের সপক্ষে যুক্তি বা বাণী (আয়াত) উল্লেখপূর্বক ভিপ কার্ড বা পোস্টার তৈরি করো।
|
তাজবিদ |
কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদাত। যিনি কুরআনের একটি হরফ পড়বেন, তিনি ১০টি নেকি পাবেন। কুরআনের পাঠক ও শিক্ষক সর্বোত্তম মানব। কুরআন তিলাওয়াতকারীর মাতা-পিতাও সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী। মহানবি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার মাতা-পিতাকে নূরের মুকুট পরানো হবে। এ মুকুটের ঔজ্জ্বল্য সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি হবে। কিয়ামতের কঠিন দিনে কুরআন তার তিলাওয়াতকারীর জন্য মহান আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। আল্লাহ তা'আলা এ সুপারিশ কবুল করবেন।
কুরআন তিলাওয়াতের এ ফযিলত অর্জন করতে হলে সহিহ-শুদ্ধরূপে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। আর এ জন্য তাজবিদের জ্ঞান অর্জন করা জরুরি।
তাজবিদ অর্থ সুন্দর বা উত্তম করা। কুরআন মাজিদের প্রতিটি হরফকে তার সিফাত অনুযায়ী নিজস্ব মাখরাজ থেকে উচ্চারণ করে বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করার নাম তাজবিদ।
আরবি হরফের উচ্চারণের স্থানসমূহকে মাখরাজ বলে। অর্থাৎ যে হরফ যে স্থান থেকে উচ্চারিত হয়, তাকে সে হরফের মাখরাজ বলে। আরবি ২৯টি হরফের মোট ১৭টি মাখরাজ রয়েছে।
আরবি হরফের ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ ভঙ্গি রয়েছে। যেমন: কোনো হরফ উচ্চারণের সময় শ্বাস চালু থাকে আবার কোনো হরফের সময় শ্বাস চালু থাকে না। কোনো হরফের উচ্চারণ কোমল আবার কোনো হরফের উচ্চারণ একটু কঠিন। হরফের এ ধরনের বিভিন্ন গুণকে সিফাত বলে।
অতএব বলা যায়, কুরআন মাজিদের প্রতিটি হরফের মাখরাজ ও সিফাত অনুযায়ী বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করাকে তাজবিদ বলা হয়।
তাজবিদসহ কুরআন তিলাওয়াত করা ওয়াজিব। তাজবিদ অনুসারে কুরআন তিলাওয়াত না করলে অনেক সময় অর্থের পরিবর্তন ঘটে, ফলে পাঠকারী গুনাহগার হয়। তার নামায বিশুদ্ধ হয় না। মহান আল্লাহ বিশুদ্ধরূপে ধীরস্থিরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন
,وَرَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلًا
অর্থ: 'আপনি ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে কুরআন তিলাওয়াত করুন।' (সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত: ৪)
তাজবিদসহ কুরআন তিলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। সুতরাং আমরা তাজবিদসহ কুরআন তিলাওয়াত করব। তাজবিদের নিয়মকানুন ভালোভাবে জানব।
পূর্ববর্তী শ্রেণিসমূহে তোমরা তাজবিদের বেশ কিছু নিয়ম জেনেছ। তারই ধারাবাহিকতায় এ শ্রেণিতে গুন্নাহ, কলকলাহ, আল্লাহ শব্দের লাম পড়ার নিয়ম ও রা হরফ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
জোড়ায় কাজ 'পূর্ববর্তী শ্রেণির (৬ষ্ঠ-৮ম) তাজবিদের পুনরালোচনা' (প্রিয় শিক্ষার্থী, শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক পূর্বের শ্রেণিতে তাজবিদ বিষয়ক যা যা শিখেছ, তা তোমরা জোড়ায় আলোচনা করে উপস্থাপন করো)। |
গুন্নাহ
গুন্নাহ কুরআন মাজিদ বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াতের একটি বিশেষ নিয়ম। গুন্নাহ অর্থ নাকে বাজিয়ে উচ্চারণ করা। আরবি হরফের আওয়াজকে নাকের বাঁশিতে নিয়ে উচ্চারণ করাকে গুন্নাহ বলে। গুন্নাহের পরিমাণ এক আলিফ। একটি আঙুলকে সোজা করে মধ্যম গতিতে বন্ধ করতে যেটুকু সময় লাগে, সেটুকু সময়কে এক আলিফ পরিমাণ সময় ধরা হয়।
গুন্নাহ মোট চার প্রকার। যথা: ১। ক্বলব গুন্নাহ ২। ইখফা গুন্নাহ ৩। ইদগামে বা-গুন্নাহ ও ৪। ওয়াজিব গুন্নাহ।
১. ক্বলব গুন্নাহ
ক্বলব অর্থ পরিবর্তন করা। নুন সাকিন ও তানবীনের পর বা () হরফ আসলে উক্ত নুন সাকিন ও তানবীনকে মিম দ্বারা পরিবর্তন করে গুন্নাহসহ পড়তে হয়। এটাকে ক্বলব গুন্নাহ বলা হয়। যেমন:
২. ইখফা গুন্নাহ
ইখফা অর্থ গোপন করা, অস্পষ্ট করা। নুন সাকিন ও তানবীনের পরে ইখফার জন্য নির্দিষ্ট যেকোনো একটি আসলে উক্ত নুন সাকিন ও তানবীনকে নাকের মধ্যে গোপন করে গুন্নাহর সঙ্গে পড়তে হয়। এটাকেই ইখফা গুন্নাহ বলে। ইখফার হরফ ১৫টি। যেমন:ت ث ج د ذ ز س ش ص ض ط ظ ف ق ك
এছাড়াও মীম সাকিনের পরে 'বা' )ب( হরফটি আসলে উক্ত মীম সাকিনকে গুন্নাহসহ পড়তে হয়। এটাকে মীম সাকিনের ইখফা গুন্নাহ বলে। যেমন
عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ - وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ
৩. ইদগামে বা-গুন্নাহ (গুন্নাহসহ ইদগাম)
ইদগাম শব্দের অর্থ মিলানো বা সন্ধি করা। ن -م -و-ي )ইয়া, ওয়াও, মীম, নুন) এই চারটি হরফের কোনো একটি নুন সাকিন ও তানবীনের পরে ভিন্ন শব্দের শুরুতে আসলে উক্ত নুন সাকিন কিংবা তানবীন যুক্ত হরফকে পরবর্তী শব্দের প্রথম শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে গুন্নাহর সঙ্গে পড়তে হয়। এটাকে বলে ইদগামে বা গুন্নাহ। যেমন-
৪. ওয়াজিব গুন্নাহ
م )মীম ও নুন) এ দুটি হরফের উপর যদি তাশদিদ (৩) থাকে, তবে এ দুটিকে অবশ্যই গুন্নাহর সঙ্গে পড়তে হবে। একে ওয়াজিব গুন্নাহ বলা হয়। যেমন: جَهَنَّمَ - إِنَّ لَمَّا ইত্যাদি।
কাজ: শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের সামনে সঠিকভাবে গুন্নাহ আদায় করতে পারে কি না, তার অনুশীলন করবে।
আল্লাহ )اَللّٰهُ( শব্দের লাম (১) উচ্চারণের নিয়ম
( الله )আল্লাহ শব্দের লাম উচ্চারণ করার পদ্ধতি দুটি।
১. ( اَللّٰهُ )আল্লাহ) শব্দের লাম হরফের পূর্বে যবর বা পেশ থাকলে উক্ত লামকে পোর করে অর্থাৎ মোটা স্বরে পড়তে হবে। যেমন:
وَاللَّهِ - اللَّهُمَّ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ
২. যদি লামের পূর্বে যের বিশিষ্ট হরফ থাকে তবে উক্ত লামকে বারিক বা পাতলা স্বরে পড়তে হবে। যেমন:
لِلَّهِ - بِسْمِ اللَّهِ - وَاسْتَغْفِرِ اللَّهَ
আল্লাহ শব্দ ছাড়া যত শব্দে লাম আছে সব লাম বারিক বা পাতলা করে পড়তে হবে। যেমন:
مَا وَلَّهُمْ
রা (ر) হরফ পড়ার নিয়মরা
(ر) হরফ পড়ার দুটি নিয়ম আছে। যথা:
১. পোর বা মোটা
২. বারিক বা পাতলা।
নিম্নলিখিত অবস্থায় রা (ر) হরফকে পোর বা মোটা করে পড়তে হয়।
১) রা (ر) হরফ এর ওপর যবর বা পেশ থাকলে তা পোর করে পড়তে হয়। যেমন: قُوُدْ
২) রা (ر ) সাকিন এর পূর্বের হরফের ওপর যবর বা পেশ থাকলে তা পোর করে পড়তে হয়। যেমন: أَرْكِسُوا - يَرْجِعُوْنَ
৩) রা (ر) সাকিন এর পূর্বের হরফে অস্থায়ী যের থাকলে তা পোর করে পড়তে হয়। আর যে অক্ষরে পূর্বে সাকিন ছিল কিন্তু অন্য শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ার জন্য সাময়িকভাবে যের দেওয়া হয়েছে, এমন যের কে অস্থায়ী যের বলে। যেমন: مَنِ ارْتَضُى - إِنِ ارْتَبْتُمْ
৪) রা (ر) সাকিন এর পূর্বের হরফে যের এবং পরে ইসতি'লার কোনো একটি হরফ আসলে উক্ত রা (ر) কে পোর করে পড়তে হয়। যেমন, قِرْطَاسٌ - مِرْصَادٌ
৫) রা (ر) হরফে যদি ওয়াকফ করা হয় এবং এটির পূর্বে ইয়া (ر) ব্যতীত অন্য কোনো হরফ সাকিন থাকে, আর উক্ত সাকিনের পূর্বাক্ষরে যবর বা পেশ থাকে, তাহলে রা (ر) কে পোর করে পড়তে হয়। যেমন: قَدْرٌ - خُسْرٌ شَهْرٌ
নিম্নলিখিত অবস্থায় রা (ر) হরফকে বারিক বা চিকন করে পড়তে হয়।
১) রা (ر) হরফে যের হলে বারিক করে পড়তে হয়। যেমন: رِزْق
২) রা (ر) সাকিন এর পূর্বের হরফ স্থায়ী যের হলে বারিক করে পড়তে হয়। যেমন: مِرْفقًا
৩) রা (ر) হরফে ওয়াকফ করার সময় এর পূর্বে ইয়া (ر) সাকিন থাকলে উক্ত রা (ر) বারিক করে পড়তে হয়। যেমন: سَعِيرٌ - خَيْرٌ - خَبِيرٌ
৪) রা (ر) হরফে ওয়াকফ করার সময় যদি এর পূর্বে ইয়া (ر) ব্যতীত অন্য কোনো হরফ সাকিন হয় এবং সেই সাকিন হরফের পূর্বাক্ষরে যের হয়, তা হলে উক্ত রা (ر) বারিক করে পড়তে হয়। যেমন: حِجْر - شعر
কলকলার বিবরণ
কলকলা অর্থ প্রতিধ্বনি। কলকলার অক্ষর ৫টি। যথা: ১ ق ط ب ج মনে রাখার জন্য এগুলোকে একত্রে قُطْبُ جَدٍ বলা হয়। এই পাঁচটি হরফে যখন সাকিন বা ওয়াকফ হয় তখন কলকলা করতে হয়। অর্থাৎ প্রতিধ্বনির মতো আওয়াজ বন্ধ হয়ে পুনরায় ফিরে আসাকে সাধারণত কলকলা বলা হয়। যেমন কোনো শক্ত জিনিসকে শক্ত মাটির ওপর নিক্ষেপ করলে নিক্ষিপ্ত বস্তু শব্দ করে ফিরে আসে, ঠিক তেমনিই কলকলার হরফকেও কলকলা করার সময় নির্দিষ্ট মাখরাজ হতে প্রতিধ্বনির মতো আওয়াজ বন্ধ হয়ে পুনরায় উচ্চারিত হয়, তাকে কলকলা বলে।
