উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী। অনন্য চারিত্রিক মাধুর্য দ্বারা তিনি মুসলমানদের বিশেষ করে নারী সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। এ ছাড়াও কুরআন, হাদিসে এবং ফিকহ বিষয়ক জ্ঞানে তাঁর অবদান অপরিসীম।
জন্ম ও শৈশব
প্রসিদ্ধ মতে তিনি নবুয়াতের চতুর্থ বছরে মক্কায় কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত আবুবকর (রা.) এবং মাতা উম্মে রুম্মান। শৈশবকালেই তাঁর আচার-আচরণ, চাল-চলন ও কথাবার্তা সকলকে মুগ্ধ করেছিল।
মহানবি (সা.)-এর সাথে বিবাহ
নবুয়াতের দশম বছরে মহানবি (সা.)-এর সাথে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যার ঘরে থাকা অবস্থায় তাঁর কাছে ওহি অবতীর্ণ হয়েছিল। স্ত্রী হিসেবে তাঁকে গ্রহণের মাঝে ইসলামের প্রভূত কল্যাণ ও হিকমত নিহিত ছিল।
শিক্ষা জীবন
পিতার কাছেই শিশু হযরত আয়েশা (রা.)-এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। তিনি পিতার নিকট থেকে কুষ্টিবিদ্যা ও কাব্য শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জনে সক্ষম হন। এ ছাড়া পিতার কাছে তিনি কাব্য, ইতিহাস, সাহিত্য ও প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন ছাড়াও তিনি গৃহস্থলি বিদ্যায়ও পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কৈশোর ও যৌবনের পুরোটা সময় কেটেছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক মহানবি (সা.)-এর একান্ত সান্নিধ্যে। তাই মহানবির সাহচর্যে তিনি কুরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। নারীদের একান্ত বিষয়সমূহ তিনি মহানবি (সা.) এর কাছে জেনে অন্যদের শিক্ষা দিতেন।
ইফকের ঘটনা
ষষ্ঠ হিজরি সনে বনু মুস্তালিক যুদ্ধে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সফরসঙ্গী ছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাঁর গলার হার হারিয়ে যায়। হার খুঁজতে গিয়ে তিনি কাফেলা থেকে পিছনে পড়ে যান। এতে তাঁর ফিরতে দেরি হয়। এ সুযোগে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই, হাসসান বিন সাবিত, মিসতাহ, হামনাহ প্রমুখ মুনাফিক তাঁর বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতে থাকে। পবিত্র কুরআনে এটি ‘ইফকের ঘটনা' বলে পরিচিত। এতে তিনি চরম মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। তাঁর জীবন বিষণ্ন হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর পিতামাতা চরম উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যান। ফলে মহান আল্লাহ সূরা নূরের ১০টি আয়াত নাজিল করে আয়েশা (রা.)-এর নির্দোষ ও পবিত্রতা ঘোষণা করেন। এভাবে মুনাফিকদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলো এবং তাঁর মর্যাদাও পবিত্র কুরআনে স্থান পেল।
ইসলামি জ্ঞান প্রসারে অবদান
ইসলামি শিক্ষা প্রচার ও সম্প্রসারণে আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতি, অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিগত জীবনসহ পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ইবাদাত, পরকাল সর্বোপরি শারঈ সকল বিধি-বিধান সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করে মুসলিম উম্মাহকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি। অসংখ্য সাহাবি ও তাবেয়ী তাঁর কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি তাফসীর, হাদিস, ফিকহ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নারীদের বিভিন্ন বিষয়ের বিধান বর্ণনায়ও তিনি অগ্রগামী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাকেন্দ্রে একসাথে ২০০ এর অধিক শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করতেন। মুসতাদরাক আল-হাকেম গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে, আয়েশা (রা.) থেকে শরিয়তের এক-চতুর্থাংশ বিধি-বিধান বর্ণিত আছে।
গুণাবলি
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন অনুপম চরিত্র-মাধুর্যের অধিকারী। তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাশক্তিসম্পন্ন, বিদুষী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, তেজস্বিনী, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী, গৃহকর্মে সুনিপুণা, শিক্ষয়িত্রী, সত্যের সাধিকা, অগ্নিবর্ষী বাগীশ, সচ্চরিত্রা, মধুর আলাপী, ধৈর্যশীল, আদর্শ স্ত্রী, জ্ঞানতাপস ও সদালাপী। এক কথায় মানবীয় চারিত্রের সকল গুণই তাঁর মধ্যে বিরাজমান ছিল। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল মুমিনা ছিলেন। তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। তাঁর সতীত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়। তা ছাড়া আল্লাহ তা'আলা তাঁর উসিলায় তায়াম্মুমের বিধান চালু করেন।
তিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই রোযা রাখতেন এবং রাত্রি বেলায় আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগিতে নিজেকে মশগুল রাখতেন। দান-সদকা করতে তিনি পছন্দ করতেন। অসহায়, ফকির, মিসকিনকে কিছু দান করতে পারলে তিনি তৃপ্তি পেতেন। দানশীলতা, মিতব্যয়িতা, পরোপকারিতা, ধর্মপারায়ণতা, দয়াসহ সর্বপ্রকার গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন।
মর্যাদা
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মহানবি (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন, ‘নারী জাতির উপর আয়েশা সিদ্দিকা (রা)-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর উপর সারিদের মর্যাদা।’(বুখারি ও ইবনে মাজাহ) সারিদ হলো আরবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য যা রুটি-গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘আয়েশা (রা.) হলেন মহিলাদের সাহায্যকারিণী।' (কানযুল উম্মাল )
একবার আমর বিন আস (রা.) রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, আয়েশা। আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে? তিনি বলেন, তাঁর বাবা।' (বুখারি) সুতরাং এ থেকে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-এর সুউচ্চ মর্যাদা প্রমাণিত হয়।
ইন্তেকাল
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ৫৮ হিজরির ১৭ রমযান ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয়।
দলগত কাজ : শিক্ষার্থীরা হযরত আয়েশা (রা.)- এর চরিত্রের উত্তম গুণাবলি ও মর্যাদা সম্পর্কে একটি পোস্টার তৈরি করবে। |
আরও দেখুন...