পঞ্চরত্রের এবারের গন্তব্য রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মভূমি বরিশালে। পঞ্চরত্নকে বরিশালে ভ্রমণে সহযোগিতা করবে শামস মামার বন্ধু মহসিন রহমান। নির্দিষ্ট দিনে পঞ্চরত্ন খুলনা বাস স্টেশনে গিয়ে বাসে উঠে বসল। বাসে যেতে যেতে আগুন বরিশাল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিল এবং তাদের ভ্রমন পরিকল্পনা পড়ে শোনাল। বাসের সিটে বসে গুন গুন করে গান গাইতে লাগল সমীর:
আয়রে বাঙ্গালী আয় সেজে আয়,
আয় লেগে যাই দেশের কাজে।
(সংক্ষেপিত)
বাহ! গানটা বেশ ভাল তো, বলল ইরা। এটা কার লেখা গান? আমি এই গানটি আগে কখনও শুনিনি। সমীর বলল এটা চারণ কবি মুকুন্দদাসের গান।
বাস ছাড়ার ফাঁকে গানের এসব বিষয় নিয়ে পঞ্চরর আলোচনা করছিল বাসের সিটে বসে। অবশেষে বাস চলতে শুরু করল বরিশালের উদ্দেশে।
বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাটি এই ছয়টি জেলা নিয়ে বরিশাল বিভাগ গঠিত। প্রাকৃতিক সম্পদ আর লোকসংস্কৃতির বিশাল উৎস এই বিভাগ। বাসে বসে এই সব আলোচনা করতে করতে পঞ্চরত্ন পৌঁছে গেল বরিশাল শহরে।
বাস স্টেশনে তাদের আমন্ত্রণ জানাতে আসলেন মহসিন সাহেব এবং তাঁর মেয়ে মালিহা। মালিহা ক্র্যাচ ব্যবহার করে। সে ফুল নিয়ে বাবার সাথে বাস স্টেশনে পঞ্চরত্নকে অভ্যর্থনা জানাল। মালিহা দশম শ্রেণির ছাত্রী। সে খুব ভাল গান গায় এবং ছবি আঁকে। স্কুলের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড মালিহার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়।
এরই মধ্যে পঞ্চরত্রের সবার সাথে তার বেশ ভাব হয়ে গেল। মালিহা তার করা কিছু জলরং, পোস্টার রং এবং প্যাস্টেল রঙে আঁকা ছবি এবং নকশা পঞ্চরত্নকে দেখাল। তারা ছবিগুলো দেখে বেশ প্রশংসা করল। পঞ্চরত্ন জলরং, পোস্টার রঙে ছবি আঁকার পদ্ধতি সম্পর্কে মালিহার কাছে জানতে চাইল। সে তাদেরকে ছবি আঁকার পদ্ধতি সম্পর্কে জানাবে বলল। এর মধ্যে পঞ্চরত্ন তাদের কল্পনায় স্বদেশ ভ্রমণের সবকিছু বিস্তারিভাবে মালিহাকে জানাল। সেও পঞ্চরত্রের সাথে বরিশাল ভ্রমণে সাথি হয়ে গেল। তারা সবাই মিলে বরিশাল ভ্রমনের একটা পরিকল্পনাও করে ফেলল। সমীর বাসে গাওয়া 'আমরা মানুষ হতে চাই' গানটি নিচু স্বরে করছিল। কথা বলার ফাঁকে মালিহা তা খেয়াল করল। সমীরের গান শুনে মালিহা বলল বাহ। তুমি তো বেশ ভালো গান কর। এটা মুকুন্দদাসের খুব বিখ্যাত একটি গান।
সমীর বলল এই গানটা মুকুন্দদাসের এটা জানতাম কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আর তেমন কিছু জানা নেই। মালিহা বলল আমাদের ভ্রমণ তালিকায় মুকুন্দদাসের কালিবাড়িও রয়েছে আমরা সেখানে গিয়ে স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারব। পঞ্চরত্রও বিষটিতে একমত হল।
এর মধ্যে মামি এসে বললেন অনেক বেলা হয়ে গেছে, চলো খেতে চলো। তোমাদের জন্য আমি বরিশালের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করেছি। খাবার টেবিলে গিয়ে পঞ্চরত্ন খুব খুশি হয়ে গেল। কারণ টেবিলে ছিল কলাপাতায় মাছ ভাজা, নারিকেল দিয়ে হাঁসের মাংসসহ অনেক কিছু।
