আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - NCTB BOOK

৩.১ কোয়ান্টাম মেকানিক্স (Quantum Mechanics)

গত শতকের প্রথম দিকে পৃথিবীর বড়ো বড়ো পদার্থবিজ্ঞানীরা কিছুতেই একটা হিসাব মিলাতে পারছিলেন না। উত্তপ্ত বস্তু থেকে যে আলো বিকিরণ হয় সেটি তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, এক টুকরা লোহাকে উত্তপ্ত করা হলে সেটি গনগনে লাল হয়, আরও বেশি হলে সেটি ধীরে ধীরে নীলাভ হতে শুরু করে। উত্তপ্ত বস্তুর বিকিরিত আলোর তীব্রতার সঙ্গে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা সবাই জানতেন। বিজ্ঞানীরা উত্তপ্ত বস্তুর জন্য একটি সূত্র দিয়ে ছোটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আলোর তীব্রতা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন আবার আরেকটি সূত্র দিয়ে বড়ো তরঙ্গদৈর্ঘ্যে আলোর তীব্রতা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। কিন্তু একটি সূত্র দিয়েই উত্তপ্ত বস্তুর জন্য বিকিরিত সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর তীব্রতা কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন না।

স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে শক্তি অবিচ্ছিন্ন (Continuous), কিন্তু বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (চিত্র ৩.১) অন্যভাবে চিন্তা করলেন। তিনি শক্তিকে অবিচ্ছিন্ন না ধরে সেটিকে বিচ্ছিন্ন (Discrete) হিসেবে বিবেচনা করলেন অর্থাৎ তিনি ধরে নিলেন শক্তিকে যত ইচ্ছে তত ছোটো অংশে বিভাজিত করা যাবে না, এর একটি ক্ষুদ্রতম কণা আছে। কম আলোর অর্থ হচ্ছে কম সংখ্যক আলোর কণা এবং বেশি আলোর অর্থ হচ্ছে বেশি সংখ্যক আলোর কণা। তখন চমৎকারভাবে একটি সূত্র দিয়েই উত্তপ্ত বস্তু হতে ছোটো থেকে বড়ো সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য শক্তির তীব্রতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলো। সেই বিচ্ছিন্ন শক্তির কণাকে বলা হলো শক্তির কোয়ান্টা এবং ধীরে ধীরে যে নতুন বিজ্ঞানের জন্ম হলো সেটি হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিজ্ঞানীরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতে বহুল ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধ্রুবরাশিটির নাম রেখেছেন প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক। এর মান 6.634 × 1034 Js এবং একে প্রকাশ করা হয় h দিয়ে।

মানুষের চোখ যথেষ্ট সংবেদী, ধারণা করা হয় যদি মানুষের চোখ আরও দশগুণ বেশি সংবেদী হতো তাহলে আমরা খালি চোখেই আলোর বিচ্ছিন্ন শক্তির কোয়ান্টা দেখতে পেতাম! অর্থাৎ তুমি যদি অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে এবং খুব ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গের আলোর তীব্রতা কমিয়ে আনা হতো, তাহলে তুমি এক সময় লক্ষ করতে যে আলো অবিচ্ছিন্নভাবে আসছে না, বিচ্ছিন্ন আলোর বিচ্ছুরণ বা কণা হিসেবে আসছে। এই কণাগুলোর সবকটির বিচ্ছুরণের তীব্রতা সমান, তবে আলোর তীব্রতা যতই কমিয়া আনা হতো কণাগুলোর সংখ্যা ততই কমে আসত।

৩.১.১ কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave-particle Duality)

আমরা সবাই তরঙ্গের সঙ্গে পরিচিত, তরঙ্গের সঙ্গে তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কম্পাংক, পর্যায়কাল ইত্যাদি নানা রাশি সংযুক্ত থাকে, এবং সেটি একস্থান থেকে অন্যস্থানে শক্তি বয়ে নিয়ে যায়। তরঙ্গের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হচ্ছে ব্যাতিচার, যেখানে একটি তরঙ্গ অন্য আরেকটি তরঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরও বড়ো বিস্তারের একটি তরঙ্গ তৈরি করে কিংবা একটি তরঙ্গ অন্য তরঙ্গের সঙ্গে বিপরীতভাবে মিলিত হয়ে সম্মিলিত 

বিস্তার কমিয়ে দেয়। (চিত্র ৩.২) প্রকৃতির একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তরঙ্গ হচ্ছে তড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ এবং এই তরঙ্গেরই একটি অংশ, যা আমাদের চোখের রেটিনায় ধরা পরে, তাকে আমরা বলি আলো। অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় দেখা গেছে আলোর আচরণ তরঙ্গের মতো নয়, বরং কণার মতো। একটা কণা যে রকম অন্য কণাকে ঠোকা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে আলো ঠিক সেভাবে ইলেকট্রনকে ঠোকা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে। আলোর কণাধর্মী এ রকম একটা উদাহরণ হচ্ছে ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট যেখানে আলোর কণা বা কোয়ান্টা একটা ধাতব পদার্থকে আঘাত করে সেখান থেকে ইলেকট্রনকে মুক্ত করে দেয়। চমকপ্রদ এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তোমরা নিশ্চয় সোলার সেল দেখেছ, সোলার সেলে এই ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট ব্যবহার করেই সূর্যের আলোর শক্তি বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

