ইসলামি আকিদা মোতাবেক কিয়ামত বলতে মহাপ্রলয়, পুনরুত্থান অতঃপর হাশরের ময়দানে দন্ডায়মান হওয়া বুঝায়। নিয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো:
(ক) মহাপ্রলয়
কিয়ামত বা মহাপ্রলয় কখন সংঘটিত হবে মহান আল্লাহ তা গোপন রেখেছেন। তিনি ছাড়া কেউ তা জানেন না। যখন আল্লাহর নির্ধারিত সময় চলে আসবে তখন কিয়ামত সংঘটিত হবে। মহান আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইসরাফিল (আ.) কর্তৃক শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার মাধ্যমে কিয়ামত বা মহাপ্রলয় ঘটবে। এ মহাপ্রলয়ের দৃশ্য অভ্যন্ত ভয়াবহ হবে। শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে সমস্ত মানুষ ভয়ে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মতো ছুটাছুটি করতে থাকবে। তারা তাদের পরিবারের লোকদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ফিরে যাবার অবকাশ পাবে না। বন্য পশুরা ভয়ে একত্রিত হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, 'হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন এক ভয়ংকর ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা দেখবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্য দানকারিনী আপন দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে এবং প্রত্যেক গর্ভধারিণী তার গর্ভপাত করে ফেলবে, তুমি দেখবে মানুষকে মাতাল সদৃশ, অথচ তারা মাতাল নয়।' (সুরা আল-হাচ্ছ, আয়াত: ১-২)
সেদিন পৃথিবী প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে। আসমান ও জমিনে আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করবেন তারা ছাড়া সবাই বেহুঁশ হয়ে পড়বে। পর্বতমালা ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত হবে এবং রঙিন পশমের মতো উড়তে থাকবে। সমুদ্রে আগুন জ্বলে ওঠবে। আকাশের আবরণ অপসারিত হয়ে গলিত তামার ন্যায় হবে। সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। নক্ষত্ররাজি বিচ্ছিন্ন হয়ে খসে পড়বে। চন্দ্র ও সূর্য একত্রিত হয়ে যাবে। সেদিন আকাশসমূহকে এমনভাবে গুটিয়ে নেওয়া হবে যেভাবে পুস্তকে লিখিত কাগজপত্র গুটিয়ে রাখা হয়। এভাবে কিয়ামত বা মহাপ্রলয়ের প্রথম পর্ব সংঘটিত হবে। এ মহাপ্রলয়ে বিশ্বাস করা ইমানের অংশ।
(খ) পুনরুত্থান
পুনরুত্থান অর্থ পুনরায় উত্থান, কবর হতে মৃতের উত্থান। মহান আল্লাহ মৃত্যুর পর মানুষকে পুনরায় জীবিত করবেন। মৃত্যুর পর পুনরায় জীবন লাভ তথা পুনরুত্থানে বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, আল্লাহই তোমাদেরকে জীবন দান করেন ও তোমাদের মৃত্যু দান করেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে কিয়ামত দিবসে একত্রিত করবেন, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সূরা আল-জাছিয়া, আয়াত: ২৬)
শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুৎকারের পর পুনরুত্থান ও হাশর বা মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হবে। এদিনই বিচারের দিন। আখিরাত বা পরকালের অনন্ত জীবনের সূচনা এদিন থেকেই হবে। আল-কুরআনে এ দিনকে 'ইয়াওমুল বা'ছ' বা পুনরুত্থান দিবস, হিসাব গ্রহণের দিবস, প্রতিদান দিবস ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
যারা এই পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে না তারা আল্লাহ তা'আলার প্রতিও বিশ্বাস রাখে না। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'কাফিররা ধারণা করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। বলুন, নিশ্চয়ই হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ, তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদেরকে সে সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।' (সুরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৭)
বাড়ির কাজ | |||
---|---|---|---|
ক্রমিক | পরিবারের সদস্য | বিশ্বাস | সঠিক/ভুল |
১ | বড় ভাই | ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামত শুরু হবে। | সঠিক |
২ | |||
৩ |
(গ) হাশর
হাশর অর্থ একত্রিত হওয়া। মহান আল্লাহর হুকুমে হযরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে সবাই পুনরায় জীবিত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। এ দিন সবাই নিজ নিজ কর্মফলপ্রাপ্ত হবে। তাই এটি 'ইয়াউমুদ্দিন' বা কর্মফল দিবস।
পৃথিবীই হবে হাশরের মাঠ। কিয়ামতের দিন পৃথিবী পরিণত হবে একটা উদ্ভিদশূন্য মসৃণ সমতল প্রান্তরে। মানুষের জন্য সেখানে কেবলমাত্র পা রাখার জায়গাই থাকবে। হাশরের দিনের দৈর্ঘ্য হবে আমাদের গণনায় পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।
আর এ দিনটিই হবে কবর থেকে জীবিত হয়ে ওঠার দিন। প্রত্যেক মানুষ ভীত-শক্ষিত চোখে তাদের কবর থেকে বের হয়ে আসবে। তারা বলবে, হায়! আমাদের দুর্ভোগ। কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে জাগিয়ে তুলল। তারা আহবানকারীর দিকে দৌড়াতে থাকবে। তাদেরকে মনে হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল। কাফিররা বলবে, এটা তো কঠিন দিন। সহসাই সকল মানুষ হাশরের ময়দানে একত্রিত হয়ে যাবে। মানুষ মনে করবে তারা পৃথিবীতে এক সন্ধ্যা বা এক সকালের বেশি অবস্থান করেনি।
