আদর্শ জীবনচরিত

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

মহান আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহর বিধিনিষেধ মান্য করা। আর এসব বিধিনিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করার জন্য অবশ্যই একটি অনুসরণীয় নীতিমালা প্রয়োজন । যাকে আমরা আদর্শ বলতে পারি। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আগত নবিগণের জীবনচরিত আমাদের আদর্শ। এর মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবনচরিত হলো সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। এমনিভাবে যাঁরা নবি ও রাসুলগণের জীবনী অনুকরণ করে ধন্য হয়েছেন তাঁদের জীবনের ভালো দিকগুলোকেও আমরা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করব।

এ অধ্যায় শেষে আমরা-
■ আদর্শ জীবনচরিতের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারব ।
■ হযরত সুলায়মান (আ.), হযরত মুসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) এর জীবনচরিত বর্ণনা করতে পারব এবং তাঁদের গুণাবলি বাস্তব ■ জীবনে প্রতিফলনে আগ্রহী হব।
■ হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপট, মক্কা বিজয়, উদারতা, মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন, বিদায় হজের ভাষণ ও আদর্শ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে পারব এবং মহানবি (স.) এর আদর্শ বাস্তব জীবনে প্রতিফলনে উৎসাহী হব।
■ হযরত আয়েশা (রা.)-এর পরিচয়, শিক্ষাজীবন, ইফকের ঘটনা, শিক্ষায় অবদান, শিক্ষকতা, গুণাবলি ও মর্যাদা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে পারব এবং বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হব।
■ হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (র.) ও হযরত রাবেয়া বসরি (র.)-এর জীবনচরিত বর্ণনা করতে পারব ও অনুসরণে আগ্রহী হব।
■ বাস্তব জীবনে মনীষীগণের গুণাবলি অনুসরণ করে আদর্শ জীবন গঠনে উদ্বুদ্ধ হব।
■ দলগতকাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারব এবং সামগ্রিকভাবে নেতৃত্ব প্রদানে আগ্রহী হতে পারব।

Content added || updated By

পরিচয়
হযরত সুলায়মান (আ.) আল্লাহর প্রসিদ্ধ নবি ছিলেন । তিনি হযরত দাউদ (আ.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র । তিনি আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭৫-৯৭০ এর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন । যে চারজন বাদশাহ সমস্ত পৃথিবীর শাসক ছিলেন হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁদের একজন । তিনি পরিণত বয়সে উপনীত হওয়ার পর তাঁর পিতা হযরত দাউদ (আ.) ইন্তিকাল করেন । এরপর আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলায়মান (আ.)-কে নবি হিসেবে হযরত দাউদ (আ.) -এর স্থলাভিষিক্ত করেন এবং সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব দান করেন ।

অলৌকিক ক্ষমতা লাভ
নবি হিসেবে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর বিশেষ মর্যাদা ছিল। আল্লাহ তাঁকে পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, জীব-জন্তু ও জিন-ইনসানের ভাষা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছিলেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“সে (সুলায়মান) বলল : হে মানুষ! আমাকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাকে সবকিছু (জ্ঞান) দেওয়া হয়েছে । নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট অনুগ্রহ। (সূরা আন-নামল, আয়াত ১৬)

তিনি ছিলেন সুবিশাল রাজ্যের রাজা । শাসনকার্য সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে সম্পাদন করার জন্য তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেতেন । খুব দ্রুত যাতায়াত করার জন্য মহান আল্লাহ তাঁকে বাতাসে ভর করে চলাচল করার ক্ষমতা দান করেছিলেন। বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তাঁর যখন যে স্থানে যাওয়ার প্রয়োজন হতো তিনি বাতাসকে আদেশ করলে বাতাস তাঁকে তাঁর বিশাল সিংহাসন ও লোকবলসহ মুহূর্তে সে স্থানে পৌঁছে দিত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

অর্থ : “আমি বায়ুকে সুলায়মানের অধীন করেছিলাম। সে সকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত ও সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করত । (সূরা সাবা, আয়াত ১২)

আল্লাহ তায়ালা জিনদের মধ্য হতে একদলকে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর অধীন করে দিলেন । তারা হযরত সুলায়মানের জন্য সমুদ্র হতে মুক্তা সংগ্রহ করে আনত । এ ছাড়া অন্যান্য কাজও করত। যেমন, সু-উচ্চ প্রাসাদ, চৌবাচ্চার ন্যায় বড় পেয়ালা ইত্যাদি নির্মাণ করত । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

অর্থ : (আমি অনুগত করে দিলাম) শয়তানদের, যারা সকলেই ছিল প্রাসাদনির্মাণকারী ও ডুবুরি।” (সূরা সাদ, আয়াত ৩৭)

তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যে গোয়েন্দার কাজ করতে আল্লাহ পাক তাঁকে 'হুদহুদ' নামক একটি পাখি দিয়েছিলেন। সে পাখিটি তাঁকে রানি বিলকিস ও তার রাজত্বের সংবাদ দিয়েছে। এ সবই তাঁর অলৌকিক শক্তির নিদর্শন।

বিচার শক্তি
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ধী-শক্তি ছিল খুবই প্রখর। আল্লাহ তায়ালা তাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি খুব বুদ্ধিমান ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন।

একদা দুজন নারী একটি শিশুর মাতৃত্ব দাবি করল। এর মীমাংসা করার জন্য তারা হযরত দাউদ (আ.)-এর নিকট এলো। সেখানে হযরত সুলায়মান (আ.)ও উপস্থিত ছিলেন। হযরত সুলায়মান (আ.) বললেন শিশু হলো একটি অথচ দাবিদার দুজন। তাহলে শিশুটি কেটে দুভাগ করে দুজনকে দিয়ে দেওয়া হোক । একথা বলে হযরত সুলায়মান (আ.) একটি ছুরি হাতে নিলেন। শিশুটিকে মাটিতে শুইয়ে দু'ভাগ করার জন্য উদ্যত হলেন । তখনই একজন নারী কাঁদতে কাঁদতে বললেন । আল্লাহর দোহাই! শিশুটিকে কাটবেন না আমি আমার দাবি ত্যাগ করলাম । শিশুটিকে জীবিত রাখুন এবং তাকে অপরজনের নিকট দিয়ে দিন। হযরত সুলায়মান (আ.) বুঝলেন এ নারীই শিশুটির প্রকৃত মাতা । তখন তিনি তাকে শিশুটি দিয়ে দিলেন এবং অন্যজনকে মিথ্যা বলার দায়ে শাস্তি দিলেন।

বালক বয়সে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর আরও একটি ঘটনা হলো- একদা দুজন লোক হযরত দাউদ (আ.)- এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বিচারপ্রার্থী হলো। তাদের একজন ছিল রাখাল অপরজন কৃষক। কৃষক তথা শস্যক্ষেতের মালিক ছাগল রাখালের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, রাখালের ছাগল রাতে ছাড়া পেয়ে তার সমস্ত ফসল বিনষ্ট করে ফেলেছে। সত্যতা যাচাই করার পর হযরত দাউদ (আ.) রায় দিলেন যে, ছাগলের মালিক তার সমস্ত ছাগল শস্যক্ষেতের মালিককে অর্পণ করুক। মামলার বাদী-বিবাদী উভয়ে রায় শুনে দরবার হতে যাওয়ার পথে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর সাথে দেখা হলে তিনি সব শুনে বললেন-আমি রায় দিলে তা ভিন্ন হতো, উভয় পক্ষের উপকার হতো। হযরত সুলায়মান (আ.) তাঁর পিতার নিকট তা ব্যক্ত করার পর তাঁর পিতা বললেন এর চাইতে উত্তম রায় কী হতে পারে? হযরত সুলায়মান (আ.) বললেন আপনি সমস্ত ছাগল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিন। সে এগুলোর দুধ, পশম দ্বারা উপকৃত হোক। আর শস্যক্ষেত ছাগলের মালিকের নিকট অর্পণ করুন। সে তাতে চাষাবাদ করে শস্য উৎপাদন করবে। যখন শস্যক্ষেত ছাগলে বিনষ্ট করার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে তখন তা তার মালিককে বুঝিয়ে দেবে। হযরত দাউদ (আ.) এ রায় পছন্দ করলেন এবং তা কার্যকর করতে বললেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“এবং আমি সুলায়মানকে এ বিষয়ের মীমাংসা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান ।” (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত ৭৯)

বাইতুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণ
হযরত সুলায়মান (আ.)-এর পিতা হযরত দাউদ (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণের কাজ সমাপ্ত করার আগে ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের আগে তিনি দোয়া করেছিলেন যে, হে আল্লাহ! আমার সন্তানের দ্বারা তা নির্মাণ করাও। আল্লাহ তায়ালা তাঁর দোয়া কবুল করলেন। জেরুজালেমের ক্ষমতা গ্রহণ করে হযরত সুলায়মান (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। এ মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের ৭ বছর সময় লেগেছিল বলে কথিত আছে। মূলত জিন জাতিরাই এ মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেছিল।

