টার্কির রাণীক্ষেত রোগ
রাণীক্ষেত টার্কির ভাইরাসজনিত তীব্র ছোঁয়াচে রোগ। পৃথিবীর কম বেশি প্রত্যেক দেশে এ রোগের প্রকোপ রয়েছে। বাংলাদেশের টার্কির রোগগুলোর মধ্যে রাণীক্ষেত সবচেয়ে মারাত্বক ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর এ রোগে দেশের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। এ রোগের ব্যাপকতা এবং ক্ষরক্ষতির পরিমাণ এত বেশি যে, টার্কি পালনের জন্য রাণীক্ষেত রোগ একটি প্রধান অন্তরার। বয়স্ক অপেক্ষা বাচ্চা টার্কি এতে বেশি মারাত্মক আক্রান্ত হয়। সাধারনত শুল্ক আবহাওয়ায়, যেমন- শীত ও বসন্ত কালে এ রোগটি বেশি দেখা যায়।
রোগের কারণঃ প্যারামিক্সোভিরিডি পরিবারের নিউক্যাসল ডিজিজ ভাইরাস নামক এক প্রজাতির প্যারামিক্সো ভাইরাস এ রোগের কারণ ।
রোগ সংক্রমণ
নিম্নলিখিতভাবে এ রোগের জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। যেমন-
রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ
রাণীক্ষেত রোগ অনেক সময় অত্যন্ত দ্রুত জীবাণু সংক্রমণের ফলে লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই টার্কি মারা যেতে পারে। তবে তা না হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যেমন-
রোগ নির্ণয় :
ময়না তদন্তে নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখে
চিকিৎসা:
ভাইরাস রোগ বিধায় এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। তবে, আক্রান্ত টার্কিতে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমিক সংক্রমণ রোধে অ্যান্টিবায়োটিক বা সালফোনেমাইড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও ০.০১% পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট পানির সঙ্গে মিশিয়ে আক্রান্ত পাখিকে দৈনিক ২/৩ বার খাওয়ানো যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ
রাণীক্ষেত রোগ প্রতিরোধে দুই ধরনের টিকা ব্যবহার করা হয়। যথা- বি. সি. আর. ডি. ডি. এবং আর. ডি. ভি ।
বি.সি.আর.ডি.ভি. : এ টিকাবীজের প্রতিটি শিশি বা ভাষালে হিম শুষ্ক অবস্থায় ১ মি. পি. মূল টিকাবীজ থাকে। প্রতিটি শিশির টিকাবীজ ও মি.লি. পাতিত পানিতে ভালোভাবে মিশাতে হয়। এরপর ৭ দিন ও ২১ দিन বয়সের প্রতিটি বাচ্চা টার্কির এক চোখে এক ফোটা করে ড্রপারের সাহায্যে প্রয়োগ করতে হবে।
আর, ডি, ভি এ টিকাবীদের প্রতিটি ভারালে ০.৩ মি.লি. মূল টিকাবীজ হিমক অবস্থার থাকে। এ টিকা দুমাসের অধিক বয়সের টার্কির জন্য উপযোগী। প্রথমে তারালের টিকাবাজ ১০০ লি.লি. পাতিত পানির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর তা থেকে ১ মি.লি. করে নিয়ে প্রতিটি টার্কির রানের মাংসে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হবে। হয় মাস পরপর এ টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
টিকা ছাড়া খামার থেকে রোগ দমনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে। যথা-
ক) রাণীক্ষেত রোগে মৃত পাখিকে গুড়িরে ফেলতে হবে বা মাটিচাপা দিতে হবে।