সেদিন প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অন্যের দিকে তাকানোর মতো হুঁশ ও চেতনা কারো থাকবে না। সেদিন পিতা তার সন্তানের কোনো উপকার করতে পারবে না। সন্তানও পিতার কোনো উপকার করতে পারবে না। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন ও যার কথা তিনি পছন্দ করবেন, তিনি ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোনো কাজে আসবে না। মানুষ তার ভাই থেকে, তার মা ও বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকে পালিয়ে থাকবে।
মহান আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করবেন। জিবরাইল (আ.) সহ ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান থাকবেন। পরম করুণাময়ের সামনে সকল আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। এক ক্ষীণ অস্পষ্ট ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাওয়া যাবে না। সকলেই চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী সত্তার সামনে অবনত হবে। জমিন তার রবের জ্যোতিতে ঝলমল করে উঠবে। নবিগণ ও সাক্ষীগণকে উপস্থিত করা হবে। আমলনামা পেশ করা হবে। অপরাধীরা তাদের আমলনামা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যাবে। তারা বলবে, 'হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। ছোট-বড় কোনো কিছুই বাদ যায়নি। এতে তো সব কিছুই রয়েছে।' প্রত্যেক মানুষ তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। জান্নাতকে নিকটে আনা হবে। জাহান্নামকে উন্মুক্ত করা হবে। সেদিন মানুষ উপলব্ধি করবে; কিন্তু এ উপলব্ধি তার কোনো কাজে আসবে না। সে বলবে, 'হায়। আমার এ জীবনের জন্য যদি আমি কিছু আগে পাঠাতাম। অর্থাৎ দুনিয়াতে নেক আমল করতাম। হায় আফসোস! আমাকে যদি আর একবার পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আমি সৎকর্মপরায়ণ হতাম।' সেদিন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে আর বলবে, হে আমাদের রব! আমরা দেখলাম ও শুনলাম। আমাদেরকে আবার পাঠিয়ে দিন, আমরা ভালো কাজ করব, আমরা এখন দৃঢ় বিশ্বাসী।
সেদিন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের সামনে ও তাদের ডান পার্শ্বে নূর ছুটতে থাকবে। মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মুমিনদেরকে বলবে, 'তোমরা আমাদের জন্য একটু থাম, যাতে আমরা তোমাদের আলো থেকে কিছুটা নিতে পারি। বলা হবে, 'তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও ও আলোর সন্ধান করো।' অতঃপর উভয়ের মাঝে একটি প্রাচীর স্থাপিত হবে যাতে একটি দরজা থাকবে। তার ভিতর ভাগে থাকবে রহমত আর বাহিরে সর্বত্র থাকবে আযাব।
অনেক মুখমণ্ডল সেদিন উজ্জ্বল হবে। তারা সহাস্য ও প্রফুল্ল থাকবে। তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি তার আমলনামা ডানহাতে পাবে সে বলবে, 'এই নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখ। আমি জানতাম আমাকে আমার হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে।' অতপর তার হিসাব সহজভাবে নেওয়া হবে। সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে।
মুত্তাকিদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তাঁরা জান্নাতের নিকট উপস্থিত হবে তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হবে। জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম। তোমরা সুখি হও এবং স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য জান্নাতে প্রবেশ করো।’
অনেক মুখমণ্ডল সেদিন ধূলি ধূসরিত ও বিবর্ণ হবে। পাপের কালিমা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। তারাই কাফির ও পাপাচারী। তারা তাদের আমলনামা বাম হাতে পাবে। আর যার আমালনামা বাম হাতে দেওয়া হবে সে বলবে, 'হায় আফসোস। আমাকে যদি আমার আমালনামা না দেওয়া হতো। আমি যদি আমার হিসাব না জানতাম। হায়া আমার মৃত্যুই যদি আমার শেষ হতো। আমার ধন-সম্পদ, আমার ক্ষমতা কোনো কাজেই এলো না।' আর যাকে তার আমালনামা তার পিঠের পিছন দিক থেকে দেওয়া হবে। সে মৃত্যুকে আহ্বান করবে। আর সে জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। অপরাধীরা সেদিন নিজ নিজ চেহারা দ্বারাই চিহ্নিত হয়ে যাবে। তাদের মাথার চুল ও পা ধরে টেনে-হিঁচড়ে নেওয়া হবে।
কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহান্নানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হবে। তাদেরকে বলা হবে-এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করো, তোমাদেরকে চিরকাল এখানে থাকতে হবে। কতই না নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল।
দলগত আলোচনা |
যে যে কাজ করবো | যে যে কাজ করবো না |
---|---|
মহান আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করবো। | আল্লাহ তা'আলার সাথে কাউকে শরিক করবো না। |
আরও দেখুন...