রাজত্বকাল ও ইন্তিকাল
হযরত সুলায়মান (আ.) ৪০ বছর নবুয়তি দায়িত্ব পালন করেন এবং সমগ্র বিশ্বের রাজত্ব করেন । তার শাসনকাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৯৬০-৯২০ সাল পর্যন্ত । তাঁর ইন্তিকালের ঘটনা বিস্ময়কর। বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ছিল অবাধ্য একদল জিন। তারা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর ভয়ে কাজ করত । কিন্তু তাঁর ইন্তিকালের আগে বাইতুল মুকাদ্দাসের কাজ শেষ হবে না আর তাঁর ইন্তিকালের সংবাদ জানলে জিনরাও কাজ করবে না । ফলে বাইতুল মুকাদ্দাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে । তাই হযরত সুলায়মান (আ.) উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে আল্লাহর নির্দেশে ব্যবস্থা নিলেন যে, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে তাঁর স্বচ্ছ কাঁচের নির্মিত মেহরাবে (বিশেষ কক্ষে) প্রবেশ করলেন। তিনি নিয়ম অনুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। যথাসময়ে তাঁর আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে গেল । কিন্তু লাঠির উপর ভর করে তাঁর দেহ অনড় থাকায় বাইরে থেকে মনে হতো তিনি ইবাদতরত আছেন । জিনেরা তাঁকে জীবিত মনে করে দিনের পর দিন কাজ করতে থাকে। এমতাবস্থায় এক বছর অতিক্রান্ত হয়। এর মাঝে বাইতুল মুকাদ্দাসের কাজও সমাপ্ত হয়। অন্য দিকে আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত সুলায়মান (আ.)-এর লাঠি উঁই পোকায় খেয়ে ফেলে।

লাঠি পড়ে গেলে হযরত সুলায়মান (আ.)-এর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে । তখন সবাই জানতে পারল যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছে । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর। আল্লাহর বাণী-

“যখন আমি তার (সুলায়মানের) মৃত্যু ঘটালাম তখন জিনদিগকে তার মৃত্যুর বিষয়ে জানাল কেবল মাটির পোকা, যা তার লাঠি খেয়েছিল । (সূরা আল-সাবা, আয়াত ১৪)

তাঁকে জেরুজালেমের কুব্বাতুস্সাখারে দাফন করা হয়। জ্ঞানবুদ্ধির আলোকে মানবিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় যে উদাহরণ হযরত সুলায়মান (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়।

কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত সুলায়মান (আ.)-এর একটি সূক্ষ্ম বিচার সম্পর্কে অনুচ্ছেদ লিখে শিক্ষককে দেখাবে।
Content added || updated By

আগমন বার্তা
প্রাচীনকালে মিসরীয় বাদশাহদের ‘ফিরআউন' বলা হতো। হযরত মুসা (আ.)-এর সমসাময়িক ফিরআউনের নাম ছিল ওয়ালিদ ইবনে মুসআব । তাঁকে ‘দ্বিতীয় রামসিস' (Ramses II)ও বলা হয় । ফিরআউন স্বপ্নে দেখে যে, ‘বাইতুল মুকাদ্দাস' থেকে এক ঝলক আগুন এসে মিসরকে গ্রাস করে ফেলেছে এবং তার অনুসারী ‘কিবতি' সম্প্রদায়কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনি ইসরাইলদের কোনো ক্ষতি করছে না। ফিরআউন তার রাজ্যের সকল স্বপ্নবিশারদ থেকে একসাথে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চায়। তারা বলল, ইসরাইল বংশে এমন এক পুত্রসন্তানের আগমন হবে যে আপনাকে ও আপনার রাজত্বকে ধবংস করে দেবে। স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুনে ফিরআউন ভীষণ উত্তেজিত হলো এবং দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল । ফিরআউন সেনাবাহিনীকে আদেশ দিল যে, বনি ইসরাইল গোত্রে কোনো পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে যেন হত্যা করা হয়। এভাবে অসংখ্য ইসরাইলি পুত্রসন্তান ফিরআউনের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়।

জন্ম
এমন দুঃসময়ে মৃত্যু পরওয়ানা কাঁধে নিয়ে হযরত মুসা (আ.) জন্মগ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মহিমায় ফিরআউনের সৈন্যবাহিনী এ সংবাদ জানতে পারল না। অপরদিকে হযরত মুসা (আ.)- এর জননী খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহর ইশারায় হযরত মুসা (আ.)-কে তাঁর মাতা সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর কী মহিমা! সিন্দুকটি ভাসতে ভাসতে ফিরআউনের রাজ প্রাসাদের ঘাটে গিয়ে ভিড়ল। ফিরআউনের স্ত্রী হযরত আসিয়া (আ.) সিন্দুকটি খুললেন। ফুটফুটে একটি সুন্দর শিশু দেখে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। নিঃসন্তান হযরত আসিয়া (আ.) শিশুটি লালন-পালন করতে লাগলেন। শিশু মুসা অন্য কারো দুধ পান না করায় তাঁর মাকেই ধাত্রী নিয়োগ করা হলো। মহান আল্লাহর কুদরতে মুসা (আ.)

তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানেই ফিরআউনের ঘরে লালিত-পালিত হতে লাগলেন। আল্লাহ বলেন-

“তখন আমি তোমাকে (মুসা-কে) তোমার মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিলাম যাতে তার চক্ষু শীতল হয় এবং সে দুঃখ না পায় ।” (সূরা তা-হা, আয়াত ৪0)

শিশুকালে ফিরআউন একবার মুসা (আ.)-কে কোলে তুলে নেয়। তখন শিশু মুসা (আ.) ফিরআউনের দাড়ি ধরে তার মুখে চড় মারেন। এতে ফিরআউন রাগান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করতে চাইল এবং বলল এই সেই শিশু যে আমার রাজত্ব ধ্বংস করবে। তখন হযরত আসিয়া (আ.) এক ভয়ংকর অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে শিশু মুসাকে ফিরআউনের রোষানল থেকে রক্ষা করেন। তখন অগ্নি মুখে নেওয়ায় তার মুখে জড়তা তৈরি হয়।

মাদইয়ানে হিজরত
একদা হযরত মুসা (আ.) দেখতে পেলেন একজন কিবতি জনৈক ইসরাইলিকে অত্যাচার করছে। তিনি অত্যাচারিত লোকটিকে বাঁচানোর জন্য অত্যাচারী কিবতি লোকটিকে একটি ঘুষি মারলেন। এতে লোকটি মারা যায় । হযরত মুসা (আ.) হতবাক হয়ে যান এবং ফিরআউনের ভয়ে মিসর ত্যাগ করে মাদইয়ানে হিজরত করেন। সেখানে হযরত শুয়াইব (আ.)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত মুসা (আ.) তাঁর সান্নিধ্যে দশ বছর অতিবাহিত করেন। হযরত শুয়াইব (আ.) তাঁর কর্মদক্ষতা, চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা সফুরাকে তাঁর সাথে বিবাহ দেন।

নবুয়ত লাভ
মাদইয়ানে কিছুকাল অবস্থানের পর মুসা (আ.) তাঁর পরিবারসহ মিসরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তুর পাহাড়ের পাদদেশে আসার পর সন্ধ্যা হয়ে যায়। রাত্রি যাপনের জন্য তিনি পাহাড়ের নিকটে 'তুয়া' নামক পবিত্র উপত্যকায় তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখানে নবুয়ত প্রাপ্ত হন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“আমি তোমাকে মনোনীত করেছি, অতএব, যা প্রত্যাদেশ হয় তা শুনতে থাকো।” (সূরা তা-হাঃ ১৩) আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে সরাসরি ও ফেরেশতাদের মাধ্যমে কথাবার্তা বলতেন। আর এ কারণে তাঁকে ‘কালিমুল্লাহ' বলা হতো।

দীনের দাওয়াত
নবুয়ত লাভের পর হযরত মুসা (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে দীন প্রচারের জন্য আদিষ্ট হন। যেহেতু তাঁর মুখে জড়তা ছিল তাই তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে আল্লাহ হযরত হারুন (আ.)-কে নবুয়ত দান করেন এবং তাকে মুসা (আ.)-এর সহযোগী করে দেন। হযরত মুসা (আ.) হযরত হারুন (আ.)-কে নিয়ে ফিরআউনের কাছে যান এবং দীনের দাওয়াত দেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“ফিরআউনের নিকট যাও নিশ্চয়ই সে সীমা লঙ্ঘন করেছে। অতঃপর বলো, তোমার পবিত্র হওয়ার আগ্রহ আছে কি? আর আমি কি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের পথ দেখাব ? যাতে তুমি তাকে ভয় করো।” (সূরা আন্-নাযিয়াত, আয়াত ১৭-১৯)