শব্দের মধ্যভাগে কলকলার হরফ সাকিন হলে সামান্য কলকলা করতে হয় এবং কিছুটা যবরের মতো করে পড়তে হয় যেমন ঃ يَدْخُلُونَ - تَجْهَلُونَ - يَبْخَلُونَ - قِطْمِيرُ - يَقْطَعُونَ
কলকলার হরফগুলো যদি ওয়াকফ অবস্থায় থাকে, তাহলে পূর্ণভাবে কলকলা করতে হয় এবং কিছুটা যবরের মতো করে আদায় করতে হয় যেন পুরা মাত্রায় যবর প্রকাশ না পায়। যেমন: جُحُودٌ - شَدِيدٌ - حِسَابٌ - صِرَاطٌ - خَلَّاق
বাড়ির কাজ 'পাঠ্যপুস্তকে নির্ধারিত সূরাসমূহ তাজবিদ অনুসারে তুমি বাড়িতে শুদ্ধভাবে চর্চা করো' (এক্ষেত্রে তুমি তাজবিদ সংক্রান্ত বিষয়ে তোমার পরিবার, প্রতিবেশি বা সহপাঠীদের মধ্যে কেউ দক্ষ থাকলে তার সহায়তা নিতে পারো)। |
অর্থ ও পটভূমিসহ আল কুরআনের কতিপয় সূরা
সূরা আল-ফীল ( سُوْرَةُ الْفِيْلِ ) |
সূরা ফীল কুরআন মাজিদের ১০৫তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। সূরাটিতে পাঁচটি আয়াত রয়েছে। ফীল অর্থ হাতি। এ সূরায় হস্তিবাহিনীর ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। ইয়েমেনের শাসক আবরাহা কাবা ঘরকে ধ্বংস করার জন্য হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কায় অভিযান করেছিল। আল্লাহ তা'আলা ছোট ছোট পাখির দ্বারা তাদের বাহিনীকে ধ্বংস করে ধুলায় মিশিয়ে দেন। সূরাটিতে হস্তিবাহিনীর এ করুণ পরিণতির কথা বর্ণিত হয়েছে বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে সূরা ফীল।
শানে নুযুল
ইয়েমেনের রাজা ছিল জুনুওয়াস। সে ছিল ইহুদি। খ্রিস্টানদের সে অকথ্য নির্যাতন করত। তাদের জোর করে ইহুদি ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত। এমনকি সে ইনজিলের কপি পুড়িয়ে দিয়েছিল। তখন রোমের বাদশাহ আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশিকে জুনুওয়াসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেন। নাজ্জাশি তখন আবরাহা নামক এক ব্যক্তিকে এক বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ জুনুওয়াসের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। আবরাহা জুনুওয়াসকে ধ্বংস করে এবং ইয়েমেনের ক্ষমতা দখল করে নেয়।
ইয়েমেনের অধিপতি হয়ে আবরাহা দেখল আরব, ইয়েমেন ও অন্যান্য দেশের জনগণ মক্কায় অবস্থিত কাবা প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে কাবাকে তাওয়াফ করে, সম্মান ও ভক্তি করে। তাই কাবার প্রতি মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা যাতে কমে যায়, পৃথিবীর মানুষ যেন কাবার কাছে না যায়, সে জন্য সে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তখন সে ইয়েমেনের রাজধানী সান'আ শহরে একটি সুন্দর ও বহু মণিমুক্তা খচিত গির্জা তৈরি করল। মানুষকে সে এ গির্জায় হাজির হতে নির্দেশ দিল এবং মক্কায় কাবা শরিফে না যাওয়ার জন্য তাগিদ দিল। কিন্তু তার শত চেষ্টা ও উদ্যোগ ব্যর্থ হলো। কেউ তার গির্জায় যেতে রাজি হলো না। সে তখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। এরই মধ্যে আরবের কোনো এক ব্যক্তি গোপনে ঐ গির্জায় প্রবেশ করে সেখানে মলত্যাগ করে রাখে। এরপর কে বা কারা তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন আবরাহা রাগে ও ক্ষোভে কাবা ঘর ভেঙে ফেলার জন্য ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে এক বিশাল হস্তি বাহিনী নিয়ে অভিযান শুরু করে। এ বাহিনীতে বিপুল সৈন্য ও তেরোটি বিশালাকায় শক্তিশালী হাতি ছিল। পথিমধ্যে আরবের যে গোত্রই তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, সে তাদেরকে ধ্বংস করে সামনে অগ্রসর হয়। তখন কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন মহানবি (সা.)-এর দাদা কুরাইশ নেতা আবদুল মুত্তালিব। আবরাহার সৈন্যরা মক্কাবাসীদের উটগুলো নিয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে আবদুল মুত্তালিবের দুইশ উটও ছিল। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, তোমার সৈন্যবাহিনী আমাদের উটগুলো আটক করেছে, সেগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করো। এতে আবরাহা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। সে বলল, আমি তোমাদের কাবা ঘর ভেঙে ফেলার জন্য এসেছি, কিন্তু তোমরা সে ব্যাপারে কোনো কথা না বলে তোমাদের উটের কথা বলছ। তখন আবদুল মুত্তালিব বললেন, 'আমি উটের মালিক, তাই উটের কথা বলছি আর কাবা ঘরের মালিক মহান আল্লাহ, তিনি তা অবশ্যই রক্ষা করবেন।' এ কথা শুনে আবরাহা কিছুক্ষণ নীরব থেকে উটগুলো ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিল। আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের পাহাড়ে আশ্রয় নিতে বললেন। সকলে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিল। পরদিন সকালে আবরাহা তার বাহিনী নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য এগিয়ে আসে। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরতে হাতিগুলো সামনে অগ্রসর হতে পারল না। এ সময় মহান আল্লাহ সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ ও হলুদ রঙের অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি প্রেরণ করেন। এরা দুই পায়ে দুটি এবং ঠোঁটে একটি করে ক্ষুদ্র কংকর নিয়ে এসে আবরাহার সৈন্যবাহিনীর উপরে নিক্ষেপ করল। ফলে আবরাহার সৈন্যবাহিনী ক্ষণিকের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল। আর আবরাহা আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল। তার সমস্ত শরীরে বসন্তের দাগের ন্যায় জখম হয়ে গেল। তার দেহ পচে রক্ত ও পুঁজ বের হতে লাগল। অতিশয় কষ্টের পর সে মারা গেল। এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর ঘরকে আবরাহার ধ্বংসের পরিকল্পনা থেকে রক্ষা করেন। উক্ত প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা'আলা সূরা ফীল নাযিল করেন এবং বিশেষ ঘটনা জগৎবাসীকে জানিয়ে দেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। |
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحْبِ الْفِيلِ
| ১. আপনি কি দেখেননি, আপনার প্রতিপালক হস্তিবাহিনীর সঙ্গে কীরূপ আচরণ করেছিলেন? |
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ | ২. তিনি কি তাদের কৌশল ব্যর্থ করে দেননি? |
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيْلَ 8 | ৩. আর তিনি তাদের প্রতি ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি প্রেরণ করেন। |
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيلٍ
| ৪. সেগুলো তাদের উপর কংকর- জাতীয় পাথর নিক্ষেপ করে। |
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ 6
| ৫. অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণসম করেন। |
ব্যাখ্যা
এ সূরায় ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংসের ব্যর্থ চেষ্টা নস্যাৎ করার ঐতিহাসিক ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। এটি মহান আল্লাহর কুদরত ও হিকমতের অপূর্ব নিদর্শন। মহানবি (সা.)- এর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে ঘটনাটি ঘটে। আবরাহা অনেক ধন-সম্পদ ও সৈন্য-সামন্তের মালিক ছিল। তার বিশাল হস্তিবাহিনী ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতার তুলনায় এসব সম্পদ ও সৈন্য-সামন্ত অতি তুচ্ছ ও নগণ্য। আল্লাহ তা'আলা মহাপরাক্রমশালী ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতে পারেন।
আবরাহা ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়েছিল। গর্ব ও অহংকারবশত মহান আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতা করেছিল। মহান আল্লাহ তাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখির সাহায্যে ধ্বংস করে দেন। এ ঘটনায় বুঝা যায় যে, যারা আল্লাহর সঙ্গে নাফরমানি করবে, ইসলামের সঙ্গে শত্রুতা করবে আল্লাহ তা'আলা দুনিয়াতেও তাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহাকে তার সৈন্য ও হস্তি বাহিনীসহ ক্ষণিকের মধ্যে ধ্বংস করে দিয়ে মহান আল্লাহ এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ব্যক্তি, সমাজ, জাতি যে-ই ইসলামের ক্ষতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হবে, দুনিয়ার কোনো শক্তি তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না। শুধু দুনিয়াতেই নয়, আখিরাতেও তারা মহান আল্লাহর ভয়াবহ আযাব থেকে রেহাই পাবে না।