আবার অন্যদিকে তোমরা নিশ্চয় এটিও জানো যে ইলেকট্রন হচ্ছে কণা; এর ভর আছে, এর ভরবেগ আছে এটি অন্য কণাকে আঘাত করে সরিয়ে দিতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিজ্ঞানীরা এক সময়ে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে কখনো কখনো ইলেকট্রন এমন আচরণ করে যেন এটি কণা নয়, যেন এটি একটি তরঙ্গ! এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আছে, বিস্তার আছে শুধু তাই নয় ইলেকট্রন ঠিক তরঙ্গের মতো ব্যাতিচার পর্যন্ত করতে পারে। ইলেকট্রন এতই নিশ্চিতভাবে তরঙ্গের মতো আচরণ করে যে, ইলেকট্রনের এই বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে রীতিমতো ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরি করা হয়েছে।

তাহলে, প্রশ্ন হচ্ছে আলো কি আসলে তরঙ্গ নাকি কণা? আবার একই সঙ্গে ইলেকট্রনের জন্যও একই প্রশ্ন করা যায়। ইলেকট্রন কি আসলে কণা নাকি তরঙ্গ?'

উত্তরটা শুনলে তোমরা হকচকিয়ে যেতে পারো, কারণ উত্তর হচ্ছে: দুটোই! অর্থাৎ আলো তরঙ্গ এবং কণা দুইরকমের বৈশিষ্ট্যই বহন করে। আবার ইলেকট্রনও কণা এবং তরঙ্গ দুইরকমের বৈশিষ্ট্যই বহন করে। আলোর বেলায় বিজ্ঞানীরা প্রথমে তার তরঙ্গ বৈশিষ্ট্যের কথা জেনেছেন আর ইলেকট্রনের বেলায় প্রথমে জেনেছেন তার কণা বৈশিষ্ট্যের কথা, এটুকুই পার্থক্য। এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি তোমাদের প্রথমে খুব বিচিত্র মনে হতেই পারে, কিন্তু জেনে রাখো সত্যিই এটা সম্ভব। পদার্থবিজ্ঞানীরা এই বিষয়টিকে বলেন কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (Wave-particle Duality)।

৩.১.২ ডি-বুগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য (De- Broglie Wavelength)

শুধু যে ইলেকট্রনকে তরঙ্গ হিসেবে দেখা যায় তা নয়। বিজ্ঞানী ডি ব্রগলি (চিত্র ৩.৩) প্রথম বলেছিলেন যে, প্রত্যেক পদার্থ বা কণার সঙ্গেও একটা তরঙ্গ থাকে, এমনকি সেই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কত হবে সেটাও তিনি বলে দিয়েছিলেন। কোনো কণার ভরবেগ যদি p হয় তাহলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে: 

যেখানে h হচ্ছে প্লাংকের ধ্রুবক। এই অত্যন্ত সহজ সমীকরণটি একটি বিস্ময়কর সমীকরণ কারণ এই সমীকরণের বাম পাশে রয়েছে তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১, যেটি পুরোপুরি তরঙ্গের একটি বৈশিষ্ট্য এবং ডানদিকে রয়েছে ভরবেগ p, যেটি পুরোপুরি কণার একটি বৈশিষ্ট্য। এই সমীকরণটি তরঙ্গ এবং কণার মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো বৈশিষ্ট্যকে একত্র করেছে।

উদাহরণ: তোমার ভর যদি 50 kg হয় আর তুমি যদি 2 m/s বেগে দৌড়াও তাহলে তোমার ডি-ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য কত?

সমাধান: তোমার ভরবেগ হবে p = 50 × 2 kg m/s = 100 kg m/s, কাজেই তোমার ডি-ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে : X = (6.634 × 10-34 / 100) m = 6.634 × 10-36 m

বুঝতেই পারছ, এটি এতই ছোটো যে, সেটি দেখার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তুমি যদি ইলেকট্রন-প্রোটনের মতো ছোটো কণার ক্ষেত্রে বিবেচনা করো, তাহলে কিন্তু এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিংবা তরঙ্গের মতো ব্যবহার এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়।

উদাহরণ: 4 × 106 ms-1বেগে গতিশীল একটি ইলেকট্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কত? (ইলেকট্রনের ভর 9.1 × 10-31 kg)

সমাধান : ইলেকট্রনটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য = h/p = h/mv = 6.634×10-34(9.1 x 10-31× 4 × 106) = 1.8 × 10-10m

খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করা যায় যে, সত্যিই যদি সব কণার জন্যই একটি তরঙ্গ থাকে, তাহলে সেটি কীসের তরঙ্গ? খুব সহজ করে বললে বলা যায় যে এই তরঙ্গটি বাস্তব কোনো তরঙ্গ নয় তবে এই তরঙ্গটির সঙ্গে একটি কণাকে কোথায় পাওয়া যাবে সেই 'সম্ভাবনার' (Probability) একটি সম্পর্ক আছে।

৩.১.৩ হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি (Heisenberg's uncertainity Principle)

৩.৪ চিত্রে একটা কণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি ভিন্ন ডি ব্রগলি তরঙ্গ দেখানো হয়েছে। এখন তোমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় চিত্রটির কোন তরঙ্গে কণাটির অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে বলা সহজ? অবশ্যই তুমি বলবে উপরের তরঙ্গটিতে। কারণ এখানে তরঙ্গটি ছোটো একটা জায়গায় আটকে আছে, কাজেই কণাটি 