হযরত মুসা (আ.) ফিরআউনকে তাঁর মু'জিযাগুলো দেখালেন এবং তাকে আল্লাহর প্রতি ইমান আনার কথা বললেন। ফিরআউন এতে কর্ণপাত করল না। উপরন্তু সে হযরত মুসা (আ.)-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল।

সত্যের জয় মিথ্যার ক্ষয়
হযরত মুসা (আ.) ফিরআউনের ষড়যন্ত্র বুঝে ফেললেন । তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। ফিরআউন হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর দলবলের মিসর ত্যাগের খবর শুনে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁদের পিছে ছুটল। হযরত মুসা (আ.) তাঁর দলবল নিয়ে নীল নদের তীরে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অন্যদিকে ফিরআউন তার সৈন্যবাহিনীসহ তাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এলো । তখন মুসা (আ.)-এর অনুসারীরা ভয় পেয়ে গেল। মুসা (আ.) তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, নিশ্চয় আমার রব আমাদেরকে পথ দেখাবেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত মুসা (আ.) তাঁর লাঠি দ্বারা নদীতে আঘাত করলেন। নদীর পানিতে রাস্তা তৈরি হলো। বনি ইসরাইলের ১২টি দলের জন্য ১২টি পথ হয়ে গেল। হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা নিরাপদে নদী অতিক্রম করলেন। ফিরআউন ও তার সৈন্যবাহিনী হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের নদী পার হতে দেখে তাঁদের অনুসরণ করল। যখন তারা নদীর মাঝখানে পৌঁছল তখনি রাস্তা নদীর পানিতে মিশে গেল। ফলে ফিরআউন তার দলবলসহ ডুবে মরল। আল্লাহর নবিকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেরাই ধ্বংস হলো। আর এভাবে সত্যের জয় হলো।

তাওরাত লাভ
আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা (আ.)-কে তাওরাত কিতাব দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। তিনি আল্লাহর আদেশে তাওরাত কিতাব আনতে তুর পাহাড়ে গেলেন। সেখানে ত্রিশ দিন থাকার ইচ্ছা করলেন কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আর দশ দিন বেশি অবস্থান করলেন। তুর পাহাড়ে হযরত মুসা (আ.) রোযা, ইতিকাফ ও কঠোর সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি তুর পাহাড়ে থাকাকালীন সময়ে তাঁর ভাই হযরত হারুন (আ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এমতাবস্থায় তাঁর অনুসারীদের অনেকেই 'সামেরি' নামক এক ব্যক্তির ধোঁকায় পড়ে গো-বৎস পূজা শুরু করে। হযরত মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব নিয়ে এসে তাদের এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হলেন। তখন তাওবা হিসেবে গো-বৎস পূজারিদের একে অপরকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হলো। যার ফলে সত্তর হাজার বনি ইসরাইল নিহত হয়।

হযরত মুসা (আ.) ও হযরত হারুন (আ.) আল্লাহর নিকট খুব কান্নাকাটি করেন। অবশেষে আল্লাহ তাদের মাফ করে দেন।

হযরত মুসা (আ.) ১২০ বছর বয়সে সিনাই উপত্যকায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে তুর পাহাড়ের পাদদেশে সমাহিত করা হয়। আমরা হযরত মুসা (আ.) এর মতো নির্ভীক হয়ে সত্যের পথে মানুষকে ডাকব। সৎ ও ন্যায়ের পথ অনুসরণের মধ্যেই জীবনের সাফল্য নিহিত।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে হযরত মুসা (আ.)-এর মুজিযার একটি তালিকা তৈরি করে শিক্ষককে দেখাবে।
Content added By

পরিচয়
মানুষের মুক্তির পয়গাম নিয়ে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে যেসব নবি ও রাসুল আগমন করেছেন হযরত ঈসা (আ.) তাদের অন্যতম। ফিলিস্তিনের ‘বাইত লাহম' (বেথেলহাম) নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মারিয়াম বিনতে হান্না বিনতে ফাখুজ। হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর হুকুমে পিতা ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম সাল হতেই খ্রিষ্টাব্দ গণনা করা হয়। পবিত্র কুরআনে তাঁকে ‘মাসিহ ইবনে মারিয়াম' কালিমাতুল্লাহ ও রুহুল্লাহ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর উপর আসমানি কিতাব ইঞ্জিল নাজিল হয়েছে।

মু'জিযা
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মু'জিযা (অলৌকিক ক্ষমতা) দান করেন। তিনি দোলনায় থাকাবস্থায় বাক শক্তি লাভ করেন। আল্লাহ তায়ালা মু'জিযা হিসাবে তাঁকে মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে চক্ষুদান করা, শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য করার শক্তি দান করেছিলেন। তিনি আল্লাহর হুকুমে মাটির তৈরি পাখিতে ফুৎকার দিয়ে জ্যান্ত বানিয়ে ফেলতেন। আল্লাহ বলেন-

“আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা একটি পাখির আকৃতি তৈরি করব। অতঃপর তাতে ফুৎকার দেব। ফলে আল্লাহর হুকুমে সেটি পাখি হয়ে যাবে। আমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করব এবং আল্লাহর হুকুমে মৃতকে জীবিত করব।” (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ৪৯)

হত্যার ষড়যন্ত্র
হযরত ঈসা (আ.) ইহুদিদেরকে তাদের অপকর্ম হতে বাধা দিলে তারা তাঁর উপর খুব ক্ষিপ্ত হয় এবং তাঁকে অনেক কষ্ট দেয়। পাশাপাশি হত্যার ষড়যন্ত্রও করে। এ হীন উদ্দেশ্যে তারা হযরত ঈসা (আ.)-এর ঘর অবরোধ করে এবং তাঁকে হত্যা করার জন্য ‘তাইতালানুস' নামক জনৈক নরাধমকে পাঠায় । কিন্তু মহান আল্লাহ হযরত ঈসা (আ.)-কে জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নেন । আর ‘তাইতালানুস' নামক ঐ ব্যক্তিকে হযরত ঈসা (আ.)-এর আকৃতি দান করেন। সে হযরত ঈসা (আ.)-কে কোনো কিছু করতে না পেরে বাইরে চলে আসে। অপেক্ষমান লোকজন তাকে হযরত ঈসা (আ.) মনে করে পাকড়াও করে। অতঃপর সবাই মিলে তাকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করে। এ মর্মে আল্লাহ বলেন-

“তারা তাকে (ঈসা-কে) হত্যাও করে নি ক্রুশবিদ্ধও করে নি বরং তারা এরূপ ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিল, যারা তার সম্পর্কে মতবিরোধ করেছিল, তারা নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল। এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করে নি। বরং আল্লাহ তাকে তাঁর কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন আর আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত ১৫৭-১৫৮)

পুনরায় দুনিয়ায় আগমন
শেষ জামানায় পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার আগে হযরত ঈসা (আ.) পুনরায় দুনিয়াতে আগমন করবেন। এসে তিনি ৪০ বছর পৃথিবীতে অবস্থান করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। জিযিয়া প্ৰথা (অমুসলিম থেকে আদায়কৃত নিরাপত্তা কর) তুলে দেবেন। ক্রুশ ভেঙে ফেলবেন। সমস্ত শূকর মেরে ফেলবেন। আল্লাহর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন। এ সময় পৃথিবীর লোকজনের আর্থিক অবস্থা এত উন্নত হবে যে, দান-সদকা নেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হযরত ঈসা (আ.) মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উম্মত হয়ে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামের দিকে আহ্বান করবেন। এরপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন এবং তাঁকে রাসুল (স.)-এর রওজা মুবারকের পাশে দাফন করা হবে। কিয়ামতের দিন তাঁরা দুজন একই স্থান হতে উঠবেন।

ভ্রান্ত বিশ্বাস
খ্রিষ্টানরা নিজেদেরকে হযরত ঈসা (আ.)-এর উম্মাত মনে করে। অধিকাংশ খ্রিষ্টান বিশ্বাস করে যে, হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র, মারিয়াম (আ.) আল্লাহর স্ত্রী এবং হযরত ঈসা (আ.)-কে ইহুদিরা ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছে। তবে কিছুসংখ্যক খ্রিষ্টান যারা হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ইমান এনেছিল ও তাঁকে সাহায্য করেছিল তাদেরকে পবিত্র কুরআনে ‘হাওয়ারি’ (সাহায্যকারী) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর যারা হযরত ঈসা (আ)-কে আল্লাহর পুত্র বলে মনে করে তাদের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ বলেন-

“বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক অদ্বিতীয় । আল্লাহ মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকেও জন্ম দেন নি এবং তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয় নি ।” (সূরা আল-ইখলাস, আয়াত ১-৩)

হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসুল । তাঁকে আল্লাহর বিশেষ কুদরতে পিতা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁর সৃষ্টিকে হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির সাথে তুলনা করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আ.) সংসারত্যাগী ছিলেন। কোনো ঘরও বাঁধেন নি এবং বিয়েও করেন নি । সারা জীবন তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ) প্রচার করে অতিবাহিত করেছেন । তাঁর উম্মতেরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র বলে শিরকে লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ.)-কে পিতামাতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তাঁর জন্য হযরত ঈসা (আ.)-কে শুধু পিতা ছাড়া সৃষ্টি করা মোটেও কঠিন ব্যাপার নয়।

তাই হযরত ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর পুত্র বলার কোনো কারণ নেই। হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং সকলের উচিত তাঁর ব্যাপারে সঠিক আকিদা পোষণ করা যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তিনি স্বাভাবিকভাবেই ইন্তিকাল করবেন। আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করব না এবং হযরত ঈসা (আ.)- কে আল্লাহর রাসুল হিসেবেই বিশ্বাস করব।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে দলগতভাবে হযরত ঈসা (আ.)-এর মুজিযার একটি তালিকা তৈরি করে উপস্থাপন করবে।
Content added || updated By

হযরত মুহাম্মদ (স.) মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি মদিনায় অবস্থানকালে মাতৃভূমি মক্কার প্রতি দরদ অনুভব করেন । তাই তিনি ষষ্ঠ হিজরি সনে ১৪০০ সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা অভিমুখে বায়তুল্লাহ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মক্কার অদূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন হযরত মুহাম্মদ (স.) ও মক্কার কাফিরদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিকগণ এটাকে হুদায়বিয়ার সন্ধি বলে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কুরআনে এ সন্ধিকে “ফাতহুম মুবিন” (সুস্পষ্ট বিজয়) বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষাপট

কারণ
হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সন্ধিতে দশ বছর পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকার কথা উল্লেখ ছিল। হুদায়বিয়ার সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী আরবের বনু খুযা'আ গোত্র মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সাথে এবং বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। বনু বকর গোত্র হুদাইবিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে কুরাইশদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র শুরু করে । তারা একরাতে মহানবি (স.)-এর সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু খুযা'আ গোত্রের উপর আক্রমণ করে। এতে বনু খুযা'আ গোত্রের কয়েক ব্যক্তি নিহত হয় । আহত হয় আরও অনেকে। বনু খুযা'আ গোত্রের লোকজন ঘটনাটি মহানবি (স.)-কে জানায়। তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন করে । মহানবি (স.) চুক্তি অনুযায়ী তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। দূত মারফত কুরাইশদের কাছে তিনি এ ঘটনার কৈফিয়ত তলব করেন। তিনি তাদের জানালেন-

ক. তোমরা খুযা'আ গোত্রকে ক্ষতিপূরণ দাও;
খ. অথবা বনু বকর গোত্রের সাথে মিত্রতা চুক্তি বাতিল কর;
গ. অথবা হুদায়বিয়ায় সম্পাদিত চুক্তি বাতিল কর।

কুরাইশরা শেষটাই গ্রহণ করল। হুদায়বিয়ার সন্ধি বাতিল হয়ে গেল।

ফলে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্য হুদায়বিয়া চুক্তির বাধ্যবাধকতা আর রইল না। পরে কুরাইশরা বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারল । তখন আপস-মীমাংসার জন্য কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে মদিনায় পাঠাল । এ পর্বে আবু সুফিয়ান ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো । অপরদিকে মহানবি (স.) মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।

মক্কা বিজয়
হিজরি অষ্টম বছরের রমযান মাসে দশ হাজার সাহাবি নিয়ে মহানবি (স.) মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মহানবি (স.) মক্কার অদূরে ‘মাররুজ জাহরান' নামক স্থানে তাঁবু গেড়ে অবস্থান নেন । অপ্রত্যাশিতভাবে উপনীত এ বিশাল বাহিনী দেখে আবু সুফিয়ানসহ মক্কাবাসী হতবাক হয়ে যায় । তারা বাধা দেওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলে। বিনা বাধায় মহানবি (স.) জন্মভূমি মক্কা জয় করেন । স্বীয় জীবন ও ইসলাম রক্ষা করার জন্য মহানবি (স.) একদিন মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিলেন । আজ বিজয়ী বীর বেশে তিনি জন্মভূমি মক্কায় প্রবেশ করলেন । সকলেই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করল । তিনি আজ মক্কার একচ্ছত্র অধিপতি । সত্যের বিজয় হলো আর মিথ্যার পরাজয় হলো । সত্যের পথে থাকলে বিজয় একদিন আসবেই ।

মহানবি (স.)-এর উদারতা
মক্কার যে সকল লোক একদিন মহানবি (স.) এর জীবন নাশ করতে চেয়েছিল আজ তারাই তাঁর সম্মুখে অপরাধী ও দয়া ভিখারি হিসেবে উপস্থিত। মহানবি (স.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আজ আমার কাছ থেকে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করো।” তারা বললো- “আপনি আমাদের দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের পুত্র, আপনার নিকট দয়াপূর্ণ ব্যবহারই আমরা চাই।”

তখন মহানবি হযরত মুহাম্মদ “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।”

দয়ালু নবি সকলকে ক্ষমা করে দিলেন । এমনকি একসময়ের ইসলামের সবচাইতে বড় শত্ৰু আবু সুফিয়ানকেও ক্ষমা করে দিলেন। উহুদ যুদ্ধে এ আবু সুফিয়ানই কুরাইশ বাহিনীর (অমুসলিম বাহিনীর নেতা ছিল। তার নেতৃত্বেই কাফির বাহিনীর হাতে ৭০ জন মুসলমান সৈনিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন । মহানবি (স.)-এর একটি দাঁত মোবারক ঐ যুদ্ধে শহিদ হয়। এত কিছুর পরও মহানবি তাকে ক্ষমা করেছিলেন । শুধু ক্ষমাই শেষ নয় । মহানবি (স.) আরও ঘোষণা দিলেন “স্বীয় ঘর ও কাবা শরিফের পাশাপাশি যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিবে তারাও ক্ষমা এবং নিরাপত্তা পাবে।” মহানবি (স.) আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দাকেও ক্ষমা করলেন । হিন্দা মহানবি (স.)-এর প্রিয় চাচা হযরত হামযা (রা.) শহিদ হওয়ার পর তাঁর নাক, কান কেটেছিল এবং বুক চিরে কলিজা বের করে চর্বণ করে চরম নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতার পরিচয় দিয়েছিল । তাকেসহ মক্কার সকলকে ক্ষমার এ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) মক্কা হতে হিজরত করে আসা মুহাজির ও মদিনায় বসবাসকারী আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন তৈরি করেছিলেন। ভ্রাতৃত্ব বন্ধন অটুট রাখার জন্য মহানবি মসজিদে নববিকে মিলনকেন্দ্র বানিয়ে দিলেন। এ ভ্রাতৃত্ব শুধু মুখে মুখে ছিল না বরং মুহাজিরদেরকে আনসারদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিলেন। তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিকের ঘরে যেদিন এ ভ্রাতৃত্ববন্ধন তৈরি করেছিলেন ঐ দিন ঐ গৃহে মোট ৯০ জন সাহাবি ছিলেন। তাঁদের অর্ধেক ছিল মুহাজির আর বাকি অর্ধেক ছিল আনসার। সম্পত্তিতে মুহাজিরদের উত্তরাধিকার বিধানটি বদর যুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল। জন্মসূত্রে আবদ্ধ না হয়ে এমন ভ্রাতৃত্ববন্ধন মানব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

বিদায় হজের ভাষণ
সূরা আন-নাস্ নাজিল হওয়ার পর হযরত মুহাম্মদ (স.) বুঝতে পারলেন যে, তার জীবন প্ৰায় শেষ। তাই তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে (দশম হিজরি) ২৩শে ফেব্রুয়ারি লক্ষাধিক সাহাবিকে সাথে নিয়ে হজ করতে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। একে বিদায় হজ বলা হয়। হযরত মুহাম্মদ (স.) ৯ই জিলহজ আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত জনসমুদ্রের সামনে যে ভাষণ দেন, তাকে বিদায় হজের ভাষণ বলা হয়। উক্ত ভাষণে তিনি ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রিয় জীবন পর্যন্ত সর্বপ্রকার দায়িত্ব, লেনদেন, পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকার ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেন। নিম্নে বিদায় হজে প্রদত্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করা হলো। আরাফাতের ময়দান সংলগ্ন ‘জাবালে রহমত' এর উঁচু টিলায় উঠে মহানবি (স.) প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করলেন, অতঃপর বললেন:

১. হে মানব সকল! আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। কারণ, আগামী বছর আমি তোমাদের সাথে এখানে সমবেত হতে পারব কি না জানি না।

২. আজকের এ দিন, এ স্থান, এ মাস যেমন পবিত্র, তেমনই তোমাদের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র।