শিক্ষা এ সূরা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই- ১. কাবা মহান আল্লাহর ঘর, আর এটি সংরক্ষণ তিনিই করবেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি এটি ধ্বংস করার দুঃসাহস দেখাতে পারবে না। ২. মহান আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতা অসীম। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাঁর মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়। ৩. যারাই মহান আল্লাহর নাফরমানি করবে, তিনি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন। ৪. আল্লাহদ্রোহী ও নাফরমানদের শাস্তি শুধু পরকালেই হবে, তা নয় বরং দুনিয়াতেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। ৫. ইসলামের বিরুদ্ধে কাফির-মুশরিকদের সমস্ত কৌশল ও ষড়যন্ত্র মহান আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন। কেননা তিনিই সর্বোত্তম কৌশলী। |
সূরা আল-কদর ( سُوْرَةُ الْقَدْرِ ) |
শানে নুযুল
কুরআন মাজিদের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বোঝানোই এ সূরা নাযিলের উদ্দেশ্য। ইবন জারির (রহ.) এ সূরার শানে নুযুলের ব্যাপারে একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন যে, বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি সারা রাত ইবাদাতে নিয়োজিত থাকতেন। আর সকাল হলেই আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়ে যেতেন এবং সারা দিন জিহাদে লিপ্ত থাকতেন। তিনি এভাবে এক হাজার মাস আল্লাহর ইবাদাতে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তখন সাহাবিগণ বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমাদের হায়াত খুবই সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ববর্তী উম্মতগণ দীর্ঘদিন জীবিত থাকতেন। বেশি বেশি ইবাদাত করার সুযোগ পেতেন। ফলে আমরা কখনই ইবাদাতের সাওয়াবের ক্ষেত্রে তাদের সমান হতে পারব না। সাহাবিগণের এমন আফসোসের পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ সূরা কদর নাযিল করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন। সাহাবিগণ বনি ইসরাইলের উম্মতদের ইবাদাত-বন্দেগির কথা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ এর চেয়েও উত্তম বস্তু এ সূরার মাধ্যমে তাদের দান করেছেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। |
إِنَّا أَنْزَلْتُهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِة
| ১. নিশ্চয়ই আমি এটি (আল-কুরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে। |
وَمَا أَدْرَكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
| ২. আর আপনি কি জানেন এ মহিমান্বিত রাত কী? |
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
| ৩. মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। |
تَنَزَّلُ الْمَلْكَةُ وَالرُّوْحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ :
| ৪. সে রাতে প্রত্যেক কাজের জন্য ফেরেশতাগণ ও রুহ (জিবরাইল ফেরেশতা) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। |
سَلْمٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
| ৫. সে রাতে উষা উদয় হওয়া পর্যন্ত শান্তিই শান্তি (বিরাজ করে)। |
ব্যাখ্যা
এ সূরায় কুরআন মাজিদ নাযিলের কথা এবং সে রাতের মাহাত্ম্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআন নাযিল করা হয়েছে লাইলাতুল কদরে। লাইলাতুল কদরে কুরআন নাযিলের অর্থ, এ রাতে সমস্ত কুরআন এক সঙ্গে নাযিল হয়েছে। লাওহে মাহফুয থেকে সম্পূর্ণ কুরআন প্রথম আসমানের বায়তুল ইযযাহ নামক স্থানে নাযিল করা হয়েছিল। লাইলাতুল কদর অত্যন্ত মহিমান্বিত রাত। এ রাতের মর্যাদা এক হাজার মাসের চেয়েও বেশি। এই একটি রাতের ইবাদাত একাধারে তিরাশি বছর চার মাস ইবাদাত করার চেয়েও উত্তম। এ রাতে হযরত জিবরাইল (আ.) অন্যান্য ফেরেশতাগণসহ মহান আল্লাহর অনুমতিক্রমে রহমত, বরকত ও শান্তির বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এ রাতে ফজর হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করে।
শিক্ষা এ সূরা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই: ১. কুরআন মাজিদ মহান আল্লাহর কালাম বা বাণী। এটি তিনি লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছেন। ২. লাইলাতুল কদর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ রাত। তবে লাইলাতুল কদর কোনটি এ সম্পর্কে হাদিসের ইঙ্গিত হলো এই যে, রমযান মাসের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতই লাইলাতুল কদর। আবার বিশেষজ্ঞ আলিমগণের অনেকেই রমযান মাসের ২৭তম রাতকে অর্থাৎ ২৬তম দিবাগত রাতকে লাইলাতুল কদর বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ৩. এ রাতের ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম। ৪. এ রাতে জিরাঈল (আ.)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাগণ শান্তি ও কল্যাণ নিয়ে দুনিয়ায় আগমন করেন। ৫. এ রাতে ফজর উদিত হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত শান্তি ও রহমত বর্ষিত হয়। ৬. লাইলাতুল কদরে কুরআন মাজিদ নাযিলের কারণেই তা এত মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।
|
আমরা বেশি বেশি নফল ইবাদাত বন্দেগির মাধ্যমে যথাযথভাবে লাইলাতুল কদর উদযাপন করব। এ রাতের সামান্য সময়ও ইবাদাত না করে অতিবাহিত করব না। তাহলেই আমরা হাজার মাস অপেক্ষা বেশি ইবাদাতের সাওয়াব অর্জন করতে পারব।
দলগত কাজ 'সুরা কদর' এর শিক্ষা অনুযায়ী কদরের রাতে আমাদের কী করা উচিত (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)
|
সূরা আদ-দুহা ( سُوْرَةُ ) |
সূরা আদ-দুহা কুরআন মাজিদের তিরানব্বই নম্বর সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হযেছে। এর আয়াত সংখ্যা এগারো। সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে সূরা ফাজরের পর এবং সূরা ইনশিরাহ এর আগে। রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর মাক্কি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে সূরাটি অবতীর্ণ হয়।
শানে নুযূল
এ সূরার শানে নুযুল সম্পর্কে হযরত জায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, ওহি অবতীর্ণের প্রাথমিক সময়ে কিছু দিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ওহি আসা বন্ধ ছিল। এতে মহানবি (সা.) খুব চিন্তিত ও বিচলিত হয়ে পড়েন। মক্কার কাফির এবং মুশরিকরা তখন বলতে শুরু করল, মুহাম্মাদের (সা.) প্রভু তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তখন আল্লাহ তা'আলা সূরা আদ-দুহা অবতীর্ণ করেন। সহিহ বুখারি এবং সহিহ মুসলিমে সূরা আদ-দুহার আরেকটি শানে নুযূল বর্ণিত হয়েছে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কয়েকদিন জিবরাইল (আ.) ওহি নিয়ে আসেননি। তখন আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল (উরওয়া বিনতে হারব) এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলল, 'হে মুহাম্মাদ! আমার মনে হয় তোমার সঙ্গে যে শয়তানটা থাকত, সে তোমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। দুই বা তিন রাত আমি তাকে তোমার কাছে আসতে দেখছি না।' তখন আল্লাহ তা'আলা এ সূরাটি নাযিল করেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে |
وَالضُّحَى :
| ১. শপথ পূর্বাহ্ণের। |
وَالَّيْلِ إِذَا سَجَى :
| ২. শপথ রাতের, যখন তা নিঝুম হয়। |
مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى
| ৩. আপনার প্রতিপালক আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং আপনার প্রতি বিরূপও হননি। |
وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْأُولَى
| ৪. নিশ্চয়ই আপনার জন্য পরবর্তী সময় তো পূর্ববর্তী সময় অপেক্ষা শ্রেয়। |
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
| ৫. আর অচিরেই আপনার প্রতিপালক আপনাকে অনুগ্রহ দান করবেন, আর আপনি সন্তুষ্ট হবেন। |
