প্রাণীর মতো উদ্ভিদের প্রতিটি কোষেও বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম একযোগে এবং প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। এ কাজগুলো একটি নিয়মশৃঙ্খলার মাধ্যমে সংঘটিত হয়, এ কারণে উদ্ভিদ জীবনে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের সমন্বয় (co-ordination) অপরিহার্য। এ সমন্বয় না থাকলে উদ্ভিদ জীবনে বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
একটি উদ্ভিদের জীবনকালে সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনচক্রের পর্যায়গুলো, যেমন অঙ্কুরোদগম, বৃদ্ধি ও বিকাশ, পুষ্পায়ন, ফল সৃষ্টি, পূর্ণতা, সুপ্তাবস্থা ইত্যাদি একটি সুশৃঙ্খল নিয়ম মেনে চলে। এসব কাজে আবহাওয়া এবং জলবায়ুজনিত প্রভাবকগুলোর গুরুত্বও লক্ষ করার মতো।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং চলনসহ বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত জটিল এবং চলমান। তা সত্ত্বেও এ কাজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে বিশেষ নিয়ম মেনে সম্পন্ন হয়, একটি কাজ কোনোভাবেই অন্য কাজকে বাধা প্রদান করে না। লক্ষ-কোটি বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে এমন সূক্ষ্ম সমন্বয় অর্জিত হয়েছে।
যে জৈব রাসায়নিক পদার্থ উদ্ভিদদেহে উৎপন্ন হয়ে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং বিকাশ, বিভিন্ন অঙ্গ সৃষ্টি ইত্যাদি কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে হরমোন বা প্রাণরস বলে। উদ্ভিদ হরমোনকে ফাইটোহরমোন (Phytohormones) বলা হয়। কেউ কেউ ফাইটোহরমোনকে উদ্ভিদ বৃদ্ধিকারক বস্তু (Plant growth substances) হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। অধিকাংশ বিজ্ঞানীদের মতে, যে রাসায়নিক বস্তুটি কোষে উৎপন্ন হয় এবং উৎপত্তিস্থল থেকে বাহিত হয়ে দূরবর্তী স্থানের কোষ বা কোষপুঞ্জের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাই হচ্ছে হরমোন (Hormone)। উদ্ভিদের প্রতিটি কোষই হরমোন উৎপন্ন করতে পারে। এরা কোনো পুষ্টিদ্রব্য নয় তবে ক্ষুদ্রমাত্রায় উৎপন্ন হয়ে উদ্ভিদের বিভিন্ন জৈবিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন: অক্সিন (Auxin), জিবেরেলিন (Gibberellin), সাইটোকাইনিন (Cytokinin), অ্যাবসিসিক এসিড (Abscisic acid), ইথিলিন (Ethylene) ইত্যাদি।
উল্লিখিত এসব হরমোন ছাড়াও উদ্ভিদে আরও কিছু হরমোন রয়েছে, যাদের আলাদা করা বা শনাক্ত করা যায়নি। এদের পসটুলেটেড হরমোন (Postulated hormones) বলে। এরা প্রধানত উদ্ভিদের ফুল ও জনন সংশ্লিষ্ট অঙ্গের বিকাশে সাহায্য করে। এদের মধ্যে ফ্লোরিজেন (Florigen) এবং ভার্নালিন (Vernalin) প্রধান। ধারণা করা হয়, ফ্লোরিজেন পাতায় উৎপন্ন হয় এবং তা পত্রমূলে স্থানান্তরিত হয়ে পত্রমুকুলকে পুষ্পমুকুলে রূপান্তরিত করে। তাই দেখা যায়, ফ্লোরিজেন উদ্ভিদে ফুল ফোটাতে সাহায্য করে। নিচে প্রধান ফাইটোহরমোনগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