৩.  মনে রাখবে অবশ্যই একদিন সকলকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিন সকলকে নিজ নিজ কাজের হিসাব দিতে হবে। 

৪. হে বিশ্বাসীগণ, স্ত্রীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে । তাদের উপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে তেমনই তোমাদের উপরও তাদের অধিকার রয়েছে।

৫. সর্বদা অন্যের আমানত রক্ষা করবে এবং পাপ কাজ হতে বিরত থাকবে ও সুদ খাবে না।

৬. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না । আর অন্যায়ভাবে একে অন্যকে হত্যা করো না।

৭. মনে রেখো! দেশ, বর্ণ-গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মুসলমান সমান । আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বিলুপ্ত হলো। শ্রেষ্ঠত্বের একমাত্র মাপকাঠি হলো আল্লাহ-ভীতি বা সৎকর্ম, সে ব্যক্তিই সবচেয়ে সেরা যে নিজের সৎকর্ম দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

৮. ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, পূর্বের অনেক জাতি এ কারণে ধ্বংস হয়েছে। নিজ যোগ্যতা বলে ক্রীতদাস যদি নেতা হয় তার অবাধ্য হবে না । বরং তার আনুগত্য করবে।

৯. দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। তোমরা যা আহার করবে ও পরিধান করবে তাদেরও তা আহার করাবে ও পরিধান করাবে। তারা যদি কোন অমার্জনীয় অপরাধ করে ফেলে, তবে তাদের মুক্ত করে দেবে, তবু তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে না। কেননা তারাও তোমাদের মতোই মানুষ, আল্লাহর সৃষ্টি। সকল মুসলিম একে অন্যের ভাই এবং তোমরা একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।

১০. জাহিলি যুগের সকল কুসংস্কার ও হত্যার প্রতিশোধ বাতিল করা হলো। তোমাদের পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী এবং তাঁর রাসুলের আদর্শ রেখে যাচ্ছি। এতে যতদিন তোমরা আঁকড়ে থাকবে ততদিন তোমরা বিপথগামী হবে না।

১১. আমিই শেষ নবি আমার পর কোনো নবি আসবেন না।

১২. তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেবে।

তারপর হযরত মুহাম্মদ (স.) আকাশের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী সঠিকভাবে জনগণের নিকট পৌছাতে পেরেছি? সাথে সাথে উপস্থিত জনসমুদ্র হতে আওয়াজ এলো “হ্যাঁ”। নিশ্চয়ই পেরেছেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মদ (স.) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো। এর পরই আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন-

“আজ আমি তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করলাম।” (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত ৩)

মহানবি (স.) কিছুক্ষণ সময় নীরব থাকলেন । উপস্থিত জনতাও নীরব ছিল। অতঃপর সকলের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, 'আল বিদা' (বিদায়)। একটা অজানা বিয়োগব্যথা উপস্থিত সকলের অন্তরকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। বিদায় হজ থেকে ফিরে মহানবি (স.) কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতঃপর ১১ হিজরি সনের রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রি: ৭ই জুন সোমবার ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর।

আদর্শ মানব হযরত মুহাম্মদ (স.)
জীবনের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় নিয়মনীতিকে আদর্শ বলা হয়। এ হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স.) হলেন মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ । আল্লাহ তায়ালা বলেন- “নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।” (সূরা আল-আহযাব, আয়াত ২১)

ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সকল দিক দিয়েই হযরত মুহাম্মদ (স.) আমাদের আদর্শ।

ক. হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর ব্যক্তিগত আদৰ্শ
হযরত মুহাম্মদ (স.) ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, হাস্যোজ্জল ও দয়ালু ছিলেন। ধনী, দরিদ্র, ইয়াতিম, অসহায়, রাজা-প্রজা সকলের সাথে তার আচরণ ছিল অনুকরণীয়। তাঁর দয়া ও ভালোবাসা সকলের পাশাপাশি শিশুদের প্রতিও ফুটে ওঠে । তিনি শিশুদের প্রতি সদয় আচরণ করতেন। অন্যকেও তা করতে উৎসাহ দিয়েছেন । হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন : “যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (সুনানে তিরমিযি)

ক্রীতদাস থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, আত্মীয়-অনাত্মীয় এমনকি জীবজন্তুর প্রতিও দয়া প্রদর্শন করতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন- “জমিনে বসবাসকারীদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানবাসীরাও তোমাদের প্রতি দয়া করবে।” (সুনানে তিরমিযি)

এক কথায়, ক্ষমাশীলতা, উদারতা, সততা ও সত্যবাদিতা, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, দানশীলতা, পরোপকারিতা, দেশপ্ৰেম ও ওয়াদা পালনসহ অনুসরণীয় গুণাগুণ রাসুল (স.)-এর জীবনে বিদ্যমান ছিল।

খ. হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পারিবারিক আদর্শ
পরিবার সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য একজন মানুষের জীবনে যতগুলো গুণ থাকা প্রয়োজন সব গুণই মহানবি (স.)-এর জীবনে ছিল। তিনি স্ত্রী-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন সকলের জন্য আদর্শ ছিলেন। পরিবারের যেকোনো সদস্য তাঁর কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি তাকে সাহায্য করতেন। তাদের সাথে সদা সত্য কথা বলতেন। মিথ্যাকে তিনি আজীবন ঘৃণা করতেন। তাঁর ব্যবহারে নম্রতা প্রকাশ পেত। তিনি পরিবারের সকলের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কোনো বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। পরিবারের কারো প্রতি রাগ করলে শুধু মুখ ফিরিয়ে নিতেন । ভালো-মন্দ কিছু বলতেন না । তাঁর পরিবারে একাধিক স্ত্রী থাকার পরও তিনি সকলের সাথে সমান আচরণ করতেন। তাঁর আচরণের কারণে পরিবারের কোনো সদস্যের মাঝে কখনো ঝগড়া বিবাদ হয় নি।

গ. হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সামাজিক আদর্শ
বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান। তাঁর সমস্ত জীবনই ছিল সংস্কারধর্মী। সমাজ ও জাতীয় জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা তিনি সুন্দর ও কল্যাণমুখী করে সংস্কার করেন নি। সামাজিক অত্যাচার ও অন্ধকার অনাচারে নিমজ্জিত আরব সমাজে তিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।

জাহেলি যুগে বিভিন্ন কারণে গোত্রদ্বন্দ্ব লেগে থাকত। সামান্য কারণেই গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ বেধে যেত। তা ছাড়া আরব মরুচারী গ্রাম্য লোকেরা লুটতরাজ করত । হযরত মুহাম্মদ (স.) সমস্ত যুদ্ধের অবসান ঘটালেন এবং লুটতরাজ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) নারীদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেন। ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের অনেক গোত্রে ও সমাজে নারীদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। তারা কেবল ভোগের পাত্রী ছিল। উত্তরাধিকারী সম্পত্তি হতে তারা বঞ্চিত ছিল। মহানবি (স.) নারীদের এসব দুর্গতি হতে রক্ষা করেন। তাদের ধর্মীয় সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দেন। তিনি ঘোষণা করেন- হয়। অর্থ-“মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।” (কানযুল উম্মাল)

মহানবি (স.) কন্যাসন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া বন্ধ করেন। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়াকে অভিশাপের পরিবর্তে সম্মানের বলে আখ্যা দেন। সুন্দরভাবে কন্যাসন্তান লালন-পালনকারীর জন্য বেহেশতের ঘোষণা দেন। ধনী-গরিব সকলের জানাযায় অংশগ্রহণ করতেন। গোলাম-দাসী সকলের দাওয়াত গ্রহণ করতেন। তাঁর আচার-আচরণে হতাশাগ্রস্থ মানুষ দিকনির্দেশনা পেত।

এ ছাড়া তিনি সামাজিক সকল অনাচার ও বৈষম্য দূর করেন। ছোট-বড় সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সকল প্রকারের সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় যেমন-সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া ও বেহায়াপনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেন । এভাবে তিনি সামাজিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন।

ঘ. হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর রাজনৈতিক আদর্শ
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) পরিপূর্ণ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অসাধারণ দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় আল কুরআনের সর্বজনীন গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করেন।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের অনেক সমাজ ও গোত্র ‘জোর যার মূল্লুক তার' এ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। মহানবি (স.) দেশ পরিচালনায় জনগণের মতামতের স্বীকৃতি দেন। যা গণতন্ত্রের মূল কথা। তিনি ধনী, গরিব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বর্ণ, গোত্র সকল বৈষম্যের অবসান ঘটান। রাষ্ট্রের সকলের সমঅধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অমুসলিম নাগরিকদেরও নিরাপত্তা দেন। তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আইনের চোখে মুসলিম-অমুসলিম, ধর্ম, বর্ণ-গোত্র সকলে সমান এ নীতির বাস্তবায়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় ভিত্তি মজবুত করার জন্য মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি সম্পাদন করেন । এ চুক্তি ‘মদিনা সনদ' নামে পরিচিত।