أَلَمْ يَجِدُكَ يَتِيمًا فَأَوْى | ৬. তিনি কি আপনাকে ইয়াতিম অবস্থায় পাননি? এর পর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। |
وَوَجَدَكَ ضَالَّا فَهَدَى 6
| ৭. এবং তিনি আপনাকে পেয়েছেন পথ সম্পর্কে অনবহিত, তারপর তিনি পথের নির্দেশ দিয়েছেন। |
وَوَجَدَكَ عَابِلًا فَأَغْنَى
| ৮. এবং তিনি আপনাকে পেয়েছেন নিঃস্ব অবস্থায়, এর পর তিনি অভাবমুক্ত করেন। |
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ
| ৯. অতএব আপনি ইয়াতিমদের প্রতি কঠোর হবেন না। |
وَأَمَّا السَّابِلَ فَلَا تَنْهَرْ
| ১০. এবং কোনো প্রার্থীকে ধমক দেবেন না। |
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثُ :
| ১১. আর আপনি আপনার প্রতিপালকের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। |
ব্যাখ্যা
নবি-রাসুলগণ আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। তাঁরা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। আল্লাহ তা'আলা নবি- রাসুলগণের প্রতি তাঁদের জন্মলগ্ন থেকেই অবিরত ধারায় করুণা দান করে থাকেন। এ সূরায় মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মাদ (স.)-এর প্রতি প্রদত্ত বিভিন্ন অনুগ্রহের বিবরণ দিয়েছেন। মহানবি (সা.) ইয়াতিম ছিলেন। জন্মের পূর্বেই তাঁর বাবা ইন্তেকাল করেন। আর মা মারা যান ছয় বছর বয়সে। তাকে লালন- পালন করার মতো কেউ ছিল না। মহান আল্লাহ তাকে লালন-পালনের সুব্যবস্থা করেছেন। প্রথমে দাদা আবদুল মুত্তালিবের ও পরে চাচা আবু তালিবের অন্তরে তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। ফলে তারা নিজ সন্তানের চেয়ে বেশি যত্নসহকারে তাঁকে লালন-পালন করেছেন।
ওহি লাভের পূর্বে তিনি মহান আল্লাহর বিধি-বিধান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন। মানব জাতির দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও পরকালীন মুক্তির জন্য চিন্তাক্লিষ্ট ছিলেন। তিনি সত্যের সন্ধানে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন ছিলেন। মহান আল্লাহ তখন তাঁকে নবুওয়াত দান করে সত্য ও সুন্দরের পথনির্দেশনা প্রদান করেন। হেদায়াতের আলোকবর্তিকা দান করেন। তিনি দরিদ্র, অসহায়, নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত ছিলেন। অতঃপর মহান আল্লাহ তাঁকে সচ্ছল ও ধনবান করেন। তাঁকে অভাবমুক্ত করেন। হযরত খাদিজা (রা) এর ধনসম্পদ দ্বারা অংশীদারী ব্যবসা করার মাধ্যমে এর সূচনা হয়। পরবর্তীতে মহান আল্লাহর হুকুমে খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ করার ফলে তাঁর সমস্ত সম্পত্তিই রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য উৎসর্গিত হয়। এভাবে মহান আল্লাহ পার্থিব জীবনে মহানবি (সা.)- কে বহু নিয়ামত ও অনুগ্রহ দান করেন।
মহান আল্লাহ পার্থিব নিয়ামতের পাশাপাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)- কে পরকালীন বিভিন্ন নিয়ামত দান করার সুসংবাদ দান করেছেন এ সূরায়। মহান আল্লাহ মহানবি (সা.) কে সুসংবাদ প্রদান করেন যে, আপনার পরকালীন জীবন পার্থিব জীবনের তুলনায় বহুগুণ উত্তম হবে। দুনিয়াতে যত নিয়ামত দেওয়া হয়েছে আখিরাতে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি প্রদান করা হবে।
মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে পরকালে এমন কিছু দান করবেন যা পেয়ে তিনি খুশি হবেন। আর হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ততক্ষণ পর্যন্ত খুশি হবেন না, যতক্ষণ না তাঁর সকল উম্মতকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সন্তুষ্ট করবেন।
এ সূরায় মহানবি (সা.)-এর প্রতি আল্লাহ তা'আলার প্রদত্ত ইহকালীন ও পরকালীন এসব অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন ইয়াতিমদের প্রতি কঠোর না হন। কোনো ভিক্ষুককে যেন ধমক না দেন। সর্বদা আল্লাহ তা'আলা প্রদত্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা এ সূরা থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়- ১. মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের কখনো পরিত্যাগ করেন না এবং তাদের প্রতি বিরূপও হন না। ২. বিপদ যতই কঠিন হোক না কেন তিনিই তাঁদের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। ৩. তাঁদের পরকালীন জীবন পার্থিব জীবনের তুলনায় বহুগুণ উত্তম ও কল্যাণময় করে দেন। ৪. ধনী ব্যক্তিদের উচিত গরিব-দুঃখী ও অসহায় ব্যক্তিদের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসা। ৫. ভিক্ষুক ও সাহায্যপ্রার্থীদের ধমক বা তিরস্কার না করে যথাসম্ভব সাহায্য করা। কারণ, আল্লাহ ধনীদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের অংশ রেখেছেন। ৬. ইয়াতিমদের ধমক না দিয়ে সব সময় তাদের সাথে কোমল আচরণ করতে হবে। ৭. ধন-সম্পদ মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। যখন তিনি এ নিয়ামত কাউকে দান করেন, তখন তার উচিত কৃপণতা পরিহার করে এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। |
একক কাজ 'সূরা আদ-দুহার শিক্ষা আমার জীবনে যেভাবে চর্চা বা অনুশীলন করব' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে সূরা আদ-দুহার শিক্ষা আমার জীবনে চর্চার কৌশল বা উপায় চিহ্নিত করে তা শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উপস্থাপন করো।)
|
সূরা আলাক ( سُوْرَةُ الْعَلَقِ ) |
সূরা আলাক আল কুরআনের ৯৬তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এর আয়াত সংখ্যা ১৯টি। এ সূরার দ্বিতীয় আয়াতের শেষ শব্দ আলাক থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে।
শানে নুযুল
নাযিলের সময়ের দিক দিয়ে এ সূরাটি দুই ভাগে বিভক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় এই সূরার প্রথম পাঁচটি আয়াত সর্বপ্রথম নাযিল হয়। এটাই প্রথম ওহি। এর মাধ্যমেই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবির নবুওয়াতের প্রকাশ ঘটেছে। সূরার বাকি ১৪টি আয়াত আরো পরে যখন মহানবি (সা.) কাবা শরিফে সালাত আদায় শুরু করেন এবং আবু জাহেল কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন, তখন নাযিল হয়। আবু জাহেল একবার তার সঙ্গী সাথিদেরকে বলে মুহাম্মাদ কি তোমাদের সামনে সালাত আদায় করে, সিজদা দেয়? তারা বলল, হ্যাঁ। তখন সে বলল, লাত ও ওজ্জার শপথ, আমি যদি তাকে সালাত আদায় করতে দেখি তবে তার কাঁধে উটের নাড়িভুঁড়ি ঝুলিয়ে দেবো। সে একদিন দেখল, মহানবি (সা.) সালাত আদায় করছেন। সে অগ্রসর হলো কিন্তু পিছু হটে গেল এবং হাত দিয়ে আত্মরক্ষা করতে লাগল। তখন তাকে বলা হলো, তোমার কী হলো? সে বলল, নিশ্চয়ই তার মাঝে আর আমার মাঝে একটি আগুনের পরিখা দেখলাম, যা অত্যন্ত ভয়াবহ ও ডানাসমৃদ্ধ। এ প্রেক্ষাপটে শেষের আয়াতগুলো নাযিল হয়।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। |
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ 6
| ১. পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। |
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ 6
| ২. সৃষ্টি করেছেন মানুষকে 'আলাক' হতে। |
اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ .
| ৩. পাঠ করুন, আর আপনার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত। |
الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ | ৪. যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। |
عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ
| ৫. শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না। |
كَلَّا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَيَطْغَى
| ৬. বস্তুত মানুষ তো সীমালঙ্ঘন করেই থাকে। |
أَن رَّاهُ اسْتَغْنَى :
| ৭. কারণ সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে। |
إِنَّ إِلَى رَبِّكَ الرَّجُعُي
| ৮. আপনার প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত। |
أَرَهَيْتَ الَّذِي يَنْهَى .
| ৯. আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে বাধা দেয়? |
عَبْدًا إِذَا صَلَّى
| ১০. এমন বান্দাকে- যখন সে সালাত আদায় করে? |
أَرَعَيْتَ إِنْ كَانَ عَلَى الْهُدَى
| ১১. আপনি লক্ষ্য করেছেন কি, যদি সে সৎ পথে থাকে |
أَوْ أَمَرَ بِالتَّقْوى .
