ইমান মুফাস্‌সাল

চতুর্থ শ্রেণি (প্রাথমিক) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - ইমান ও আকাইদ | NCTB BOOK
আমান্তু বিল্লাহি ওয়ামালাইকাতিহী ওয়াকুতুবিহী 
ওয়ারুসুলিহী ওয়াইয়াওমিল আখিরি ওয়ালকাদরি
খাইরিহী ওয়াশাররিহী মিনাল্লাহি তাআলা                خَيْرِهِ وَشَرِهِ مِنَ اللَّهِ تَعَالَى
ওয়াল বা‘সি বা'দাল মাউত ।                       وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْ

অর্থ : আমি ইমান আনলাম আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাব ও তাঁর রাসুলগণের উপর। আরও ইমান আনলাম শেষ দিবসে ও তকদিরের ভালোমন্দে যা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে।

ইমান অর্থ বিশ্বাস। আর মুফাসসাল অর্থ বিস্তারিত । ইমান মুফাসসাল অর্থ বিস্তারিত বিশ্বাস। আমরা মুমিন। ইসলামের কতকগুলো মূল বিষয়ের উপর আমাদের ইমান আনতে হয়। আমরা এর আগে যে বিষয়গুলোকে সংক্ষিপ্ত কথায় স্বীকার করেছি, এখন সে বিষয়গুলোকে বিস্তারিত ভাবে জানব। বিস্তারিতভাবে স্বীকার করব। সে জন্য একে বলা হয় ইমান মুফাসসাল ।

ইমান মুফাসালে আমরা সাতটি বিষয়ের উপর ইমান আনি। বিষয়গুলো হলো :

১. আল্লাহ ২.  ফেরেশতা৩. কিতাব
৪. রাসুলগণ৫. শেষ দিবস৬. তকদির
৭. মৃত্যুর পর পুনরুত্থান 

১। ইমানের প্রথম বিষয় : আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাস

ইমানের প্রথম কথাই হলো আল্লাহ তায়ালার উপর বিশ্বাস। আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ তাঁর সত্তায় এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোনো শরিক নেই। তিনি তাঁর গুণাবলিতেও অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। তিনি অনাদি, অনন্ত। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। যখন কোনো কিছুই ছিল না তখন ছিলেন তিনি। আবার একদিন সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তিনিই থাকবেন। মহান আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু শোনেন ও দেখেন। আসমান জমিনের সবকিছু তাঁর সৃষ্টি। তিনি সকল সৃষ্টির পালনকর্তা। তিনি পরম দয়ালু। তিনিই সবকিছুর মালিক। আমরা ভালো কাজ করলে তিনি খুশি হন। মন্দ কাজ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন। আমরা আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ভালো কাজ করব।

২। ইমানের দ্বিতীয় বিষয় : মালাইকা বা ফেরেশতাগণে বিশ্বাস

ফেরেশতাগণ আল্লাহ তায়ালার বিশেষ সৃষ্টি। তাঁরা নূরের তৈরি। নূর মানে আলো। তাঁরা আল্লাহর আদেশে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। তাঁরা কখনো আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন না। তাঁদের পানাহারের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর জিকিরই তাঁদের জীবিকা। তাঁদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তাঁদের মধ্যে চারজন ফেরেশতা প্রসিদ্ধ।

ক. হযরত জিবরাইল (আ) : তিনি নবি-রাসুলগণের কাছে আল্লাহর ওহি নিয়ে আসতেন। ওহি মানে আল্লাহর বাণী।

খ. হযরত মিকাইল (আ) : তিনি জীবের জীবিকা বণ্টন ও মেঘবৃষ্টির দায়িত্বে নিয়োজিত ।

গ. হযরত আযরাইল (আ) : তিনি আল্লাহর হুকুমে জীবের জান কবজ করেন।

ঘ. হযরত ইসরাফিল (আ) : তিনি শিঙ্গা হাতে আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় আছেন । তিনি প্রথম ফুঁ দেবেন, তাতে সকল সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ফুঁ দেবেন তখন সবকিছু জীবন ফিরে পাবে।

একদল ফেরেশতা আছেন, যারা মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব রাখেন। তাঁদের বলে কিরামান কাতিবিন। মানে সম্মানিত লেখকগণ। মুনকার-নকির নামে আরও ফেরেশতা আছেন। তারা কবরে প্রশ্ন করবেন। প্রশ্ন করবেন- আল্লাহ, রাসুল ও দীন সম্বন্ধে। আল্লাহর অনুগত বান্দারা এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন।