খ) খামারের যাবতীয় সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি জীবাণুনাশক ওষুধ (যেমন- আয়োসান, সুপারসেপ্ট ইত্যাদি প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশিত মাত্রায়) দিয়ে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
টার্কির ফাউল কলেরা রোগ
টার্কির ফাউল কলেরা রোগের কারণ:
এটি ব্যাকটেরিয়া জনিত ছোঁয়াচে রোগ। যা সাধারণত গৃহপালিত ও বন্য পাখিকে আক্রান্ত করে । এ রোগ সেপ্টিসেমিক রোগ, যার ফলে আক্রান্ত পাখিতে উচ্চ আক্রান্ত হার ও উচ্চ মৃত্যুহার পরিলিক্ষত হয় । এ রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হলো পাশুরেলা মাল্টোসিডা নামক ব্যাকটেরিয়া ।
ফাউল কলেরা রোগের বিস্তার: মুক্তভাবে চলাফেরা করে এমন সব পাখি বিশেষ করে চড়ুই, কবুতর,বয়স্ক পাখি ও ইঁদুর এ রোগের অন্যতম বাহক হিসেবে কাজ করে। তীব্র সংক্রমণের ক্ষেত্রে ইঁদুরের ভূমিকা ১০% । চড়ুই পাখি ও কবুতর কোন রকম লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও আক্রান্ত খামারের খাদ্য, খাদ্যের ব্যাগ ও অন্যান্য সরঞ্জাম এ রোগের ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে।
ফাউল কলেরা রোগের লক্ষণ:
পোস্ট মর্টেম পরীক্ষা
চিকিৎসা
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা -
উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা, উপযুক্ত স্যানিটেশন, খামারের পরিবেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, খামারে ইঁদুর ও টিকটিকির উপদ্রব ঠেকানো, বয়স্ক পাখি যথাসময়ে কালিং করা ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। খামারের আশেপাশে কুকুর, শেয়াল, বিড়াল, শূকর ইত্যাদি প্রাণির ঘোরাফেরা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে। টার্কি জোনের ক্ষেত্রে, যে অঞ্চলে টার্কির আধিক্য বেশি সেখানে টার্কি খামারের অভ্যন্তরে মুক্তভাবে চলাফেরা করে এমন সব পাখির আনাগোনা বন্ধ করতে হবে। অসুস্থ টার্কি দ্রুতই সুস্থ টার্কি থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে হবে। মৃত টার্কি মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হবে কিংবা মৃত টার্কি পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নতুন করে টার্কি বাচ্চা তুলতে হলে খামার ভালো করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে জীবাণুনাশক দ্বারা স্প্রে করে খামারের অভ্যন্তরে ও বাইরের জীবাণু ধ্বংস করতে হবে।
টার্কির ফাউল পক্স রোগ
টার্কি ফাউল পক্স একটি ভাইরাসজনিত ছোঁয়াচে রোগ। সব বয়সের সব প্রজাতির পাখি এতে আক্রান্ত হতে পারে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যপকতা লাভ করে। তখন মৃত্যুহার অত্যন্ত বেড়ে যায়। যদিও ফাউল পক্স বলতে সব পাখির বসন্ত রোগকেই বুঝায় তথাপি বর্তমানে আলাদা নামেও, যেমন- পিজিয়ন পক্স, টার্কি পক্স, ক্যানারি পক্স প্রভৃতি ডাকা হয়। পৃথিবীর প্রায় পোল্ট্রি উৎপাদনকারী দেশেই বসন্ত রোগ দেখা যায়। এ রোগের পাখির দেহের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত উন্মুক্ত স্থানে এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গে ক্ষুদ্র লালচে নডিউল সৃষ্টি হয় যা বসন্তের গুটি নামে পরিচিত ।