ঙ. মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর অর্থনৈতিক আদর্শ
মহানবি (স.) তৎকালীন আরব সমাজে প্রচলিত চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের যে প্রচলন ছিল তা নিষিদ্ধ ঘোষণাকরেন । সুদের পরিবর্তে ব্যবসাকে উৎসাহিত করেন। আল্লাহ বলেন-“আল্লাহ সুদকে হারাম (নিষিদ্ধ) আর ব্যবসাকে হালাল (বৈধ) করেছেন।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫)

ঘুষ প্রথাও তিনি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা করেন: “ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষ দাতা উভয়ে জাহান্নামি” । সমাজ থেকে তিনি প্রতারণামূলক সকল ব্যবসা বন্ধ করে দেন। সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। সম্পদে যাতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত থাকে তার উদ্যোগ নেন। রাজস্বের উৎস হিসেবে যাকাত, গণিমত (যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী), জিযিয়া (অমুসলিম হতে আদায়কৃত নিরাপত্তা কর), খারাজ (অমুসলিমদের ভূমিকর), উশর (মুসলিমদের উৎপন্ন ফসলের কর) ইত্যাদি গ্রহণ করেন।

Content added By

পরিচয় হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী। তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা। তাঁর মায়ের নাম উম্মে রুম্মান। তাঁর উপাধি ছিল ‘সিদ্দিকা’ ও ‘হুমায়রা' । আর তাঁর উপনাম হলো-উম্মুল মুমিনিন ও উম্মু আব্দুল্লাহ । তিনি হিজরতের পূর্বে ৬১৩/ ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কুরাইশ বংশের নিয়মানুযায়ী জন্মের পর তাঁর লালন-পালনের ভার দেওয়া হয় ওয়ায়েল নামে এক লোকের স্ত্রীর উপর । শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারিণী । শিশুকাল থেকে তাঁর শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয় । শৈশবকালেই তাঁর আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা ও মেধাশক্তি সকলকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁর মধ্যে সর্বদা শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল । তিনি অন্য শিশুদের মতো খেলাধুলা, আমোদফূর্তি ও দৌড়াদৌড়ি করতে ভালোবাসতেন ।
হযরত খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর নবুয়তের দশম সনে মহানবি (স.)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)- এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয় । হযরত খাওলা বিনতে হাকিম ছিলেন এ বিবাহের ঘটক । এ বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারিত হয় ৪৮০ দিরহাম । বিবাহের তিন বছর পর রাসুল (স.)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)- এর দাম্পত্য জীবন শুরু হয় । হযরত আবু বকর (রা.) বিবাহের কাজির দায়িত্ব পালন করেন ।

শিক্ষাজীবন
তৎকালীন আরব সমাজে লেখা-পড়ার তেমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না । হযরত আয়েশা (রা.) পিতার কাছ থেকেই মূলত লেখাপড়া শুরু করেন । তিনি কাব্য, সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন । যা একবার শুনতেন সাথে সাথে মুখস্থ করে ফেলতেন। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন ছাড়াও তিনি গৃহস্থালী বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন ।

ইফকের ঘটনা
ষষ্ঠ হিজরি সনে বনু মুস্তালিক যুদ্ধে রাসুল (স.)-এর সাথে হযরত আয়েশা (রা.)ও ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাঁর গলার হার হারিয়ে যায় । হারানো হার খুঁজতে গিয়ে তিনি কাফেলা থেকে পিছনে পড়ে যান। ফিরতে দেরি হয়ে যায় । এ সুযোগে মুনাফিকরা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা করল । এতে তিনি চরম মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তাঁর জীবন একেবারে বিষণ্ন হয়ে ওঠে । কিন্তু তিনি ধৈর্য হারান নি । আল্লাহর উপর আস্থা রেখে অটল ছিলেন। এ সময়ে রাসুল (স.) ও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি । তিনি চিন্তিত হলেন । হযরত আয়েশা (রা.)-এর পিতামাতাও চরম উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে কালাতিপাত করছিলেন। অবশেষে হযরত আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা বর্ণনা করে সূরা নুরে ১১-২১ নম্বর আয়াত নাজিল হলো। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো। রাসুল (স.) চিন্তামুক্ত হলেন । হযরত আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা ও চারিত্রিক মাধুর্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

শিক্ষায় অবদান
হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে তাফসির, হাদিস, ফিকাহ ও আরবদের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। শরিয়তের বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল ও নীতিগত বিষয়ে তার পরামর্শ নেওয়া হতো। তুলনামূলক কম বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে মর্যাদা
হযরত আয়েশা (রা.) রাসুল (স.)-এর অতি আদরের সহধর্মিণী ছিলেন । তিনি মহানবি (স.)-এর অন্য স্ত্রীদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন । রাসুল (স.) বলেন- “নারী জাতির উপর আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।” (বুখারি ও ইবনে মাজাহ)। সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, যা রুটি, গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রাসুল (স.) আরও বলেন-“আয়েশা (রা.) হলেন- মহিলাদের সাহায্যকারিনী।” (কানযুল উম্মাল)
একবার নবি করিম (স.) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন-“হে আয়েশা! ইনি জিব্রাইল, তোমাকে সালাম দিচ্ছে ।” (বুখারি)। হযরত আয়েশা (রা.) নিজ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আজকের নারী সমাজও যদি হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো তপস্যা করেন তাহলে তাঁরাও মর্যাদাবান হবেন। সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী । অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন । তাঁর বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি। তন্মধ্যে ১৭৪টি হাদিস ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যৌথভাবে বর্ণনা করেছেন । ইমাম বুখারি ৫৪টি হাদিস এবং ইমাম মুসলিম ৬৯টি হাদিস এককভাবে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন । আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় । ইবনে শিহাব জুহুরি বলেন, “তিনি (আয়েশা) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ছিলেন।' (তাহজিবুত্ তাহজিব)

শিক্ষকতা
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষভাবে নারীদের বিভিন্ন বিষয় তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করা হতো । তিনি হাদিস শিক্ষাদানে বেশি সময় ব্যয় করতেন । একসাথে তাঁর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০০-এর অধিক। অনেক বড় বড় সাহাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন । তিনি বিভিন্ন ঘটনা, প্রশ্নোত্তর এবং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে শিক্ষা দিতেন। হযরত আবু মুসা আশআরি (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), আমর ইবনে আছ (রা.) প্রমুখ সাহাবি তাঁর হাদিসের পাঠদানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন ।

গুণাবলি
হযরত আয়েশা (রা.)-এর চরিত্র ও আদর্শ অতুলনীয় । তিনি তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির দ্বারা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে বহুগুণের সমন্বয় ঘটেছিল । তিনি ছিলেন, অনন্য সুন্দরী, তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি সম্পন্ন, সত্যের সাধক, আদর্শ স্বামী সেবিকা, জ্ঞানতাপস ও সদালাপী। এক কথায় বলতে গেলে মানবীয় চরিত্রের সকল গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মুনাফিক ও হিংসুকগণ তাঁর উপর যে অপবাদ দিয়েছিল তখন তিনি আল্লাহর উপর নির্ভরশীল ছিলেন । ধৈর্যই তাঁকে স্থির-অবিচল রেখেছিল। রাতের অধিকাংশ সময় তিনি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। গরিব অসহায়দের দান সদকা করতে তিনি পছন্দ করতেন ও আনন্দ পেতেন। দানশীলতা, মিতব্যয়িতা, দয়া, পরপোকারিতা, ধর্মপরায়ণতাসহ সর্ব প্রকার গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন । স্বামী প্রেমও তার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাসুল (স.)ও তাঁর সাথে খেলাধুলা ও দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। পর্দার আয়াত নাজিল হওয়ার পর তিনি কঠোরভাবে পর্দা করতেন।

মর্যাদা
হযরত আয়েশা (রা.) রাসুল (স.)-এর অতি আদরের সহধর্মিণী ছিলেন । তিনি মহানবি (স.)-এর অন্য স্ত্রীদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন । রাসুল (স.) বলেন- “নারী জাতির উপর আয়েশা (রা.)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।” (বুখারি ও ইবনে মাজাহ)। সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, যা রুটি, গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রাসুল (স.) আরও বলেন-“আয়েশা (রা.) হলেন- মহিলাদের সাহায্যকারিনী।” (কানযুল উম্মাল)
একবার নবি করিম (স.) আয়েশা (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন-“হে আয়েশা! ইনি জিব্রাইল, তোমাকে সালাম দিচ্ছে ।” (বুখারি)। হযরত আয়েশা (রা.) নিজ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আজকের নারী সমাজও যদি হযরত আয়েশা (রা.)-এর মতো তপস্যা করেন তাহলে তাঁরাও মর্যাদাবান হবেন ।

ইন্তিকাল
উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) ৫৮ হিজরির ১৭ রমযান ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকি নামক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। হযরত আয়েশা (রা.)-এর ধৈর্য, জ্ঞানসাধনা, পাণ্ডিত্য, স্বামীভক্তি ও চারিত্রিক মাধুর্য আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।

কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত আয়েশা (রা.)-এর উত্তম চরিত্রের উপর একটি অনুচ্ছেদ লিখে শিক্ষককে দেখাবে।
Content added || updated By

হযরত রাবেয়া বসরি (র.)