নিশ্চয়ই সেখানে আছে। নিচের তরঙ্গটিতে যেহেতু তরঙ্গটা অনেকদূর বিস্তৃত তাই বস্তুটার অবস্থান এর যে কোনো জায়গায় হতে পারে, অর্থাৎ তুমি অবস্থানটি আর নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না। এবারে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, চিত্রের কোনো তরঙ্গে কণাটির ভরবেগ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে? তাহলে তুমি নিশ্চয় বলবে যে নিচের তরঙ্গে ভরবেগ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে, কারণ সেটিতে তরঙ্গটা যেহেতু অনেকটুকু বিস্তৃত, সেখানে অনেকগুলো তরঙ্গদৈর্ঘ্য থেকে নিখুঁতভাবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বের করা সম্ভব, আর ডি-ব্রগলির সূত্র অনুযায়ী ভরবেগ p হচ্ছে h/入 কাজেই তরঙ্গদৈর্ঘ্য । যত নিশ্চিতভাবে মাপা হবে ভরবেগও তত নিশ্চিতভাবে বলা যাবে। উপরেরটিতে তো পুরো একটা তরঙ্গদৈর্ঘ্যই নেই-কেমন করে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অনুমান করা যাবে? কাজেই উপরের তরঙ্গে তুমি কণাটির ভরবেগ আর নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না।

এই উদাহরণটি থেকে তুমি দেখতে পাচ্ছ কোনো কণার অবস্থান নির্দিষ্ট করে জানলে তার ভরবেগ অনিশ্চিত হয়ে যায়। আবার ভরবেগ ভালো করে জানলে অবস্থানটা অনিশ্চিত হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে হাইজেনবার্গের  বিখ্যাত অনিশ্চয়তার সূত্র।

গাণিতিকভাবে কোনো অবস্থানের অনিশ্চয়তাকে প্রকাশ করা হয় Ax দিয়ে। Ax কম হওয়া মানে অবস্থানে অনিশ্চয়তা কম, অর্থাৎ অবস্থানটা ভালো করে জানি আবার ∆x বেশি হওয়া মানে অবস্থানের অনিশ্চয়তা বেশি অর্থাৎ অবস্থানটা ভালো করে জানি না। একইভাবে ভরবেগের অনিশ্চয়তা প্রকাশ করা হয় Ap দিয়ে। Ap কম হওয়া মানে ভরবেগের অনিশ্চয়তা কম, অর্থাৎ ভরবেগটা ভালো করে জানি আবার Ap বেশি হওয়া

মানে ভরবেগে অনিশ্চয়তা বেশি অর্থাৎ ভরবেগটা ভালো করে জানি না। Ax এবং Ap ব্যবহার করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্রকে এভাবে লেখা হয় :

Δχ.Δρ ≥ h/4π

মনে রেখো, একই সঙ্গে অবস্থান এবং ভরবেগ নিশ্চিতভাবে জানতে না পারার বিষয়টি কিন্তু বিজ্ঞানীদের বা তাদের পরিমাপ করার যন্ত্রের অক্ষমতা নয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে, এক সময় যখন বিজ্ঞান অনেক উন্নত হবে, তখন আরও ভালো যন্ত্রপাতি দিয়ে নিখুঁতভাবে একই সঙ্গে অবস্থান আর ভরবেগ মেপে ফেলা যাবে-এটি কখনোই হবে না। প্রকৃতি তার নিয়মের মধ্যে এই অনিশ্চয়তাটুকু রেখে দিয়েছে। তবে h -এর মান যেহেতু খুবই ছোটো তাই অনিশ্চয়তার মানও খুব কম বলে আমাদের দৈনন্দিন বৈজ্ঞানিক পরিমাপে বা প্রযুক্তির কাজে কখনো কোনো সমস্যা হয় না।'

পদার্থবিজ্ঞানে এই অনিশ্চয়তা সূত্রের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। পরবর্তী কালে তোমরা যারা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করবে তারা দেখতে পাবে, এই অনিশ্চয়তার সূত্র থেকে ইলেকট্রন-প্রোটন, অণু-পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র কণাদের বিচিত্র জগৎ বর্ণনা করতে গড়ে উঠেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নামে বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা।

৩.২ কণা-পদার্থবিজ্ঞান (Particle Physics)                    

আমরা আমাদের চারপাশে তাকালে মানুষজন, গাছপালা, দালানকোঠা, আকাশের দিকে তাকালে চাঁদ সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, মহাকাশের গভীরে তাকালে গ্যালাক্সি পর গ্যালাক্সির দেখতে পাই এবং আমরা সবাই জানি সেগুলোর সবকিছু তৈরি হয়েছে কিছু পরমাণু দিয়ে এবং সেই পরমাণুগুলো তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে। তোমাদের নিশ্চয়ই জানার কৌতূহল হয় যে এই ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন কি সত্যিকারের মৌলিক কণা, নাকি সেগুলোও অন্যকিছু দিয়ে তৈরি হয়েছে? এই তিনটি কণা ছাড়া অন্য কোনো বস্তু কণা কি আছে? তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে এই মৌলিক বস্তুকণাগুলো পরস্পরের সঙ্গে চার ধরনের বল দিয়ে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে যেগুলো হচ্ছে মহাকর্ষ বল, তড়িৎ চৌম্বক বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল ও সবল নিউক্লিয় বল। কিন্তু তোমরা কি জানো এই বলগুলো আসলে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে এক ধরনের শক্তি কণা বিনিময় করে? যার অর্থ এই ভৌতজগত তৈরি হয়েছে দুই ধরনের কণা দিয়ে, যেগুলো হচ্ছে বস্তুকণা এবং শক্তিকণা। পদার্থবিজ্ঞানের যে শাখায় বস্তুকণা এবং শক্তিকণার বিভাজন এবং ক্রিয়া-বিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয় সেটি হচ্ছে কণা পদার্থবিজ্ঞান। এই অধ্যায়ে আমরা সেই কণা পদার্থবিজ্ঞানের অসাধারণ বৈচিত্র্যময় জগতের সঙ্গে তোমাদের একটুখানি পরিচয় করিয়ে দেব, তবে সেটি সম্পর্কে সত্যিকারের ধারণা পেতে হলে তোমাদের পদার্থবিজ্ঞানের আরও অনেক গভীরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে বস্তুকণা এবং শক্তিকণা দিয়ে, বস্তুকণাকে বলা হয় 'ফার্মিওন' (Fermion) এবং শক্তিকণাকে বলা হয় 'বোজন' (Boson)। তাই আমরা বলতে পারি এই মহাবিশ্বের যে কোনো 