খেতে খেতে মহসিন মামা বলেন বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অশ্বিনীকুমার হলে বরিশাল সংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সমন্বয়ে শুরু হয়েছে বিভাগীয় সাংস্কৃতিক উৎসব। এ উপলক্ষ্য বসেছে পক্ষকাল ব্যাপী লোকমেলা। সে মেলায় আজ রাতে যাত্রা পরিবেশিত হবে। আমরা সবাই মিলে যাত্রা দেখতে যাব। মহসিন মামা পঞ্চররের কাছে জানতে চাইলেন তারা আগে যাত্রা দেখেছে কি না। পঞ্চরত্ন জানাল তারা আগে কখনও যাত্রা দেখেনি। তখন মহসিন মামা বলেন তবে তোমাদের যাত্রা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিই। তাহলে তোমরা যাত্রা ভালভাবে উপভোগ করতে পারবে। এই বলে তিনি যাত্রা সম্পর্কে বললেন-
যাত্রা
বাংলা লোকনাটোর অন্যতম জনপ্রিয় সাংস্কৃতিকধারার নাম হলো যাত্রা। যাত্রা অর্থ গমন, কোনো বিশেষ বা শুভকাজে গমন করাকে বুঝাতেই এই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাচীনকালে এমন স্ট্রীতির প্রচলন থাকলেও যাত্রার ভিতর দিয়ে এখানকার মানুষের দেশপ্রেম, মুক্তিসংগ্রাম ও সমাজ সংস্কারের কথা প্রকাশিত হয়েছে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনির সংযোজন ঘটে। কৃষকের কর্মপঞ্জিকার সাথে মিল রেখে বাংলাদেশে শ্রাবণ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত যাত্রার অভিনয় চলে। যাত্রায় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে মন্দিরা, খোল বাঁশি, ড্রাম, বেহালা, বাংলা ঢোল, তবলা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
দেশপ্রেম আর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধারাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে জাত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে মানুষ যাত্রার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছে। যাত্রার মাধ্যমে কথকতা, সংলাপ, নৃত্য, অভিনয়, সংগীত, বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত প্রয়োগ দেখা যায়। ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য পরিবেশনার মতো যাত্রাও পরিবেশন করা হয় খোলা মঞ্চে। যার চারদিকে দর্শক বসা থাকে। একজন প্রমটার পাণ্ডুলিপি দেখে অভিনেতা/অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দেন। মঞ্চের দুদিক দিয়ে মঞ্চে উঠার জন্য সিঁড়ি থাকে। বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যন্ত্রীগণ মঞ্চের বাইরে বসেন। যন্ত্রীদলের সাথে একজন প্রমটার থাকেন, যিনি যাত্রাভিনয় চলাকালিন অভিনেতাদের জন্য সংলাপ বলতে থাকেন।
রাতে পঞ্চরত্ন সবার সাথে অশ্বিনীকুমার হলে যাত্রাভিনয় দেখল। যাত্রা দেখতে দেখতে পঞ্চরর নিজেরাই যাত্রার জগতে হারিয়ে গেল। কল্পনার যাত্রায় তারা নিজেরাই অভিনয় করতে লাগল। এই অপূর্ব ভাল লাগার মধ্য দিয়ে এক সময় যাত্রা শেষ হলো। যাত্রা দেখে সেদিনের মতো তারা বাসায় ফিরল। এর মধ্যে আলোচনা করে তারা ঠিক করল ফিরে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো বিষয় ঠিক করে শ্রেণিকক্ষে এমন একটি পরিবেশনার আয়োজন তারা করবে।
যাত্রা দেখে বাসায় ফিরে রাতে সবাই মাতলেন গভীর গল্পে। গল্পের ফাঁকে সমীরকে মহসিন মামা বললেন মালিহার কাছ থেকে জানলাম তোমরা চারণ কবি মুকুন্দদাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। আমরা যদি মুকুন্দদাসের কালিবাড়ি ভ্রমণে যাই তবে কেমন হয়?
সাথে সাথে পঞ্চরত্ন আর মালিহা বলল খুব ভাল হয়, সেখান থেকে আমরা মুকুন্দদাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারব। পরের দিন তারা মুকুন্দদাসের কালিবাড়ি ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে মুকুন্দদাসের বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারল।
মুকুন্দ দাসের জন্ম ১৮৭৮ সালে ঢাকা জেলায় হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা কিন্তু বরিশালে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অসাধারণ সব গণসংগীত রচনা করে তা মানুষকে গেয়ে শুনাতেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বরিশালে ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। মুকুন্দ দাস গান, কবিতা, নাটক রচনা করে সে আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেন। তাঁকে চারণকবি নামে সবাই জানে। ১৯০৫ সালে তিনি তাঁর প্রথম যাত্রাপালা 'মাতৃপূজা' রচনা করেন। যাত্রার মধ্য দিয়ে সংগ্রামের কাজকে আরও বেগবান করে তোলেন। যাত্রাদল নিয়ে তিনি সারাদেশে ভ্রমণ শুরু করেন। অভিনয়ের মাঝখানে তিনি বক্তৃতার মতো করে সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন। একপর্যায়ে ব্রিটিশ পুলিশ 'মাতৃপূজা' যাত্রাপালার পাণ্ডুলিপিকে বাজেয়াপ্ত ঘোষনা করে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুকুন্দ দাসের গড়া কালীমন্দিরের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এখানকার মন্দিরের গায়ে চিত্রশিল্পী প্রেমলালের আঁকা চারণকবি মুকুন্দ দাসের ছবির দেখা মেলে। পঞ্চরত্র জানতে পারল প্রতি বছর এখানে মুকুন্দ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবার পঞ্চরত্ন মহসিন মামার কাছে জানতে চাইল বরিশালে কি কি কারুশিল্প তৈরি হয়।
মহসিন মামা বললেন বরিশালের হস্ত ও কারুশিল্পের রয়েছে নানা রকমের বৈচিত্র্য। বরিশালের প্রতিটি জেলায় রয়েছে হস্ত ও কারুশিল্পের নিজস্ব ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য। যেমন- পিরোজপুরের শোলা শিল্প, পটুয়াখালীর মৃৎশিল্প ও বাঁশ শিল্প, ঝালকাঠির গামছা এবং বরগুনা জেলার হোগলা শিল্প উল্লেখযোগ্য। তবে বরিশালের নারকেলের মালা (খোল) দিয়ে তৈরি হস্ত ও কুটির শিল্প বিখ্যাত। ফেলে দেওয়া প্রাকৃতিক উপকরণ নারকেলের মালা (খোল) কে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করা হয় এই শিল্পে। পঞ্চরত্র মহসিন মামার সাথে নারকেলের মালা (খোল) দিয়ে কীভাবে পণ্য তৈরি হয় তা দেখতে গেল।
নারকেলের মালা (খোল) দিয়ে তৈরি হস্ত ও কুটির শিল্প নারকেল খাওয়ার পর তার মালা (খোল) অপ্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়। কিন্তু বর্তমানে নারকেলের বাই প্রোডাক্টস অর্থাৎ নারকেলের উচ্ছিষ্ট মালা দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন শোপিস বা গৃহসজ্জার সামগ্রী। নারকেলের মালা (খোল) ছাড়াও এসব শোপিস বানাতে আরও ব্যবহার করা হয় পাট, সুতা, বাঁশ, কাঠ, প্রভৃতি উপকরণ। এসব উপকরন দিয়ে তৈরি হয় চাবির রিং, পাখি, ফুল, কচ্ছপ, হাতি, ফুলদানি, মোমদানি, টেবিলল্যাম্পসহ নানা ধরনের নান্দনিক শোপিস। এই নারকেলের খোল ব্যবহার করা হয় বাদ্যযন্ত্র একতারায়। তাছাড়া নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি জামার বোতাম পোশাককে নান্দনিক করে তোলে। নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি এই সব পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে সারা দেশে। হস্ত ও কুটির শিল্পের নতুন উদ্যোক্তারা নারকেলের মালা দিয়ে আরও নতুন নতুন পণ্য তৈরি করছে।
পঞ্চরত্ন দেখল নারকেলের মালা (খোল) দিয়ে কিভাবে সুন্দর হস্তশিল্প তৈরি হয়। আকাশ বলল আমরাও এই রকমই কিছু করব। আমরা নিজেদের আশপাশের পরিত্যক্ত উপকরণ। সামগ্রী দিয়ে নতুন পণ্য তৈরি করার চেষ্টা করব। আমাদের এই কাজটির নাম হবে 'নবরূপ'
'নবরূপ' এ যেভাবে আমরা পরিত্যক্ত জিনিস দিয়ে নতুন শিল্প সামগ্রী তৈরি করব।
নবরূপ' কাজটি করার জন্য আমাদের সৃজনশীল বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হবে। এই কাজটির মধ্য দিয়ে আমরা ঘর সাজানোর পণ্য তৈরি করতে পারব। সাথে সাথে পরিত্যক্ত জিনিসের পুনর্ব্যবহার করতে পারব। এতে করে পরিবেশ দূষণরোধ করার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারব।
এবার পঞ্চরত্রের বরিশাল ভ্রমণে বের হওয়ার পালা। আকাশ বলল ঘুরতে বের হবার আগে আমরা মালিহা আপুর কাছ থেকে জলরং ও পোস্টার রঙে ছবি আঁকার করণকৌশলটা শিখে নিতে চাই। আকাশের কথার উত্তরে মালিহা বলল আমি এসব মাধ্যমের করণকৌশল শিখেছি আমার বাবার এক শিল্পী বন্ধুর কাছ থেকে। আমি যতটুকু জানি তা জানাতে পারব। বাকিগুলো তোমাদের অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ত্তে আনতে হবে।
এবার আমরা জানব জলরং ও পোস্টার রঙে কিভাবে ছবি আঁকতে হয়-
জলরং ছবি আঁকার একটি জনপ্রিয় মাধ্যম। পানি বা জলের সাথে রং মিশিয়ে আঁকা হয় বলে একে জল রং বলে এর ইংরেজি নাম (water colour) জলরঙের ছবি আঁকার প্রধান উপকরণ হলো রং। জলরং সাধারণত টিউবে কিনতে পাওয়া যায়। টিউব ছাড়া প্যান/কেক আকারেও জলরং কিনতে পাওয়া যায়।
জলরঙের প্রয়োজনীয় আরেকটি উপকরণ হলো তুলি। সাবল নামক একধরনের প্রাণীর লেজের লোম দিয়ে তৈরি (sable hair brush) তুলি জলরঙের জন্য খুব উপযোগী। তাছাড়া কাঠবিড়ালীর লোম দিয়ে তৈরি (squirrel hair brush) তুলিসহ বিভিন্ন রকমের তুলি জলরঙের জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রাণির লোমের পরিবর্তে বর্তমানে সিনথেটিক উপাদান দিয়ে তৈরি অনেক ভালমানের জলরঙের তুলি পাওয়া যায়। জলরঙের জন্য সাধারণত গোল (round) চ্যাপ্টা (flat) তুলি ব্যবহার করা হয়।
গোল তুলিগুলো- ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২ ইত্যাদি নাম্বারে পাওয়া যায়। তুলির নাম্বার বাড়ার সাথে সাথে তার সাইজ মোটা হতে থাকে। চ্যাপ্টা তুলির ক্ষেত্রে মাপটি হয় ইঞ্চিতে যেমন- আধা ইঞ্চি, ১ ইঞ্চি, ২ ইঞ্চি, ৩ ইঞ্চি, ৪ ইঞ্চি ইত্যাদি।
জলরঙের জন্য হাতে তৈরি কাগজ (handmade paper) বিশেষভাবে উপযোগী। তাছাড়া কার্টিজ পেপারসহ অন্যান্য কগজেও এই মাধ্যমে ছবি আঁকা হয়। এছাড়া জলরঙের জন্য পানি রাখার পাত্র আর রং গোলানোর জন্য কালার প্যালেট প্রয়োজন হয়।
প্রথমে কাগজটি ছবি আঁকার বোর্ডে ভালভাবে ক্লিপ অথবা টেপ দিয়ে আটকে নিতে হবে। তারপর বিষয়বস্তু যেমন-
জড়জীবন, দৃশ্য, অবয়বসহ যে কোনো বিষয়ের হালকা ড্রইং করে নিতে হবে। তারপর পানি দিয়ে কাগজটি ভিজিয়ে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে চ্যাপ্টা তুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। কাগজে পানিটা হালকা শুষে নিয়ে আর্দ্র ভাবটা থাকা অবস্থায় রং দিতে হয়। এই পদ্ধতির জলরং কে ভেজা (wet) পদ্ধতি বলে।
কাগজে রং দেওয়ার আগে তা প্যালেটে প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে ভালভাবে গুলিয়ে নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে জলরঙের সব রঙের ঘনত্ব একই রকমের না। জলরঙে রঙের সাথে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে রংকে গাঢ় থেকে হালকা করে ছবিতে ব্যবহার করা হয়। কোন রং গুলোতে কি পরিমাণ পানি দিতে হবে তা অনুশীলনের মাধ্যমে আয়ন্ড করতে হবে।
কোনো কোনো শিল্পী কাগজ না ভিজিয়েও সরাসরি কাগজে রং দিয়ে ছবি আঁকেন। জলরঙের এই পদ্ধতিকে শুকনো (dmy) পদ্ধতি বলে।
জলরং পানিতে পাতলা করে গুলিয়ে কাগজে লাগানো হয়। প্রথম স্তরের (first wash) রং লাগানোর একটু পর আর্দ্র থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় স্তরের (second wash) রংটা লাগানো হয়। এই ভাবে একটা স্তরের উপর আরেকটা স্তর (wash) দিয়ে হালকা থেকে প্রয়োজনমতো ধীরে ধীরে রং গাঢ় করা হয়, পরে সূক্ষ্ম (detail) কাজ করে ছবি শেষ করা হয়।
জলরঙের ছবিগুলোতে দুই রকমের চরিত্র দেখতে পাওয়া যায় স্বচ্ছ (transparent) অস্বচ্ছ (opaque)। স্বচ্ছ পদ্ধতিতে রঙের প্রায় প্রতিটা স্তর দেখা যায়। অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে রঙের কোনো স্তর দেখা যায় না। জলরঙে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ (transparent) পদ্ধতিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
পোস্টার রঙে ছবি আঁকার করণকৌশলও জলরঙের মতো। তবে পোস্টার রঙের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ (opaque) পদ্ধতিতে ছবি আঁকা হয়। পোস্টার রং নকশা বা অলংকরণের জন্য বেশি ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও জলরঙে অনেক ছবি এঁকেছেন। ১৯৩৮ সালে সর্বভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে জয়নুল আবেদিন তাঁর জলরঙের ছবির জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জলরঙে আকাঁ চিত্রকর্ম
সেদিনের মতো পঞ্চরয়ের জলরং আর পোস্টার রঙের অনেক অনুশীলন হল। পঞ্চরত্ন এবং মালিহা ঠিক করল তারা বরিশালের যেসব স্থানে ভ্রমণে যাবে সেখানের কিছু দৃশ্য তারা জলরঙে আঁকার চেষ্টা করবে। সাথে সাথে বিভিন্ন স্থাপনা থেকে সংগ্রহ করা নকশাগুলো পোস্টার রঙে আঁকার চেষ্টা করবে।
পঞ্চররের এবারের ভ্রমণের গন্তব্য যথাক্রমে অক্সফোর্ড মিশন গির্জা, কড়াপুর মিয়াবাড়ি মসজিদ এবং কালেক্টরেট ভবন, শাপলার বিল এবং কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত।
অক্সফোর্ড মিশন গির্জা
