জীবন পাঠ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) - NCTB BOOK

মানবসভ্যতা বিকাশে বর্তমান শতকের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়ন এবং বিরূপ পরিবেশে জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা। এসব ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম। এই অধ্যায়ে জীববিজ্ঞানের সংজ্ঞা, শাখাসমূহের নাম এবং জীবের নামকরণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-

  • জীববিজ্ঞানের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব
  • জীববিজ্ঞানের প্রধান শাখাগুলো বর্ণনা করতে পারব।
  • জীবের শ্রেণিবিন্যাসের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • জীবের শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করতে পারব। 
  • জীবের শ্রেণিবিন্যাসকরণ পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারব। 
  • দ্বিপদ নামকরণের ধারণা ও গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব। 
  • বাস্তবজীবনে জীবের শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হব।

জীববিজ্ঞানের ধারণা

আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে যাদের জীবন আছে তারা জীব, আর যেসব জিনিসের জীবন নেই সেগুলো জড়। মোটা দাগে বোঝার জন্য বিশ্বের সব পদার্থকে এরকম দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম বিচারে কোথায় জড়-অচেতনের শেষ আর কোথায় জীবনের শুরু, তা অনেক সময়ই বলা মুশকিল। আসলে, জীবনের ভিত্তিমূলে কাজ করে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের সেই একই নিয়ম, যা কিনা জড় জগৎকেও নিয়ন্ত্রণ করে। তাই জীবজগৎকে বুঝতে হলে ভৌতবিজ্ঞান, তথা পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের জ্ঞান জরুরি। কিন্তু এটা ভাবলে ভুল হবে যে ভৌতবিজ্ঞান জানলে আলাদা করে জীববিজ্ঞান পাঠ নিষ্প্রয়োজন। বরং জীবনকে ভাবা যেতে পারে অনেকগুলো জড়ের এমন এক জটিল সমাবেশ হিসেবে, যেখানে ঐ জটিলতার কারণে নতুন কিছু গুণের উদ্ভব ঘটেছে। ঠিক যেমন হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের নির্দিষ্ট আনুপাতিক সংযোগে পানি তৈরি হয়, যার বৈশিষ্ট্য হাইড্রোজেন বা অক্সিজেন কোনোটার মতোই হয় না। তাই জড়ের সুনির্দিষ্ট সন্নিবেশে জীব গঠিত হলেও তার মধ্যে এমন সব নতুন ধরনের বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে, যা তার জড় গাঠনিক উপাদানগুলোর মধ্যে ছিল না।

জীববিজ্ঞান বেশ প্রাচীন বিজ্ঞান। জীববিজ্ঞানকে ইংরেজিতে Biology বলে। এটি গঠিত হয়েছে গ্রিক bios (জীবন) এবং logos (জ্ঞান) শব্দ দুটির সংযোগের মাধ্যমে। যেহেতু চিকিৎসা ও কৃষিসংক্রান্ত ব্যাপারে জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, সেহেতু সভ্যতার একেবারে আদিকাল থেকে গ্রিস, মিশর, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতবর্ষ ও চীনসহ বিভিন্ন অঞ্চলের সভ্যতায় জীববিজ্ঞানের কিছু না কিছু চর্চা হয়েছে। যদিও সেসব চর্চাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিচারে ঠিক বিজ্ঞান বলা যায় না, তবু জ্ঞানের এই শাখার বিকাশের জন্য তা অপরিহার্য ছিল।