রোগের কারণ:
পক্সভিরিডি পরিবারের ফাউল পক্স ভাইরাস নামক ভাইরাস বসন্ত রোগের কারণ।
সংক্রমণঃ নিন্মলিখিতভাবে এ রোগ সংক্রমিত হতে পারে। যথা-
রোগের লক্ষণঃ
বসন্ত রোগ প্রধানত দুই প্রকৃতিতে দেখা যায়। যথা-
ক. ত্বকীয় বা হেড ফর্ম : এ প্রকৃতিতে আক্রান্ত পাখির মুখমণ্ডলে বসন্তের গুটি দেখা যায়। আক্রান্ত পাখির ক্ষুধামন্দা, দৈহিক ওজন হ্রাস ও ডিম উৎপাদন কমে যাওয়া প্রধান বৈশিষ্ট্য। এটিকে শুষ্ক বসন্তও বলা হয়।
খ. ডিপথেরিটিক প্রকৃতি :
এ প্রকৃতিতে প্রথমে আক্রান্ত পাখির জিহ্বায় ক্ষত দেখা যায়। এ ক্ষত পরে শ্বাসনালী ও ফুসফুসে বিস্তার লাভ করে। ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমিক সংক্রমণে অবশেষে পাখির মৃত্যু ঘটে। এ প্রকৃতির বসন্ত আর্দ্র বসন্ত নামে পরিচিত।
এ দুই প্রকৃতির বসন্তে আবার পাখিতে মৃদু ও তীব্র আকারে রোপ লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে।
যেমন-
মৃদু প্রকৃতির বসন্তে-
তীব্র প্রকৃতির বসন্তে
রোগ নির্ণয়-
চিকিৎসা:
এ রোগের কোনো কার্যকরী চিকিৎসা নেই। তবে আক্রান্ত ক্ষত জীবাণুনাষক ওষুধ (যেমন- মারকিউরিকক্রোম) দিয়ে পরিষ্কার করে তাতে সকেটিল, সালফানিলামাইড বা অন্য কোনো জীবাণুনাশক পাউডার লাগালে সুফল পাওয়া যায় ।
রোগ নিয়ন্ত্রণ
রোগ প্রতিরোধের জন্য যথাসময়ে পাখিদের টিকা প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের সৃষ্টি এবং মশা নিয়ন্ত্রণও জরুরি। বসন্ত প্রতিরোধের জন্য এ দেশে দুই ধরনের টিকা প্রয়োগ করা হয়। যথা-
১। পিজিয়ন পক্স টিকা:
এটি ৩ মি.লি. পাতিত পানির সাথে মিশিয়ে দুই সপ্তাহের বাচ্চার ডানার পালকবিহীন অংশে বাইফকর্ড প্রিকিং নিডল বা সূঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে প্রয়োগ করা হয় ।
২। ফাউল পক্স টিকা:
এ টিকা হিমশুষ্ক অবস্থায় ০.৩ মি.লি. মাত্রায় কাঁচের অ্যাম্পুলে থাকে। এ পরিমান টিকা পরিশ্রুত পানিতে মিশিয়ে দুইশত পাখিতে প্রয়োগ করা যায়। পিজিয়ন পক্স টিকার মতো এ টিকাও এ পদ্ধতিতে বাইফকর্ড প্রিকিং নিডল দিয়ে পাখির ডানার পালকবিহীন স্থানে ৩ বার বিদ্ধ করতে হবে প্রতিবারই পরিসৃত পানিতে গুলানো টিকায় নিডল চুবিয়ে নিতে হবে। এ টিকা প্রয়োগের ৫,৭ ও ১০ তম দিনে টিকাবদ্ধ স্থানে বসন্তের গুটি দেখা গেলে এর কার্যকারিতা প্রমাণ হবে। এ টিকা এক মাসের বেশি বয়সের টার্কিকে প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও বিদেশে প্রস্তুত বসন্ত রোগের টিকা পাওয়া যায়। যেমন- ওভোডিপথেরিন ফোর্ট (ইন্টারভেট) যা কোম্পানির নির্দেশমতো মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। বছরে একবার পাখিতে এ টিকা প্রয়োগ করা হয়।
টার্কির ব্ল্যাকহেড বা হিস্টিমোনিয়াসিস রোগ
