জীবন পরিচালনার জন্য জীবকোষে প্রতি মুহূর্তে হাজারো রকমের জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে থাকে। এসব বিক্রিয়ার জন্য কমবেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে শক্তির মূল উৎস সূর্য। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সৌরশক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে পরিণত করে শর্করাজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। প্রাণী কিংবা অসবুজ উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে সরাসরি আবদ্ধ করে দৈহিক কাজে ব্যবহার করতে পারে না। জীবন পরিচালনার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয়, সে শন্তির জন্য তাদের কোনো না কোনোভাবে সবুজ উদ্ভিদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এসব বিষয় আলোচনা করাই জীবনীশক্তি বা বারোএনার্জেটিক্স (Bioenergetics)-এর মূল উদ্দেশ্য। এই অধ্যায়ে সংক্ষিপ্তাকারে জীবনীশক্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
জীবনীশক্তি বা জৈবশক্তি (bioenergy) বলতে আমরা ভিন্ন বা বিশেষ কোনো শক্তিকে বুঝাই না । পদার্থবিজ্ঞানে শক্তির যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা থেকে, এটি আলাদা কিছু নয়, জীবদেহ বা জৈব অণুর রাসায়নিক বন্ধন ছিন্ন করার মাধ্যমে প্রাপ্ত শক্তিকে এই নামে ডাকা হয় মাত্র। জীব প্রতিনিয়ত পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে, সংগৃহীত শক্তিকে একরূপ থেকে অন্যরূপে পরিবর্তিত করে, কখনো বা সঞ্চয় করে এবং শেষে সেই শক্তি আবার পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়।
DNA এবং RNA-এর গাঠনিক উপাদানগুলোর একটি হলো অ্যাডেনিন। এটি একটি নাইট্রোজেন বেস । এর সাথে পাঁচ কার্বনবিশিষ্ট রাইবোজ সুগার অণু যুক্ত হবে তৈরি হয় অ্যাডিনোসিন। অ্যাডিনোসিন অপুর সাথে পর্যায়ক্রমে একটি, দুটি এবং তিনটি ফসফেট/ফসফোরিক এসিড গ্রুপ যুক্ত হয়ে যথাক্রমে অ্যাডিনোসিন মনোফসফেট (AMP), অ্যাডিনোসিন ডাইফসফেট (ADP) এবং অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট (ATP) গঠন করে। এভাবে ফসফেট যুক্ত করতে বাইরে থেকে শক্তি দিতে হয়। এই বিক্রিয়ার নাম ফসফোরাইলেশন (phosphorylation)। আবার এর বিপরীত প্রক্রিয়ায়, ফসফেট গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হলে শক্তি বের হয়ে আসে। এই বিক্রিয়ার নাম ডিফসফোরাইলেশন (dephosphorylation)। উল্লেখ্য, প্রতিযোগ ATP অণুর প্রান্তীয় ফসফেট গ্রুপে 7.3 কিলোক্যালরি (প্রায় 30.55 কিলোজুল) শন্তি জমা থাকতে পারে। পরিবেশ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে তাকে কোষের তথা জীবদেহের ব্যবহার-উপযোগী রূপে পরিবর্তিত করার জন্য কাজ করে দুটি কোষীয় অঙ্গাণু: মাইটোকন্ড্রিয়া এবং প্লাস্টিড। উভয়েরই রয়েছে ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম নামক একসেট বিশেষ জৈব অণু, যাদের কাজ হলো বাহ্যিক শক্তি-উৎস থেকে আহরিত শক্তিকে ATP -এর ফসফেট গ্রুপের শক্তি হিসেবে জমা করা। মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্ষেত্রে সেই শক্তি-উৎস হতে পারে পুষ্টি উপাদান (যেমন: গ্লুকোজ) বা কোনো অন্তর্বর্তীকালীন অণু (যেমন: NADH2) এবং প্লাস্টিডের (বিশেষত ক্লোরোপ্লাস্ট) ক্ষেত্রে সেই শক্তি-উৎস হলো সূর্যালোক বা অন্য কোনো উপযুক্ত উৎস থেকে আগত ফোটন। আবার, ATP-এর রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে যে শক্তি বের হয়, সেই শক্তি দিয়ে জীবদেহের প্রতিটি জৈবনিক কাজ অর্থাৎ, মাংসপেশির সংকোচন থেকে ইন্দ্রিয়ানুভূতি, খাবার খাওয়া থেকে হজম করা, নিঃশ্বাস নেওয়া থেকে কথা বলা, চিৎকার করা থেকে হাসি-কান্না, দৈহিক বৃদ্ধি থেকে প্রজনন, দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখা থেকে শুরু করে দেহের প্রতিটি কোষের স্বাভাবিক আয়তন বজায় রাখা এর সবই সম্পন্ন হয়। আমরা যে খাবার খাই তা জারিত হয়, সেই জারণ থেকে নির্গত শক্তি দ্বারা ফসফোরাইলেশনের মাধ্যমে আবার সেই ভাঙা দুই টুকরা জোড়া লেগে ATP তৈরি হয়। শক্তির প্রয়োজন হলে তা আবার ভাঙে। তারপর খাদ্য থেকে শক্তি নিয়ে আবার জোড়া লাগে। এ যেন এক রিচার্জেবল ব্যাটারি। ATP শক্তি জমা করে রাখে এবং প্রয়োজন অনুসারে অন্য বিক্রিয়ায় শক্তি সরবরাহ করে। এজন্য ATP-কে অনেক সময় ‘জৈবমুদ্ৰা’ বা ‘শক্তি মুদ্রা' (Biological coin or energy coin) বলা হয়।
সবুজ উদ্ভিদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে এরা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) এবং পানি থেকে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাদ্য তৈরি করে। সবুজ উদ্ভিদে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য তৈরি হওয়ার এ প্রক্রিয়াকে সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis) বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় আলোকশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সবুজ উদ্ভিদে প্রস্তুত খাদ্য উদ্ভিদ নিজে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ব্যবহার করে এবং অবশিষ্ট খাদ্য ফল, মূল, কাণ্ড অথবা পাতায় সঞ্চিত রাখে। উদ্ভিদে সঞ্চিত এই খাদ্যের উপরেই মানবজাতি ও অন্যান্য জীবজন্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে।
সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হলো: ক্লোরোফিল, আলো, পানি এবং কার্বন ডাই- অক্সাইড। সালোকসংশ্লেষণ একটি জৈব রাসায়নিক (biochemical) বিক্রিয়া, যেটি এরকম:
6CO2 + 12H2O আলো/ ক্লোরোফিল C6H1206 + 6H2O + 6O2 |
পাতার মেসোফিল টিস্যু সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রধান স্থান। স্থলজ সবুজ উদ্ভিদ মাটি থেকে মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে পাতার মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছায় এবং স্টোমা বা পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে বায়ু থেকে CO2 গ্রহণ করে, যা মেসোফিল টিস্যুর ক্লোরোপ্লাস্টে পৌঁছে। জলজ উদ্ভিদ পানিতে দ্রবীভূত CO2 গ্রহণ করে। বায়ুমণ্ডলে 0.03% এবং পানিতে 0.3% CO2 আছে, তাই জলজ উদ্ভিদে সালোকসংশ্লেষণের হার স্থলজ উদ্ভিদ থেকে বেশি।
অক্সিজেন এবং পানি সালোকসংশ্লেষণের উপজাত দ্রব্য (by-product)। এটি একটি জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া (oxidation-reduction process)। এ প্রক্রিয়ায় H2O জারিত হয় এবং CO3 বিজারিত হয়।
সালোকসংশ্লেষণ একটি জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। 1905 সালে ইংরেজ শারীরতত্ত্ববিদ ব্ল্যাকম্যান (Blackman) এ প্রক্রিয়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন। পর্যার দুটি হলো, আলোকনির্ভর পর্যায় (Light dependent phase) এবং আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় (Light independent phase) ।