৩। ইমানের তৃতীয় বিষয় : আসমানি কিতাবে বিশ্বাস

আল্লাহ তায়ালা নবি-রাসুলের কাছে ওহি পাঠিয়েছেন। ওহি হলো আল্লাহর বাণী। আল্লাহর বাণীসমূহের সমষ্টিকে বলে আসমানি কিতাব। আসমানি কিতাবে আছে মানুষের জন্য হিদায়াত। মুক্তির কথা।

আসমানি কিতাব হলো ১০৪ খানা। ৪ খানা বড়। আর ১০০ খানা ছোট। ছোট কিতাবকে সহীফা বলে। সহীফা মানে পুস্তিকা ।

৪ খানা বড় কিতাব হলো :

১. তাওরাত : হযরত মূসা (আ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।

২. যাবূর : হযরত দাউদ (আ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।

৩. ইনজিল : হযরত ঈসা (আ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।

৪. কুরআন মজিদ : হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল।

কুরআন মজিদ সর্বশেষ আসমানি কিতাব। এতে আছে কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বের সকল মানুষের সব সমস্যার সমাধান, ভালো হওয়ার শিক্ষা। আমরা সকল কিতাবে বিশ্বাস করব। আর কুরআন মজিদের শিক্ষা মেনে চলব।

৪। ইমানের চতুর্থ বিষয় : নবি-রাসুলে বিশ্বাস

আমরা আগেই জেনেছি মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা ওহি পাঠিয়েছেন। ওহি আসত নবি-রাসুলগণের কাছে। নবি-রাসুলগণ মানুষের শিক্ষক। তাঁরা আদর্শ শিক্ষক। তাঁরা ছিলেন নিঃস্বার্থ মানবদরদি। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন । তাঁকে খুশি করার পথ দেখাতেন। কিতাবে বিশ্বাস করা যেমন ইমানের অঙ্গ, নবি-রাসুলে বিশ্বাস করাও তেমনি ইমানের অঙ্গ।

প্রথম নবি হলেন হযরত আদম (আ)। আর শেষ নবি হলেন হযরত মুহাম্মদ (স)। এই দুজনের মাঝে অনেক নবি-রাসুল এসেছেন। আল্লাহ বলেন “এমন কোনো জনপদ নেই যেখানে আমি কোনো নবি পাঠাইনি।”

কুরআন মজিদে ২৫ জন নবি-রাসুলের নাম উল্লেখ আছে। যেমন হযরত আদম (আ), হযরত ইদরীস (আ), হযরত নূহ (আ), হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত ইসমাঈল (আ), হযরত ইসহাক (আ), হযরত ইয়াকুব (আ), হযরত ইউসূফ (আ), হযরত হূদ (আ), হযরত সালিহ (আ), হযরত লূত (আ), হযরত শুআইব (আ), হযরত আইয়্যুব (আ), হযরত জাকারিয়া (আ), হযরত দাউদ (আ), হযরত সুলাইমান (আ), হযরত মূসা (আ), হযরত ঈসা (আ), হযরত মুহাম্মদ (স) । আমরা সকল নবি-রাসুলগণে বিশ্বাস করব। সম্মান করব। আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর আদর্শ মেনে চলব।

৫। ইমানের পঞ্চম বিষয় : শেষ দিবসে বিশ্বাস

আমরা এই দুনিয়ায় চিরদিন বেঁচে থাকি না। এ জীবন চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী আমাদের যেমন জন্ম আছে, তেমনি মৃত্যুও আছে। সকল প্রাণীরই মৃত্যু আছে। যার জীবন আছে তার মৃত্যু আছে। আমাদের সুন্দর পৃথিবীও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না ।

আমাদের মৃত্যুর পরের জীবনকে বলে আখিরাত। আখিরাত মানে পরকাল। মৃত্যুর পরেই এ জীবনের শুরু হয়। কবর, কিয়ামত, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম-এসবই আখিরাতের জীবনের অন্তর্ভুক্ত। আখিরাতের জীবনের শুরু আছে শেষ নেই। সে জীবন অনন্ত কালের । আল্লাহ বলেন, “এ দুনিয়ার জীবনতো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু । আর আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস।”