বরিশাল নগরের বগুড়া রোডের পাশে লাল ইটের তৈরি অক্সফোর্ড মিশন গির্জাটি অবস্থিত। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি 'লাল গির্জা' নামে পরিচিত। জীবনানন্দ দাশ সড়কের পাশে বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাল গির্জাটি। যা প্রায় ১১৪ বছরের প্রাচীন। গির্জাটি একতলা হলেও এর উচ্চতা প্রায় চারতলার সমান। কাঠের তৈরি ছাদ আর মেঝেতে সুদৃশ্য মার্বেলের ব্যবহার এই স্থাপনাকে করেছে অনন্য। এই লাল গির্জা জড়িয়ে আছে কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা 'আকাশে সাতটি তারা' কবিতাটির সাথে।
পঞ্চররের এবারের গন্তব্য বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সাতলা গ্রামের শাপলার বিল। এই যেন রূপকথার ফুলের রাজ্য। এই বিলে যতটুকু দৃষ্টি যায় শুধু শাপলা আর শাপলা। তিন ধরনের শাপলার দেখা মিলবে এই বিলে লাল, সাদা এবং বেগুনি। সেখানে পৌঁছে পঞ্চরর নৌকাযোগে শাপলা বিলে ভেসে বেড়াতে লাগল। এখানকার শাপলা ফুলের দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হওয়ায় এটির প্রতি আলাদা ভালোবাসা সকলেরই রয়েছে। নৌকায় বসে তারা শাপলা-শালুকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দু' নয়ন ভরে উপভোগ করতে লাগল। এই অপুরূপ দৃশ্যটি ভারা জলরং আর পোস্টার রঙে আঁকার চেষ্টা করল। জলরঙে ছবি আঁকার বিষয়ে মালিহা তাদের সহযোগিতা করল।
এরপর তারা গেল কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে। 'সাগরকন্যা' নামে পরিচিত পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এই সৈকতের কাছেই রয়েছে রাখাইন পল্লী। কুয়াকাটা হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান। এখানে 'রাস পূর্ণিমা' এবং 'মাঘী পূর্ণিমা' উৎসবে বহু পুণ্যার্থী আসেন। সৈকতের পাশে অবস্থিত রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দির। যেখানে রয়েছে প্রায় সাঁইত্রিশ মণ ওজনের অষ্ট ধাতুর তৈরি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি। কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে তারা জলরং আর পোষ্টার রঙে ছবি আঁকল।
এরপর পঞ্চরত্ন গেল কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে। এই নদীর রূপ অন্তরে ধারণ করে এবার তাদের বিদায় নেবার পালা। এবার পঞ্চরত্ন যাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।
মহসিন মামাও পঞ্চরত্রের সাথে ঢাকা যাবে সেখানে তিনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন এর একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করবেন। পঞ্চরত্ন মামার কাছে কর্মশালাটির বিষয়ে জানতে চাইলে মামা বলেন দেশের সম্পদ ব্যবহার করে বিশ্ববাজারের উপযোগী নতুন নতুন হস্ত ও কারুপণ্য তৈরিই এই আবাসিক কর্মশালার মূল বিষয়।
সেদিন রাতে মহসিন মামাসহ পঞ্চরত্ন বেরিয়ে পড়ল ঢাকার উদ্দেশে। সব বিষয়ে সহযোগিতার জন্য পঞ্চরত্ন কৃতজ্ঞতা জানাল মালিহাকে। সমগ্র ভ্রমণের বিস্তারিত সবকিছু মালিহাকে লিখে জানাবে বলল পঞ্চরত্ন। পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা মামার সাথে রওয়ানা হলো বরিশালের লঞ্চঘাটের উদ্দেশে।
এই অধ্যায়ে আমরা যা করব-
আরও দেখুন...