| ১২. অথবা তাকওয়ার নির্দেশ দেয়। |
أَرَعَيْتَ إِن كَذَّبَ وَتَوَلَّى
| ১৩. আপনি কি লক্ষ্য করেছেন? যদি সে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, |
أَلَمْ يَعْلَمُ بِأَنَّ اللَّهَ يَرَى *
| ১৪. তবে সে কি জানে না যে, আল্লাহ দেখেন |
كَلَّا لَبِنْ لَّمْ يَنْتَهِ ۚ لَنَسْفَعًا بِالنَّاصِيَةِ
| ১৫. সাবধান, সে যদি বিরত না হয় তবে আমি তাকে অবশ্যই হেঁচড়িয়ে নিয়ে যাব, মস্তকের সম্মুখভাগের কেশগুচ্ছ ধরে- |
نَاصِيَةٍ كَاذِبَةٍ خَاطِئَةٍ .
| ১৬. মিথ্যাচারী, পাপিষ্ঠের কেশগুচ্ছ। |
فَلْيَدْعُ نَادِيَهُ .
| ১৭. অতএব সে তার পার্শ্বচরদিগকে আহ্বান করুক। |
سَنَدْعُ الزَّبَانِيَةَ
| ১৮. আমিও আহ্বান করব জাহান্নামের প্রহরীদের। |
كَلَّا لَا تُطِعْهُ وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ .
| ১৯. সাবধান! আপনি এর অনুসরণ করবেন না এবং সিজদা করুন ও আমার নিকটবর্তী হন। |
ব্যাখ্যা
প্রকাশ্যভাবেই এ দুইয়ের মধ্যে মিল রয়েছে। প্রথম আয়াতটি বাহ্যিক গঠন ও সৌন্দর্য বর্ণনা করে। আর দ্বিতীয় আয়াতটি মৌলিক সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনা করে। এই সূরার শুরুতে পড়া ও শিক্ষাদানের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নাযিলকৃত অনন্য নিয়ামত ও অনুগ্রহ আল কুরআন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মানব জীবনে প্রাচুর্য ও শক্তিমত্তার জন্য অবাধ্যাচরণ এবং এ নিয়ামত পেয়ে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর আবু জাহেলের পাপাচার উল্লেখ করা হয়েছে। সে প্রিয়নবি (সা.)- কে সালাত আদায়ে বাধা দিত। সালাতরত অবস্থায় উটের নাড়িভুঁড়ি কাঁধে পেঁচিয়ে দিত। এরপর এরকম পাপিষ্ঠ কাফিরদের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যদি তারা এহেন কার্যকলাপ থেকে বিরত না থাকে, তাদেরকে পাকড়াও করা হবে এবং ভয়ানক শাস্তি হিসেবে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে। সর্বশেষে, বেশি বেশি সিজদা করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে- বান্দা যখন সিজদায় থাকে, তখন তার প্রতিপালকের অধিক নিকটবর্তী হয়।
সূরা আলাকের পূর্বের সূরা তীনে আল্লাহ তা'আলা মানুষের সৃষ্টি সম্পর্কে বলেন যে, নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। সূরা আলাকে আল্লাহ তা'আলা বলেন, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলাক তথা লেগে থাকা জমাট বাধা রক্ত থেকে।
সূরা আলাকের শেষ আয়াত সিজদার আয়াত। এ আয়াত যে পাঠ করে এবং শোনে, সবার ওপর তিলাওয়াতের সিজদা করা ওয়াজিব।
শিক্ষা এ সূরা থেকে শিক্ষা লাভ করা যায়- ১. আল্লাহ তা'আলা মহানবি (সা.)-এর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। ২. আল্লাহ তা'আলা মানুষকে কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। ৩. সম্পদের প্রাচুর্য মানুষকে আল্লাহ তা'আলার অবাধ্যতায় প্ররোচিত করে। ৪. আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে বাধা প্রদান করলে তার পরিণতি ভয়াবহ। ৫. আল্লাহ তা'আলা বান্দার প্রতি অসংখ্য অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। ৬. বেশি বেশি সিজদা করলে আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য লাভ করা যায়।
|
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন (বাড়ির কাজ) সূরা আলাকের শিক্ষা তোমার বাস্তব জীবনে চর্চা বা অনুশীলনের ক্ষেত্রগুলোর তালিকা প্রস্তুত করো। |
সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত |
কুরআন মাজিদের প্রতিটি সূরা ও আয়াত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্যাদাবান। তবে বিশেষ কিছু আয়াত ও সূরা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তার মধ্যে সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত অন্যতম। সূরা আল-হাশর পবিত্র কুরআনের ৫৯তম সূরা। এটি মদিনায় নাজিল হয়। আমরা এখন সূরা আল-হাশরের শেষ তিন আয়াত অর্থাৎ ২২, ২৩ ও ২৪তম আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা, ফযিলত সম্পর্কে জানব।
ফযিলত
সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াতের অনেক গুরুত্ব ও ফযিলত রয়েছে। এ আয়াতগুলোর মধ্যে মহান আল্লাহর কতিপয় মাহাত্ম্যপূর্ণ গুণবাচক নামের পরিচয় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এ তিন আয়াতের ফযিলত সম্পর্কে মহানবি (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলা তিন বার শিক্ষাবর্ষ ২০২৪
أَعُوذُ بِاللهِ السَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّحِيمِ
(উচ্চারণ: আউযু বিল্লাহিস সামিইল আলিমি মিনাশ শাইতানির রাজিম।) পাঠ করার পর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত তিলাওয়াত করবে, আল্লাহ তা'আলা তার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেবেন। যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত উক্ত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকবে। আর এ সময়ের মাঝে যদি লোকটি মারা যায়, তাহলে সে শহিদের মৃত্যু লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এভাবে পাঠ করবে, সে-ও এই ফযিলত লাভ করবে। (তিরমিযি)
অনুবাদ
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
| দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। |
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ
| ১. তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। |
عَلِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ | ২. তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাত। |
هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ
| ৩. তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। |
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ
| ৪. তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। |
الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلِّمُ | ৫. তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি। |
الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ | ৬. তিনিই নিরাপত্তাদানকারী, তিনিই রক্ষক। |
الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ
| ৭. তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমান্বিত। |
سُبْحَنَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ .
| ৮. তারা যা কিছু শরিক স্থির করে, আল্লাহ তা থেকে পবিত্র, মহান। |
هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ
| ৯. তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা। |
الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ
| ১০. উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদাতা |
لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
| ১১. তাঁর রয়েছে উত্তম নামসমূহ। |
يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ
| ১২. আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। |
وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
| ১৩. তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। |
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহে মহান আল্লাহর কিছু গুণবাচক নামের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এ সমস্ত গুণবাচক নামে মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও মাহাত্ম্যের বহিঃপ্রকাশ করা হয়েছে। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ বা মা'বুদ নেই। সৃষ্টির কাছে যা গোপন ও অজানা তিনি তা জানেন। আর যা তাদের কাছে প্রকাশ্য ও জানা, তিনি তা-ও জানেন। এই বিশ্ব- জাহানের কোনো বস্তুই তার জ্ঞানের বাইরে নয়। তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। তাঁর রহমত অসীম ও অফুরন্ত, সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত। বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসই তাঁর বদান্যতা ও অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আসমান-জমিন থেকে শুরু করে সৃষ্টির সকল কিছু তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন, যা ইচ্ছা করেন, তা-ই হয়। ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য একমাত্র তিনিই। আসমান-জমিনের সবই তাঁরই তাসবিহ পড়ে ও পবিত্রতা ঘোষণা করে। সুতরাং আমাদের কর্তব্য একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা। তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।
আল-হাদিস |
প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে হাদিস সর্ম্পকে জেনেছ। তোমরা সেখানে হাদিসের পরিচয়, প্রকারভেদ, গুরুত্ব ও বিশুদ্ধ ৬টি হাদিসগ্রন্থ সম্পর্কে জেনেছ। মানবিকতা ও নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কিত এবং মুনাজাতমূলক জীবনঘনিষ্ঠ নির্বাচিত কিছু হাদিস শিখেছ। তোমরা সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে হাদিস সম্পর্কে যা শিখেছ, নবম শ্রেণিতে তার সঙ্গে হাদিস, সুন্নাহ, আসার, হাদিসে কুদসি, মাতরুক, মাওযু হাদিসের পরিচয় ও হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারবে। পাশাপাশি নির্বাচিত কিছু হাদিসের শিক্ষা এবং মুনাজাতমূলক জীবনঘনিষ্ঠ হাদিস শিখে বাস্তব আমল করতে পারবে।
হাদিস
হাদিস ( حَدِيث )আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো কথা, বক্তৃতা, বাণী, বার্তা, সংবাদ, বিষয় ও খবর ইত্যাদি। সাধারণত রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর কথা, কাজ, অনুমোদন ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলে। নবি করিম (সা.) যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন, অথবা সমর্থন জানিয়েছেন, তাকে হাদিস বলা হয়।
সুন্নাহ ( السُّنَّة )