 

১৯২১ সালে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কার্জন হল থেকে ১৯২৪ সালে আইনস্টাইনকে তিনি একটি চিঠি লিখে জানান যে, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হিসাবে একটু গড়মিল আছে, হিসাবটা অন্যরকম হলে ভালো হতো। সেটি কেমন হওয়া উচিত তার ওপর তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এই তরুণ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন তার প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে একটি জার্নালে প্রকাশ করতে। আইনস্টাইন তৎক্ষণাৎ চিঠির জবাব দিয়ে সত্যেন বসুর ইংরেজি প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে একটি জার্নালে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সত্যেন বসুর সেই কাজের কারণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক কণাকে তার নাম অনুসারে বোজন কণা ডাকা হয়।

 

একটি মৌলিক কণা নেয়া হলে মোটা দাগে সেটা হয় 'ফার্মিওন', না হয় 'বোজন' হবে। এই বোজন নামটা এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন বাঙালি অধ্যাপক সত্যেন বসুর (চিত্র ৩.৬) নাম থেকে, আর ফার্মিওন নামটা এসেছে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির (চিত্র ৩.৬) নাম থেকে। মৌলিক কণা ফার্মিওন এবং বোজনের অনেক বড়ো একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যটি সহজভাবে বলতে হলে এভাবে বলা যায় : হুবহু একরকম কণা হলে যখন সেগুলো একসঙ্গে থাকতে পারে না তখন বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে ফার্মিওন। আর যখন হুবহু একরকম কণা একসঙ্গে থাকে তখন বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে বোজন। ইলেকট্রন হচ্ছে ফার্মিওন, তাই তোমরা যখন পরমাণুর গঠন পড়েছ তখন লক্ষ করেছ একটি শক্তিস্তরে সবকটি ইলেকট্রনকে গাদাগাদি করে রাখা যায় না। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ইলেকট্রন দিয়ে একটি শক্তিস্তর পূর্ণ হয়ে গেলেই অন্য ইলেকট্রনের জায়গা করে দেয়ার জন্য পরের শক্তিস্তরে চলে যেতে হয়। আবার আলোর কণা বা ফোটন হচ্ছে বোজন। ফোটন এক শক্তিস্তরে থাকতে পারে বলে এত তীব্র আলোর লেজার রশ্মি তৈরি করা সম্ভব হয়।

৩.২.১ পরমাণুই শেষ কথা নয়

পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বস্তুকণা ফার্মিওন আর শক্তিকণা বোজন দিয়ে তৈরি হয়েছে। ফার্মিওন নামের বস্তুকণাদের আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগের নাম কোয়ার্ক অন্য ভাগের নাম লেপটন। কোয়ার্ক হচ্ছে সেইসব ফার্মিওন যেগুলো সবল নিউক্লিয় বল অনুভব করে, আর যেগুলো নিউক্লিয় বল অনুভব করে না তারা হচ্ছে লেপটন। ইলেকট্রন হচ্ছে একটি লেপটন। পরমাণুর গঠন পড়ার সময় আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন এই তিনটি মৌলিক কণার কথা পড়েছি। ইলেকট্রন সত্যি সত্যি লেপটন জাতীয় একটি মৌলিক কণা হলে প্রোটন ও নিউট্রন কিন্তু মৌলিক কণা নয়, সেগুলো তৈরি হয়েছে আপ কোয়ার্ক (u) ও ডাউন কোয়ার্ক (d) নামে দুই ধরনের কোয়ার্ক দিয়ে। আমরা জেনেছিলাম সকল পরমাণু তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে। সেটি এবারে আরও সঠিকভাবে বলা যায় যে, সকল পরমাণু তৈরি হয়েছে ইলেকট্রন এবং আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক (e এবং u, d) দিয়ে। (এখানে জেনে রাখো এই কোয়ার্কের মাঝে কিন্তু কোনো কিছু উপরে (up) কিংবা নিচে (down) নেই, এটি শুধু খেয়ালি বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম।)

কোয়ার্ক যেরকম দুটি, লেপটনও কিন্তু দুটি। একটি হচ্ছে আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন অন্যটির নাম নিউট্রিনো। আমরা সাধারণভাবে নিউট্রিনোর কথা বলি না, কারণ এটি কোনোভাবে সাধারণ মানুষের চোখে দৃশ্যমান নয়, প্রতি সেকেন্ডে তোমার চোখের আইরিশের ভেতর দিয়ে দশ লক্ষ নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে তুমি কিন্তু ভুলেও সেটি কখনো টের পাও না। এর ভর বলতে গেলে নেই, এটি কোনো কিছুর সঙ্গে সহজে বিক্রিয়া করে না, অবলীলায় এটি শোষিত না হয়ে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ দীর্ঘ সীসার পাতের ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে। এটি ইলেকট্রনের সঙ্গে থাকা আরেকটি লেপটন, তাই তাকে ডাকা হয় ইলেকট্রন নিউট্রিনো এবং লেখা হয় v হিসেবে। আমরা বোজন নামের শক্তি কণাদের মাঝে একটু পরে আসব, আপাতত ফার্মিওন কণার একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা লিখে ফেলি। এটি খুবই সহজ সরল:

এই বেলা তোমাদের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানিয়ে দেওয়া যায়, সেটি হচ্ছে প্রত্যেকটি বস্তুকণার একটি প্রতিকণা রয়েছে। একটি কণা এবং প্রতিকণা একত্র হলে দুটিই অদৃশ্য হয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। শুধু তাই না শক্তি ব্যবহার করে উপযুক্ত পরিবেশে বস্তুকণা এবং তার প্রতিকণা তৈরি করা যায়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সমান পরিমাণ বস্তুকণা এবং তাদের প্রতিকণা থাকার কথা ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না কেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হয়েছে শুধু বস্তুকণা দিয়ে। কিন্তু উপরের তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ করতে হলে ফার্মিওনের এই পরিবারে তাদের প্রতিকণাগুলোও যোগ করতে হবে। কাজেই তালিকাটি হবে এরকম:

উপরের কণাগুলো হচ্ছে বস্তুকণা, এদের ভেতর বল বা শক্তির বিনিময় করার জন্য তালিকাতে আমাদের শক্তিকণা বোজনগুলোও যুক্ত করতে হবে। সেগুলো হচ্ছে:

তোমরা এখানে আমাদের পরিচিত ফোটন বা আলোর কণাকে দেখছ এটি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তির দায়িত্বে আছে। জি নট (Z) এবং ডাবলিউ প্লাস এবং ডাব্লিউ মাইনাস (W_+, W_) হচ্ছে দুর্বল নিউক্লিয় শক্তির বাহক, মুওন (g) হচ্ছে সবল নিউক্লিও বলের বাহক এবং গ্রেভিটন (G) হচ্ছে মহাকর্ষ বলের বাহক। এখানে উল্লেখ্য যে, এই তালিকার অন্য কণাগুলোর অস্তিত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা গেলেও গ্রেভিটনের অস্তিত্ব এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

৩.২.২ স্ট্যান্ডার্ড মডেল (Standard Model)

কাজেই একজন মোটামুটি এই ভেবে আনন্দ পেতে পারত যে, মাত্র চারটি বস্তুকণা ফার্মিওন দিয়েই এই মহাবিশ্বের সকল পদার্থের গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি শেষ পর্যন্ত এত সহজ থাকেনি। দেখা গেল ফার্মিওনের যে পরিবারটির কথা বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে সেটা যথেষ্ট নয়। ঠিক এ রকম আরও দুটো পরিবার দরকার। u, d, e, v এর পরিবারটিকে প্রথম প্রজন্ম বলা হয়। এই প্রথম প্রজন্ম দিয়েই পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু গঠিত হলেও প্রকৃতির রহস্য বোঝার জন্য আমাদের হুবহু এরকম আরও দুটি প্রজন্ম প্রয়োজন, সেগুলো হচ্ছে: c. s, µ, vµ এবং t, b, t, v,

এবং আলাদা করে লেখা না হলেও মনে রাখতে হবে, অবশ্যই তার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে তাদের প্রত্যেকটির প্রতিপদার্থ। আমরা যদি প্রতিপদার্থগুলো আলাদাভাবে না লিখি তাহলে ছোটো একটা ছকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল মৌলিক কণাকে লিখে ফেলা যায় (চিত্র ৩.৭)। সংগত কারণেই তোমাদের মনে হতে পারে শক্তিকণা বোজনগুলোর প্রতিকণাগুলোকেও আমাদের তালিকায় নেওয়া দরকার। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বস্তুকণার ভেতরে বল বা শক্তি আদানপ্রদানকারী এই শক্তিকণা বোজনগুলোর কয়েকটি নিজেরাই নিজেদের প্রতিকণা, কয়েকটি একটি অন্যটির প্রতিকণা তাই তাদের আলাদা তালিকা করার প্রয়োজন হয়নি।

এই সকল কণা ব্যবহার করে পদার্থবিজ্ঞানের যে মডেল দিয়ে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা হয় সেটাকে বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল। তোমরা হয়তো পর্যায় সারণি সম্পর্কে জেনেছ। পর্যায় সারণিতে যেমন- মৌলিক পদার্থগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানো থাকে, স্ট্যান্ডার্ড মডেলেও একইভাবে একটি সারণিতে মৌলিক কণাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাজানো থাকে। তবে তোমাদের মনে রাখতে হবে এই কণাগুলোর ভর, চার্জ এবং আরও নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আলোচনাটুকু সহজ রাখার জন্য যেগুলো সম্পর্কে এখানে কিছু বলা হয়নি।

এক সময়, পরমাণুকে অবিভাজ্য একক ভাবা হতো। পরবর্তী কালে ইলেকট্রন এবং পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের পর সেই ধারণা পরিবর্তিত হয়। আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে নিউট্রন আবিষ্কারের  পরে, পদার্থবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন কণা পদার্থবিজ্ঞানের সব কণার কথা জানা হয়ে গেছে। এর পরের বছরগুলোতে শত শত পদার্থবিজ্ঞানী কেবলই কণাদের সিঁড়ি ভেঙে আরও গভীরে গিয়েছেন। কেউ এই কণাদের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করে তত্ত্ব দিয়েছেন, কেউ আবার ল্যাবরেটরিতে নতুন নতুন কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।