জন্ম ও পরিচয়
ইসলামের ইতিহাসে নারীদের মধ্যে যারা মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে হযরত রাবেয়া বসরি (র.) অন্যতম । এ মহান তাপসী রমনী ৯৯ হিজরি মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন । তাই তাঁকে বসরি বলা হয় । তাঁর পিতা খুব দরিদ্র ছিলেন । যেদিন রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ঐ দিন রাতে তার পিতার ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর মতো তৈলও ছিল না। তাঁর পিতাও একজন মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) ছিলেন । চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ ছিলেন । তাই তার নাম রাখা হলো রাবেয়া (চতুর্থ) । বাল্য বয়সেই তার পিতামাতা ইন্তিকাল করেন । ফলে তাঁকে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় ।

ক্রীতদাসী
হযরত রাবেয়া বসরি (র.)-এর পিতামাতার ইন্তিকালের পর তার বড় বোনেরা জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে অন্যত্র চলে যান । এ সময়ে বসরায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রীত হন। তাঁর মনিব ছিল দুষ্ট প্রকৃতির। তাই তাঁকে দিয়ে অনেক কাজ করাত। রাবেয়া বসরি দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। তারপরও রাতের বেলায় বিনিদ্র থেকে শুধু আল্লাহর ইবাদত করতেন। একদিন রাতে তাঁর মনিবের ঘুম ভেঙে গেল। সে জানালা দিয়ে দেখতে পেল, তার ক্রীতদাসী রাবেয়া একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করছে। উপর হতে একটি বাতি তার ঘর আলোকিত করে রেখেছে। এক পর্যায়ে রাবেয়া মোনাজাত ধরে আল্লাহর দরবারে বললেন, 'হে আল্লাহ তুমি আমাকে কোনো মানুষের অধীন করে না রাখলে আমি সর্বক্ষণ শুধু তোমার ইবাদত করতাম।' রাবেয়ার মনিব এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল এবং সকালবেলা তাঁকে পরিপূর্ণ স্বাধীন করে দিল। তিনি জীবনে বিবাহ করেন নি। কেবল আল্লাহর ইবাদতে জীবন কাটিয়ে দেন।

আল্লাহর উপর আস্থা ও ইবাদত
তাপসী রাবেয়া বসরি (র.) আল্লাহর উপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জীর্ণ কুটিরে বসবাস করতেন। তবু কোনো মানুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। হযরত রাবেয়া বসরি অসুস্থ হলে আব্দুল ওয়াহিদ আমর ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরি তাঁকে দেখতে যান। তখন সুফিয়ান সাওরি হযরত রাবেয়া বসরিকে বললেন, যদি আপনি মুখ খুলে বলেন তাহলে আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। রাবেয়া বললেন, হে আবু সুফিয়ান আপনি কি জানেন না কার ইচ্ছায় আমার এ অসুস্থতা? যাঁর ইচ্ছা তিনি কি আল্লাহ নন ? সুফিয়ান বললেন, হ্যাঁ! রাবেয়া বললেন, তাহলে কেন আমাকে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে বলছেন!

মালিক ইবনে দিনার নামে এক লোক রাবেয়া বসরির পরিচিত ছিলেন। তিনি একদা রাবেয়ার আর্থিক দুরবস্থা দেখে বললেন, আপনি বললে আমি আমার এক ধনীবন্ধু থেকে আপনার জন্য সাহায্য আনতে পারি । রাবেয়া বললেন, হে মালিক! আমাকে এবং আপনার বন্ধুকে কি আল্লাহই রিযিক দেন না? মালিক বলল, হ্যাঁ! রাবেয়া বললেন, আল্লাহ কি দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যের কারণে ভুলে যাবেন? এবং ধনীদেরকে তাদের ধনসম্পদের কারণে মনে রাখবেন? মালিক বলল, না। তখন রাবেয়া বললেন, আল্লাহ যেহেতু আমার অবস্থা জানেন তখন তাঁকে আমার আবার স্মরণ করানোর দরকার কী?

আল জাহিজ বলেন, রাবেয়ার কয়েকজন পরিচিত লোক তাঁকে বললেন, আমরা যদি আপনার আত্মীয় স্বজনদের বলি তাহলে তারা আপনাকে একজন ক্রীতদাস কিনে দেবেন। রাবেয়া বললেন, সত্য কথা এই যে, যিনি সমস্ত পৃথিবীর মালিক তার কাছেই পার্থিব কিছু চাইতে আমার লজ্জা হয় । অতএব যারা পৃথিবীর মালিক নয় তাদের কাছে কী করে আমি চাইতে পারি?

ইবাদত করার ক্ষেত্রে হযরত রাবেয়া বসরি (র.) ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যখনই সময় পেতেন তখনই আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি দিনে রোজা রাখতেন আর রাতে নফল নামায পড়তেন। তিনি সর্বদা আল্লাহর নিকট এ বলে প্রার্থনা করতেন যে, ‘হে প্রভু, আমাকে আমার নিজ কাজে (ইবাদতে) ব্যস্ত রাখুন। যাতে আমাকে কেউ আপনার যিকির (স্মরণ) হতে বিমুখ করতে না পারে।'

আধ্যাত্মিকতা
শুধু পুরুষরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে এমন নয় । অনেক নারীও আল্লাহর ‘ওলি’ (বন্ধু বা কাছের লোক) হতে পেরেছেন। আল্লাহ তাদের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছেন। হযরত রাবেয়া বসরি (র.)- এরও অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। একদা হযরত রাবেয়া বসরি (র.) একটি হাঁড়িতে কিছু খাদ্যদ্রব্য রান্না করছিলেন। তার একটি পেঁয়াজের দরকার পড়ে। কিন্তু তাঁর ঘরে কোনো পেঁয়াজ ছিল না। তখন একটি পাখি তার ঠোঁটে করে একটি পেঁয়াজ এনে তাঁর কাছে ফেলে দেয়। হযরত রাবেয়া বসরি (র.) একবার শস্য বুনছিলেন। পঙ্গপালেরা শস্যক্ষেতের উপর এসে পড়েছিল। তখন রাবেয়া প্রার্থনা করে বললেন, ‘হে আমার প্রভু এ হলো আমার জীবিকা। যদি আপনি চান তাহলে আমি তা আপনার শত্রুদের বা বন্ধুদের দিয়ে দেব।' তখন পঙ্গপালেরা উড়ে পালিয়ে গেল। ওলি হিসেবে তাঁর থেকে আরও অনেক কারামত প্রকাশিত রয়েছে।

অনাড়ম্বর জীবনযাপন
হযরত রাবেয়া বসরি (র.) সদা সর্বদা সহজ সরল জীবনযাপন করতেন । তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন না । তিনি সর্বদা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করতেন। আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা চাইতেন, সর্বদা আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট তাওবা (অনুশোচনা) করতেন । তিনি বলতেন, 'মুখে মিথ্যা তাওবা করে কী লাভ যদি কাজে তা প্রমাণ পাওয়া না যায়।' তিনি সর্বদা আল্লাহর একজন শোকরগুজার (কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারিণী) বান্দা ছিলেন । খেয়ে, না খেয়ে, দুঃখে-কষ্টে, সর্বাবস্থায় তিনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেন।

ইন্তিকাল
অনেক শ্রম, কষ্টসাধ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জীবনযাপন করার পর আল্লাহর প্রিয় এই নারী ১৮৫ হিজরি/৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় ইন্তিকাল করেন । তাঁকে বসরায় দাফন করা হয়। কথিত আছে যে, মুহাম্মদ ইবনে তুসী নামক এক লোক তাঁর কবরে যান । গিয়ে বলেন যে, হে রাবেয়া, আপনি গর্ব করতেন যে, উভয় জগতের বিনিময়েও আপনি আপনার মাথা নত করবেন না। আপনি কি সেই উন্নত অবস্থা লাভ করেছেন? জবাবে একটি আওয়াজ এলো- 'আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি।'

হযরত রাবেয়া বসরি (র.)-এর জীবন আধ্যাত্মিকতা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও সংযমের আদর্শে পরিপূর্ণ । আমরা তাঁর জীবনের আলোকে আমাদের জীবন গড়ব । ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাব।

কাজ : শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে বসে হযরত রাবেয়া বসরি (র.)-এর জীবনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনার একটি তালিকা তৈরি করে শিক্ষককে দেখাবে।
Content added || updated By

হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (র.)