সুন্নাহ শব্দটি হাদিসের সমার্থক শব্দ। সুন্নাহ শব্দের অর্থ পথ, পদ্ধতি, কর্মের নীতি ও আদর্শ। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে পথ, পন্থা ও রীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করে চলতেন, তাকে সুন্নাহ বলা হয়। অন্য কথায় রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রচারিত আদর্শই সুন্নাহ। কুরআন মাজিদে উত্তম আদর্শ বলতে এই সুন্নাহকেই বুঝানো হয়েছে।
আসার (آثار )
আসার শব্দটির অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন ও বস্তুর অবশিষ্ট অংশ। আসার শব্দটিও কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর হাদিসকে নির্দেশ করে। কিন্তু অনেকেই হাদিস ও আসার এর মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে- সাহাবিগণ থেকে শরি'আত সম্পর্কে যা কিছু উদ্ধৃত হয়েছে, তাকে আসার বলে। কারো কারো মতে, সাহাবি ও তাবেয়িগণের কথা ও কাজ, সমর্থন ও অনুমোদনই হলো আসার।
হাদিসে কুদসি: যে হাদিসের মূল বক্তব্য আল্লাহ তা'আলা সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্ন বা ইলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন, তাকে হাদিসে কুদসি বলে। মাতরুক ( مَتْرُوْكْ ): মাতরুক শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিত্যক্ত, পরিত্যাজ্য ও বাতিল। যে রাবি সকল মুহাদ্দিসের নিকট দুর্বল, তার বর্ণিত হাদিসকে মাতরুক বলে। অন্য কথায় যে হাদিস কোনো দুর্বল রাবি একা বর্ণনা করেছেন তাই 'মাতরুক' বা পরিত্যক্ত। তার হাদিস 'মারদুদ' বা প্রত্যাখ্যাত।
মাওযু ( مَوْضُوعٌ ) বা জাল হাদিস: মাওযু শব্দের অর্থ জাল, মনগড়া, বানোয়াট, তৈরিকৃত, নির্মিত, মিথ্যা কথা রটনা এবং ভুলভাবে মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাণী বর্ণনা করা ইত্যাদি। মহানবি (সা.)-এর উপর বানোয়াট ও রচনাকৃত কথাকেই মাওযু হাদিস বলে। অন্য কথায় যে হাদিসের রাবি জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছেন বলে প্রমাণিত, তার বর্ণিত হাদিসকে মাওযু হাদিস বলে। মোটকথা মহানবি (সা.) এর নামে অসত্যভাবে যে কথা বলা হয়েছে, তা-ই জাল হাদিস।
মাওযু বা জাল হাদিসের হুকুম: জাল হাদিস যেহেতু হাদিস নয়, তাই জাল ও বানোয়াট জানার পরও উক্ত বক্তব্যটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর হাদিস বলে প্রচার করা হারাম। তবে মানুষকে জাল হাদিস চেনানোর জন্য তা বর্ণনা করা জায়েয।
হাদিসের গুরুত্ব
হাদিস মুসলমানদের এক অমূল্য সম্পদ। ইসলামি শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হাদিস। ইসলামি জীবন বিধানের অন্যতম মূলভিত্তি। কুরআন মাজিদের পরই হাদিসের স্থান। কুরআন মাজিদ যেখানে ইসলামি জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি পেশ করে, হাদিস সেখানে এ মূলনীতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে। কুরআন ইসলামের আলোকস্তম্ভ, হাদিস তাঁর বিচ্ছুরিত আলো। কুরআনে আল্লাহ তা'আলা এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য ওহি। হাদিস অপ্রকাশ্য ওহি। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কখনও মনগড়া কথা বলেননি। মহান আল্লাহর নির্দেশনা পেয়েই তিনি মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জানাতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى * إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
অর্থ: এবং তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)
হাদিসে কুরআনের নির্ভুল ব্যাখ্যার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন, কর্ম, ত্যাগ, আদর্শ, ধৈর্য, মানবপ্রেম, আল্লাহর ভয়, সত্যের পথে আপসহীনতা, বিশ্বস্ততা, সততা, নবুওয়াত, হেদায়াত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়।
আল কুরআনে 'সব কিছুর' বর্ণনা রয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই 'প্রাথমিক নির্দেশ'। ব্যাখ্যা ছাড়া যেগুলো পালন করা অসম্ভব। মহানবি (সা.) সংক্ষিপ্ত নির্দেশগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন: ইসলামের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত 'সালাত'। কুরআনের অনেক স্থানে সালাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কুরআনে সালাতের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। অর্থাৎ 'সালাত' কী, কখন তা আদায় করতে হবে, কখন কত রাকআত আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাকআত কী পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাকআতে কুরআন পাঠ কীভাবে হবে, রুকু কয়টি হবে, সিজদা কয়টি হবে, কীভাবে রুকু ও সিজদা আদায় করতে হবে। কোনো কিছুই কুরআনে শিক্ষা দেওয়া হয়নি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাতের বিস্তারিত পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلُوةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ
অর্থ: তোমরা সালাত আদায় করবে যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ। সালাতের সময় হলে তোমাদের মধ্যে একজন আযান দেবে। এরপর তোমাদের মধ্যে যে বয়সে বড় সে তোমাদের সালাতের ইমামতি করবে। (বুখারি)
অনুরূপভাবে কুরআনে যাকাত প্রদানের নির্দেশ এসেছে। কিন্তু যাকাত প্রদানের বিস্তারিত নির্দেশনা কুরআনে নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) এগুলোর নিয়ম-কানুন বিস্তারিতভাবে হাদিসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই কুরআনের মতো হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। মোটকথা একজন মুসলমানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্ত বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা আমরা রাসুলের হাদিসে পেয়ে থাকি। এ জন্য আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَمَا أَتْكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهُكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ: রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদের নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক। (সূরা হাশর, আয়াত : ৭)
আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করা একান্ত জরুরি। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর আনুগত্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন'। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মানব জাতির শিক্ষক ছিলেন। আমরা হাদিসের মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ জানতে পারি। তিনি কেমন ছিলেন, কীভাবে কুরআন লাভ করলেন, কীভাবে তা শিক্ষা দিলেন, কীভাবে সংকলন করলেন ইত্যাদি।
অতএব মানব জীবনে হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। হাদিস ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কুরআন বোঝা বা ইসলামি জীবন গঠন করা সম্ভব নয়। আবার হাদিসকে অস্বীকার করা কিংবা সন্দেহ পোষণ করা কুফরি। সুতরাং আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুবহু অনুকরণ করব। হাদিসের ভিত্তিতেই কুরআনের নির্দেশাবলি পালন করব। আর হাদিসের আলোকে জীবন গঠন করব।
মহানবি (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাদিস |
হাদিস-১: (সন্তানকে সালাতের নির্দেশ সম্পর্কিত হাদিস)
مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلُوةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِيْنَ
অর্থ: তোমরা তোমাদের সন্তানদের সালাতের জন্য নির্দেশ দাও, যখন তারা সাত বছরে পৌঁছে। (আবু দাউদ)
ব্যাখ্যা
এই হাদিসে সন্তানকে দ্বীন শিখানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিশুর জীবনের গতিপথ নির্ধারণে পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সন্তানকে আখিরাতের প্রস্তুতির শিক্ষা দেওয়া মাতাপিতার ওপর কর্তব্য। তাকে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনী শিক্ষা দিতে হবে। আদব-কায়দা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে হবে। তাছাড়া তাকে যদি ভালো কাজ শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে সে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যবান হবে। আর যদি তাকে মন্দ কাজে অভ্যস্ত করা হয়। অথবা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়। তাহলে সে হতভাগ্য ও ধ্বংস হবে।
ইমানের পর সালাতই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। পিতা-মাতার দায়িত্ব হলো শৈশব থেকে সন্তানকে সালাতে অভ্যস্ত করা। তাহলে সে ভবিষ্যতে সালাতের প্রতি যত্নবান হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাতকে মু'মিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্যকারী আখ্যা দিয়েছেন। শুধু সালাত আদায় নয়, বরং পরিবার ও সমাজে সালাত প্রতিষ্ঠার নির্দেশও দিয়েছে ইসলাম।
মা-বাবা ও অভিভাবককেও সালাতের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। কারণ, শিশুরা বড়দের দেখে শেখে। মা- বাবা সালাত আদায়ের সময় সন্তানকে পাশে রাখবে। যেন সন্তান তাদের অনুকরণ করতে পারে। শুধু উপদেশ বা ধারণা দেওয়াই যথেষ্ট নয়। মোটামুটি বুঝ-জ্ঞান হলে সন্তানকে মসজিদে নিতে হবে। সাত বছর বয়স হলে সন্তানকে হাতে-কলমে সালাত শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানের সামনে সালাতের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। সালাত না পড়ার কুফল ও শাস্তি বর্ণনা করতে হবে। সালাত সম্পর্কিত ঘটনা শোনাতে হবে। তাহলে শিশুরা সালাতে উৎসাহী হবে।
সন্তান ঠিকমতো সালাত পড়ছে কি না, সেদিকেও মা-বাবাকে লক্ষ রাখতে হবে। সালাতে অলসতা করলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সন্তান যেন সালাতের প্রতি যত্নবান হয়, সেজন্য মা-বাবা দোয়াও করবে। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তানকে উৎসাহের মাধ্যমে সালাতে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করবে। ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সন্তানকে সালাতের নির্দেশ দেবে। এরপরও তারা সালাতে অবহেলা করলে প্রয়োজনে শাসন করবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সন্তানদের নেককার ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার তাওফিক দান করুন।