এখন পর্যন্ত যে কণাগুলোর কথা বলা হয়েছে তাদের ভর নির্ধারণ করার জন্য হিগস বোজন (Higgs Boson) নামে আরও একটি বোজনের (H) অস্তিত্ব পদার্থবিজ্ঞানীরা আগেই অনুমান করেছিলেন। অবশেষে 2013 সালে সার্ন নামের একটি গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলেন-যেটি এখন স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তালিকায় (চিত্র ৩.৭) দেখানো হয়। হিগস বোজনের আবিষ্কার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বড়ো একটি অর্জন।

৩.৩ আপেক্ষিক তত্ত্ব (Theory of Relativity)

আইনস্টাইনের (চিত্র ৩.৮) বিখ্যাত আপেক্ষিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে নিচের দুটি স্বীকার্য মেনে নিয়ে:

 

(১) সব জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো একইরকম দেখাবে এবং 

(২) সব জড় প্রসঙ্গ কাঠামোয় আলোর গতিবেগ একই হবে

 

তোমরা যারা এই স্বীকার্য দুটি পড়েছ তাদের কাছে প্রথম স্বীকার্যটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হতে পারে। পুরোপুরি স্থির প্রসঙ্গ কাঠামো বলে কিছু নেই, সব প্রসঙ্গ কাঠামোর বেলাতেই একটির সঙ্গে অন্যটির তুলনা করে দুটি কাঠামোর আপেক্ষিক বেগ বের করতে হয়। পৃথিবী নিজেই সূর্যকে ঘিরে ঘণ্টায় প্রায় লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটে যাচ্ছে। কাজেই কোনো জড় প্রসঙ্গ কাঠামোই আসলে বিশেষ কোনো কাঠামো নয়, সবকটিই এক। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ কাঠামোতে ভিন্ন পদার্থবিজ্ঞান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে দ্বিতীয় স্বীকার্যটি আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে না। একটা গাড়ি যদি ঘণ্টায় 60 কিলোমিটার বেগে যায় আর তুমি যদি ঘণ্টায় 40 কিমি বেগে যাও, তাহলে তোমার মনে হবে অন্য গাড়িটি তোমার সাপেক্ষে 60 40 = 20 কিমি বেগে যাচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় স্বীকার্যটি বলছে অন্য কথা। আমরা জানি কেউ যদি তোমার দিকে একটা ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে আলোক রশ্মি পাঠায় তোমার মনে হবে রশ্মিটি আলোর বেগে তোমার কাছে পৌঁছাচ্ছে। এখন তুমি নিজেই যদি আলোর অর্ধেক বেগে যেতে থাকো, তাহলে যদি আবার ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে তোমার দিকে আলোক রশ্মি পাঠানো হয় তাহলে একইভাবে আলো তোমার কাছে অর্ধেক বেগে পৌঁছানো কথা, কিন্তু দ্বিতীয় স্বীকার্য বলছে তখনও আলোটি তোমার কাছে আলোর বেগেই পৌঁছাবে।

যাই হোক, আপেক্ষিক তত্ত্বের স্বীকার্য দুটি ব্যবহার করা হলে কী বিচিত্র ঘটনা ঘটতে থাকে এবারে আমরা তার কয়েকটি উদাহরণ দিই।

৩.৩.১ সময় প্রসারণ (Time Dilation)

ধরা যাক, তুমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছো এবং তোমার বন্ধু ট্রেনে বসে আছে, যার গতিবেগ v, তোমার বন্ধুর কাছে দুটি আয়না, একটি নিচে আরেকটি H উচ্চতায়; আলো নিচের আয়না থেকে উপরে এবং উপরের আয়না থেকে নিচে প্রতিফলিত হয় (চিত্র ৩.৯)। আলো নিচ থেকে উপরে (কিংবা উপর থেকে নিচে) যেতে । সময়ে ঘড়ির একটি ক্লিক হয়, অর্থাৎ এটাই তার ঘড়ি। তাহলে, t = H/c যেখানে c হচ্ছে আলোর বেগ। তুমিও ঠিক করলে তুমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের ভেতরে তাকিয়ে ক্লিকগুলো মাপবে। ট্রেনটি যেহেতু বেগে যাচ্ছে তাই তুমি অবশ্যই দেখবে 'তোমার' ঘড়ির প্রথম ক্লিকটি যখন ঘটেছে সেই । সময়ে উপরের আয়নাটি vt দূরত্বে সরে গেছে। কাজেই তোমার কাছে মনে হবে ঘড়ির ক্লিক হওয়ার সময় আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করেছে পিথাগোরাসের সূত্রানুযায়ী সেটা হচ্ছে: √H² + v²²

আবার, আইনস্টাইন বলেছেন সব জায়গায় আলোর বেগ সমান, তাই তোমার ঘড়ির এক ক্লিকের সময়কে যদি বলি, তাহলে,  <math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>t</mi><mo>=</mo><mfrac><msqrt><msub><mi>H</mi><mn>2</mn></msub><mo> </mo><mo>+</mo><mo> </mo><msub><mi>v</mi><mn>2</mn></msub><msub><mi>t</mi><mn>2</mn></msub></msqrt><mi>c</mi></mfrac></math>

অর্থাৎ

কিন্তু আমরা জানি, তোমার বন্ধুর ঘড়ির ক্লিক 

তাহলে লেখা যায়:

   