(a) অক্সিন
চার্লস ডারউইন এ হরমোন প্রথম আবিষ্কার করেন। যাকে কোল (Kogl) এবং হ্যাগেন স্লিট (Haagen Snit) পরবর্তীতে অক্সিন নামে অভিহিত করেন। চার্লস ডারউইন উদ্ভিদের ভ্রূণমুকুলাবরণীর (Coleoptiles) উপর আলোর প্রভাব লক্ষ করেন। যখন আলো বাঁকাভাবে একদিকে লাগে, তখন ভূণমুকুলাবরণী আলোর উৎসের দিকে বেঁকে যায়। অথচ অন্ধকারে এটি খাড়াভাবে বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে ভ্রূণণমুকুলাবরণীর অগ্রভাগে অবস্থিত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এর জন্য দায়ী। ঐ পদার্থটি অক্সিন নামক হরমোন। অক্সিন প্রয়োগ করা হলে শাখা কলমে মূল গজায় এবং অকালে ফলের ঝরে পড়া বন্ধ হয়। উদ্ভিদকোষে অক্সিনের পরিবহন নিম্নমুখীভাবে হয়। অক্সিনের প্রভাবে অভিস্রবণ এবং শ্বসন ক্রিয়ার হার বেড়ে যায়। বীজহীন ফল উৎপাদনেও এর ব্যবহার রয়েছে। অক্সিন প্রকৃতপক্ষে একটিমাত্র হরমোন নয়, এটি বেশকিছু ফাইটোহরমোনের একটি সাধারণ নাম বা শ্রেণি যারা সবাই কোনো না কোনোভাবে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত, যেমন: ইন্ডোল অ্যাসিটিক এসিড (IAA), ইন্ডোল বিউটাইরিক (IBA), ন্যাপথালিন অ্যাসিটিক এসিড (NAA) ইত্যাদি।
(b) জিবেরেলিন
ধানের বাকানি (Bakanae) রোগের জীবাণু এক ধরনের ছত্রাক যা ধানগাছের অতিবৃদ্ধি ঘটায়। এই ছত্রাক থেকে এক ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশিত হয়, যার প্রভাবে এরকম অতিবৃদ্ধি হয়ে থাকে। এই পদার্থটি জিবেরেলিন। অধিকাংশ জিবেরেলিন উদ্ভিদের পাকা বীজে থাকে, তবে চারাগাছ, বীজপত্র এবং পত্রের বর্ধিষ্ণু অঞ্চলেও এটি দেখা যায়। এর প্রভাবে উদ্ভিদের পর্বমধ্যগুলো দৈর্ঘ্যে বেড়ে যায়, যার কারণে উদ্ভিদ কান্ডের অতিবৃদ্ধি ঘটে। এ জন্য খাটো উদ্ভিদে এই হরমোন প্রয়োগ করলে উদ্ভিদটি অন্যান্য সাধারণ উদ্ভিদ থেকেও অধিক লম্বা হয়ে যায়। ফুল ফোটাতে, বীজের সুপ্তাবস্থার দৈর্ঘ্য কমাতে এবং অঙ্কুরোদগমে এর কার্যকারিতা রয়েছে।
(c) সাইটোকাইনিন
এই ফাইটোহরমোন বা উদ্ভিদ হরমোনটি ফল, শস্য এবং ডাবের পানিতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো উদ্ভিদের মূলেও এদের পাওয়া যায়। সাধারণভাবে এটি বিভিন্ন ঘনত্বে অক্সিনের সাথে যুক্ত হয়ে কোষ বিভাজনকে উদ্দীপিত করে। এছাড়া কোষবৃদ্ধি, অঙ্গের বিকাশসাধন, বীজ এবং অঙ্গের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গকরণে ও বার্ধক্য বিলম্বিতকরণে এ হরমোন ভূমিকা পালন করে। কোষ বিভাজনের সময় সাইটোকাইনিন হরমোনের প্রভাবে কোষের সাইটোকাইনেসিস ঘটে।
(d) ইথিলিন
এ হরমোনটি একটি গ্যাসীয় পদার্থ। এটি ফল পাকাতে সাহায্য করে। এই হরমোন ফল, ফুল, বীজ, পাতা এবং মূলেও দেখা যায়। ইথিলিন বীজ এবং মুকুলের সুপ্তাবস্থা ভঙ্গ করে, চারা গাছের কান্ডের বৃদ্ধি ঘটিয়ে চারা গাছকে লম্বা হতে সাহায্য করে, ফুল এবং ফল সৃষ্টির সূচনা করে। ইথিলিন পাতা, ফুল এবং ফলের ঝরে পড়া ত্বরান্বিত করে। কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
হরমোনের ব্যবহার
অক্সিন ও অন্যান্য কৃত্রিম হরমোন শাখাকলমে মূল উৎপাদনে সাহায্য করে। ইন্ডোল অ্যাসিটিক এসিড (IAA) নামক এক ধরনের অক্সিনের প্রভাবে ক্যাম্বিয়ামের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যালাস নামক (Callus) এক ধরনের অনিয়ন্ত্রিত কোষগুচ্ছের সৃষ্টি হয় এবং ক্ষতস্থান পূরণ হয়। অক্সিন প্রয়োগ করে ফলের মোচন বিলম্বিত করা হয়। বীজহীন ফল উৎপাদনে অক্সিন ও জিবেরেলিনের ব্যবহার রয়েছে।
বৃদ্ধি (Growth)
উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গ বিকাশের ক্ষেত্রে আলো এবং উষ্ণতার প্রভাব লক্ষণীয়। এর ফলে বিভিন্ন সংশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন উপাদান উৎপন্ন হয়ে নতুন অঙ্গের সৃষ্টি করে। আলোর উপস্থিতিতে সম্ভবত অক্সিন হরমোন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ফলে অন্ধকারের দিকে অক্সিনের ঘনত্ব বাড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, আলোর দিকে থাকা অক্সিন অন্ধকার দিকে চলে যায়, ফলে সেদিকে বৃদ্ধি বেশি হয় এবং আলোকিত অংশের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, কাজেই উদ্ভিদটি আলোর দিকে বেঁকে বৃদ্ধি পায়।
ভূণমূল বা ভ্রূণকাণ্ডের অগ্রাংশ অভিকর্ষের উদ্দীপনা অনুভব করতে পারে। একে অভিকর্ষ উপলব্ধি (Geoperception) বলে। অভিকর্ষণের ফলে কোষের উপাদানগুলো নিচের দিকে স্থানান্তরিত হয়। এদের চাপ পড়ে পার্শ্বীয় কোষের প্রাচীরে। এর ফলে অভিকর্ষণীয় চলন দেখা যায়।
অনেক উদ্ভিদের পুষ্প প্রস্ফুটন দিনের দৈর্ঘ্যের উপর অধিক নির্ভরশীল। যেমন চন্দ্রমল্লিকা একটি ছোটদিনের উদ্ভিদ। দীর্ঘ আলোক ঐসব উদ্ভিদে পুষ্প উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়। উদ্ভিদে আলো-অন্ধকারের এ ছন্দ এক ধরনের জৈবিক ঘড়ি (biological clock)-এর উদাহরণ।
উদ্ভিদের আলো-অন্ধকারের ছন্দের উপর ভিত্তি করে পুষ্পধারী উদ্ভিদকে তিন ভাগে করা হয়:
(a) ছোটদিনের উদ্ভিদ (Short Day Plant): পুষ্পায়নে দৈনিক গড়ে 8-12 ঘণ্টা আলো প্রয়োজন। যেমন: চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া।
(b) বড়দিনের উদ্ভিদ (Long Day Plant): পুষ্পায়নে দৈনিক গড়ে 12-16 ঘণ্টা আলো প্রয়োজন। যেমন: লেটুস, ঝিঙা।
(c) আলোক নিরপেক্ষ উদ্ভিদ (Day Neutral Plant): পুষ্পায়নে দিনের আলো কোনো প্রভাব ফেলে না। যেমন: শসা, সূর্যমুখী।
উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং পুষ্পায়নে আলোর মতো তাপ এবং শৈত্যেরও প্রভাব রয়েছে। দেখা গেছে অনেক উদ্ভিদের অঙ্কুরিত বীজকে শৈত্য প্রদান করা হলে তাদের ফুল ধারণের সময় এগিয়ে আসে। শৈত্য প্রদানের মাধ্যমে উদ্ভিদের ফুল ধারণ ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়াকে ভার্নালাইজেশন (Vernalization) বলে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে উদ্ভিদের পুষ্প সৃষ্টিতে উষ্ণতার প্রভাব পড়ে। শীতের গম গরমকালে লাগালে ফুল আসতে বহু দেরি হয়। কিন্তু বীজ রোপণের পূর্বে 2° সেলসিয়াস থেকে 5° সেলসিয়াস উষ্ণতা প্রয়োগ করলে উদ্ভিদে স্বাভাবিক পুষ্প প্রস্ফুটন ঘটে।
কাজেই তোমরা দেখতে পাচ্ছ, আলো, অভিকর্ষ, তাপ এ ধরনের উদ্দীপক উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। এভাবেই উদ্ভিদ তার শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কাজের মধ্যে সমন্বয় ঘটায়।
চলন (Movement)
উদ্ভিদ অন্যান্য জীবের মতো অনুভূতি ক্ষমতাসম্পন্ন। এজন্য অভ্যন্তরীণ বা বহি-উদ্দীপক উদ্ভিদদেহে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, তার ফলে উদ্ভিদে চলন ঘটে। কতগুলো চলন উদ্ভিদদেহের বৃদ্ধিজনিত আবার কিছু চলন অভ্যন্তরীণ এবং পারিপার্শ্বিক উদ্দীপকের প্রভাবে হয়ে থাকে। চলন যেভাবেই হোক না কেন তা অবশ্যই কোনো না কোনো প্রভাবকের কারণে ঘটে থাকে।
উদ্ভিদ চলনকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়, সামগ্রিক চলন (Movement of locomotion) এবং বক্রচলন (Movement of curvature)। উদ্ভিদদেহের কোনো অংশ যখন সামগ্রিকভাবে প্রয়োজনের তাগিদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে তাকে সামগ্রিক চলন বলে। যেমন, হত্রাক এবং উন্নত শ্রেণির উদ্ভিদের যৌনজনন কোষে (Gametes) কিংবা জুস্পোরে- এ ধরনের চলন দেখা যায়। তাছাড়া কিছু ব্যাকটেরিয়া এবং কিছু শৈবাল, যেমন: Volvox, Chlamydomonas ও ডায়াটম শৈবালে এই ধরনের চলন দেখা যায়। অন্যদিকে মাটিতে আবদ্ধ উন্নতশ্রেণির উদ্ভিদ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতে পারে না এবং এদের অঙ্গগুলো নানাভাবে বেঁকে যায়। এ ধরনের চলনকে বজ্রচলন বলে। কান্ডের আলোকমুখী চলন, মূলের অন্ধকারমুখী চলন, আকর্ষী অবলম্বনকে পেঁচিয়ে ধরা ইত্যাদি বক্রচলনের উদাহরণ। সামগ্রিক চলন এবং বক্রচলন আবার নানা ধরনের হয়। তার মধ্যে ফটোট্রপিক চলন উল্লেখযোগ্য।
ফটোট্রপিক চলন বা ফটোট্রপিজম (Phototropic movement or phototropism)
ফটোট্রপিক চলন এক ধরনের বক্লচলল। উদ্ভিদের কান্ড এবং শাখা-প্রশাখার সবসময় আলোর দিকে চলন ঘটে এবং মূলের চলন সবসময় আলোর বিপরীত দিকে হয়। কান্ডের আলোর দিকে চলনকে পজিটিভ ফটোট্রপিজম এবং মূলের আলোর বিপরীত দিকে চলনকে নেগেটিভ ফটোট্রপিজম বলে।
একক কাজ
কাজ: শ্রেণিকক্ষের জানালায় টবসহ একটি উদ্ভিদ রেখে এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ কর এবং প্রাপ্ত ফলাফল যুক্তিসহ উপস্থাপন কর।
একক কাজ
কাজ: কয়েকটি অঙ্কুরিত ছোলা বীজের সাহায্যে মূলের ভূ-অভিমুখী চলন পরীক্ষা কর ও প্রান্ত ফলাফল যুক্তিসহ উপস্থাপন কর।
Read more