শিক্ষা ১. মাতা-পিতার দায়িত্ব হলো সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষাসহ আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া। ২. মাতা-পিতা নিজে সালাতের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া। ৩. সন্তানকে ৭ বছর থেকে সালাতে অভ্যস্ত করা। শিশুকাল থেকে সালাতে অভ্যস্ত না হলে পরে সালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ৪. ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও সালাতে অবহেলা করলে শাসন করা। |
হাদিস-২ (বৃক্ষরোপণ সম্পর্কিত হাদিস)
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا فَيَأْكُلُ مِنْهُ إِنْسَانٌ أَوْ طَيْرٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلَّا كَانَتْ لَهُ صَدَقَةٌ
অর্থ: কোনো মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা ফসল আবাদ করে, এরপর তা থেকে মানুষ অথবা পাখি অথবা চতুষ্পদ প্রাণি খায়, তবে তা তার জন্য সাদকাহ হিসেবে গণ্য হবে। (তিরমিযি)
ব্যাখ্যা
এ হাদিসে মহানবি (সা.) বৃক্ষরোপণ ও ফসল উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। মানুষের জীবনযাত্রায় সবুজ বৃক্ষ ও ফসলের অবদান অপরিসীম। এর দ্বারা মানুষ বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। বেঁচে থাকার জন্য মানুষের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রয়োজন। বৃক্ষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে। বৃক্ষ থেকে আমরা খাদ্য, ওষুধ, পোশাক, কাঠ, ফল ইত্যাদি লাভ করি। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও বৃক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি, জলবায়ুর উষ্ণতা রোধ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য।
আবার বৃক্ষ আমাদের আর্থিক সচ্ছলতাও প্রদান করে। খাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধ পর্যন্ত সবকিছুই মানুষ বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন করে। মানুষ এসব করে নিজ প্রয়োজনে, নিজের জন্য। বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদের মাধ্যমে মানুষ যে সৃষ্টির সেরা, তা প্রমাণিত হয়ে যায়।
আমরা অনেকেই কৃষিকাজকে তুচ্ছ মনে করি। ছোট বলে ঘৃণা করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজই ছোট নয়। সৎভাবে করা সকল কাজই উত্তম। বৃক্ষরোপণেও কোনো লজ্জা নেই; বরং এটি অনেক সাওয়াবের কাজ।
বৃক্ষরোপণ বা ফসল ফলানো এমন একটি কাজ যা দ্বারা শুধু মানুষই নয় পশুপাখি এবং অন্যান্য প্রাণিও উপকৃত হয়। এ জন্য মহানবি (সা.) বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সাদকাহ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
শিক্ষা ১. মহানবি (সা.) আমাদেরকে বৃক্ষরোপণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। ২. সৃষ্ট জীবের উপকারের প্রত্যাশায় বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদ করা সাদকায়ে জারিয়া। যতদিন এগুলো বেঁচে থাকবে, ততদিন ব্যক্তির আমলনামায় সাওয়াব লিপিবদ্ধ হতে থাকবে। ৩. বৃক্ষরোপণ দ্বারা মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। পরিবেশ সংরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি আখিরাতেও প্রতিদান পাওয়া যায়। এ জন্য প্রত্যেকের উচিত বীজ বপন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিচর্যা করা। ৪. বৃক্ষরোপণ ও চাষাবাদ করা নবির সুন্নাত। ৫. মানুষের উৎপাদিত ফল-ফসলে পশু-পাখি এবং অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। ৬. পরিবেশ ও মানুষের জন্য ঔষধি বৃক্ষ বা ফলবান বৃক্ষ খুবই উপকারি। ৭. মু'মিনের কোনো তৎপরতাই বৃথা যায় না। ৮. অপরের উপকার করাই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
|
হাদিস-৩: (কাজের শুরুতে সংকল্প বা নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কিত হাদিস)
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ
অর্থ: প্রকৃতপক্ষে সকল কাজ (এর ফলাফল) নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। (বুখারি)
ব্যাখ্যা
ইসলামে বিশুদ্ধ নিয়তের গুরুত্ব অনেক বেশি। সালাত, সাওম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। নিয়তের বিশুদ্ধতা না থাকলে ভালো কাজও মূল্যহীন। আল্লাহর কাছে সেই কাজ গ্রহণযোগ্য হবে না। নিয়তে গরমিল থাকার কারণে ভালো কাজ করেও জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হবে।এই হাদিসটি সহিহ বুখারির সর্বপ্রথম হাদিস। এর তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে যা করে, সব কিছুই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। এ হাদিস দ্বারা কাজের উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। নিয়ত আরবি শব্দ। নিয়ত হচ্ছে মনের ঐকান্তিক ইচ্ছা বা সংকল্প। শরি'আতের পরিভাষায় খাঁটি নিয়ত হলো একনিষ্ঠতার সঙ্গে শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করা।
পরকালে মানুষের সকল কৃতকর্মের হিসাব হবে। সেদিন কে কোন নিয়তে কাজ করেছে, তার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হবে। মানুষ সৎ উদ্দেশ্যে কাজ করলে পুরস্কার পাবে। নেক নিয়তে কাজ করে ব্যর্থ হলেও পুরস্কার পাবে। আর মন্দ উদ্দেশ্যে কাজ করলে শাস্তি পাবে। যেমন যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সমাজসেবা করে, তাদের সমাজসেবাও হবে, আবার তারা আল্লাহর নিকট প্রতিদানও পাবে। আবার যারা লোক দেখানোর নিয়তে সমাজসেবা করে, তাদের শুধু সমাজসেবাই হবে। তারা আল্লাহর নিকট কোনো প্রতিদান পাবে না। কারণ, আল্লাহ তা'আলা মানুষের চেহারার দিকে না তাকিয়ে অন্তর দেখবেন। নিয়ত সঠিক না হলে ভালো কাজও মন্দ হিসেবে পরিগণিত হবে। লোক দেখানো কাজকে ইসলামের পরিভাষায় রিয়া বলে। রিয়া সম্পর্কে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ এক প্রেক্ষাপটে এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। আর তা হলো- উম্মে কায়স নামের একজন নারী ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন। তখন জনৈক ব্যক্তি তাঁকে বিয়ে করার জন্য মদিনায় হিজরত করে। ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্য জানতে পেরে রাসুলুল্লাহ (সা.) এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। যার মূল বক্তব্য হলো- আল্লাহ তা'আলার সন্তষ্টির জন্য হিজরত করা অত্যন্ত পুণ্যময় কাজ। আল্লাহর সন্তষ্টির নিয়ত না থাকায় লোকটি হিজরতের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হলো।
সুতরাং আমরা বিশুদ্ধ নিয়তে সকল কাজ করব। লোক দেখানো বা দুনিয়াবি লাভের আশায় কোনো কাজ করব না; বরং আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসুলের সন্তষ্টির জন্য কাজ করব।
শিক্ষা ১. আমাদের প্রতিটি কাজে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। ২. কর্মফল নিয়তের উপরই নির্ভশীল। নিয়ত ভালো হলে উত্তম প্রতিদান পাবে। আর নিয়ত খারাপ হলে ভালো কাজ করেও সাওয়াব পাবে না। ৩. আল্লাহ তা'আলা মানুষের বাহ্যিক আমলের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের অবস্থাও লক্ষ করেন। ৪. প্রচারণামূলক লোক দেখানো ইবাদাত বা কাজ পরিহার করা উচিত। ৫. মৃত্যুর পর সব কাজেরই হিসাব হবে। ৬. নিয়ত খারাপ হলে ভালো কাজ করেও পরকালে শাস্তি পেতে হবে।
|
হাদিস-৪ (রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা সম্পর্কিত হাদিস
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
অর্থ: তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু'মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয়পাত্র হব। (বুখারি)
ব্যাখ্যা
এ হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব নির্দেশ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকৃত মু'মিন হওয়ার শর্ত। নবি (সা.)- এর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা ছাড়া তাঁর আদর্শ সমাজে বাস্তবায়ন অসম্ভব।
ইমানের দাবি হলো, সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকেই প্রাধান্য দেওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণে নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দেওয়া। এভাবে নবি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা।
অতএব মু'মিনদেরকে সকল ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসার প্রমাণ দিতে হবে। বলতে হবে আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা এবং আনুগত্য।
শিক্ষা
১. প্রকৃত ইমানের দাবি হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা।
২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে। ৩. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন সম্ভব নয়।
৪. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা হলো সমাজ জীবনে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ বাস্তবায়ন করা।
৫. মহানবি (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা হবে আকিদা, বিশ্বাস, জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকজনিত।
৬. ইসলামি আদর্শ ও বিশ্বাসের পরিপন্থী সকল প্রিয়জনকে উপেক্ষা করে মহানবি (সা.)- কে ভালোবাসতে হবে।
হাদিস- ৫ (মু'মিনের ওপর অপর মু'মিনের দায়িত্ব সম্পর্কিত হাদিস)
لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ
অর্থ : এক মু'মিনের ওপর আরেক মু'মিনের ছয়টি হক রয়েছে। সে অসুস্থ হলে তাকে সেবা করবে, মারা গেলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে, তাকে ডাক দিলে সে সাড়া দেবে, তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে সালাম দেবে, সে হাঁচি দিলে তার জবাব দেবে এবং তার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সব সময় তার কল্যাণ কামনা করবে। (তিরমিযি)