অর্থাৎ

এই নিরীহ সমীকরণটি আমাদের পরিচিত জগৎকে পুরোপুরি ওলটপালট করে দিয়েছে। আবার মনে করিয়ে দেই, এখানে। হচ্ছে তোমার ঘড়িতে মাপা সময় আর। হচ্ছে তোমার বন্ধুর ঘড়িতে মাপা সময়। তুমি স্থির দাঁড়িয়ে আছো এবং তোমার বন্ধু বেগে যাচ্ছে, এটুকুই পার্থক্য।

এখানে, এর মান কম হলে। এবং to -এর মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই, কিন্তু যদি আলোর বেগের কাছাকাছি হয় তাহলে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার ঘটতে থাকে। যেমন- যদি v = 0.99c হয় তাহলে    

অর্থাৎ তোমার বন্ধু যদি 0.99c বেগে গতিশীল একটি ট্রেনে দশ বছর কাটায় (t = 10 বছর) তাহলে তার বয়স বাড়বে ঠিক দশ বছরই। কিন্তু, একই সময়ে তোমার বয়স বাড়বে (t = 7t 70) সত্তর বছর। পনেরো বছরে রওনা দিয়ে সে পঁচিশ বছরের যুবক হিসেবে ফিরে এসে দেখবে তুমি পনের বছরে শুরু করে এর মাঝে পঁচাশি বছরের থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছো।

তোমার তুলনায় তোমার বন্ধু। বেগে যাচ্ছে, কিন্তু তোমার বন্ধুর তুলনায় তুমিও তো বেগে যাচ্ছ। তাহলে উল্টোটা কেন সত্যি হয় না? অর্থাৎ, দশ বছর কাটিয়ে দিয়ে তুমি কেন আবিষ্কার করো না যে তোমার বয়স যখন দশ বছর বেড়েছে তখন তোমার বন্ধুর বয়স সত্তর বছর বেড়ে গেছে?

এটি আপেক্ষিক তত্ত্বে একটা অত্যন্ত মজার প্রশ্ন। কার বয়স বেড়েছে দেখার জন্য তোমার এবং তোমার বন্ধুর দেখা হতে হবে, দেখা না হলে তোমরা কখনওই জানবে না কার বয়স কত বেড়েছে। দেখা হতে হলে মাঝে একজনকে থামতে হবে এবং গতি পরিবর্তন করে ফিরে আসতে হবে। যে থামবে এবং গতি পরিবর্তন করবে তার সময় অতিক্রান্ত হবে কম। কেন সেটি হবে তার ব্যাখ্যাটি খুব কঠিন নয় কিন্তু আপাতত সেটি আমরা উপরের ক্লাসের জন্য রেখে দেই।

সময়ের প্রসারণের এই বিখ্যাত সমীকরণটি শুধু একটা মজার সূত্র হতে পারত কিন্তু এটা মোটেও সেটা হয়ে থাকেনি। বিজ্ঞানীরা এর অসংখ্য উদাহরণ দেখেছেন এবং এটি সত্যি।

৩.৩.২ স্থান সঙ্কোচন (Space Contraction)

তোমরা আগের পরিচ্ছেদে দ্বিতীয় প্রজন্মের লেপটন হিসেবে মিউওনের কথা পড়েছ। বায়ুমণ্ডলে পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় 10 km উপরে কসমিক রে'র আঘাতে এই মিউওন কণার জন্ম হয় যেটার আয়ু মাত্র 2.2 মাইক্রো সেকেন্ড। এটি যদি প্রায় আলোর বেগেও (3) × 10° m/s) ছুটে আসে তাহলে এই সময়ে এটি মাত্র 0.66 km দূরত্ব অতিক্রম করবে, কোনোভাবেই পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারবে না।

কিন্তু আমরা নিয়মিতভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে মিউওন দেখে থাকি কারণ এটি আলোর বেগের কাছাকাছি (0.998c) বেগে ছুটে আসার কারণে সময় প্রসারণ ঘটে থকে। 2.2 মাইক্রো সেকেন্ড 

চিত্র: ৩.১০: স্থির পৃথিবী থেকে ছুটে আসা মিউওনকে মনে হবে বেগে নিচে ছুটে আসছে। মিউওন থেকে মনে হবে পৃথিবীটাই মিউগুনের দিকে বেগে ছুটে আসছে।

সময় প্রসারিত হওয়ার কারণে তার মান হয়: 

0.998c বেগে 35 মাইক্রো সেকেন্ডে অতিক্রান্ত দূরত্ব 10.5 কিমি, যেটি পৃথিবী পৃষ্ঠে এসে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট।

মিউওনের পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে আসার ব্যাপারটি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। ধরা যাক বায়ুমণ্ডলের উপর থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠের দূরত্ব ।. এবং তুমি তোমার ঘড়িতে একটি মিউওনকে। সময়ে এই দূরত্ব অতিক্রম। করতে দেখেছ (চিত্র ৩.১০)। কাজেই তোমার কাছে মনে হবে মিউওনের বেগ হচ্ছে:       = L/t

আবার মিউওনের ঘড়িতে (1) মিউওনের মনে হবে সে নিজে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পৃথিবীটাই বেগে তার দিকে ছুটে আসছে (চিত্র ৩.১০) এবং। সময়ে পৃথিবীটা তার কাছে পৌঁছে গেছে। মিউওনের যদি মনে হয় পৃথিবীটা। দূরত্বে আছে তাহলে তার কাছে বেগটা হচ্ছে: 

