পঞ্চদশ অধ্যায়
খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমন্ত্র
খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমন্ত্র রচিত হয়েছে পবিত্র বাইবেলের আলোকে। এগুলো আমাদের ধর্মবিশ্বাসের মূল বিষয়। এই বিষয়গুলো একসাথে সংক্ষিপ্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। এগুলো আমরা বিশ্বাস করি ও পালন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই কারণ এগুলো বিশ্বাস ও পালন করা বাধ্যতামূলক। এই বিশ্বাস মন্ত্রটি খ্রিষ্টমণ্ডলীর বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি ও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা। বিশ্বাসমন্ত্রটির মাধ্যমে খ্রিষ্টবিশ্বাসীর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমন্ত্রকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়, যেমন: ধর্মবিশ্বাসসূত্র, প্রেরিতগণের শ্রদ্ধামন্ত্র এবং খ্রিষ্ট বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমন্ত্রটি হলো এই স্বর্গ-মর্ত্যের স্রষ্টা সর্বশক্তিমান পিতা ঈশ্বরে এবং তাঁর অদ্বিতীয় পুত্র আমাদের প্রভু সেই যীশু খ্রিষ্টে আমি বিশ্বাস করি, যিনি পবিত্র আত্মার প্রভাবে গর্ভস্থ হইয়া কুমারী মারীয়া হইতে জন্মগ্রহণ করিলেন, পোন্তিয় পিলাতের শাসনকালে যাতনাভোগ করিলেন, ক্রুশবিদ্ধ, গতপ্রাণ ও সমাধিস্থ হইলেন, পাতালে অবরোহণ করিলেন, তৃতীয় দিবসে মৃতদের মধ্য হইতে পুনরুত্থান করিলেন। স্বর্গারোহণ করিলেন, সর্বশক্তিমান পিতা ঈশ্বরের দক্ষিণ পার্শ্বে উপবিষ্ট আছেন। সেই স্থান হইতে জীবিত ও মৃতদের বিচারার্থে আগমন করিবেন। আমি পবিত্র আত্মায় বিশ্বাস করি পুণ্যময়ী কাথলিক মণ্ডলী, সিদ্ধগণের সমবায়, পাপের ক্ষমা, শরীরের পুনরুত্থান এবং অনন্ত জীবন বিশ্বাস করি। আমেন।
বিশ্বাসমন্ত্রের ব্যাখ্যা
আমাদের বিশ্বাসমন্ত্রটি ইতোমধ্যে আমরা মুখস্থ করেছি। কিন্তু এর সব অর্থ আমরা এখনো জানি না। এই কারণে আমরা এই অধ্যায়ে বিশ্বাসমন্ত্রের বিভিন্ন অংশের অর্থ সম্পর্কে জানব।
১। “স্বর্গমর্ত্যের স্রষ্টা সর্বশক্তিমান পিতা ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করি” সৃষ্টির সূচনালগ্নে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সবকিছু, মানুষ,
জগৎ ও যত জীবজন্তু আছে সবই সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর “শক্তিমান পরাক্রমী,” তাঁর অসাধ্য কিছুই নেই। তাঁর শক্তি সর্বব্যাপী ও রহস্যময়। ভালোবাসার কারণে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
২। “যীশু খ্রিষ্ট পবিত্র আত্মার প্রভাবে গর্ভস্থ হইয়া কুমারী মারীয়ার হইতে জন্মগ্রহণ করিলেন”
ঈশ্বর পুত্র মানুষ হলেন মানবজাতির জন্য, আমাদের পরিত্রাণের জন্য। ‘আমরা পাপী আমরা যেন ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলিত হতে পারি। আমাদের পাপের পরিত্রাণ সাধনের জন্য ঈশ্বর পুত্র সত্যিকারে ‘রক্ত মাংসের’ মানুষ হলেন। এই কথা বিশ্বাস করা খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাসের এমন একটি বৈশিষ্ট্য যা অন্য কোথাও নেই ৷
৩। “ পোন্তিয় পিলাতের শাসনকালে যাতনাভোগ করিলেন, ক্রুশবিদ্ধ হইলেন, মৃত্যুবরণ করিলেন ও সমাধিস্থ হইলেন।”
যীশু আমাদের সমস্ত পাপের বোঝা বহন করতে ক্রুশীয় মৃত্যুই মেনে নিলেন। যীশু খ্রিষ্ট
ক্রুশে মৃত্যু বরণ করেছেন। তাঁর দেহ কবরে সমাহিত হয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরের শক্তিতে
তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় নি।
৪। “পাতালে অবরোহণ করিলেন, তৃতীয় দিবসে পুনরুত্থান করিলেন”
যীশু এ পৃথিবীতে আসার আগে যেসব ধার্মিকেরা মারা গিয়েছিলেন তাঁরা পাতালে মুক্তিদাতার অপেক্ষায় ছিলেন। আমাদের প্রভু যীশু খ্রিষ্ট প্রথমে শয়তানের সকল শক্তিকে জয় করেছেন। এরপর পাতালে নেমে গিয়ে সেখানে অপেক্ষমাণ ধার্মিকদের তিনি উদ্ধার করেছেন। তাঁদের জন্যও তিনি স্বর্গের দ্বার খুলে দিলেন।
যীশু মৃত্যুর তিন দিন পর পুনরুত্থান করলেন অর্থাৎ মৃত্যু থেকে বেঁচে উঠলেন। পুনরুত্থিত যীশুকে প্রথমে দেখেছেন ও সাক্ষ্য দিয়েছেন কয়েকজন নারী। তারপর যীশু দেখা দিয়েছেন পিতরকে এবং পরে অন্য শিষ্যদের । যীশুর পুনরুত্থানে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তিনি ঈশ্বর এবং তাঁর কাজকর্ম ও শিক্ষা সবই সত্য।
৫। “স্বর্গারোহণ করিলেন, সর্বশক্তিমান পিতা ঈশ্বরের দক্ষিণ পার্শ্বে উপবিষ্ট আছেন”
পিতার ডান পাশে যীশুর স্থান হওয়ার অর্থ হলো, তিনি পিতার সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন। মানব জাতির পরিত্রাণ এনেছেন। মৃত্যুকে জয় করেছেন। পিতা তাঁকে মহিমান্বিত করেছেন। তিনি এখন স্বর্গ ও পৃথিবীর ‘প্রভু’। তিনি সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রভু।
৬। “সেখান থেকে তিনি জীবিত ও মৃতদের বিচার করতে আগমন করিবেন”
যীশু খ্রিষ্ট পিতার কাছ থেকে একটা অধিকার পেয়েছেন। সেই অধিকার নিয়ে তিনি মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য কাজ করেছেন। মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে তিনি স্বর্গ ও পৃথিবীর রাজা হয়েছেন। এই অধিকার নিয়ে তিনি জগতের শেষ দিন সকল মানুষের বিচার করতে আসবেন ৷
৭। “আমি পবিত্র আত্মায় বিশ্বাস করি”
এই কথা বলে খ্রিষ্টমণ্ডলী স্বীকার করে যে, পবিত্র আত্মা হলেন ঐশ ত্রিব্যক্তির তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি পিতা ও পুত্র থেকে আগমন করেছেন। তিনি পিতা ও পুত্রের সমতূল্য। তিনি আরাধনা ও স্তুতির যোগ্য। ঈশ্বর তাঁর পুত্রের সেই পরম আত্মাকে আমাদের হৃদয়ে পাঠিয়েছেন ।
৮। “পুণ্যময়ী কাথলিক মণ্ডলী”
খ্রিষ্টমণ্ডলী হলো সেই জনগণের সমাজ, যাদের ঈশ্বর জগতের সকল প্রান্ত থেকে আহ্বান করে একত্রিত করেন। তারা যেন খ্রিষ্টের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে ও দীক্ষাস্নান গ্রহণ করে। এভাবে তারা যেন ঈশ্বরের সন্তান এবং যীশু খ্রিষ্টের দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হয়। তারা যেন পবিত্র আত্মার মন্দির হতে পারে।
৯। “সিদ্ধগণের সমবায়”
সিদ্ধগণের সমবায় হলো খ্রিষ্টমণ্ডলীর সকল সদস্য মণ্ডলীর পুণ্য সবকিছুর সহভাগী হন। তাঁরা ধর্মবিশ্বাস, খ্রিষ্টযাগ ও খ্রিষ্টপ্রসাদ এবং আধ্যাত্মিক দানগুলোর সহভাগী হন। সেই ভালোবাসা যেখানে থাকবে না কোনো স্বার্থপরতা, লোভলালসা বা কামনাবাসনা ।
১০। “পাপের ক্ষমায় বিশ্বাস করি”
খ্রিষ্ট নিজেই খ্রিষ্টমণ্ডলীর হাতে পাপ ক্ষমা করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দান করেছেন। তিনি
তাঁর প্রেরিতদূতদের বলেছেন: “তোমরা পবিত্র আত্মাকে গ্রহণ কর। তোমরা যদি কারো পাপ ক্ষমা কর, তবে তা ক্ষমা করাই হবে; যদি কারও পাপ ক্ষমা না কর, তা ক্ষমা না করাই থাকবে।”
১১। “শরীরের পুনরুত্থানে বিশ্বাস করি”
খ্রিষ্ট সেই শেষ দিনে আমাদের পুনর্জীবিত করবেন। তখন যারা পবিত্র জীবন যাপন করেছে ও ভালো কাজ করেছে তারা নব জীবন লাভ করবে। আর যারা মন্দ কাজ করেছে, তারা পাপের শাস্তি পাবে।
১২। “অনন্ত জীবনে বিশ্বাস করি”
অনন্ত জীবন হলো সেই জীবন যা মৃত্যুর পর শুরু হবে। সেই জীবন অসীম। তার আগে
প্রত্যেকটি মানুষকে জীবিত ও মৃতদের বিচারকর্তা যীশু খ্রিষ্টের সামনে ব্যক্তিগত বিচারের জন্য দাঁড়াতে হবে। সেখানেই নির্ধারিত হবে তার অন্তিম স্থান।
১৩। “আমেন”
আমেন কথাটির অর্থ হলো, তাই হোক বা সত্যি সত্যি হ্যাঁ। প্রার্থনার শেষে আমেন বলার মাধ্যমে আমরা স্বীকার করি, যা আমরা প্রার্থনায় বলেছি তা অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে সত্যি জেনেই বলেছি।
বিশ্বাসের পথে অটল থাকার জন্য প্রতিদিন এই প্রার্থনাটি বলবে হে আমাদের স্বর্গীয় পিতা, তুমি তোমার পবিত্র আত্মার আলো আমাদের দান কর। আমরা যেন সর্বদা তোমার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারি। আমাদের বিশ্বাসের দুর্বলতা তুমি ক্ষমা কর ও বিশ্বাস দৃঢ় করে তোল। আমরা যেন কখনো বিশ্বাসে দুর্বল না হই। আমরা যেন কোনোদিন প্রার্থনা করতে ভুলে না যাই। আমাদের এমন উৎসাহ দান কর, যেন আমরা তোমাকে ও প্রতিবেশীদের সবসময় ভালোবাসতে পারি। ভালো কাজের দ্বারা যেন আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি। আমেন।
কী শিখলাম
খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসমন্ত্র হলো পবিত্র বাইবেল থেকে নেওয়া আমাদের ধর্মবিশ্বাসের মূলবিষয়সমূহ। এগুলো আমরা বিশ্বাস করি ও পালন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। এই বিশ্বাসমন্ত্রটি খ্রিষ্টমণ্ডলীর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা । বিশ্বাসমন্ত্রটির মাধ্যমে খ্রিষ্টবিশ্বাসীর প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়।
গান করি
বিশ্বাসে ভরো মন তবে পাবে দরশন জীবিত যীশুর পরিচয়,
উঠেছেন যীশু বেঁচে আয় তোরা নেচে নেচে (২) আনন্দে বল সবে জয় জয় । মাগদালিনী মেরী পেয়েছে দেখা তাঁর, প্রিয়জনে তাঁরে দেখেছে কতবার (২) তুমিও দেখা পাবে ধন্য জীবন হবে (২) যীশু প্রেমে হবে মধুময় ৷
পরিকল্পিত কাজ
কী কী উপায়ে বিশ্বাসের পথে অটল থাকা যায় তার একটি তালিকা তৈরি কর।
১। শূন্যস্থান পূরণ কর
(ক) বিশ্বাসমন্ত্র খ্রিষ্টমণ্ডলীর একটা গুরুত্বপূর্ণ---------------
(খ) ঈশ্বরের শক্তি সর্বব্যাপী ও------------------
(গ) আমাদের পাপের পরিত্রাণ সাধনের জন্য------------------সত্যিকারের মানুষ হলেন ৷
(ঘ) ধার্মিকেরা পাতালে------------------- অপেক্ষায় ছিলেন।
(ঙ) সৃষ্টির সূচনা লগ্নে ঈশ্বর আকাশ ও-----------------সৃষ্টি করেন ।
৩। সঠিক উত্তরটিতে টিক (√) চিহ্ন দাও
৩.১ ঈশ্বর কিসের প্রেরণায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন?
(ক) ভালোবাসার
(খ) ভালো লাগার
(গ) অনুভূতির
(ঘ) প্রশংসার
৩.২ যীশুকে ‘প্রভু’ বলে ডাকার সত্যিকার অর্থ হলো—
(ক) ঈশ্বর বলে স্বীকার করা
(খ) শ্রদ্ধা করা
(গ) সম্মান করা
(ঘ) মেনে চলা
৩.৩ কাদের পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরপুত্র মানুষ হলেন ?
(ক) শয়তানের
(খ) স্বর্গদূতদের
(গ) মানবজাতির
(ঘ) সকল সৃষ্টির
৩.৪ যীশু আমাদের পাপের বোঝা বহন করতে কী করেছেন?
(ক) জন্ম নিয়েছেন
(খ) যাতনা ভোগ করেছেন
(গ) ক্রুশীয় মৃত্যুবরণ করেছেন
(ঘ) পুনরুত্থিত হয়েছেন
৩.৫ যীশু মৃত্যুর কতোদিন পর পুনরুত্থান করেছেন
(ক) ১ দিন
(খ) ৩ দিন
(গ) ৫ দিন
(ঘ) ৭ দিন
৪। সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও
(ক) কে পাতালে অবরোহণ করলেন?
(খ) প্রভু যীশু খ্রিষ্ট কিসের শক্তিকে প্রথম জয় করেছেন?
(গ) কারা নব জীবন লাভ করবে?
৫। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
(ক) “আমি পবিত্র আত্মায় বিশ্বাস করি” এর অর্থ ব্যাখ্যা কর।
(খ) বিশ্বাসের পথে অটল থাকার জন্য একটি প্রার্থনা লেখ।
আরও দেখুন...