ব্যাখ্যা
ইসলামে রয়েছে অধিকার ও কর্তব্যের সুন্দর সমন্বয়। সবাইকে দেওয়া হয়েছে তার প্রাপ্য অধিকার। ইসলামে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অন্যের হকের ওপর। আর মু'মিনরা পরস্পর ভাই ভাই। এক মুসলমান ভাইয়ের ওপর অন্য মুসলমান ভাইয়ের ছয়টি হক রয়েছে। হকগুলো হলো:
একজন মু'মিন অসুস্থ হলে তার খোঁজখবর নেওয়া, সেবা-শুশ্রুষা করা, তাকে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা করা, তার সুস্থতার জন্য দোয়া করা ইত্যাদি অন্য মু'মিনের নৈতিক দায়িত্ব। এটি আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধনী-গরিব, পরিচিত-অপরিচিত সকল মু'মিনের জন্য। কেননা, রোগীর সেবা করার মাঝেই আল্লাহর সেবা নিহিত।
এছাড়া কোনো মু'মিন মারা গেলে তার জানাযায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এটা শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়; বরং তা ঈমানের অঙ্গও বটে। জানাযায় অংশগ্রহণ ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ কাজ।
মু'মিনের ডাকে যথাসাধ্য সাড়া দিতে হবে। বিশেষ করে একজন মু'মিন যখন কোনো ভালো কাজে ডাকবে, অথবা কোনো বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ডাকবে, অথবা খাওয়ানোর জন্য ডাকবে, তখন তার ডাকে সাড়া দেওয়া অন্য মু'মিনের কর্তব্য।
ইসলামে আদব বা সামাজিক শিষ্টাচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম হলো সালাম বিনিময় করা। সালাম আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সম্ভাষণ। তিনি জান্নাতিদের লক্ষ করে সালাম দেবেন। সালাম অত্যন্ত সহজ ও অন্যের জন্য কল্যাণ কামনামূলক একটি সম্ভাষণ। কারো ঘরে প্রবেশের পূর্বে, মজলিসে আগমন করলে উপস্থিত লোকদের, ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবাইকে সালাম দিতে হবে। তাছাড়া যে আগে সালাম দেবে সেই আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।
কোনো মু'মিন যদি হাঁচি দিয়ে 'আলহামদুলিল্লাহ' (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর) বলে, তাহলে শ্রোতা তার উত্তরে 'ইয়ারহামুকাল্লাহ' (আল্লাহ তোমার উপর অনুগ্রহ করুক) বলবে। এ উত্তর শোনার পর হাঁচি দাতা 'ইয়াহদিকুমুল্লাহু' (আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন) বলবে। হাঁচিদাতা হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ না বললে জবাব দেওয়া লাগবে না। হাঁচির আদব হলো, হাঁচি দেওয়ার সময় হাত অথবা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা এবং যথাসম্ভব শব্দ কম করা।
মু'মিনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে তার কল্যাণ কামনা করতে হবে। অনুপস্থিতিতে কল্যাণ কামনার অর্থ হলো, তার অনুপস্থিতিতে তার সম্পদ নষ্ট না করা এবং নষ্ট হতে দেখলে তা হেফাজত করা। উপস্থিতিতে কল্যাণ কামনার অর্থ হলো, তাকে সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করা, তার প্রতি যুলুম না করা, তাকে যুলুম করতে না দেওয়া, তাকে ধোঁকা না দেওয়া, ধোঁকায় পড়ার আশংকা থাকলে তাকে সচেতন করা, তার সঙ্গে বিভেদ না করা ইত্যাদি।
এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের আরো কিছু দায়িত্ব হলো, তাকে সাহায্য করা, তার দোষ গোপন রাখা, তার ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করা, তার সম্পর্কে মনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ পুষে না রাখা ইত্যাদি।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তিকে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে অপর মুসলিম ভাইয়ের হকগুলোকে যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন।
শিক্ষা ১. অসুস্থতার সময় একজন মু'মিন অপর মু'মিনের পাশে থেকে সেবা ও সহায়তা করবে। ২. মু'মিনের জানাযায় অংশগ্রহণ করবে। তার পরিবার-পরিজনকে সান্ত্বনা দেবে। তার দাফনের কাজ শেষ করবে। ৩. বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় তার দাওয়াতে সাড়া দেবে। ৪. পরিচিত অপরিচিত সকল মু'মিনের মাঝে সালামের প্রচলন করবে। ৫. হাঁচি দেওয়ার পর তার জন্য দোয়া করবে। ৬. মু'মিনের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবে না; বরং সার্বিকভাবে তার কল্যাণ কামনা করবে।
|
হাদিস-৬ (মৃত্যু পরবর্তী আমল সম্পর্কিত হাদিস)
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ : إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
অর্থ: যখন কোনো লোক মারা যায়, তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তিন প্রকার আমল ব্যতীত। সাদকাহ জারিয়া (চলমান দান); ঐ ইলম, যা দ্বারা অন্য লোক উপকৃত হয়; আর নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে। (মুসলিম)
ব্যাখ্যা
পৃথিবীতে মানুষের সব কর্মতৎপরতা সংরক্ষণ করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এসব কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। প্রিয় নবি (সা.) আলোচ্য হাদিসে এ তিনটি আমলের কথা উল্লেখ করেছেন। আমল তিনটি হলো
এমন দান, যাতে মানুষ ও প্রাণিজগৎ সর্বদা উপকৃত হয়। এ দানের সাওয়াব চলমান। যেমন: মসজিদ, মাদ্রাসা, ইয়াতিমখানা, সরাইখানা, হাসপাতাল, পুল নির্মাণ, গাছ লাগানো, দীর্ঘস্থায়ী অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজ ইত্যাদি।
এমন জ্ঞান, যাতে মানুষ উপকৃত হয়। যেমন: ইসলামি ও জনকল্যাণমূলক বই-পুস্তক রচনা করা, জনকল্যাণমুখী আবিষ্কার, আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ ছাত্র তৈরি করে যাওয়া, যারা অন্যদের জ্ঞান বিতরণ করতে থাকবে, এমন আদর্শ রেখে যাওয়া যা চিরকাল মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগাতে থাকবে ইত্যাদি।
অনুরূপ সুশিক্ষিত ও আদর্শ সন্তান রেখে গেলে সন্তানের সৎকর্ম দ্বারা মাতা-পিতা উপকৃত হতে থাকবে। সন্তান যত দিন নেক কাজ করবে, মাতা-পিতা ততদিন তা থেকে সাওয়াব পেতে থাকবে। সন্তান মাতা-পিতার জন্য দোয়া করতে থাকবে। নেক সন্তান বলবে, হে আল্লাহ মাতা-পিতা আমার প্রতি দয়া ও সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন, আমার শৈশবকালে আদর-যত্ন দিয়ে লালন-পালন করেছিলেন, তুমি তাঁদের প্রতি অনুরূপ দয়া ও অনুগ্রহ করো।
অতএব যারা চলমান জনকল্যাণমূলক কাজ করবে, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান রেখে যাবে, তারা মৃত্যুর পরও সাওয়াব পেতে থাকবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের এ ধরনের কাজ করার তাওফিক দান করুন।
শিক্ষা ১. মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আমলের পথ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সাদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান মানুষের জন্য সাওয়াব পাঠাতে পারে। ২. সাধারণ দানের পাশাপাশি সাদকায়ে জারিয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কল্যাণমূলক কাজ হলো সর্বোত্তম ইবাদাত। ৩. আমাদের যথাসম্ভব স্থায়ী কল্যাণমূলক ও সংস্কারমূলক কাজে অর্থ ও মেধা ব্যয় করা উচিত। তাহলে মৃত্যুর পরও ভালো কাজে অংশগ্রহণের ধারা অব্যাহত থাকবে। ৪. মাতা-পিতার দায়িত্ব হলো সন্তানকে সৎ ও আদর্শবান মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সন্তানের কর্তব্য হলো মাতা-পিতার আনুগত্য করা। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য দোয়া করা। ৫. মু'মিনের সকল কাজের মূল লক্ষ্য হবে আখিরাতের সফলতা।
|
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন 'কুরআন-হাদিসের যে শিক্ষায় আমার জীবন আলোকিত করব' (উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে কুরআন-হাদিসের শিক্ষা তোমার বাস্তব জীবন কীভাবে আলোকিত বা উদ্ভাসিত করবে ৩০০ শব্দের মধ্যে লিখে আনবে।) |
মুনাজাতমূলক দুটি হাদিস |
বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। তিনি আমাদের প্রতিপালক। পরম দয়ালু ও দাতা। তাঁর নিকট রয়েছে অফুরন্ত নিয়ামত। আমরা আল্লাহ তা'আলার নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ চাইব। আমরা ডাকলে তিনি সাড়া দিবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে আল্লাহর নিকট চাওয়ার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। মহানবি (সা.)-এর বহু মুনাজাতমূলক হাদিস রয়েছে। আমরা এখানে মোনাজাতমূলক দুটি হাদিস শিখব।
হাদিস- ১
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاقِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَهْوَاءِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আ'উজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাকি ওয়াল আ'মালি ওয়াল আহওয়া।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট গর্হিত চরিত্র, গর্হিত কাজ ও কুপ্রবৃত্তি হতে আশ্রয় চাই। (তিরমিযি)
হাদিস- ২
২ اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالسَّدَادَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল হুদা ওয়াস্ সাদা-দা।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট হেদায়াত ও সরলপথ প্রার্থনা করছি। (মুসলিম)
উপরিউক্ত হাদিস দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুনাজাতমূলক হাদিস। প্রথম হাদিসে গর্হিত চরিত্র, গর্হিত কাজ ও কুপ্রবৃত্তি হতে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় হাদিসে হেদায়াত ও সরলপথ প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রার্থনা শিখানো হয়েছে। আমরা অর্থসহ হাদিস দুটি শিখব। হাদিস দুটির মাধ্যমে আল্লাহর নিয়ামত প্রার্থনা করব। তাহলে আল্লাহ তা'আলা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ দান করবেন।
শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াতের আসর এ অধ্যায়ের পূর্ববর্তী সেশনগুলোর আলোকে তোমরা শুদ্ধভাবে কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করো।
|
আরও দেখুন...