জীববিজ্ঞানের শাখাগুলো

জীবের যে দুটি ধরন আমরা চারপাশে তাকালেই দেখতে পাই, সেগুলো হলো উদ্ভিদ এবং প্রাণী। তাই বহুদিন পর্যন্ত জীববিজ্ঞান পাঠের সুবিধার জন্য একে দুটি শাখায় ভাগ করে নেওয়ার প্রচলন ছিল: উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং প্রাণিবিজ্ঞান। এ রীতি এখনও কিছুটা চালু আছে। যদিও জীববিজ্ঞান আজ এতটাই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে শুধু দুটি শাখায় ভাগ করে এখন এর পাঠ আর চলবে না। এমন অনেক জীব আছে যা উদ্ভিদ বা প্রাণী কোনোটাই নয়। যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি। আবার যখন প্রাণী, উদ্ভিদ, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস প্রভৃতির কোনো সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে একসাথে বিশ্লেষণ করার দরকার হয়, তখন আর জীবের ধরনভিত্তিক শাখা লাগসই হয় না। তাই প্রয়োজনের তাগিদে জীববিজ্ঞান এখন বহুসংখ্যক শাখায় বিভক্ত হয়েছে। জ্ঞানের প্রায় প্রতিটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত শাখাগুলোকে ভৌত বা মৌলিক এবং ফলিত এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। জীববিজ্ঞানও তার ব্যতিক্রম নয়।

ভৌত শাখা বলতে সেসব শাখা বোঝানো হয়, যেখানে তার তাত্ত্বিক ভিত্তি অনুসন্ধান করাটা প্রয়োগ- সংক্রান্ত দিকের তুলনায় বেশি গুরুত্ব পায়। আর যেখানে প্রয়োগটাই বড়, সেটা হচ্ছে ফলিত শাখা।

Please, contribute to add content into ভৌত জীববিজ্ঞান.
Content

ফলিত জীববিজ্ঞান

এ শাখায় রয়েছে জীবন-সংশ্লিষ্ট প্রায়োগিক বিষয়গুলো। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য শাখার কথা নিচে উল্লেখ করা হলো:

(a) জীবাশ্মবিজ্ঞান (Palaeontology): প্রাগৈতিহাসিক জীবের বিবরণ এবং জীবাশ্ম সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(b) জীবপরিসংখ্যানবিদ্যা (Biostatistics): জীবপরিসংখ্যান-বিষয়ক বিজ্ঞান। 

(c) পরজীবীবিদ্যা (Parasitology): পরজীবিতা, পরজীবী জীবের জীবনপ্রণালি এবং রোগ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(d) মৎস্যবিজ্ঞান (Fisheries): মাছ, মাছ উৎপাদন, মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(e) কীটতত্ত্ব (Entomology): কীটপতঙ্গের জীবন, উপকারিতা, অপকারিতা, ক্ষয়ক্ষতি, দমন ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(f) অণুজীববিজ্ঞান (Microbiology): ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, আণুবীক্ষণিক ছত্রাক এবং অন্যান্য অণুজীব সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(g) কৃষিবিজ্ঞান (Agriculture): কৃষিবিষয়ক বিজ্ঞান। 

(h) চিকিৎসাবিজ্ঞান (Medical Science): মানবদেহ, রোগ, চিকিৎসা ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(i) জিনপ্রযুক্তি (Genetic Engineering): জিনপ্রযুক্তি ও এর ব্যবহার সম্পর্কিত বিজ্ঞান।

(j) প্রাণরসায়ন (Biochemistry): জীবের প্রাণরাসায়নিক কার্যপ্রণালি, রোগ ইত্যাদি সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(k) পরিবেশবিজ্ঞান (Environmental Science): পরিবেশ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(1) সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান (Marine Biology): সামুদ্রিক জীব সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(m) বনবিজ্ঞান (Forestry): বন, বন সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং সংরক্ষণ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(n) জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology): মানব এবং পরিবেশের কল্যাণে জীব ব্যবহারের প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিজ্ঞান। 

(০) ফার্মেসি (Pharmacy): ঔষধশিল্প ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিজ্ঞান। 

(p) বন্য প্রাণিবিদ্যা (Wildlife): বন্যপ্রাণী বিষয়ক বিজ্ঞান। 

(q) বায়োইনফরমেটিকস্ (Bioinformatics): কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর জীববিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, যেমন * ক্যান্সার বিশ্লেষণ বিষয়ক বিজ্ঞান।

 

একক কাজ 

একক কাজ 

কাজ: দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত জীববিজ্ঞানের খবর থেকে জীবিবিজ্ঞানের শাখার তালিকা তৈরি কর। 

প্রয়োজনীয় উপকরণ: দৈনিক সংবাদপত্র/সাময়িকী, কাঁচি/কাটার, আঠা, আর্টপেপার, সাইনপেন।

পদ্ধতি: 3-5 জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে যাও। 

প্রতিটি দল দৈনিক পত্রিকা বা সাময়িকী থেকে একটি করে খবর খুঁজে বের করবে যেখানে জীববিজ্ঞানের একাধিক শাখার সম্পৃক্ততা রয়েছে এবং সেই খবরের সাথে সংশ্লিষ্ট জীববিজ্ঞানের ভৌত এবং ফলিত শাখার তালিকা করবে। তারপর আর্ট পেপারে খবরটির পেপার কাটিং আঠা দিয়ে লাগিয়ে তার পাশে বা নিচে সাইনপেন দিয়ে শাখাগুলোর সেই তালিকা লিখে প্রদর্শন করবে।

জীবের শ্রেণিবিন্যাস

আজ পর্যন্ত বিভিন্ন উদ্ভিদের প্রায় চার লক্ষ এবং প্রাণীর প্রায় তের লক্ষ প্রজাতির নামকরণ ও বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ সংখ্যা চূড়ান্ত নয়, কেননা প্রায় প্রতিদিনই আরও নতুন নতুন প্রজাতির বর্ণনা সংযুক্ত হচ্ছে। অনুমান করা হয়, ভবিষ্যতে সব জীবের বর্ণনা শেষ হলে (যদি সত্যি কখনো শেষ করা যায়) এর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় এক কোটিতে। জানা, বোঝা এবং শেখার সুবিধার জন্য এই অসংখ্য জীবকে সুষ্ঠুভাবে বিন্যাস করা বা সাজানোর প্রয়োজন। জীবজগৎকে একটি স্বাভাবিক নিয়মে শ্রেণিবিন্যাস করার প্রয়োজনীয়তা অবশ্য অনেক আগে থেকেই প্রকৃতিবিদগণ অনুভব করেছিলেন। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই জীববিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা পড়ে উঠেছে, যার নাম ট্যাক্সোনমি বা শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা। শ্রেণিবিন্যাসের লক্ষ্য মূলত একটাই। তা হচ্ছে এই বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় জীবজগৎকে সহজভাবে অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে সঠিকভাবে জানা। 

শ্রেণিবিন্যাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সুইডিস প্রকৃতিবিদ ক্যারোলাস লিনিয়াস (1707-1778)। 1735 সালে আপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমির অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ, বিশেষ করে ফুল সংগ্রহ আর জীবের শ্রেণিবিন্যাসে তাঁর অনেক আগ্রহ ছিল। তিনিই প্রথম জীবের পূর্ণ শ্রেণিবিন্যাসের এবং নামকরণের ভিত্তি প্রবর্তন করেন। অসংখ্য নমুনা জীবের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে তিনি জীবজগৎকে দুটি ভাগে, যথা উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাণিজগৎ হিসেবে বিন্যস্ত করেন।

 

শ্রেণিবিন্যাসের উদ্দেশ্য 

শ্রেণিবিন্যাসের উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি জীবের দল ও উপদল সম্বন্ধে জ্ঞান আহরণ করা। জীবজগতের ভিন্নতার দিকে আলোকপাত করে আহরিত জ্ঞানকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা, পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানকে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা এবং প্রতিটি জীবকে শনাক্ত করে তার নামকরণের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি জীবজগৎ এবং মানবকল্যাণে প্রয়োজনীয় জীবগুলোকে শনাক্ত করে তাদের সংরক্ষণে সচেতন হওয়া।

জীবজগৎ

 ক্যারোলাস লিনিয়াসের সময়কাল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জীবজগৎকে উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাণিজগৎ হিসেবে বিবেচনা করে দুটি রাজ্যে (Kingdom) শ্রেণিবিন্যাস করা হতো। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বর্তমানে কোষের DNA এবং RNA-এর প্রকারভেদ, জীবদেহে কোষের বৈশিষ্ট্য, কোষের সংখ্যা ও খাদ্যাভ্যাসের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে আর. এইচ. হুইটেকার (R. H. Whittaker) 1969 সালে জীবজগৎকে পাঁচটি রাজ্য বা ফাইভ কিংডমে (Five Kingdom) ভাগ করার প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে মারগুলিস (Margulis) 1974 সালে Whittaker-এর শ্রেণিবিন্যাসের পরিবর্তিত ও বিস্তারিত রূপ দেন। তিনি সমস্ত জীবজগৎকে দুটি সুপার কিংডমে ভাগ করেন এবং পাঁচটি রাজ্যকে এই দুটি সুপার কিংডমের আওতাভুক্ত করেন। 

সুপার কিংডম 1

 প্রোক্যারিওটা (Prokaryotae): এরা আদিকোষ (নিউক্লিয়াস সুগঠিত নয়) বিশিষ্ট এককোষী, আণুবীক্ষণিক জীব।

 

(1) রাজ্য I

মনেরা (Monera) 

বৈশিষ্ট্য: এরা এককোষী, ফিলামেন্টাস (একটির পর একটি কোষ লম্বালম্বিভাবে যুক্ত হয়ে ফিলামেন্ট পঠন করে), কলোনিয়াল। কোষে ক্রোমাটিন বস্তু থাকে কিন্তু নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়ার পর্দা নেই। এদের কোষে প্লাস্টিড, মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা ইত্যাদি নেই, কিন্তু রাইবোজোম আছে। কোষ বিভাজন দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। প্রধানত শোষণ পদ্ধতিতে খাদ্যগ্রহণ করে। তবে কেউ কেউ ফটোসিনথেসিস বা সালোকসংশ্লেষণ পদ্ধতিতে খাদ্য প্রস্তুত করে। উদাহরণ: নীলাভ সবুজ শৈবাল, ব্যাকটেরিয়া।

(b) সুপার কিংডম 2 ইউক্যারিওটা (Eukaryota):

 এরা প্রকৃতকোষ (নিউক্লিয়াস সুগঠিত) বিশিষ্ট এককোষী বা বহুকোষী জীব। এরা এককভাবে অথবা কলোনি আকারে দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। 

(i) রাজ্য-2: প্রোটিস্টা (Protista) বৈশিষ্ট্য: এরা এককোষী বা বহুকোষী, একক বা কলোনিয়াল (দলবদ্ধ) বা ফিলামেন্টাস এবং সুগঠিত নিউক্লিয়াস বিশিষ্ট। কোষে ক্রোমাটিন বন্ধু নিউক্লিয়ার পর্দা দ্বারা পরিবৃত্ত থাকে। ক্রোমাটিন বস্তুতে DNA, RNA এবং প্রোটিন থাকে। কোষে সকল ধরনের অঙ্গাণু থাকে। খাদ্যগ্রহণ শোষণ বা ফটোসিনথেটিক পদ্ধতিতে ঘটে। মাইটোসিস কোষ বিভাজনের মাধ্যমে অযৌন প্রজনন ঘটে এবং কনজুগেশলের মাধ্যমে অর্থাৎ জৈবনিকভাবে ভিন্ন কিন্তু গঠনগতভাবে এক, এরূপ দুটি গ্যামেটের মিলনের মাধ্যমে যৌন প্রজনন ঘটে। কোনো ভ্রুণ পঠিত হয় না। উদাহরণ: অ্যামিবা, প্যারামেসিয়াম, এককোষী ও বহুকোষী শৈবাল।

(ii) রাজ্য 3: ফানজাই (Fungi) বৈশিষ্ট্য: অধিকাংশই স্থলজ, মৃতজীবী বা পরজীবী। দেহ এককোষী অথবা মাইসেলিয়াম (সরু সুতার মতো অংশ) দিয়ে গঠিত। এগুলোর নিউক্লিয়াস সুপঠিত। কোষপ্রাচীর কাইটিন বস্তু দিয়ে পঠিত। খাদ্যগ্রহণ শোষণ পদ্ধতিতে ঘটে। ক্লোরোপ্লাস্ট অনুপস্থিত। হ্যাপ্লয়েড স্পোর দিয়ে বংশবৃদ্ধি ঘটে। উদাহরণ: ইস্ট, Penicillium, মাশরুম ইত্যাদি।

(iii) রাজ্য 4: প্লানটি (Plantae) বৈশিষ্ট্য: এরা প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত সালোকসংশ্লেষণকারী উদ্ভিদ। এদের দেহে উন্নত টিস্যুতন্ত্র বিদ্যমান। এদের ভূণ সৃষ্টি হয় এবং তা থেকে ডিপ্লয়েড পর্যায় শুরু হয়। প্রধানত স্থলজ, তবে অসংখ্য জলজ প্রজাতি আছে। এদের যৌন জনন অ্যানাইসোগ্যামাস (anisogamous) অর্থাৎ আকার, আকৃতি অথবা শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যবিশিষ্ট ভিন্নধর্মী দুটি প্যামেটের মিলনের মাধ্যমে যৌন জনন সম্পন্ন হয়। এরা আর্কিপোনিয়েট অর্থাৎ আর্কিপোনিয়াম বা স্ত্রীজনন অঙ্গবিশিষ্ট উদ্ভিদ। এরা সপুষ্পক। উদাহরণ: উন্নত সবুজ উদ্ভিদ।

 

প্লানটির বিভাগগুলো ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো:

 

(iv) রাজ্য 5: 

অ্যানিমেলিয়া (Animalia) বৈশিষ্ট্য: এরা নিউক্লিয়াসবিশিষ্ট ও বহুকোষী প্রাণী। এদের কোষে কোনো জড় কোষপ্রাচীর, প্লাস্টিড ও কোষগহ্বর নেই। প্লাস্টিড না থাকায় এরা হেটারোট্রোফিক অর্থাৎ পরভোজী এবং খাদ্য গলাধঃকরণ করে, দেহে জটিল টিস্যুতন্ত্র বিদ্যমান। এরা প্রধানত যৌন জননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। পরিণত ডিপ্লয়েড পুরুষ এবং স্ত্রী প্রাণীর জনানা থেকে হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট উৎপন্ন হয়। ভ্রুণ বিকাশকালীন সময়ে ঘূর্ণীয় স্তর সৃষ্টি হয়।

উদাহরণ: প্রোটোজোয়া ব্যতীত সকল অমেরুদণ্ডী এবং মেরুদণ্ডী প্রাণী। 

 

 

2004 সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস কেভলিয়ার-স্মিথ (Thomas Cavalier-Smith) জীবজগতের প্রোটিস্টাকে প্রোটোজোয়া (Protozoa) এবং ক্রোমিস্টা (Chromista) নামে দুটি ভাগে ভাগ করেন এবং মনেরাকে ব্যাকটেরিয়া রাজ্য হিসেবে পুনঃ নামকরণ করেন। এভাবে তিনি জীবজগৎকে মোট ছয়টি রাজ্যে ভাগ করেছেন। এ বিষয়ে তোমরা উপরের শ্রেণিতে আরও বিস্তারিত জানবে। এখানে বিভিন্ন রাজ্যের প্রাণীগুলোর যে বৈশিষ্ট্যসমূহের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তোমরা এই বইটি পড়ার সময়ে পরবর্তী অধ্যায়ে সেগুলোর সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত হবে।

শ্রেণিবিন্যাসের বিভিন্ন ধাপ

শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিটি ধাপে তার আগের ধাপের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ হয়। যত উপরের ধাপ, তার অন্তর্ভুক্ত বৈশিষ্ট্যের সংখ্যা তত কম এবং অন্তর্ভুক্ত জীবের সংখ্যা তত বেশি। আবার যত নিচের ধাপ, তার অন্তর্ভুক্ত বৈশিষ্ট্যের সংখ্যা তত বেশি এবং অন্তর্ভুক্ত জীবের সংখ্যা তত কম। একটি জীবকে প্রজাতি পর্যায়ে বিন্যাসে মূলত আন্তর্জাতিক কোড চিহ্নিত সাতটি ধাপ আছে।

রাজ্য (Kingdom)

   পর্ব (Phylum)

       বিভাগ (Division)

           শ্রেণি (Class) 

                বর্গ (Order) 

                    গোত্র (Family) 

                        গণ (Genus)

                             প্রজাতি (Species)

 

উপরের ধাপ যেন বড় একটা সেট আর তার নিচের ধাপ হলো তার উপসেট। রাজ্যের উপসেট হলো পর্ব, পর্বের উপসেট হলো শ্রেণি, শ্রেণির উপসেট হলো বর্গ... ইত্যাদি। শ্রেণিবিন্যাসের এই পদ্ধতিকে বলে নেস্টেড হায়ারার্কি (nested hierarchy)। অনেক সময় পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য আগের ধাপের যেসব বৈশিষ্ট্য পরের ধাপেও থাকে, সেগুলো উহ্য রাখা হয়। সেভাবে লিখলে মানুষের (Homo sapiens) শ্রেণিবিন্যাস হবে এরকম:

 

রাজ্য (Kingdom): Animalia; কারণ, সুকেন্দ্রিক কোষবিশিষ্ট, বহুকোষী, পরভোজী এবং জটিল টিস্যুতন্ত্র আছে।

পর্ব (Phylum): Chordata; কারণ, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে নটোকর্ড থাকে। 

শ্রেণি (Class): Mammalia; কারণ, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায় এবং লোম/চুল আছে। 

বর্গ (Order): Primate; কারণ, আঁকড়ে ধরার উপযোগী হাত এবং ঘ্রাণ অপেক্ষা দৃষ্টিশক্তি বেশি উন্নত।

গোত্র (Family): Hominidae; কারণ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংওটাং প্রভৃতির সাথে সাদৃশ্য আছে।

গণ (Genus): Homo; কারণ, দেহের অনুপাতে মস্তিষ্ক সবচেয়ে বড় এবং খাড়াভাবে দুই পায়ে হাঁটতে পারে।

প্রজাতি (Species): Homo sapiens; কারণ, চওড়া এবং খাড়া কপাল, খুলির হাড় Homo গণের অন্য প্রজাতির তুলনায় পাতলা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উন্নত।

 

কোনো প্রজাতিকে শ্রেণিবিন্যাসের কোন ধাপে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তার কারণগুলো জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে জেনে নিতে হয়, কারণ কোনো একটা প্রজাতির শ্রেণিবিন্যাস লেখার সবচেয়ে প্রচলিত রীতি এটাই, যেখানে আলাদা করে কারণগুলো লেখা হয় না।

দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতি

 

একটি জীবের বৈজ্ঞানিক নাম দুটি অংশ বা পদ নিয়ে গঠিত হয়। প্রথম অংশটি তার গণের নাম এবং দ্বিতীয় অংশটি তার প্রজাতির নাম। যেমন, গোল আলুর বৈজ্ঞানিক নাম Solanum tuberosum। এখানে Solanum গণ নাম এবং tuberosum প্রজাতির নাম বুঝায়, এরুপ দুটি পদ নিয়ে গঠিত নামকে দ্বিপদ নাম এবং নামকরণের প্রক্রিয়াকে দ্বিপদ নামকরণ (binomial nomenclature) পদ্ধতি বলে। দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতির লক্ষ্য একটাই, তা হচ্ছে এই বৈচিত্র্যময় জীবজগতের প্রতিটি জীবকে আলাদা নামে সঠিকভাবে জানা। আন্তর্জাতিকভাবে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি মেনে জীবের বৈজ্ঞানিক নাম নির্ধারণ করা হয়। উদ্ভিদের নাম International Code of Botanical Nomenclature (ICBN) কর্তৃক এবং প্রাণীর নাম International Code of Zoological Nomenclature (ICZN) কর্তৃক স্বীকৃত নিয়মানুসারে হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এই code পুস্তকাকারে লিখিত একটি দলিল। নামকরণ ল্যাটিন শব্দে হওয়ায় কোনো জীবের বৈজ্ঞানিক নাম সারা বিশ্বে একই নামে পরিচিত হয়।

1753 সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী ক্যারোলাস লিনিয়াস Species plantarum বইটি রচনা করেন। এই বইটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করে, কারণ এর প্রকাশনার মাধ্যমে তিনি দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং গণ ও প্রজাতির সংজ্ঞা দেন। তিনিই প্রথম ঐ গ্রন্থে জীবের শ্রেণি, বর্গ, গণ এবং প্রজাতি ধাপগুলো ব্যবহার করেন। লিনিয়াসের এই দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার উদ্ভাবন। এ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিটি জীবের:

(a) নামকরণ ল্যাটিন ভাষায় কিংবা ল্যাটিন ভাষার মতো করে উপস্থাপন করতে হবে। (তরুণ প্রাণিবিজ্ঞানী সাজিদ আলী হাওলাদার সম্প্রতি নতুন প্রজাতির এক ব্যাঙ আবিষ্কার করেছেন, যা কেবল ঢাকায় পাওয়া যায়। ব্যাঙটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ হয়েছে Zakerana dhaka। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা কাজী জাকের হোসেনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই গণের নাম জাকেরানা রাখা হয়েছে।)

(b) বৈজ্ঞানিক নামের দুটি অংশ থাকবে, প্রথম অংশটি গণ নাম এবং দ্বিতীয় অংশটি প্রজাতি নাম। যেমন: Labeo rohita। এটি রুই মাছের বৈজ্ঞানিক নাম, এখানে Labeo গণ এবং rohita প্রজাতিক পদ। 

(c) জীবজগতের প্রতিটি বৈজ্ঞানিক নামকে অনন্য (unique) হতে হয়। কারণ, একই নাম দুটি পৃথক জীবের জন্য ব্যবহারের অনুমতি নেই।

(d) বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশের প্রথম অক্ষর বড় অক্ষর হবে, বাকি অক্ষরগুলো ছোট অক্ষর হবে এবং দ্বিতীয় অংশটির নাম ছোট অক্ষর দিয়ে লিখতে হবে। যেমন- পিঁয়াজ Allium cepa, সিংহ Panthera leo। 

(e) বৈজ্ঞানিক নাম মুদ্রণের সময় সর্বদা ইটালিক অক্ষরে লিখতে হবে। যেমন; ধান Oryza sativa, কাতল মাছ Catla catla। 

(f) হাতে লেখার সময় গণ ও প্রজাতিক নামের নিচে আলাদা আলাদা দাগ দিতে হবে। যেমন: Oryza sativa, Catla catla । 

(g) যদি কয়েকজন বিজ্ঞানী একই জীবকে বিভিন্ন নামকরণ করেন, তবে অগ্রাধিকার আইন অনুসারে প্রথম বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদত্ত নামটি গৃহীত হবে।

(h) যিনি প্রথম কোনো জীবের বিজ্ঞানসম্মত নাম দিবেন। তাঁর নাম প্রকাশের সালসহ উত্ত জীবের বৈজ্ঞানিক নামের শেষে সংক্ষেপে সংযোজন করতে হবে। যেমন: Homo sapiens L,1758, Oryza sativa L,1753 (এখানে L লিনিয়াসের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ, তবে দৈনন্দিন গবেষণা ও পাঠে এটুকু অনেক সময় লেখা হয় না)।