পরিচয়
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ ৬১ হিজরি সনে উমাইয়া বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল আজিজ। মাতা হলেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.)-এর পৌত্রী উম্মু আসিম লায়লা। তিনি একজন উমাইয়া খলিফা ছিলেন। তাঁকে ‘দ্বিতীয় উমর’ ও ইসলামের 'পঞ্চম খলিফা' বলা হয়।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন
শিশুকাল হতেই তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু ও জ্ঞানতাপস। শিশু বয়সে তিনি পিতার সাথে মিসর গমন করেন এবং সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন । এরপর তিনি কুরআন ও হাদিসের উচ্চতর জ্ঞান লাভের আশায় মদিনায় গমন করেন । তৎকালীন সময়ে মদিনার বিখ্যাত শিক্ষকদের নিকট হতে তিনি জ্ঞানার্জন করেন । তিনি কুরআন, হাদিস, তাফসির ও আরবি সাহিত্যের উপর উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করেন । তিনি উমাইয়া শাসক খলিফা আব্দুল মালিকের কন্যা ফাতিমার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ।

গভর্নর পদে নিয়োগলাভ
খলিফা ওয়ালিদ, উমর ইবনে আব্দুল আজিজ-কে ৮৭ হিজরি সনে মদিনার গভর্নর হিসাবে নিয়োগ দান করেন । তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দায়িত্ববোধ সহকারে দায়িত্ব পালন করেন। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য তিনি মজলিশে শুরা গঠন করেন। এর সদস্য ছিলেন দশ জন মুত্তাকি (আল্লাহভীরু) লোক। তিনি শাসনকার্যের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মজলিশে শুরার মতামত গ্রহণ করতেন। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তিনি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ করেন। গভর্নর থাকাকালে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ কারণে তৎকালীন প্রখ্যাত মনীষী সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব তাঁকে ‘মাহদি' (সুপথপ্রাপ্ত) উপাধি দিয়েছিলেন।

জনকল্যাণমূলক কাজ
গভর্নর নির্বাচিত হয়ে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ জনসাধারণের কল্যাণার্থে কাজ শুরু করেন । তিনি ‘মসজিদে নববি'র সংস্কার ও সৌন্দর্য বর্ধন করেন। তিনি অসংখ্য ঘরবাড়ি, পয়ঃপ্রণালী ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন । পিপাসার্ত মানুষের জন্য তিনি অনেক কূপ খনন করেন । মসজিদে নববির বাগানে একটি ঝর্ণা ও চৌবাচ্চা নির্মাণ করেন। সমগ্র এলাকায় বিশেষ করে মক্কা, মদিনা ও তায়েফের মাঝে চলাচলের জন্য সংযোগ সড়ক তৈরি করেন । শুধু জনকল্যাণমূলক কাজ নয় তিনি জ্ঞানেরও প্রসার ঘটিয়েছেন। তিনি জ্ঞানপিপাসু ছিলেন । গভর্নর থাকাকালেও তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য কিতাবাদি অধ্যয়ন করতেন।

খলিফা পদ লাভ
হিজরি ৯৯ সন মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা সুলায়মান ইবনে আব্দুল মালিক ইন্তিকাল করলে উমর ইবনে আব্দুল আজিজ মুসলিম জাহানের খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফা নিযুক্ত হয়ে তিনি পূর্ববর্তী খলিফাদের গৃহীত সকল অন্যায় নীতি বাতিল করে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেন। তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে খলিফা নির্বাচনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি উপস্থিত লোকদের বলেন- ‘হে মানবমণ্ডলী! আমার অনিচ্ছা ও সাধারণ মানুষের মতামত ছাড়া আমাকে খলিফা মনোনীত করা হয়েছে। আমি আপনাদের বাধ্য করছি না, আপনারা যাকে ইচ্ছা খলিফা নির্বাচন করুন ।' তার এ ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা বলল ‘আমরা আপনাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলাম, আমরা আপনার খিলাফতের উপর সন্তুষ্ট।' অতঃপর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর প্রাদেশিক গভর্নরদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত চিঠিতে তিনি উল্লেখ করলেন- “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তার কিতাব মেনে চলো এবং রাসুলের সুন্নাত অনুসরণ কর ।” উমাইয়া বংশের লোকজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাবে রাষ্ট্র ও জনসাধারণের যে সকল সম্পদ দখল করে রেখেছিল তিনি তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এবং যথাযথ মালিকের কাছে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন । এমনকি তাঁর স্বীয় স্ত্রীর সম্পত্তি, উপঢৌকনসামগ্রী, গহনাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা বাইতুল মালে জমা দেন। রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদিনের আদর্শ বাস্তবায়ন করেন। বিশেষ করে হযরত উমর (রা.)-এর শাসননীতি অনুসরণ করেন। অনারব মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । তিনি সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরপেক্ষ শাসননীতি প্রণয়ন করেন। রাষ্ট্রে সুখশান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য পূর্ববর্তী উমাইয়া খলিফাদের সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থান্বেষী নীতি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন । রাষ্ট্রে ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা, সাম্যের ধারণা ও সকল জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন । এ কারণে তাঁকে ‘উমাইয়া সাধু' (Umayyad Saint ) বলা হয় ।

হাদিস সংকলনে অবদান
ইসলামি জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস হচ্ছে আল হাদিস। রাসুল (স.)-এর হাদিসগুলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। হাদিসগুলো সংরক্ষণ ও সংকলনের জন্য তিনি প্রাদেশিক গভর্নরদের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের কাছে লেখেন- 'তোমরা রাসুল (স.)-এর হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দাও এবং তা সংগ্রহ ও সংকলন করো।' তারই প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বে হাদিস সংকলিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহসহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ফলে হাদিস হারিয়ে যাওয়া ও বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রচারের ব্যবস্থা
উমর ইবনে আব্দুল আজিজ বিশ্বাস করতেন যে 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড' । তিনি গভর্নরদের নিকট প্রেরিত পত্রে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিতেন। শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে তিনি অনেক প্রশিক্ষক নিয়োগ করেন। শিক্ষকদের জন্য মাথাপিছু মাসিক ১০০ দিনার (স্বর্ণমুদ্রা) ভাতার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সময়ে সিন্ধু, আফ্রিকা, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ইসলাম ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে।

কৃতিত্ব
দ্বিতীয় উমর নামে খ্যাত হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআন-হাদিস ও খোলাফায়ে রাশেদিনের নীতি অনুসরণ করেছিলেন । তাই তাঁকে চার খলিফার পর ইসলামের পঞ্চম খলিফা বলা হয়।
তাঁর আমলে কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় । তিনি মানুষের মাঝে পারস্পরিক বিরোধ দূর করে সাম্য ও সম্প্রীতির সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন । তাঁর সময়ে জনসাধারণের আর্থিক অবস্থার এতবেশি উন্নতি হয়েছিল যে, যাকাত গ্রহণ করার মতো লোকও খুঁজে পাওয়া যেত না। তিনি ছিলেন একাধারে ফকিহ (ইসলামি আইনশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ), মুজতাহিদ (ইসলাম ধর্মজ্ঞানে সুপণ্ডিত) এবং কুরআন ও হাদিসের হাফিজ।

চরিত্র
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ ছিলেন আল্লাহর নির্দেশ পালনকারী, বিনয়ী ও নম্র প্রকৃতির মানুষ । তাঁর অন্তরে এত আল্লাহভীতি ছিল যে, তিনি প্রায় আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। খলিফা হয়েও তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন । রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দৈনিক মাত্র দু-দিরহাম ভাতা গ্রহণ করতেন। একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে তিনি অন্য ধর্মালম্বীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতেন। তার আমলে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও অগ্নি উপাসকগণকে তাদের গির্জা ও উপাসনালয় নিজ নিজ অধিকারে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল । তার আমলে সকল ধর্মের লোক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করত । তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে উদার চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। তিনি 'আইলা' ও সাইপ্রাসের খ্রিষ্টানদের কর কমিয়ে দেন । নাজরানের খ্রিষ্টানদের তিনি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেন। জ্ঞানচর্চায় অমুসলিম মনীষীদেরও সাহায্য করেছিলেন । তিনি তাদের দ্বারা কয়েকটি গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন ।

ইন্তিকাল
এ মহামনীষী ১০১ হিজরি মোতাবেক ৭১৯ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন । তাঁর খিলাফতকাল ছিল প্রায় আড়াই বছর । আমরা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজের জীবনাদর্শ অনুসরণ করব। তাঁর ধর্মপরায়ণতা, জীবনসাধনা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করব।

কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজের ধর্মপরায়ণতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বাড়ির কাজ হিসেবে সংক্ষেপে লিখে শিক্ষককে দেখাব।
Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion