পরিচয়
কুরআন শব্দটি আরবি। এটি কারউন শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। কারউন অর্থ পড়া বা পাঠ করা। অতএব, কুরআন শব্দের অর্থ হলো পঠিত। আল-কুরআন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পঠিত কিতাব। প্ৰত্যেক দিনই লক্ষ-কোটি মুসলমান এ গ্রন্থ তিলাওয়াত করে থাকে। আমরা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এ গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন সূরা ও আয়াত পাঠ করে থাকি। এ জন্য এ কিতাবের নাম রাখা হয়েছে আল-কুরআন। ইসলামি পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য হযরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর উপর যে কিতাব নাজিল করেছেন তাকেই আল-কুরআন বলা হয়। এটি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। সর্বকালের সকল মানুষের জন্য এ কিতাব হিদায়াতের উৎস।
আল-কুরআন ‘লাওহি মাহফুযে' বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ । এটি প্রথমে কদরের রাতে প্রথম আসমানের ‘বায়তুল ইয়্যাহ’ নামক স্থানে এক সাথে নাজিল করা হয় । এরপর সেখান থেকে আল-কুরআন আমাদের প্রিয়নবি (স.)-এর উপর নাজিল করা হয়। মহানবি (স.)-এর ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালে সর্বপ্রথম সূরা আলাকের ৫টি আয়াত অবতীর্ণ হয়। তারপর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর জীবদ্দশায় প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে নাজিল করা হয়। এভাবে ২৩ বছরে খণ্ড খণ্ড আকারে পুরো কুরআন নাজিল হয়।
আল-কুরআনের সূরাসমূহ দুইভাগে বিভক্ত । যথা- মক্কি ও মাদানি। মহানবি (স.) আল্লাহর নির্দেশে নবুয়তের ত্রয়োদশ বর্ষে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। নবি করিম (স.)-এর এ হিজরতের পূর্বে নাজিল হওয়া সূরাসমূহ মক্কি সূরা হিসেবে পরিচিত। এ সূরাসমূহে সাধারণত আকাইদ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, বেহেশত-দোযখ, কিয়ামত ইত্যাদি হলো মক্কি সূরাগুলোর বিষয়বস্তু। অন্যদিকে মহানবি (স.)-এর মদিনায় হিজরতের পর নাজিলকৃত সূরাসমূহকে মাদানি সূরা বলা হয়। এ সূরাসমূহে সালাত, যাকাত, সাওম, হজ, জিহাদ, হালাল-হারাম, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।
আল-কুরআনের বেশ কিছু নাম রয়েছে । আল-কুরআনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে এ নামসমূহ রাখা হয়েছে । এগুলো আল-কুরআনের বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে । নিম্নে এর কতিপয় নাম উল্লেখ করা হলো-
ক. আল-ফুরকান (পার্থক্যকারী) : আল-কুরআন সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী। এ জন্য একে আল-ফুরকান বলা হয়।
খ. আল-হুদা (হিদায়াত, পথপ্রদর্শন) : কুরআন মজিদের মাধ্যমে ন্যায় ও সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করা হয় বলে একে আল-হুদা নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গ. আর রাহমাহ (রহমত, দয়া, করুণা) : পবিত্র কুরআন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত ও করুণাস্বরূপ। তাই একে রাহমাহ বলা হয়েছে।
ঘ. আয-যিকর (উপদেশ, আলোচনা) : কুরআন মজিদে বহু ঘটনার আলোচনা ও বহু উপদেশ রয়েছে। তাই একে যিকর নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ঙ. আন-নুর (জ্যোতি, আলো) : পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে হালাল-হারামের রহস্য উদ্ভাসিত হয়, তাই একে ‘নুর' বলা হয়।
কুরআন মজিদ ৩০টি (ত্রিশটি) ভাগে বিভক্ত । এর প্রতিটি ভাগকে এক একটি পারা বলা হয়। এর সূরা সংখ্যা মোট ১১৪টি। এগুলোর মধ্যে ৮৬টি সূরা মক্কি এবং ২৮টি সূরা মাদানি । আল-কুরআনে সর্বমোট ৭টি মনজিল, ৫৪০টি রুকু ও ১৪টি সিজদার আয়াত রয়েছে। এর আয়াত সংখ্যা সর্বমোট ৬২৩৬টি, মতান্তরে ৬৬৬৬টি।
আল-কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
আল-কুরআন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মহাগ্রন্থ । আল-কুরআন আমাদের আল্লাহ তায়ালার পরিচয় দান করে। আমরা আল্লাহ তায়ালাকে চিনতাম না। তাঁর ক্ষমতা ও গুণাবলি সম্পর্কে জানতাম না। আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ করে আমাদের প্রিয়নবি (স.)-এর উপর কুরআন মজিদ নাজিল করেন। মহানবি (স.) আমাদের আল-কুরআন শিক্ষা দেন। ফলে আমরা আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করি। তাঁর আদেশ- নিষেধ জানতে পারি। কী কাজ করলে তিনি খুশি হন আর কোন কাজ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন তাও জানতে পারি। আল-কুরআন না থাকলে এগুলো সম্ভব হতো না। অতএব বোঝা গেল যে, মানব জীবনে আল-কুরআনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
আল-কুরআন মানব জাতির হিদায়াতের প্রধান উৎস। কোন পথে চললে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ করবে আল-কুরআন তা আমাদের দেখিয়ে দেয়। পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ইত্যাদির পরিচয় দান করে। আল-কুরআনের নির্দেশনামতো চলে আমরা কল্যাণ লাভ করতে পারি। আখিরাতে আল-কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি আল-কুরআনের নির্দেশ মেনে চলবে সে হবে মহাসৌভাগ্যশালী। সে পাবে চিরশান্তির জান্নাত। আর যে কুরআন মজিদের আদেশ নিষেধ মানবে না তার স্থান হবে যন্ত্রণাদায়ক জাহান্নামে৷
আল-কুরআন আমাদের নৈতিক ও মানবিক আদর্শ শিক্ষা দেয়। আল-কুরআন অনুসরণ করে আমরা উত্তম চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি । ফলে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ইত্যাদি দূরীভূত হবে।
কুরআন মজিদ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। এটি কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা নির্দিষ্ট জাতির জন্য নাজিল হয় নি। বরং এটি সর্বজনীন ও সর্বকালীন মহাগ্রন্থ। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে সকলের হিদায়াতের জন্য এ কুরআন নাজিল হয়েছে।
আল-কুরআনের শিক্ষা
কুরআন মজিদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। এটি যাবতীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার। এছাড়া মানুষের জীবনে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়ে থাকে তার সমাধানের ব্যাপারে এতে ইঙ্গিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
অর্থ : “আমি এ কিতাবে কোনো কিছুই বাদ দেই নি।” (সূরা আল-আনআম, আয়াত ৩৮)
আল-কুরআনের সকল জ্ঞান ও শিক্ষাই সুস্পষ্ট। সংক্ষিপ্ত ও প্রামাণ্য। এতে উল্লেখিত সকল প্রকার আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান সমগ্র বিশ্বের সকল মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য, যুগোপযোগী ও যুক্তিসংগত। এ কিতাবে কোনোরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই। এটি সকল প্রকার ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে। আল-কুরআনের প্রথমেই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
অর্থ : “এটি সেই কিতাব, যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই ।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২)
আল-কুরআন ইসলামি শরিয়াহ'র প্রধান উৎস। মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন কেমন হবে তা এ কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। মানুষ কীভাবে ইবাদত করবে, কীভাবে চরিত্র গঠন করবে তাও এ কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ (র.)-এর মতে, আল-কুরআনে বহু জ্ঞানের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এগুলো মোট পাঁচভাগে বিভক্ত। যথা-
১. ইলমুল আহকাম বা বিধি-বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান।
২. ইলমুল মুখাসামা বা বিতর্ক বিদ্যা।
৩. ইলমুত তাযকির বি আলা ইল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ ও নিদর্শন সম্পর্কিত জ্ঞান।
৪. ইলমুত তাযকির বি আইয়ামিল্লাহ বা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিজগতের অবস্থা, তাঁর প্রদত্ত পুরস্কার ও শাস্তি সংক্রান্ত জ্ঞান।
৫. ইলমুত তাযকির বিল মাউত ওয়ামা বাদাল মাউত বা মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কিত জ্ঞান।
প্রকৃতপক্ষে আল-কুরআন মানবজাতির মহামুক্তির সনদ। এটি মানুষকে আলোর দিকে পরিচালনা করে। শান্তি ও কল্যাণের পথ দেখায়। সুতরাং আমরা আল-কুরআন পড়ব। এর অর্থ জানব এবং তদনুযায়ী আমল করব। আল-কুরআনের জ্ঞান শিক্ষা করে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করব।
কাজ : এ পাঠ পড়ে কুরআন মজিদের শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থী যা জানতে পেরেছে তা তার পাশের বন্ধুকে বলবে। |
আরও দেখুন...