 

 

সাধারণ নাম                                                                 বৈজ্ঞানিক নাম

ধান                                                                              Oryza sativa 

পাট                                                                              Corchorus capsularis

 আম                                                                            Mangifera indica 

কাঁঠাল                                                                          Artocarpus heterophyllus

 শাপলা                                                                         Nymphaea nouchalt

 জবা                                                                            Hibiscus rosa-sinensis

 কলেরা জীবাণু                                                             Vibrio cholerae 

ম্যালেরিয়া জীবাণু                                                         Plasmodium νίνακ 

আরশোলা                                                                    Periplaneta americana

মৌমাছি                                                                       Apis indica 

ইলিশ                                                                         Tenualosa ilisha  

কুনো ব্যাঙ                                                                  Duttaphrynus melanostictus (Bufo melanostictus) 

দোয়েল                                                                       Copsychus saularis 

রয়েল বেঙ্গল টাইগার                                                  Panthera tigris 

মানুষ                                                                          Homo sapiens

 

 

কাজ: মনে কর তুমি তোমার এলাকায় একটি নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার করেছ। তুমি এটিকে কী নাম দিবে? তোমার নামকরণের যৌন্ত্রিকতা ব্যাখ্যা কর।

১. জীববিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব কী? 

২. জীববিজ্ঞানের ভৌত শাখাগুলোর নাম লেখ। 

৩. জীববিজ্ঞানের ফলিত শাখাগুলোর নাম লেখ 

৪. দ্বিপদ নামকরণ পদ্ধতি কী? 

৫. শ্রেণিবিন্যাসের ধাপগুলো উল্লেখ কর।

 

১. জীবের শ্রেণিবিন্যাসের প্রয়োজনীয়তা কী?

 

১. জীববিজ্ঞানের কোন শাখায় কীটপতল নিয়ে আলোচনা করা হয়? 

ক. এন্টোমোলজি            খ. ইকোলজি

 গ. এন্ডোক্রাইনোলজি     ঘ. মাইক্রোবায়োলজি 

২. শ্রেণিবিন্যাসের উদ্দেশ্য হলো- 

1. জীবের উপদল সম্পর্কে জানা

 ii. জীবের এককের নামকরণ করতে পারা 

iii. বিস্তারিতভাবে জ্ঞানকে উপস্থাপন করা নিচের 

কোনটি সঠিক?   

ক. i ও iii        খ. i ও ii 

গ. ii ও iii        ঘ. i, ii ও iii

পাশের উদ্দীপকটি লক্ষ কর এবং ৩৩৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও। 

৩. চিত্রে প্রদর্শিত জীবটির নাম কী? 

   ক. অ্যামিবা            খ. ডায়াটম 

   গ. প্যারামেসিয়াম    ঘ. ব্যাকটেরিয়া

৪. উদ্দীপকে প্রদর্শিত জীবটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-

 i. এরা চলনে সক্ষম  ii. এরা খাদ্য তৈরিতে অক্ষম 

iii. তাদের নিউক্লিয়াস সুগঠিত নিচের 

কোনটি সঠিক?

 ক. i ও ii     খ. ii ও iii 

 গ. i ও iii     ঘ. i, ii ও iii

 

 

ক. শ্রেণিবিন্যাসের একক কী? 

খ. বংশগতিবিদ্যাকে জীববিজ্ঞানের ভৌত শাখা বলা হয় কেন? 

গ. চিত্র-২-এর উদ্ভিদটির নামকরণের ক্ষেত্রে কীভাবে তুমি ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে ব্যাখ্যা কর। 

ঘ. চিত্র-১ এবং চিত্র-২ এর মধ্যে কোন জীবটি অধিক উন্নত, কারণসহ বিশ্লেষণ কর।

Promotion