ইমানের অন্যান্য বিষয়ের উপর বিশ্বাস যেমন জরুরি, আখিরাত বা শেষ দিবসে বিশ্বাসও তেমনি জরুরি। দুনিয়ায় যে যেমন কাজ করবে আখিরাতে তেমনি ফল ভোগ করবে। ভালো কাজ করলে আখিরাতে পুরস্কার পাবে। আর মন্দ কাজের জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। শেষ দিবস বা আখিরাতে বিশ্বাসী ব্যক্তি তার কাজকর্মে সতর্ক হয়। পুরস্কারের আশায় ভালো কাজ করে। আর শাস্তির ভয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। এতে তার নৈতিক চরিত্র উন্নত হয় ৷

  কবি যথার্থই বলেছেন, 

                                                       দুনিয়াটা আখিরাতের

                                                           খামার বাড়ি ভাই

                                                   ভবের হাটের ক্ষেতখামারে 

                                                         ফসল ফলান চাই ৷ 

                                                    এই ফসলের নেইকো জুড়ি

                                                      এক কণা তার হয় না চুরি 

                                                        হিসাব লেখেন দুই মুহরী 

                                                                সদা সৰ্বদাই ॥

                                                       অচিন দেশের যাত্রী সবাই

                                                        টারমিনালে ক্ষণিকের ঠাঁই

                                                         কখন যে হায় ঘণ্টা বাজে

                                                              ঘড়ির সময় হলে ॥

                                                                                          —কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী

৬। ইমানের ষষ্ঠ বিষয় : তকদিরে বিশ্বাস

তকদির মানে ভাগ্য। আমাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকারী আল্লাহ তায়ালা। আমাদের জীবনে যা ঘটে, যা হয় সবই হয় আল্লাহর নির্ধারিত হুকুমে। এই নির্ধারিত হুকুমকে বলে তকদির। আমাদের ভাগ্যে কী আছে, আমরা তা জানি না। আমরা চেষ্টা করব, কাজ করে যাব। আর ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করব। সফল হলে শোকর করব। বিফল হলে সবুর করব, তকদির বলে মেনে নিব। তকদিরে বিশ্বাস মানুষকে অলস করে না।

আশায় উজ্জীবিত করে।

৭। ইমানের সপ্তম বিষয় : মৃত্যুর পর পুনরুথানে বিশ্বাস

মৃত্যুই আমাদের শেষ কথা নয়। ইহকালে আমরা যেসব কাজ করি তার জবাবদিহি করতে হবে পরকালে। সকলকে আবার জীবিত করে হাশরের ময়দানে উঠানো হবে। সেখানে হিসাব-নিকাশ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে বিচার করা হবে। বিচারক হবেন মহান আল্লাহ । ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে জান্নাত দেওয়া হবে। জান্নাত হলো পরম সুখের স্থান। যারা পাপ করবে, খারাপ কাজ করবে তাদের শাস্তির জন্য নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে। জাহান্নাম হলো চরম দুঃখ-কষ্ট ও ভীষণ শাস্তির স্থান।

পুনরুত্থানে বিশ্বাস মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলে। পুরস্কারের আশায় সৎকর্মশীল করে তোলে। আর শাস্তির ভয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। এতে নৈতিক চরিত্র উন্নত হয়। আমরা-

                                           একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকেই মাবুদ বলে বিশ্বাস করব।

                                           আল্লাহর ফেরেশতাগণে বিশ্বাস করব।

                                            আল্লাহর রাসুলগণকে বিশ্বাস করব।

                                           শেষ দিবসে বিশ্বাস করব। তকদিরে বিশ্বাস করব।

                                            মৃত্যুর পর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করব। 

                                            আখিরাতের পুরস্কারের আশায় ভালো কাজ করব। 

                                            আখিরাতের শাস্তির ভয়ে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকব। 

                                             আমাদের নৈতিক চরিত্র উন্নত করব।

পরিকল্পিত কাজ:

১. শিক্ষার্থীরা ইমান মুফাস্সালের অর্থ সুন্দর করে খাতায় লিখবে।

২. শিক্ষার্থীরা চারজন প্রধান ফেরেশতার নাম ও তাঁদের কাজ খাতায় লিখবে।

৩. শিক্ষার্থীরা দশজন নবি-রাসুলের নাম খাতায় লিখবে। 

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion