কল্পনানির্ভর লেখা

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - রচনা পড়ি দৃষ্টিভঙ্গি বুঝি | NCTB BOOK
Please, contribute to add content into কল্পনানির্ভর লেখা.
Content

কল্পনানির্ভর রচনায় বৈচিত্র্য

নিচে কয়েক ধরনের কল্পনানির্ভর রচনার তালিকা দেওয়া হলো। এসব কল্পনানির্ভর রচনার বৈশিষ্ট্য কী, ডানের কলামে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।

কল্পনানির্ভর রচনায় শ্রেণি

রচনার বৈশিষ্ট্য

রূপকথা 
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি 
রম্যরচনা 

নিচে গোলা গোলাম মুরশিদের লেখা একটি কল্পনানির্ভর রচনা দেওয়া হলো। রচনাটি আমেরিকান লেখক লিও বুসকাগলিয়ার যার (১৯২৪-১৯৯৮) কাহিনির ছায়া অবলম্বনে রচিত।

গোলাম মুরশিদ (জন্ম ১৯৪০) বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 'আশার ছলনে ভুলি', 'হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি', 'বিদ্রোহী রণক্লান্ত' ইত্যাদি।

 

কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু

গোলাম মুরশিদ

কখন যে বসন্ত চলে গেছে টেরই পাইনি। গরমের সুন্দর হাওয়া গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমার জন্ম মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে, পাহাড়ের গায়ে। তাই ভারি ভালো লাগছে এই উষ্ণ হাওয়া। আমার নাম কিশলয়। এখনো কিশোর আমি। প্রথম আমি চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম বসন্তের এক ভোরবেলায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম চারদিকটা। আমার বাসা একটা বড়ো গাছের মগডালে। আমার চারদিকে আমারই মতো শত শত পাতা। তোমরা বোধহয় পাতাগুলোকে ভাবো একই চেহারার। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখো, হুবহু একই চেহারার দুটি পাতা পাবে না তুমি। আমার ধারেই থাকে 'আলো'। আলোর মতোই তার স্বভাবটা হালকা-

খিলখিল করে হাসে। আর ডান পাশে বেণু। পর্ণা থাকে একটু সামনে, ওপরের দিকে।

ছেলেবেলা থেকে আমরা সবাই বাতাসের সঙ্গে গাইতে শিখেছি, নাচতে শিখেছি। রোজ রোদে স্নান করি। কী যে ভালো লাগে। তারপর বিকেল বেলা যখন আলো কমে আসে; আমার মন খারাপ করে তখন। আলো, বেলু, পর্ণী-ওদেরও করে বোধহয়।

মাঝেমধ্যে বৃষ্টি নামে। তার ধারায় স্নান করতে আমার খুব ভালো লাগে। সমস্ত শরীরটা ধুয়ে যায়। সে বৃষ্টিও কি এক রকম! কখনো ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে। কখনো অঝোর ধারায় যেন রাগ করে ঝরতে থাকে। সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে সে গর্জন করতে থাকে। তার রাগী চোখের দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত আকাশটাকে আলোতে ঝলসে দেয়। কিন্তু একটু পরই যখন তার মেজাজ ভালো হয়, তখন রোদ হেসে ওঠে।

আলোর কথা বলেছি, বেণুর কথা বলেছি, পর্ণার কথাও। কিন্তু এখনো শোনোনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুর কথা। তার নাম ঋষি। সে অনেক কিছু জানে।

ঋষিই একদিন বলেছিল আমাকে, আমরা নাকি সবাই একটা গাছের অংশ। গাছটা আছে একটা ছোটো গাঁয়ের এক পাশে-একটা বাগানে। গায়ের লোকেরা একে বলে পার্ক। সবুজ ঘাস বিছানো একটা মাঠ আছে সেই বাগানে। চারদিকে অনেক গাছ। নানা ধরনের গাছ। কোনোটার পাতা বড়ো, কোনোটার ছোটো। কারও পাতা বেশ গোল, কারও লম্বাটে। যে গাছে আমার জন্ম তার পাশেই আছে একটা দেবদারু গাছ। লম্বা লম্বা কোঁকড়ানো পাতা। কিন্তু দূরে আছে একটা মজার গাছ। তার পাতাগুলো খুব সরু আঁশের মতো। যখন তার গায়ে হাওয়া লাগে, তখন শোঁ শোঁ করে সে গান করে। অন্য গাছের পাতারা চুপ করে শোনে। মাঝেমধ্যে তারা ঝরঝর মড়মড় করে তালি দেয়। পাতার মতোই-অনেক গাছে ফল ধরে, আবার অনেক গাছে ফল ধরে না। যে গাছে আমার জন্ম, সে গাছে কোনো ফল ধরে না।

একদিন ঋষি বলেছিল, গাছগুলো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মাটির তলায় আছে তাদের শেকড়। লম্বা, মোটা, খুব শক্ত শেকড়। মাট আঁকড়ে ধরেই গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। রোজ গাছের ডালে এসে বাসে নানা রকমের পাখি। গাছের ডালেই তারা বাসা বাঁধে। রাতের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু রাত পোয়ানোর আগেই তাদের ঘুম ভেঙে যায়।

আমি যে একটা পাতা-এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে আমার। ভালো লাগে আশপাশের বন্ধুদের। আর আমি সত্যি ভালোবাসি যে গাছে আমার জন্ম, তাকে। সেই তো আমার মা। তার রস খেয়েই নাকি আমরা বেঁচে আছি-মায়ের দুধের মতো। আমি যে ঘুড়ির মতো আকাশে ভেসে থাকি, হাওয়ার সঙ্গে তালে তালে নাচি- সে কথা ভাবতেই আমার শরীরটা কেমন শিউরে ওঠে।

এবার গরমের সময়ে অনেকেই বেড়াতে এসেছে এই বাগানে। ছেলেমেয়েরা। বুড়োবুড়িরা। নানা বয়সের অনেক লোক। অনেকে এসে বসেছে আমাদেরই ছায়ায়। ছায়া দিতে আমার ভারি ভালো লাগে। একদিন পর্ণীকে জিগগেস করেছিলাম, সে বলেছিল ছায়া দিতে তারও নাকি খুব ভালো লাগে। ঋষি তো সবই জানো একদিন সে আমাকে বলেছিল, ছায়া দেওয়া নাকি আমাদের জীবনের একটা লক্ষ্য।

লক্ষ্য? আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম। তারপর ঋষিকে জিগগেস করলাম, 'লক্ষ্য কী?'

ঋষি বলল, 'লক্ষ্য হলো বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য।' তারপর বুঝিয়ে বলল, 'আমরা যে জন্মেছি, আমরা যে বেঁচে আছি, এর কারণ কী? বেঁচে থেকে যদি অন্যদের জীবনটাকে একটু সুখ দিতে পারি, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারি, তাহলে বাঁচার একটা মানে হয়। তাই না? যেমন ধরো, গরমে বেশ কাতর হয়ে বুড়োবুড়িরা বাড়ি থেকে বাগানে আসে হাওয়া খেতে, শরীরটা জুড়াতে, একটু বিশ্রাম করতে, তখন আমরা ছায়া দিলে তাদের ভালো লাগে। নয়তো তারা কোথায় বসবে, বলো? বাচ্চারা খেলতে আসে এই পার্কে। তারা কি গরম রোদের মধ্যে খেলবে? আমাদের ছায়ায় খেলে, তাই না? রোজ বাড়িতে খায় সবাই। একদিন একটু ফুর্তি করার জন্য খাবারদাবার নিয়ে বাগানে আসে। বনভোজন করতে। আসে ছেলেমেয়ে নিয়ে। চেয়ে দেখো, কেউ এসে মাঠের মধ্যিখানে বসে না। বসে মাঠের ধারে, গাছের তলায়। কারণ, সেখানটাই একটু ঠান্ডা। এভাবে সবার কাজে লাগতে পারলে জীবনের একটা মানে হয়। তাই না?' একসঙ্গে অনেক কথা বলে ঋষি চুপ করল।

যারা বেড়াতে আসে তাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসি বুড়োবুড়িদের। আর বাচ্চাদের। বুড়োবুড়িরা ঠান্ডা ছায়ায় কেমন চুপচাপ বসে থাকে। বেশি নড়াচড়া করে না। কথা বলে আন্তে আস্তে-যেন ফিসফিস করো

ছোট ছেলেমেয়েদেরও আমি পছন্দ করি। কিন্তু তারা একটু দুরন্ত হয়। কেউ কেউ আমার মা-গাছকে আঘাত করে। কেউ কেউ গাছের বাঁকলে নিজেদের নাম লেখে। কেউ আবার আমাদেরই ছিঁড়ে নেয়। আমার সাথিদের ছিঁড়তে দেখে আমার কষ্ট হয়, বেচারাদের জন্য কান্না পায়। কিন্তু তবু ছোটদের হৈচৈ করে খেলতে দেখে আমার ভালো লাগে। সেদিন দুটো ছেলেমেয়ে এসেছিল তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। কী মিষ্টি চেহারা তাদের!

এভাবে দেখতে দেখতে গরমের সময়টা আমার চলে গেল।

তারপর এলো হেমন্ত। কার্তিকের রাতে কেমন শীত শীত করতে শুরু করল। অয়ানের শুরুতে এক রাতে সত্যি খুব ঠান্ডা লাগল। রাতের বেলা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীরটা কে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে। পরের দিন ভোরের আলোতে দেখলাম, আমার গায়ে কী যেন সাদা সাদা লেগে আছে। অন্যদের দিকে চেয়ে দেখলাম, তাদের গাও সাদা সাদা। ঋষিকে জিগগেস করলাম, 'এটা কী, ভাই?' সে বলল, 'রাতের বেলা হিম পড়েছিল।' 'হিম? হিম কী?' আমি আবার জিগগেস করলাম। সে বুঝিয়ে বলল-বেশি ঠান্ডা পড়লে বাতাসে যে বাষ্প থাকে, তা-ই জমে গিয়ে নাকি হিম পড়ে। 'বুঝলে, কিশলয়। হিম থেকে বোঝা যাচ্ছে শীতকাল এসে গেছে। দেখবে কী রকম শীত পড়ে। আর চারদিকটাই ঢেকে যাবে সাদা বরফে। মনে হবে যেন কে সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে!' ঋষি বলল, সবজান্তার মতো।

হিম পড়ার পর কদিন কেটে গেছে। একদিন বিকেলে এদিকে-ওদিকে চেয়ে দেখলাম। কেমন যেন মনে হলো। মনে হলো সমস্ত বাগানটার রং বদলে যাচ্ছে। হয়তো আগে থেকেই রং বদল শুরু হয়েছে। কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। অল্প দিন আগেও চারদিকটা কেমন সবুজে ছেয়ে ছিল। মনে হতো যেন সবুজের বান ডেকেছে বাগানে, মাঠে, গাছগুলোর ওধারের দিঘিতে, এমনকি আকাশের কানায় কানায়। সেই সবুজ যেন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। তার বদলে এ কী রঙের খেলা শুরু হলো পাতায় পাতায় । 

মনে হলো, সমস্ত পার্কে রঙের আগুন লেগেছে। আমার বন্ধু আলোর দিকে চেয়ে দেখলাম, তাকে চেনা যাচ্ছে না। সবুজের বদলে তার রং হয়েছে গাঢ় হলুদ। বেণুর রং হয়েছে আরও বাহারে। উজ্জ্বল কমলা রং। পর্ণার গায়ে যেন আবির মেখে লালের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কখন যে আমিও হলুদ আর কমলা মেশানো একটা অদ্ভুত রঙে নেয়ে উঠেছি খেয়ালই করিনি। ভাবলাম, কোনো এক অজানা জাদুতে সবারই রং পাল্টে গেছে। ঋষি! ঋষির রংটা দেখতে হয়! দেখলাম, তার গায়ে লেগেছে বেগুনির ছাপ। আশ্চর্য! মনে হলো আমরা সবাই মিলে আকাশের রংধনুর রঙে স্নান করে উঠেছি।

আমরা তো সবাই একই মায়ের সন্তান। তা হলে এমন বিচিত্র রং হলো কেন আমাদের? ঋষিকেই জিগগেস করলাম। সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল: 'হই, আমরা একই গাছের পাতা। কিন্তু আমরা সবাই আলাদা। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও আলাদা। সূর্যের আলো আমাদের ওপরে পড়েছে এক-একভাবে। ছায়া পড়েছে এক-এক রকম। তা হলে বলো, আমাদের রং এক-এক রকম হবে না কেনা' ঋষি আবার বলল, 'জানো, এই রঙের মরসুমকে কী বলে? একে বলে হেমন্ত। ঝরে যাওয়ার কালা' কষির কথা শুনে কী এক অজানা ভয়ে মনটা দুলে উঠল।

এরই মধ্যে একদিন ভারি অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। সেই ছেলেবেলা থেকে হাওয়ার সঙ্গে নেচে নেচে বড়ো হয়েছি। হাওয়াকে চিরদিন দেখেছি, কী প্রসন্ন। রাগ দেখিনি কখনো। তাকে ডেকেছি মিতা বলে। সেই হাওয়াই একদিন এলো কী প্রচন্ড রাগী চেহারায়া এত দিন তার ঘাড়ে চড়ে খেলেছি। আজ মনে হলো, বোঁটা থেকে সে আমাদের ছিঁড়ে নেবে। আছাড় দিয়ে ছুড়ে ফেলবে। সত্যি সত্যি বাতাসের তোড়ে কেউ কেউ ছিঁড়ে গেল গাছের ডাল থেকে। কেউ বা কোথায় উড়ে গেল তার খবরও জানি না। একটা ডাল ভেঙে গেল পাশের গাছটার। সত্যি আমরা পাতারা সবাই ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকলাম। আমরা একে অন্যকে ফিসফিস করে জিগগেস করলাম, 'এটা কী হচ্ছে?'

সবজান্তা ঋষি উত্তর দিল। বলল, 'তোমরা জানো না, কিন্তু হেমন্তের প্রথম দিকে এটা হয়েই থাকে। এ হলো পাতাদের বাসা বদলের সময়। এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় চলে যাওয়ার সময়। লোকেরা একে বলে মরে যাওয়া, এক কথায় মৃত্যু।'

আমি সহজেই ভয় পাই। ঋষিকে জিগগেস করলাম, ‘আমরা কি সবাই মরে যাব?’

'হ্যাঁ, আমরা সবাই-সবাই মরে যাব। সবাই মরে যায়। বড়ো-ছোটো, দুর্বল-সবল-কেউই চিরদিন বেঁচে থাকে না। আমরা মরে যাব।' আমার মলিন মুখ দেখে ঋষি একটু থেমে গেল। তারপর আবার বলল, ‘দেখো, কিশলয়, আমরা সবাই আসি একটা কাজ নিয়ে। একটা ভূমিকা পালন করতে। সূর্যের আলোতে আমরা বেড়ে উঠি, চাঁদের আলো গায়ে মাখি, হাওয়ার সঙ্গে নাচি, বৃষ্টিতে স্নান করি। আমরা নাচতে শিখি, গাইতে শিখি, হাসতে শিখি। কখনো কখনো কাঁদিও। কিন্তু আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা চলে যাই। আমরা মরে যাই।’

ঋষির সব কথাই আমি নীরবে মেনে নিয়েছি। কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আজ পারলাম না। প্রায় প্রতিবাদের সুরে গলায় জোর এনে বললাম, 'আমি মরব না।' তারপর থেমে আবার বললাম, ‘ঋষি, তুমি কি মরবে?’

ঋষির মুখের একটি পেশিও নড়লো না। অবলীলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমি মরব তো! আমার যখন সময় হবে, তখন আমি মরে যাব।’

'সময়! কখন সময় হবে?'-আমি জিগগেস করলাম।

ঋষি বলল, ‘সেটা কেউই ঠিক করে জানে না।’

আমি ভাবলাম, ঋষি নিশ্চয় ভুল বলেছে। এই যে আমি, বেঁচে আছি, ভাবছি, ভালোবাসছি, কল্পনা করছি-এই আমি কি মরতে পারি? কক্ষনো না।

কিন্তু দিন যায়। আমি লক্ষ করি, আরও পাতা ঝরে পড়ছে। মা-গাছের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। তা হলে, ঋষিই কি ঠিক বলেছে? তা হলে এদের কি সময় হয়ে গেছে?