হিস্টিমোনাস মিলিয়ামিডিল নামক এককোষি প্যারালাইট এর কারণে ব্ল্যাকহেড ডিজিজ হয়ে থাকে। পরিপাকতন্ত্রের সিকামে বসবাসকারী হেটেরেকিস না न म ও লার্ভা এ রোগের বাহক। ছেটেরেকিস কৃমির ডিম ও পার্ভাতে হিন্টিযোনাস মিশিরাপ্রিডিস নামক এক কোষি প্যারাসাইট বসবাস করে। মেটেরেফিল কৃমির ডিম ও লার্ভা মাটিতে বসবাসকারি কেঁচোর মধ্যে ১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মুরগীর তুলনার টার্কিতে রাহের বিভিন্ন এর প্রভাব খুবই মারাত্মক এবং এর রোগের কারণে পুরো টার্কি খামারই ধ্বংশ হতে যেতে পারে। মেটেরেফিল কৃষির বিষ/মার্কা যুক্ত মুরগীর পারখানা খাওরার মাধ্যমে এবং এ কৃষির ডিম ও লার্ভা ধারণকারী কেঁচো, পোকা খাওয়ার মাধ্যমে টার্কিতে ব্ল্যাকহেড রোগের সংক্রমণ ঘটে। এটি প্রথমে টার্কির পরিপাকতন্ত্রের শিকার ক্ষত/আলসার সৃষ্টি করে এবং পাখি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। পরবর্তীতে এটি পাখির নিবার স্থান দিয়ে রক্তনালীতে প্রবেশ করে লিভারে পৌঁছায় এবং লিভারে ছোট ছোট হোল/গর্ভের সৃষ্টি করার মাধ্যমে লিভারকে অকার্যকর করে ফেলে। অবশেষে পাখি মারা যায় ।
টার্কির ব্ল্যাকহেড বা হিস্টিমোনিয়াসিস রোগের সংক্রমণ-
টার্কির ব্ল্যাকহেড বা হিস্টিমোনিয়াসিস রোগের লক্ষণ
টার্কির ব্ল্যাকহেড বা হিস্টিমোনিয়াসিস রোগের চিকিৎসা
এন্টিকক্সিডিয়ালি অথবা এন্টিবায়োটিক দ্বারা হিস্টোমানিয়াসিস ডিজিজ নিরাময় হয় না। এই এককোষী প্যারাসাইট হিস্টোমোনাস এর ইউনিক স্ট্রাকচার ও মেটাবলিজম এর কারণে কোন এন্টিকক্সিডিয়াল অথবা এন্টিবায়োটিক একে ধ্বংস করতে পারে না; তবে সেকেন্ডারি ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশন এর ক্ষেতে কিছুটা উপকার পাওয়া যায় ৷
টার্কির ব্ল্যাকহেড বা হিস্টিমোনিয়াসিস রোগ প্রতিরোধ:-
১. এ রোগ নিরাময়ের জন্য এখনও পর্যন্ত কার্যকারি কোন ঔষধ না থাকায় সারা বিশ্বেই রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আক্রান্ত পাখিকে সাথে সাথে সুস্থ পাখি থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে আলাদা রাখার ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় ।
২. খামারে টার্কির পাশাপাশি অন্যান্য মুরগী, ফেন্সি মুরগী এবং গেম বার্ড পালন করতে হলে অবশ্যই যথাযথাভাবে রুটিন মাফিক কৃমিনাশক ব্যবহার করতে হবে। কারণ কৃমিই এ রোগের ধারক ও বাহক
৩. খামারের লিটার সবসময় পরিষ্কার ও পোকা মুক্ত রাখতে হবে।
৪. পাখির চারণভূমিতে কেঁচোর পরিমাণ যাতে কম থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে বা কেঁচো বসবাসকারী স্থানে টার্কির প্রবেশ রহিত করতে হবে।
৫. অসুস্থ পাখিকে অবশ্যই সাথে সাথে দূরে আলাদা শেডে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। এতে করে অন্যান্য সুস্থ পাখিগুলো রক্ষা পাবে। ব্ল্যাকহেড রোগ প্রতিরোধ ও সংক্রমণ ঠেকাতে অসুস্থ পাখিকে আলাদা রাখাই সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। এ পদক্ষেপটিই খামারকে বাঁচিয়ে দিবে।
টার্কি মুরগির একটি আদর্শ সংক্ষিপ্ত ভ্যাকসিন সিডিউল
ব্রিডার ফার্ম এর ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত ভ্যাকসিন চার্টটি অনুসরন করা যেতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা
আরও দেখুন...