লক্ষ করো,এর মান সবসময়েই 1 থেকে কম, কাজেই L-এর মান সব সময়ই । থেকে 1-2 কম। এখানে আমাদের স্থির অবস্থার সাপেক্ষে কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য। (মিউওনের জন্য 10.5km) হলে আমাদের সাপেক্ষে বেগে গতিশীল কাঠামো থেকে সেই দূরত্বটিকে মনে হবে। (মিউওনের জন্য 0.63km)। কাজেই মিউওন যখন প্রচণ্ড বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছিল, তার মনে হচ্ছিল সে বুঝি স্থির বরং পৃথিবীটাই প্রচণ্ড বেগে তার দিকে ছুটে আসছে। শুধু তা-ই না, সে কারণে বায়ুমণ্ডল থেকে পৃথিবী পর্যন্ত, পুরো দূরত্বটাই সংকুচিত হয়ে ছোটো একটুখানি হয়ে গেছে। তাই মিউওন মাত্র 2.2 মাইক্রো সেকেন্ড বেঁচে থেকেই এই ছোটো দূরত্বটা অতিক্রম করে ফেলেছে।

৩.৩.৩ আপেক্ষিক ভরবেগ ও শক্তি (Mass & Energy)

আমরা সবাই জানি আমদের ত্রিমাত্রিক জগতে একটা বস্তুর অবস্থানকে নির্দিষ্ট করতে তিনটি মাত্রার জন্য তিনটি স্থানাঙ্কের প্রয়োজন হয়, একটি কোঅর্ডিনেট সিস্টেমে সেই তিনটি মাত্রার স্থানাংককে সাধারণত x, y এবং z দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এবারে তোমরা একটি বিস্ময়কর তথ্যের জন্য প্রস্তুত হও আইনস্টাইনLOSOP তার আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন, প্রকৃতিকে অনেক সহজে ব্যাখ্যা করা যায় যদি আমরা ত্রিমাত্রিক জগতটিকে চতুর্মাত্রিক জগৎ হিসেবে ধরে নিই, যেখানে চতুর্থ মাত্রাটি হচ্ছে সময়। এই চতুর্মাত্রিক জগতে একটি বস্তুর অবস্থান শুধু তিনটি স্থানাংক দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয় না, তার সঙ্গে সময়টিকেও একটি মাত্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী কালে তোমরা এই নতুন উপলব্ধির কারণে কীভাবে বিজ্ঞানের জগৎটি শুধু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি, অনেক নতুন বিজ্ঞানেরও জন্ম দিয়েছে সেগুলো জানার সুযোগ পাবে। আপাতত আমরা শুধু নতুন কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তোমাদের জানিয়ে দিই, সেজন্য একটি স্থির কাঠামো এবং তার সাপেক্ষে একটি গতিশীল বস্তুর সঙ্গে যুক্ত আরেকটি কাঠামো কল্পনা করে নিই।

চিত্র ৩.১১: বামদিকে চলন্ত ট্রেনের মাঝখানে বসে থাকা একজন যদি একসঙ্গে দুই পাশে দুটি আলোক রশ্মি হাড়ে সে দেখবে দুটি আলোক রশ্মি একইসঙ্গে ট্রেনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। ডানপাশের ছবিতে, একজন বহিরে দাঁড়িয়ে চলন্ত ট্রেনের দিকে তাকালে দেখবে ট্রেনটি ডানদিকে সরে যাওয়ার কারণে আলোক রশ্মি বামদিকে আগে ট্রেনের শেষ প্রান্তে পৌঁছাচ্ছে, এবং ডানদিকে পরে।

১। একটি কাঠামোতে যদি একই সময়ে কিন্তু ভিন্ন অবস্থানে দুটি ঘটনা ঘটে তাহলে গতিশীল ভিন্ন কাঠামোতে মনে হবে ভিন্ন সময়ে দুটি ঘটনা ঘটেছে।

২। একটি কাঠামোতে যদি একই অবস্থানে কিন্তু ভিন্ন সময়ে দুটি ঘটনা ঘটে তাহলে গতিশীল ভিন্ন কাঠামোতে মনে হবে ভিন্ন অবস্থানে দুটি ঘটনা ঘটেছে।

দেখতেই পাচ্ছ সময় সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণা আপেক্ষিক তত্ত্ব পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিয়েছে।

তবে আপেক্ষিক তত্ত্বের কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্রটি আগেই অনেকবার তোমাদের বলা হয়েছে, সেটি হচ্ছে:  E = mc²

এখানে E হলো শক্তি, m হলো ভর, আর হলো আলোর বেগের মান। অর্থাৎ, পদার্থের ভরকেও আসলে শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। সেক্ষেত্রে অল্প একটুখানি ভর থেকে প্রচুর পরিমাণ শক্তি তৈরি করা যায়। আপেক্ষিক সূত্রে একটুখানি গভীরে গেলেই এই সূত্রটিকে বের করে ফেলা যায় কিন্তু আমরা আপাতত সেটি না করে শধু সূত্রটি তোমাদের জানিয়ে রাখছি।

আপেক্ষিক তত্ত্বের এই আলোচনায় আমরা সব সময় সমবেগ ধরে নিয়েছি, কোনো ত্বরণ বিবেচনা না করে একটি বিশেষ অবস্থা কল্পনা করে নেওয়া হয় বলে এটিকে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব (special theory of relativity) বলা হয়। যখন সমবেগের পরিবর্তে ত্বরণযুক্ত অবস্থা বিবেচনা করা হয় তখন সেটি হচ্ছে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব (General theory of relativity)। সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে, মহাবিশ্বের প্রসারণ বা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব সবকিছু ব্যাখ্যা করে থাকে।

 

Content added By
Promotion