আমি লক্ষ করলাম, কোনো কোনো পাতা ঝরে পড়ার আগে প্রাণপণ গাছটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। হাওয়াকে ফাঁকি দিতে চায়। আবার কেউ কেউ হাওয়ায় চড়ে মৃত্যুর রথ এলে নিজের বাঁধনটাকে ছেড়ে দেয়। তারপর ঝরে পড়ে নীরবে, শান্তভাবে।

দিন থেমে থাকে না। তারই মধ্যে একদিন আমি চারদিকটা চেয়ে দেখি। দেখলাম, গাছের ডালগুলো প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। একদিন ঋষিকে বললাম, 'ঋষি, তুমিই বোধহয় ঠিক। হয়তো মরতেই হবে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে। আমি জানি না নিচে, গভীরে কী আছে। মনে হয়, সেখানে আছে এক রাশ জমাট-বাঁধা অন্ধকার।'

শান্ত কণ্ঠে ঋষি বলল, 'দেখো, কিশলয়, আমরা যা জানি না, তাকে আমরা সবাই ভয় পাই।' 'কিন্তু বসন্ত গিয়ে যখন গরমের সময় এলো, তখন তো আমরা ভয় পাইনি। গরমের সময় গিয়ে যখন হেমন্ত এলো তখনো তো ভয় পাইনি। এই পরিবর্তনই স্বাভাবিক। তা হলে মৃত্যুর ঋতু দেখে ভয় পাব কেন?'

আমাদের মা-গাছ? সেও কি মরে যাবে?'

'হ্যাঁ, একদিন সেও মরে যাবে। কিন্তু সে কথা থাক। মনে রেখো, এ গাছের থেকেও শক্তিশালী একটা জিনিস আছে। সে হলো জীবন। জীবনের কোনো শেষ নেই। আমরা সেই অন্তহীন জীবনের অংশ।'-ঋষি বুঝিয়ে বলল।

'আমরা কি আবার ফিরে আসব? আগামী বসন্তে?'
 

না, আমরা বোধহয় ফিরব না। কিন্তু জীবন থেমে যাবে না। জীবন আবার ফিরে আসবে।'

আমার মন তবু তৃপ্তি পায় না, সাত্বনা পায় না। আবার বলি, 'তাহলে এই যে এলাম, এই যে বড়ো হলাম, হাসিকান্নায় এত দিন বেঁচে থাকলাম, এর মানে কী?' একটু থেমে আবার ভেবে বললাম, 'যদি করেই যাব, যদি বিদায় নিতেই হবে, তাহলে এসেছিলাম কেন?'
কোনো আবেগ দেখাল না ঋষি। বলল, ‘এটাই জীবন। এই যে সূর্যের আলোতে বেঁচে থাকলাম, এই যে চাঁদের আলোর স্নেহশীতল স্পর্শ পেলাম, এই তো জীবন! একসঙ্গে আনন্দের সময় কাটিয়েছি আমরা। ছায়া দিয়েছি। বুড়োবুড়ি আর শিশুদের দেখেছি-সেবা করেছি। হেমন্তে রঙের খেলা দেখেছি। দেখেছি ঋতুবদলের পালা। এই কি যথেষ্ট নয়? এই তো জীবন!’

সেদিন গোধুলি আলোয় হাওয়ার রথ এলো। ঋষি তাতে চেপে বসল। মনে হলো, পড়ে যেতে যেতেও সে শান্ত হাসিতে উদ্ভাসিত। দূরে যেতে যেতে আমাকে বলল, ‘কিশলয়, এখনকার মতো বিদায়, ভাই!’

ডালটায় আর কেউ বাকি নেই। শুধু আমি। একা। কোথায় গেল আলো, বেণু, পর্ণা। খেয়াল করিনি তো। কোথায় গেল আমার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু-ঋষি। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু নিঃসঙ্গ।

পরের দিন মরসুমের প্রথম বরফ পড়ল। পেঁজা তুলোর মতো। সুন্দর। কোনো ভার নেই তার কিন্তু ভারি ঠান্ডা। সেই সঙ্গে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। সূর্যের আলো দেখা গেল না প্রায় সারা দিন। দিনটা কেটে গেল দেখতে দেখতেই। মনে হলো, আমার যেটুকু রং বাকি ছিল, তাও যেন হারিয়ে গেল। ডালটাকে ধরে রাখার শক্তি আমার যেন লোপ পাচ্ছে। তারই মধ্যে বরফ পড়ছে নিঃশব্দে। রাতের নীরব অন্ধকারে অজানা কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমার ওপর বরফ জমে উঠছে ধীরে ধীরে।

ভোরবেলাতে একটা হাওয়া এলো। সেই সঙ্গে যেন এলো অজানার আহ্বান। আমি ডালটাকে ছেড়ে দিলাম। একটুও লাগল না আমার। আমি যেন ভেসে চলেছি নিচের দিকে, খুব ধীরে। তারপর মাটিতে পড়ে প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম পুরো গাছটাকে। কী বিশাল! কী দৃঢ়। নিশ্চিত জানি, আমি বিদায় নিলেও এ গাছ বেঁচে থাকবে বহুকাল। জানি আমিও জীবনের অংশ ছিলাম। ভাবতেও আমার গর্ব হচ্ছে-আমি জীবনের অংশ ছিলাম। জীবনের ধন কিছুই বিফলে যায়নি। কিছুই বিফলে যাবে না।

আমি পড়লাম, তুলোর মতো নরম এক ভাল বরফের ওপর। মনে হলো, সে বরফ নিষ্প্রাণ শীতল নয়। তার ভেতর প্রাণের উষ্ণতা টের পেলাম যেন। আমি বড্ড ক্লান্ত। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে আমার।

কিশলয় সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল।

কিশলয় জানত না, শীতের পরে আবার বসন্ত আসবে। জানত না, চিরদিন বরফ থাকবে না। বরফ গলে গিয়ে জল হবে। সে জানত না, সেই জলে মিশে তার শুকনো দেহটা মা-গাছের শেকড়ে গিয়ে আবার গাছে মিশে যাবে। জানত না, তার দেহটা বিফলে যাবে না। গাছটা আরও জোরালো হয়ে উঠবে। যা একদমই জানত না কিশলয়, সে হলো: গাছ আর মাটিতে মিলে এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে নতুন ফাল্গুনে আরেক রাশ পাতা আসবে গাছে।

Content added By

কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' রচনার ভিত্তিতে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া আছে। তোমার একজন সহপাঠীর সাথে এগুলো নিয়ে আলোচনা করো এবং সংক্ষেপে উত্তর তৈরি করো।

 

ক. লেখক এই রচনায় প্রকৃতির পালাবদলের কেমন ছবি এঁকেছেন?

________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

 

খ. মানুষের জীবনের সাথে গাছের পাতার মিল কোথায়?

________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

 

গ. এই রচনায় জীবন সম্পর্কে লেখকের কোন মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে?

________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

Content added By

'কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' রচনাটির যেসব বক্তব্য নিয়ে তোমার মতামত রয়েছে বা মনে প্রশ্ন জেগেছে, তা নিচের ছকে লেখো। কাজ শেষে কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে উত্তর মেলাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা দেওয়া হলো।

 

Content added By

এটি কেন কল্পনানির্ভর লেখা

'কিশলয়ের জন্ম মৃত্যু' শিরোনামের রচনাটিকে কেন কল্পনানির্ভর লেখা বলা যায়? উদাহরণ দিয়ে বোঝাও।

___________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________________

 

কল্পনানির্ভর লেখা

চারপাশের যে জগৎ আমরা দেখতে পাই, তাকে বলে বাস্তব জগৎ। কল্পনানির্ভর রচনায় থাকে কাল্পনিক ও অবাস্তব ঘটনা কিংবা চরিত্র। বিভিন্ন ধরনের কল্পনানির্ভর রচনা রয়েছে:
রুপকথা: এ ধরনের রচনায় রাজা, রানি, দৈত্য-দানব ইত্যাদি থাকে। এসব গল্প সাধারণত মানুষের মুখে মুখে চলতে থাকে এবং একটি গল্পের কাঠামো পায়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি: এ ধরনের রচনায় ভবিষ্যতের জগৎ, বিজ্ঞানের অনাবিষ্কৃত এলাকা, গ্রহান্তরের কাল্পনিক ধারণা ইত্যাদি যুক্ত থাকে।
রম্যরচনা: এ ধরনের রচনায় লেখক সরস ভঙ্গিতে কোনো বক্তব্য বা কাহিনি তুলে ধরেন। অনেক সময়ে কৌতুক-হাস্যরস, কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ব্যবহার করে এ ধরনের লেখাকে আকর্ষণীয় করা হয়ে থাকে।
এছাড়া অতিকল্পনা রয়েছে এমন গল্প-উপন্যাসকেও কল্পনানির্ভর রচনা হিসেবে গণ্য করা হয়। 'কিশলয়ের জন্ম- মৃত্যু' এ ধরনের একটি কল্পনানির্ভর রচনা।

Content added || updated By
Promotion